ঢাকা, রবিবার, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (২৪) || অনুবাদ : আলীম আজিজ

অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৪
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (২৪) || অনুবাদ : আলীম আজিজ অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।

এছাড়াও তিনি ছিলেন লাতিন আমেরিকান সাহিত্য জগতের বেশ প্রভাবশালী লেখক। তাঁর মৃত্যুর পর স্পেনের এল পায়েস—তাঁকে উল্লেখ করেন ‘আর্জেন্টিনাইন সাহিত্যের শেষ ধ্রুপদী লেখক’ বলে।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।

২৩তম কিস্তির লিংক

তারপরও, দেশলাইয়ের কাঠি পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়ার আগে আগে ওর চোখের কোমল দৃষ্টি আমার চোখে পড়ল। তারপর—পুরো অন্ধকার—আমি টের পেলাম আমার চুলে হাত রেখেছে ও। তারপর নরম গলায় বলল:
‘আমি অবশ্যই তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু আমাকে সব কিছু নিয়ে কথা বলতে হবে কেন?’
‘ঠিক আছে,’ তারপরও আমি নাছোড় গলায় বললাম, ‘আমাকে তুমি কী ধরনের ভালোবাসো? ভালোবাসা অনেক রকমের হয়। তুমি একটা কুকুরকে ভালোবাসতে পারো, ছোট কোনো শিশুকে ভালোবাসতে পারো। আমি যে ভালোবাসার কথা বোঝাতে চাইছি, তা সত্যিকারের ভালোবাসা, তুমি বুঝতে পারছ?’
চকিতে তখুনি, আমার মধ্যে বিদ্যুতের চমকের মতো অন্তর্জ্ঞান প্রাপ্তির মতো কিছু একটা ব্যাপার যেন ঘটে গেল, একবারই। দ্রুতগতিতে দেশলাইয়ের দ্বিতীয় কাঠিটা জ্বাললাম। ঠিক যা সন্দেহ করেছিলাম, মারিয়ার মুখে হাসি। এটাই, এক মুহূর্তেরও কম সময়, পরক্ষণেই ও আর হাসছে না, মুহূর্তের এক দশমাংশ আগেই যেন ও হাসছিল। এরপর কোনো কোনো সময় আমার এরকম একটা অনুভূতি হচ্ছিল যে, কেউ একজন আমার ওপর নজর রাখছে, সেই সন্দেহে তাই, আচমকা ঘুরে দাঁড়ালাম, কিন্তু কাউকে খুঁজে পেলাম না ঠিক, তবে মনে হচ্ছিল আমার চারপাশের শূন্যতা খুব বেশি সময়ের পুরনো নয়, খুবই সাম্প্রতিক, ক্ষীপ্রগতির কেউ একজন যেন মাত্র দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়েছে, তবে যাওয়ার আগে তার রেখে যাওয়া মৃদু তরঙ্গে এখনও বাতাস কম্পমান। পুরো অনুভূতিটুকু অবিকল এ রকম।

‘তুমি হাসছিলে,’ রাগী গলায় বললাম।
‘হাসছিলাম?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ও।
‘হ্যাঁ। তুমি হাসছিলে। তুমি যে রকম ভেবেছ, এতো সহজে আমাকে বোকা বানাতে পারবে না। কোনো কিছুই আমার দৃষ্টি এড়ায় না। ’
‘তো কী দেখেছো তুমি?’ গলায় কাঠিন্য ওর।
‘তোমার মুখে। হাসির মতো দেখেছি। ’
‘কী নিয়ে হাসব?’ একইরকম কঠিন গলায় বলল ও।
‘আমার সরলতা নিয়ে। তারপর আমার ওসব প্রশ্ন যে, তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো কিনা, বাসলেও সেটা শিশুর মতো কিনা। আর সব আমি কিভাবে জানব... তবে তুমি হাসছিলে। আমি নিশ্চিত। ’
উঠে দাঁড়িয়ে গেল মারিয়া।
‘কী হলো?’ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘আমি এখন যাব’ রূঢ় গলার জবাব ওর।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। ‘কী, যাবে মানে?’
‘তাই তো বললাম। আমি যাব এখন। ’
‘যাবে মানে, কী বলছো তুমি? কেন?’
কোনো জবাব দিল না ও। আমি ঝট করে ওর হাত ধরে ফেললাম, তারপর প্রায় ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম:
‘তুমি... কেন... কেন যাবে?’
‘কারণ আমি ভয় পাচ্ছি যে তুমিও আমাকে বুঝতে পারছ না। ’
প্রচণ্ড রাগ হলো আমার একথা শুনে।
‘তোমাকে বুঝতে পারছি না মানে কী? তোমার কাছে যে বিষয়ে জানতে চেয়েছি তা আমার কাছে জীবন মরণের মতো ব্যাপার, আর তুমি কিনা জবাব দেওয়ার পরিবর্তে হাসছো। তারপর তুমি রেগে গেলে। আর তাছাড়া তোমার কেন মনে হল যে তোমাকে আমি বুঝতে পারছি না?’
‘আমি হাসছি এটা তোমার কল্পনা,’ শীতল গলায় বলল ও।
‘আমি নিশ্চিত। ’
‘তুমি ভুল দেখেছ। আর আমি খুবই কষ্ট পাচ্ছি এটা দেখে যে তুমি এটা বিশ্বাস করেছো। ’
কোনটা বিশ্বাস করব আর কোনটা করব না আমি বুঝতে পারছি না। আরও সুস্পষ্টভাবেই বলি, আমি ওর হাসি দেখিনি, ওর মুখে হাসির আভাসের মতো কিছু একটা দেখেছি যা এখন গুরুতর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘উহ্, আমি জানি না, মারিয়া। আমাকে মাফ করো। ’ শোচনীয়ভাবেই দুঃখিত এখন আমি। ‘আমার নিশ্চিতভাবেই মনে হয়েছে আমি তোমাকে হাসতে দেখেছি। ’
বিষণ্নতায় ছেয়ে গেছে ভেতরটা, তারপরও আমি ওর কথার জন্য অপেক্ষা করছি। একটু পর আমার বাহুতে ওর হাতের স্পর্শ পেলাম, শান্ত, কোমল। তারপর ওর নরম আর মায়াভরা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম:
‘তুমি এটা কিভাবে ভাবলে?’
‘আমি জানি না, আমি জানি না। ’ আমার প্রায় কেঁদে ফেলার মতো দশা।
আমাকে টেনে নিয়ে বেঞ্চে বসাল ও, তারপর আগের মতো মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
‘তোমাকে আগেই সাবধান করেছিলাম আমি তোমার জন্য শুধু বিপদই ডেকে আনব। ’ খানিক আগের নীরবতা ভেঙে বলল ও। ‘এখন দেখছো আমিই ঠিক ছিলাম। ’
‘এটা আমারই ভুলে হয়েছে,’ আমি আপত্তি জানালাম।
‘এটা আমার ভুলেও হতে পারে,’ বিষণ্ন গলায় বলল ও, যেন স্বগতোক্তি করছে।
‘বিস্ময়কর,’ মনে মনে ভাবলাম।
‘কী বিস্ময়কর?’ জিজ্ঞেস করল মারিয়া।

একদম হতবিহ্বল হয়ে পড়েছি আমি। তখুনি আমার মধ্যে এই বিশ্বাসও তৈরি হল (এবং এরপরেও যা ছিল) যে মারিয়া আমার মন পড়তে সক্ষম। আজ আমি বিস্ময় নিয়ে ভাবি সেদিন কি আমি নিজের অজান্তেই স্বগতোক্তির মতো করেছিলাম?
‘কী বিস্ময়কর বললে না?’ পুনরোক্তি করল ও, আমি এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম যে ওর প্রশ্নের জবাব দেইনি।
‘তোমার বয়স। ’
‘আমার বয়স?’
‘হ্যাঁ, তোমার বয়স। তোমার বয়স কত?’
হেসে ফেলল ও।
‘তোমার কী ধারণা, আমার বয়স কত?’
‘ঠিক ওই ব্যাপারটাকেই আমি বিস্ময়কর বলেছি,’ জবাব দিলাম আমি। ‘প্রথমবার আমি যখন তোমাকে দেখি, আমি ভেবেছি ছাব্বিশের মতো হবে। ’
‘আর এখন?’
‘আমি জানি না। শুরুতেও আমার মধ্যে দ্বিধা ছিল, কারণ কিছু একটা—শারীরিক কোনো কিছু না—আমার মনে হয়েছে...’
‘কী মনে হয়েছে?’
‘মনে হয়েছে তোমার বয়স আরও বেশি। তোমার সঙ্গে দেখার হওয়ার কোনো কোনো সময়ে আমার মনে হয়েছে আমি যেন ছোট্ট একটা শিশু। ’
‘তোমার বয়স কত?’
‘আটত্রিশ। ’
‘তোমার বয়স আসলেই কম। ’
আমি এখনও বিভ্রান্তিতেই আছি। ওর তুলনায় আমি নিজেকে বয়স্ক ভেবেছি এ কারণে নয়, কারণ সব কিছু যেভাবে এগিয়েছে তাতে আমারই ওর চেয়ে বয়সে অনেক বড় হবার কথা। ছাব্বিশের বেশি ওর বয়স হওয়ারই কথা না।

‘হ্যাঁ, যথেষ্ট কম বয়স,’ পুনরাবৃত্তি করল ও, সম্ভবত আমার বিভ্রান্ত অবস্থা বুঝেই।
‘থাক, তুমি বলো তোমার বয়স কত?’ আমি জানতে চাইলাম।
‘আমার বয়সে কী এসে যায়?’ জিজ্ঞেস করলও , গম্ভীর গলা।
‘তাহলে তুমি আমার বয়স কত জিজ্ঞেস করলে কেন?’ প্রায় বিরক্তির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি আমি।
‘এগুলো অর্থহীন কথাবার্তা,’ জবাব দিল ও। ‘পুরো ফালতু বাত। আর আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে এ সব তোমার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ। ’

আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ? আমাদের এই আলোচনা? আসলে, এটা কিভাবে ঘটছে? আমি সব এমন গুলিয়ে ফেলেছি যে প্রথম প্রশ্নটা কী কারণে কী করেছিলাম তাও ভুলে গেছি। না, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, প্রথম প্রশ্নটা করার আগে ওটা নিয়ে আমি কোনো রকম চিন্তাভাবনাই করিনি। শুধু বাসায় ফেরার পর, আরও কয়েক ঘণ্টা পরে, আমাদের ওই অকিঞ্চিৎকর আলোচনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারলাম আমি।

(চলবে)

২৫তম কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৫১৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।