ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ পৌষ ১৪৩১, ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০২ রজব ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নোবেলজয়ী লেখকের উপন্যাস

নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (৪) || অনুবাদ : মাসুদুজ্জামান

অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৪
নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (৪) || অনুবাদ : মাসুদুজ্জামান অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

___________________________________

 ‘নিখোঁজ মানুষ’ [মিসিং পারসন, ১৯৭৮] এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেওয়া পাত্রিক মোদিয়ানোর ষষ্ঠ উপন্যাস। যুদ্ধ মানুষকে কতটা নিঃসঙ্গ, অনিকেত, আত্মপরিচয়হীন, অমানবিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে, এটি হয়ে উঠেছে তারই চমকপ্রদ আলেখ্য।

‘রু দে বুতিক অবসক্যুর’ শিরোনামে ফরাসি ভাষায় লেখা উপন্যাসটির নামের আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘অন্ধকার বিপনীর সড়ক’। ড্যানিয়েল ভিসবোর্ট ১৯৮০ সালে এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এর প্রধান চরিত্র ডিটেকটিভ গাই রোলান্দ। রহস্যময় একটা দুর্ঘটনার পর স্মৃতিভ্রষ্ট গাই তার আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে নামে। ধীরে ধীরে তার সামনে উন্মোচিত হতে থাকে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা প্যারি কব্জা করে নিলে বন্ধুদের কাছ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিখোঁজ হয়। বন্ধুরাও নানা দিকে ছিটকে পড়ে। সমগ্র উপন্যাসটি সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আসলে নিখোঁজ মানুষের গল্প। ১৯৭৮ সালে উপন্যাসটি অর্জন করে প্রি গোঁকুর্ত পুরস্কার। পাঠকদের উপন্যাসটি পাঠের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এখানে উল্লেখ্য যে, এর আগে মদিয়ানোর কোনো লেখা বাংলায় অনূদিত হয়নি। ফরাসি উচ্চারণ এবং কিছু বাক্যাংশের অর্থ উদ্ধারে সাহায্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ফরাসি ভাষার অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য। - অনুবাদক
___________________________________

৩য় কিস্তির লিংক

আধো আলো-অন্ধকারে একটা টেবিলে এক নারী একা বসে আছেন। তার পরনে অনুজ্জ্বল নীল পোশাক। দুই করতল দিয়ে চিবুকটা ধরা। সে কি কোনো স্বপ্নে বিভোর?
“বিয়ের কনে?”
“ওখানে মেয়েটি কী করছে?” অর্তের জিজ্ঞাসা করলেন।
“আমি জানি না,” ওয়েটারের উত্তর।
“তুমি কি জিজ্ঞেস করেছিলে কী চান তিনি?”
“না, না। তিনি কিছুই চান না। ”
“আর অন্য যারা, তারা কিছু চান না?”
“তারা আরও একডজন বোতল ক্রুগ মদ অর্ডার দিয়েছে। ”
অর্তের কাঁধ ঝাঁকালেন।
“এ নিয়ে আমার অবশ্য মাথা ঘামাবার কিছু নেই। ”
আর সোয়ানশিৎজে, ‘বিয়ের কনে’র ব্যাপারটি খেয়ালই করেননি, অথবা তারা কী বলছেন শোনেননি, আবার সেই কথাটা বলে ফেললেন :
“হ্যাঁ... স্তিওপ্পা... আপনার কি স্তিওপ্পার কথা মনে আছে?”
তিনি বেশ উত্তেজিত। আমি এমনভাবে হেসে কথাটার পরিসমাপ্তি টানলাম যে তা অনেকটা হেঁয়ালির মতো শোনালো:
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই, কিছুটা ...”
তিনি এবার অর্তেরের দিকে ঘুরে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন:
“উনি স্তিওপ্পার কথা মনে করতে পারছেন। ”
“ঠিক এমনটাই আমি ভেবেছিলাম। ”
শাদা-কোটের ওয়েটারটি তখনও অর্তেরের সামনে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে, কিছুটা বিমূঢ়।
“স্যার, আমার মনে হয় তারা কয়েকটা রুম ব্যবহার করবে... আমি তাহলে কী করবো?”
“আমি জানতাম এই বিয়ের অনুষ্ঠানটা বাজেভাবে শেষ হবে,” অর্তের বললেন। “যাই হোক, এ নিয়ে আমাদের কিছুই করার দরকার নাই …”
এরপর শূন্যে তিনি তার হাতের এমন একটা ভঙ্গি করলেন, যেন উড়ন্ত কোনো মাছিকে তাড়াচ্ছেন।
“কাজের কথায় আসি,” বললেন তিনি। “তাহলে আপনি স্বীকার করছেন যে স্তিওপ্পাকে জানতেন?”
“হ্যাঁ,” আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম।
“অন্যভাবে যদি বলি, আপনি ওই একই ভীড়ের মধ্যে ছিলেন... তারাও ভীড়ের মধ্যে ছিলেন, ছিলেন না, পল...?”
“আরে...! ওরা সবাইতো চলে গেল,” বিষণ্নভাবে বললেন সোনাশিৎজে। “স্যার, ব্যতিক্রম শুধু আপনি, আমি দারুণ খুশি যে আপনাকে ওই ভীড়ের দঙ্গলে রাখতে পারছি... আপনি ওই ভীড়ের মধ্যেই ছিলেন... আপনি ভাগ্যবান! ... এখনকার তুলনায় সেই সময়টা ছিল অনেক ভালো, মানুষের আভিজাত্যও ছিল বেশি...”
“উপরন্তু আমরা ছিলাম আরও তরুণ,” অর্তের হেসে কথাটা বললেন।
“কোন সময়ের কথা বলছেন আপনারা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল।
“তারিখ-টারিখের হিসেবে আমরা অতটা ভালো বলতে পারি না,” বললেন সোনাশিৎজে। “কিন্তু যাই বলি, পেছন ফিরে শুরুর সময়টার কথাই বলছি, এই আর কি...”
হঠাৎ মনে হলো, তিনি যেন বেশ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত।
“নিশ্চয়ই ওই ঘটনার সঙ্গে আপনার কোনো না কোনো যোগসূত্র আছে,” অর্তের বললেন।
এরপর উঠে দাঁড়ালেন তিনি, ঘরের কোণে যে বারটা আছে সেখানে গেলেন, একটা পত্রিকা নিয়ে ফিরে এসে তার পাতা ওল্টাতে লাগলেন।
পত্রিকাটা পরে আমার হাতে তুলে দিয়ে একটা নোটিশের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন:
বিরানব্বই বছর বয়সে ২৫শে অক্টোবর মারি দ্য রোজেনের মৃত্যু হয়েছে।
তার কন্যা, পুত্র, নাতি, ভ্রাতুষ্পুত্র ও ভাগ্নেদের পক্ষ থেকে খবরটা ঘোষণা করা হলো।
তার বন্ধুবান্ধব, জর্জ সাশে এবং স্তিওপ্পা দ্য জাগরেভের পক্ষ থেকেও খবরটা নিশ্চিত করা হলো।
স্যন্ত জনভিয়েভ দেবোয়া সিমেট্রিতে কবর দেওয়ার পর ৪ঠা নভেম্বর বিকাল ৪টায় সিমেট্রি চ্যাপেলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করা হবে।
নবম দিনের ডিভাইন অনুষ্ঠানটি হবে ৫ই নভেম্বর রাশান অর্থোডক্স চার্চে। ঠিকানা : ১৯ রু ক্লোদ লোর‌্যাঁ, ৭৫০১৬, প্যারি।
এই ঘোষণাকে আমন্ত্রণ হিসেবে গ্রহণ করবার জন্য অনুরোধ করা হলো।
“তাহলে কী দাঁড়ালো, স্তিওপ্পা এখনও জীবিত?” সোনাশিৎজে বললেন। “আপনি কি তাকে দেখতে চান?”
“না। ” আমি বললাম।
“আপনি ঠিকই বলেছেন। মানুষকে বর্তমানের মধ্যে বাঁচতে হয়। জঁ, ব্রান্ডি খেলে কেমন হয়?”
“চমৎকার। ”

সময় যতই গড়াতে লাগলো, স্তিওপ্পা আর আমার অতীত সম্পর্কে তারা আগ্রহ হারাতে থাকলেন। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির কোনো হেরফের হলো না। অবশেষে যাই ঘটুক, আমি তো তাদের বিবেচনার মধ্যেই আছি।
অনেকটা নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বললাম, “পত্রিকাটা কি আমি নিতে পারি?”
“অবশ্যই,” বললেন অর্তের।
আমরা পরস্পর পানপাত্রের টুংটাং ধ্বনি তুললাম। আমার চোখের সামনে যা ভেসে উঠলো তাহলো দুই ওয়েটারের আবছায়া চেহারা। এমনকি স্তিওপ্পা দ্য জাগারেভের স্মৃতিও প্রায় মুছে গেল। সোনাশিৎজে যেমন বললেন, তারা এই স্তিওপ্পার কথা কিছুই শোনেননি সেই “শুরুর সময়টা ছাড়া। ”
“ও, তাহলে আপনি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ?” অর্তের আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
“এখন আর নই। আমার মালিক অবসর নিয়েছেন। ”
“আর আপনি, এখনও কাজ করছেন?”
আমি কাঁধ ঝাঁকালাম কিন্তু কোনো উত্তর দিলাম না।
“যাই হোক, আপনাকে দেখে আমার উৎফুল্ল হওয়া উচিত। আবার যে কোনো সময়ে আসবেন। ”
তিনি পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়ালেন আর তার হাতটা আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
“আপনাদের এখন বিদায় জানাচ্ছি বলে কিছু মনে করবেন না, আমার এখনও হিসেবপত্তর নিয়ে বসতে বাকি... আর ওরাও পানাহারের উৎসবে মেতে আছে। ”
তিনি পুকুরের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।
“বিদায়, জঁ। ”
“বিদায়, পল। ”
অর্তের আমার দিকে চিন্তান্বিত চোখে তাকালেন। কথা বলে উঠলেন বেশ কোমল স্বরে:
“আপনি এখন দাঁড়িয়ে আছেন, আমাকে অনেক কিছু মনে করিয়ে দিচ্ছেন...”
“আপনাকে উনি কী মনে করিয়ে দিচ্ছেন?” সোনাশিৎজে তাকে জিজ্ঞেস করলেন।
“আমরা তখন ওতেল কাস্তিঈতে কাজ করি, একজন খদ্দের প্রত্যেক দিন সন্ধ্যায় আসতেন, বেশ দেরি করে আসতেন...”
সোনাশিৎজে আবার ঘুরে আমাকে আপাদমস্তক দেখলেন।
বললেন, “এটা সম্ভব,” “আপনিই ওতেল কাস্তিঈর সেই পুরানো খদ্দের...”
আমি বিমূঢ় একটা হাসি দিলাম।

সোনাশিৎজে আমার হাতটা ধরে রেস্তোরাঁটা পেরিয়ে এলেন। আমরা যখন রেস্তোরাঁতে প্রথম ঢুকি, তার চেয়েও ওই রেস্তোরাঁতে এখন ঘন হয়ে অন্ধকার নামছে। ধূসর নীল রঙের পোশাক পরা কনেটি আর সেই টেবিলে নেই। বাইরে এসে শুনলাম গানের প্রচণ্ড ঝংকার আর মানুষের হাসি, পুকুরের অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে।
“আপনি কি আমাকে মনে করিয়ে দিতে পারবেন সেই গানটার কথা, কোন গান ছিল সেটা... এখন যে গানটা বাজছে, সেটা...
“স্তিওপ্পা?” সোনাশিৎজে জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ, কোন গানটা তিনি সবসময় বাজাতে বলতেন...
তিনি গানের প্রথম কিছু অংশ শিস দিয়ে গাইলেন, তারপর চুপ করে গেলেন।
“আপনি কি স্তিওপ্পাকে আবার দেখবেন?”
“দেখতে পারি। ”
তিনি আমার বাহু বেশ শক্ত করে চেপে ধরলেন।
“তাকে বলবেন এখনও সোনাশিৎজে তার কথা অনেক ভাবে। ”
আমার ওপর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন:
“জঁ-ই মনে হয় ঠিক কথাটা বলেছেন। আপনি হোটেল কাস্তিঈর একজন কাস্টমার ছিলেন... মনে করতে চেষ্টা করেন... রু কম্বোর হোটেল কাস্তিঈ...”

আমি ঘুরে সরে গেলাম আর গাড়ির দরোজাটা খুললাম। দেখলাম কে যেন সামনের আসনে বসে পড়েছেন আর জানালার দিকে ঝুঁকে আছেন। আমি নিচু হয়ে দেখলাম এবং কনেকে চিনতে পারলাম। তিনি প্রায় ঘুমে, তার ধূসর নীল পোশাক প্রায় উরু অব্দি উঠে আছে।
সোনাশিৎজে বললেন, “এই মেয়েটাকে ওখান থেকে আমাদের বের করতে হবে। ”
আমি আস্তে করে তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি ঘুমের অতলেই থাকলেন। তো এবার আমি তার কোমর ধরে ওঠাবার চেষ্টা করলাম আর কোনোরকমে গাড়ি থেকে বের করে আনলাম।
আমি বললাম, “আমরা কিন্তু তাকে মাটিতে ফেলে রেখে যেতে পারি না। ”
বাহুবন্ধনে আঁকড়ে ধরে আমি তাকে রেস্তোরাঁতে নিয়ে আসতে থাকলাম। তার মাথা আমার কাঁধে আর তার সুমসৃণ চুল আমার ঘাড়ে আলতো করে চুমু খাচ্ছে। তীব্র সুগন্ধযুক্ত পারফিউম মেখেছেন তিনি, সেই ঘ্রাণ আমাকে কী যেন মনে করিয়ে দিল। কিন্তু কী সেটা?

(চলবে)

৫ম কিস্তিরি লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।