ভারতের এক বিদ্যাজীবী-পরিবারের সফল উত্তরাধিকার হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (জন্ম: চব্বিশ পরগনার নৈহাটি, ৬ ডিসেম্বর ১৮৫৩; মৃত্যু: ১৭ নভেম্বর ১৯৩১)। প্রকৃত নাম শরৎনাথ ভট্টাচার্য।
পরিষদ-প্রকাশিত ‘প্রচীন বাংলা গ্রন্থাবলী’ নামক দ্বি-মাসিক পত্রিকার ১১টি সংখ্যা সম্পাদনা করেন তিনি। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থাবলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত ‘হাজার বছরের বাঙ্গালা ভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা’ (প্রকাশকাল: ১৯১৬)। বাংলাসাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হিশেবে পরিচিত এই ‘চর্য্যাচর্য্য বিনিশ্চয়’ বা ‘চর্যাপদ’ ১৯০৭ সালে নেপাল থেকে হরপ্রসাদই আবিষ্কার করেন। বাংলাসাহিত্য যে হাজার বছরের পুরনো, তা হরপ্রসাদের এই আবিষ্কারের পথ ধরেই প্রমাণিত হয়। গবেষণা এবং পুঁথি-আবিষ্কার ও সম্পাদনা ছাড়াও তিনি উপন্যাস লিখেছেন— ‘কাঞ্চনমালা’ (১৯১৬), ‘বেনের মেয়ে’ (১৯২০)। এছাড়া কয়েকজন প্রাচীন মনীষীর জীবন ও কর্মের ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন; মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর নাট্যরূপ দিয়েছেন। ইংরেজি ভাষায় কিছু পুস্তিকাও রচনা করেছেন তিনি। তবে সবকিছুর ওপরে তিনি পরিচিতি লাভ করেছেন প্রাচ্যতত্ত্ববিদ হিশেবে। সাহিত্যভিত্তিক গবেষণা, বৌদ্ধবিদ্যা ও হিন্দুধর্মতত্ত্ব আলোচনা, ইতিহাসচর্চা, প্রত্নতত্ত্ব-অনুশীলন, স্মৃতিকথা রচনা প্রভৃতিতে হরপ্রসাদের পাণ্ডিত্য আজও তুলনাহীন।
পেশাগত জীবনে হরপ্রসাদ কলকাতার হেয়ার স্কুলে ট্রান্সলেশন-মাস্টার, লক্ষ্মৌই ক্যানিং কলেজে সংস্কৃতের অধ্যাপক, বেঙ্গল লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান, প্রেসিডেন্সি কলেজে সংস্কৃত বিভাগের প্রধান, সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল, সরকারের ব্যুরো অব ইনফরমেশন-এর প্রধান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান (১৮ জুন ১৯২১ থেকে ৩০ জুন ১৯২৪) হিশেবে দায়িত্বপালন করেন। কাজের স্বীকৃতি-স্বরূপ তিনি ১৮৯৮-তে ‘মহামহোপাধ্যায়’ ১৯১১-তে ‘সিআইসি’, এবং ১৯২৭-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘ডিলিট’ উপাধিতে ভূষিত হন। বর্ণিল ও কর্মময় জীবন-যাপনকারী এই পণ্ডিত ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অতি সাধারণ এবং মানুষের প্রতি গভীরভাবে দরদী। ভারতবর্ষের পুরনো ও আধুনিক সাম্প্রদায়িক সঙ্কট থেকে বহুদূরে— মানবতার আলোকশিখার ছায়াতলে তাঁর অবস্থান। হরপ্রসাদের জীবনবোধ বুঝার জন্য আমরা তাঁর দেওয়া বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতির শেষ অভিভাষণ থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করছি:
এখানে হিন্দু-মুসলমান ভেদ নাই, আচরণীয় অনাচরণীয় ভেদ নাই, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য ভেদ নাই। ইহার উদ্দেশ্য, বাংলার সীমার মধ্যে মানুষ যাহা কিছু করিয়াছে, সেইগুলি বাহির করা এবং তাহার একটি উজ্জ্বল ব্যাখ্যা দেওয়া— তাহাতে মঙ্গল বৈ অমঙ্গল হইবে না— এরূপ খাঁটি মঙ্গলময় ব্যাপারে যৎকিঞ্চিৎ সাহায্য করিতে পারিলেও সেটা আমি ধর্ম বলিয়া মনে করি। আপনারা যদি ধর্ম অধর্ম না মানেন, আমি সেটা ভাগ্য বলিয়া মনে করি— আপনারা মানুন আর নাই মানুন, আমি ইহাকে ধর্ম পুণ্য ও ভাগ্য- এই তিন বলিয়াই মানি এবং আমার পরম সৌভাগ্য যে আমি এরূপ পুণ্যময় অনুষ্ঠানের সহিত এত দীর্ঘকাল জড়িত ছিলাম।
ছাত্রজীবন থেকেই হরপ্রসাদের লেখক-প্রতিভা প্রকাশ পায়। স্নাতক-শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে ‘ভারত মহিলা’ শীর্ষক প্রবন্ধ লিখে লাভ করেন ‘হোলকার পুরস্কার’। সাধু ভাষায় লিখলেও পরবর্তীকালে চলিত বাংলার প্রবহমানতায় তাঁর নির্মোহ সমর্থন ছিল। ভাষা-প্রয়োগে কথ্যরীতির প্রয়োজনীয়তা তিনি অস্বীকার করেননি; প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাষার গতিকে প্রাণবন্ত মনে করেছেন। কারণ সে ভাষা খুব সহজে কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে। নিজেও প্রচলিত ও সাধারণের বোধগম্য প্রচুর শব্দ প্রয়োগ করেছেন। ‘সহস্র’ স্থলে ‘হাজার’; ‘প্রাচীন’ স্থলে ‘পুরানো’; ‘কথিত’ স্থলে ‘বলা’ লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন হরপ্রসাদ বাবু।
একথা সম্ভবত সকলেই মানবেন যে, বুদ্ধি থাকলেও সাধারণত সাধনার প্রমাণ বাঙালি রাখতে পারে না। আমরা কম শিখে বেশি লাভ করতে চাই। অবশ্য অল্পকিছু ব্যতিক্রম মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তেমনই এক অনন্য সাধক। সাধনা দিয়ে জ্ঞান অর্জন করা চলে বটে, কিন্তু তাকে সহজ করে অনুধাবন করা এবং প্রকাশ করা সাধারণ ব্যাপার নয়। লক্ষ্যণীয় বিষয়, দার্শনিকশক্তির বলে হরপ্রসাদ বাবু অর্জিত জ্ঞান, চিন্তা ও প্রকাশের সরলতার কারণে, নিজের ও অপরের জন্য সহজ করে তুলতে পেরেছেন। প্রবন্ধের ভাষায় এবং পরিবেশনশৈলীতে তাঁর নিজেস্বতা পাঠকের নজর কাড়ে। ‘তৈল’ (প্রথম প্রকাশ: ‘বঙ্গদর্শন’, চৈত্র ১২৮৫) প্রবন্ধটিতে বিশেষভাবে পাঠকের অভিনিবেশ প্রতিফলিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে মননশীলতার পাশাপাশি সৃজনশীলতার প্রকাশও ঘটেছে। লেখক তাঁর সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের মানচিত্র তুলে ধরেছেন বর্তমান প্রবন্ধটিত। । রচনাটির আরম্ভ এরকম:
তৈল যে কী পদার্থ তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন, তাঁহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ— বাস্তবিক স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কী? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠাণ্ডা করে তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠাণ্ডা করিতে আর-কিসে পারে!
মানুষ মানুষকে স্নেহ করবে, শ্রদ্ধা করবে, ভালোবাসবে— এটাই স্বাভাবিক। কাজেই চিন্তাবিদদের চোখে স্নেহ বা ভিন্নার্থে তৈল আদান-প্রদান কোনো খারাপ বস্তু নয়। কিন্তু, খুবই পরিতাপের বিষয়— সমাজ-রূপান্তরের পরিক্রমায় ‘তৈল’ শব্দটির প্রয়োগ নেতিবাচক অর্থে প্রচলিত হয়েছে। কেননা, মানুষের সন্তুষ্টি-অর্জনে যেখানে শক্তি-বিদ্যা-ধন-কৌশল প্রভৃতি কোনো কাজে আসে না, তখন ‘তৈল’ বেশ কাজ দেয়। ‘তৈল’ শব্দটির এখানে তাৎপর্যগত অর্থ দাঁড়ায় মিথ্যা প্রশংসা বা লোক-দেখানো স্তুতি। তার মানে, স্নেহ বা শ্রদ্ধা তার চরিত্র হারিয়ে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করলে তা ‘তৈল’ হিশেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
এখানে কোনো ধনী-গরীব, চাকর-মালিক প্রভেদ নেই। তবে তৈল-প্রয়োগের উপযুক্ত প্রতিবেশ ও সময়টা বুঝতে হয়। এ জন্য তেল প্রদানের সঙ্গে কৌশলের সম্বন্ধকে লেখক অস্বীকার করতে পারেননি। তিনি জানেন, ‘কৌশল করিয়া একবিন্দুও দিলে যত কার্য হয়, বিনা কৌশলে কলস কলস ঢালিলেও তত হয় না। ’ ঐতিহাসিক ও সমাজ-বিশ্লেষক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আরও জানাচ্ছেন:
ব্যক্তিবিশেষে তৈলের গুণতারতম্য অনেক আছে। নিষ্কৃত্রিম তৈল পাওয়া অতি দুর্লভ। কিন্তু তৈলের এমনি একটি আশ্চর্য সম্মিলনী শক্তি আছে যে তাহাতে উহা অন্য সকল পদার্থের গুণই আত্মসাৎ করিতে পারে। যাহার বিদ্যা আছে তাহার তৈল আমার তৈল অপেক্ষা মূল্যবান। বিদ্যার উপর যাহার বুদ্ধি আছে তাহার আরো মূল্যবান। তাহার উপর যদি ধন থাকে তবে তাহার প্রতিবিন্দুর মূল্য লক্ষ টাকা। কিন্তু তৈল না থাকিলে তাহার বুদ্ধি থাকুক, হাজার বিদ্যা থাকুক, হাজার ধন থাকুক কেহই টের পায় না।
তৈল দিবার প্রবৃত্তি স্বাভাবিক। এ প্রবৃত্তি সকলেরই আছে এবং সুবিধামতে আপন গৃহে ও আপন দলে সকলেই ইহা প্রয়োগ করিয়া থাকে, কিন্তু অনেকে এত অধিক স্বার্থপর যে বাহিরের লোককে তৈল দিতে পারে না। তৈলদান প্রবৃত্তি স্বাভাবিক হইলেও উহাতে কৃতকার্য হওয়া অদৃষ্টসাপেক্ষ।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ সমকালে চেতনা-জাগানিয়া রচনা হিশেবে পরিচিতি লাভ করেছে। উত্তরকালেও বিস্তৃত হয়েছে এর পরিপ্রেক্ষিত ও প্রাসঙ্গিকতা। এই বিষয়টি নিয়ে তাঁর আগে এবং পরে আর কেউ এত বিশ্লেষণমূলক গভীর ভাবনা প্রকাশ করতে পারেননি। হরপ্রসাদের চিন্তা-দরোজা এবং প্রকাশের ভার ও দক্ষতা পাঠককে সামান্য হলেও নতুন করে ভাবতে অনুপ্রাণিত করে। কেবল নিজে চিন্তাবিদের ভূমিকায় অবতীর্ণ থেকে নয়, আরও অনেককে চিন্তার ভুবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে, বোধহয় সমাজ-পরিবর্তনের ডাক দিতে চেয়েছেন দার্শনিক হরপ্রসাদ। সমাজকে ধরতে চেয়েছেন মানুষের বিবেচনা ও প্রবণতার আলোয় এবং আড়ালের আলো-ছায়ায়। তাই তিনি মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন মানুষেরই মানচিত্র।
বাংলাদেশ সময় : ১৮৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৪