___________________________________
‘নিখোঁজ মানুষ’ [মিসিং পারসন, ১৯৭৮] এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেওয়া পাত্রিক মোদিয়ানোর ষষ্ঠ উপন্যাস। যুদ্ধ মানুষকে কতটা নিঃসঙ্গ, অনিকেত, আত্মপরিচয়হীন, অমানবিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে, এটি হয়ে উঠেছে তারই চমকপ্রদ আলেখ্য।
___________________________________
৭ম কিস্তির লিংক
(৮ম কিস্তি)
“না। ”
“আর আপনি দেশত্যাগ নিয়ে আগ্রহী, তাইতো?”
“আমি... আমি দেশত্যাগী মানুষদের নিয়ে একটা বই লিখছি। একজন... একজন পরামর্শ দেয়ায় আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম... পল সোনাশিৎজে ...”
“সোনাশিৎজে?...”
তিনি রুশ উচ্চারণে নামটা বললেন। নামের উচ্চারণটা বেশ মসৃণ, যেন বাতাস গাছের গায়ে গুঞ্জন তুলছে।
“এটা জর্জিয়ার একটা নাম... আমি এই নামটার কথা জানি না...। ”
ভ্রু কুচকে তাকালেন তিনি।
“সোনাশিৎজে... না, জানি না তো...”
“আমি ঠিক বোকার মতো কথা বলছি। আসলে আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। ”
“বলেন, উত্তর দিতে পারলে সুখী হবো...”
বিষণ্নভাবে হাসলেন তিনি।
“দেশত্যাগের গল্প আসলে দুঃখের গল্প... কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন যে আমার নাম স্তিওপ্পা?...”
“আমি... আমি ঠিক জানি না...”
“যারা আমাকে স্তিওপ্পা বলে ডাকতো তাদের প্রায় সবাই আজ মৃত। জীবিতদের সংখ্যা এত কম যে একআঙুলে গুণে শেষ করতে পারবেন। ”
“সোনাশিৎজের কথা বলছিলাম...”
“আমি তাকে ঠিক চিনি না। ”
“আমি কি আপনাকে... কিছু প্রশ্ন করতে পারি?”
“হ্যাঁ করেন, কিন্তু আমি যেখানে থাকি আপনি কি সেখানে আসতে পারবেন? আমরা ওখানে গিয়েও কথা বলতে পারি। ”
রু জুলিয়াঁ পোতাঁয় একটা প্রবেশদ্বার দিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম। বেশকিছু অ্যাপার্টমেন্টকে পাশ কাটিয়ে একটা শূন্য স্থান পেরিয়ে এলাম। একটা কাঠের সিঁড়ি আর দুটো জাফরিকাটা দরোজা অতিক্রম করতে হলো। আমাদের শারীরিক উচ্চতা আর সংকীর্ণ সিঁড়ির কারণে মাথা নিচু আর দেয়ালের দিকে মাথাটা ঘুরিয়ে আমরা ঢুকছি। কপাল আর দেয়ালের মধ্যে তাই কোনো ঠোকাঠুকি হলো না।
পাঁচতলার দুই রুমের একটা ফ্লাটে তিনি থাকেন। শোবার ঘরটা তিনি আমাকে দেখালেন এবং বিছানার ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়লেন।
“মাফ করবেন,” তিনি বললেন, “সিলিংটা অনেক নিচু। দাঁড়িয়ে থাকাও স্বস্তিদায়ক নয়। ”
সত্যিই আমার মাথা আর সিলিংয়ের মধ্যে কয়েক ইঞ্চির ব্যবধান। এই জন্য আমাকে কুঁজো হয়ে নড়াচড়া করতে হচ্ছে। অন্য রুমটাতে যেতে হলেও দুজনের মাথাই এতটা উঁচু যে দরোজার ফ্রেমটা সতর্কতার সঙ্গে পেরুতে হলো। আমি ঠিকই কল্পনা পারছিলাম, দরোজার ওই ফ্রেমটার সঙ্গে স্তিওপ্পার কপাল অনেকবারই হয়তো ঠোক্কর খেয়েছে।
তিনি জানালার পাশে রাখা বিবর্ণ নীল রঙে মোড়ানো ছোট্ট একটা সোফা দেখিয়ে বললেন, “যদি ইচ্ছা হয়... আপনি নিজেও এখানে শুয়ে আড়মোড়া ভাঙতে পারেন...। ”
“মনে করেন, এটা আপনার নিজের বাড়ি... সটান শুয়ে পড়লে আপনি আরও আরাম বোধ করবেন... কিন্তু আপনি যদি বসেও থাকেন, মনে হবে খাঁচায় আটকে আছেন... দয়া করে তাই শুয়ে পড়েন...”
আমি সেটাই করলাম।
তিনি পাশের টেবিলের ওপর রাখা গোলাপি শেডের ল্যাম্পটার আলো জ্বালালেন। ল্যাম্পটা থেকে খুব নরম মৃদু আলো বিচ্ছুরিত হতে থাকলো আর সিলিংয়ের গায়ে সৃষ্টি হলো ছায়াচিত্রের।
“তাহলে আপনি দেশত্যাগ নিয়ে বেশ আগ্রহী, তাইতো?”
“অনেক। ”
“আপনার বয়সও তো এখন অনেক কম...”
আমি কি তরুণ? আমি কখনই ভাবি না যে আমি তরুণ আছি। কাছেই সোনালি ফ্রেমের একটা বড় আয়না দেয়ালে ঝুলছে। আমার মুখটা তাকিয়ে দেখলাম। আমি তরুণ নাকি?
“ওহ্... না, ততটা তরুণ নই আমি...”
কয়েক মুহূর্তের নৈঃশব্দ্য। আমাদের দুজনেই রুমটার দুই প্রান্তে ক্লান্তি দূর করার জন্য আড়মোড়া ভাঙছি। মনে হলো দুজনেই বুঝি আফিম খেয়ে হাত-পা-শরীর নাড়ছি।
তিনি বললেন, “আমি এইমাত্র একটা মৃত মানুষের অন্তিম অনুষ্ঠান থেকে ফিরছি। ” “এটা দুর্ভাগ্যজনক, যে-বৃদ্ধাটি মারা গেলেন তার সঙ্গে আপনার দেখা হলো না... তিনি আপনাকে অনেক কথা জানাতে পারতেন... দেশত্যাগের কথা যদি বলেন তাহলে তিনিই ছিলেন সেই আসল মানুষ যার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারতেন...”
“সত্যি?”
“অনেক সাহসী এক নারী ছিলেন তিনি। শুরুতে রু দু মঁথ্যাবোরেতে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান খুলেছিলেন এবং অনেক কিছু দিয়ে সবাইকে সাহায্য করতেন... ব্যাপারটা খুব কঠিন ছিল সেই সময়...”
স্তিওপ্পা বিছানার কোণায় এসে বসলেন, তার শরীরটা বাঁকানো, হাত দুটো আড়াআড়িভাবে রাখা।
“আমার বয়স তখন পনেরো... যখনকার কথা বলছি তখন খুব বেশি কেউ অবশিষ্ট নেই...”
“ছিলেন জর্জ সাখার...,” আমি দুম করে কথাটা বলে ফেললাম।
“খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। আপনি তাকে চিনতেন?’’
মনে পড়লো, এই কি সেই লোক যার শরীরটা মনে হচ্ছিল প্লাস্টার করা? নাকি সে ওই ন্যাড়া-মাথার মঙ্গোলীয় শরীরী কাঠামোর মানুষটা?
“দেখেন,” বললেন তিনি, “সব কিছু আবার আমি আপনাকে বলতে পারবো না... বলতে গেলে ব্যাপারটা আমাকে বিষণ্ন করে ফেলে... কিন্তু আপনাকে আমি কিছু ছবি দেখাতে পারবো... সেই সময়ের কিছু মানুষের নাম আর তারিখ বলতে পারি... বাকিটা আপনি নিজের মতো করে সাজিয়েগুছিয়ে নেবেন...। ”
“এ আপনার দয়া, আপনাকে আমি যন্ত্রণা দিচ্ছি, কী যে ঝামেলার মধ্যে ফেলেছি। ”
আমার দিকে তাকিয়ে তিনি হাসলেন।
“আমার কাছে অনেক ছবি আছে... লোকে সব ভুলে যায় তো, তাই ছবিগুলোর পেছনে নাম আর তারিখ লিখে রেখেছি...”
তিনি উঠে দাঁড়ালেন, নিচু হলেন, তারপর অন্য রুমে গেলেন।
আমি একটা ড্রয়ার খোলার শব্দ পেলাম। ফিরলেন তিনি, তার হাতে একটা বড় লাল রঙের বাক্স, বিছানার প্রান্তে ঠেঁস দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লেন।
“আসেন, আমার পাশে বসেন। ছবিগুলো দেখতে আপনার সুবিধা হবে। ”
আমি তাই করলাম। বাক্সের গায়ে গোথিক অক্ষরে একটা কনফেকশনারির নাম খোঁদাই করে লেখা। বাক্সটা খুললেন তিনি। বাক্সটা ছবিতে ভরা।
“বিখ্যাত যেসব মানুষ দেশত্যাগ করেছেন, আপনি এর মধ্যে তাদের ছবি পেয়ে যাবেন,” বললেন তিনি।
(চলবে)
৯ম কিস্তির লিংক
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০১৪
শিল্প-সাহিত্য
নোবেলজয়ী লেখকের উপন্যাস
নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (৮) || অনুবাদ: মাসুদুজ্জামান
অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।