___________________________________
এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।
________________________________
৪২তম কিস্তির লিংক
৪৩তম কিস্তি
অদ্ভূত সব ব্যাপার ঘটলো। আমরা বাড়িতে ফিরে দেখি হান্তের খুবই উত্তেজিত হয়ে আছে (যদিও সে এমন এক ধরনের মানুষ যে কারো অনুভূতির প্রদর্শনী করাটাকে অরুচিকর মনে করে)। তাই হয়তো সে দ্রুত তার মনোভঙ্গি গোপন করার চেষ্টা করলো, কিন্তু এটা পরিষ্কার বাতাসে কিছু একটা ভেসে বেড়াচ্ছে। মিমি বিদায় হয়েছে, আর খাবার ঘরে ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার প্রস্তুত। বুঝলাম, আমরা স্পষ্টতই দেরি করে ফেলেছি, কারণ আমরা ঢোকামাত্র চাকর-বাকরদের ব্যস্ততা নজরে পড়লো। খাবারের সময় খুব কমই কথা হলো আমাদের। আমি সতর্কতার সঙ্গে হান্তেরের প্রতিটা শব্দ আর অঙ্গভঙ্গি খেয়াল করলাম, কারণ আমার ধারণা ছিলো ওসব থেকে হয়তো আমার অনেক ঘটনারই দিশা মিলবে, একইসঙ্গে আমার বেশ কিছু সূত্রেরও পরীক্ষা হয়ে যাবে এই সুযোগে, যা আমি আগেই পরখ করে দেখতে চেয়েছিলাম। মারিয়াকেও খেয়াল করলাম আমি। ওর চেহারা দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। তবে থমথমে ভাবটা খানিকটা হালকা করার জন্য, ও জানাল সার্ত্রের লেখা একটা উপন্যাস পড়ছে সে। কিন্তু মেজাজ খারাপের প্রমাণ দিতেই বোধকরি, ফুঁসে উঠলো হান্তের: ‘এখনকার উপন্যাস আর এই বয়সে! এরা যা খুশি লিখে... কিন্তু কোন্ বোকা এটা পড়ে!’
কেউ কোনো জবাব দিলো না, আর হান্তেরও তার এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া প্রশমনে আর কোনো উদ্যোগ নিলো না। এতে এটা বুঝতে বেগ পেতে হলো না যে, মারিয়ার ওপর সে খেপে আছে। আর যেহেতু সাগরতীরে যাওয়ার আগে পর্যন্তও ওর এই বিরক্তির কোনো নমুনা আমি দেখিনি, কাজেই আমি ধরেই নিলাম এর মূলে আছে আমাদের সাগরতীরের আলাপচারিতা: ঠিকই, আমাদের ওই সংলাপের কারণে ও অসন্তুষ্ট না হলেই বরং আমি আশ্চর্য হবো—আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, আমাদের ওই দীর্ঘ সময় নিরুদ্দিষ্ট থাকাটাই ওর রাগের মূল কারণ। এখন উপসংহারটা এমন ভাবতে পারি: হান্তের ঈর্ষান্বিত, আর ওর এই ঈর্ষা থেকে এটাই প্রমাণ হয় সাধারণ বন্ধুত্ব আর আত্মীয়তার চেয়েও মারিয়ার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা আরও বাড়তি কিছু। তার মানে আবার এও না যে ওদেরকে প্রেমিক-প্রেমিকাই হতে হবে। বরং বিপরীতটা হওয়ার সম্ভবনাই বেশি, মারিয়া অন্য কারো ব্যাপারে বেশি মনযোগ দিচ্ছে এটাই হয়তো ওকে রাগিয়ে দিয়েছে। আর হান্তেরের বিরক্তির কারণ যদি হয় ঈর্ষা, তাহলে সে নিশ্চিতভাবেই আমার প্রতি বৈরি হবে, কারণ আমাদের মধ্যে আগে থেকে কোনো সম্পর্ক নেই। আর এখানে এই ব্যাপরটাই ঘটেছে আসলে। অন্য কোনো রকম কিছুর ইঙ্গিত না থাকলেও, মারিয়ার সাগর পারের ওই খাড়া ঢালটার কথা উল্লেখ করতেই আমার দিকে যে তীর্যক চাহনি হানলো হান্তের যা বোঝার তা ওর থেকেই বুঝে নেওয়া যায়।
খাওয়া শেষ হওয়ার পর পরই ক্লান্তির কথা বলে দ্রুত উঠে পড়লাম আমি। আমার পরিকল্পনা হলো যথাসম্ভব সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা। দোতলায় উঠে এলাম, দরজা খুলে আমার ঘরে ঢুকলাম, বাতি জ্বালালাম, শব্দ করে দরজাটা লাগালাম যেন পুরোটা বন্ধ করে দিচ্ছি, তারপর নিচের কথা শোনার জন্য সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে, হান্তেরের কণ্ঠস্বর কানে এলো, রাগী গলায় কি যেন বলছে ও, যদিও ওর কথা পরিষ্কার বোঝা গেলো না। মারিয়া নিরুত্তর। তারপর আবারও হান্তের, আরেকটু বেশি সময় নিয়ে এবং আরও উত্তেজিত গলায় কিছু একটা বললো। ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই মারিয়া বাধা দিল, খুব সংক্ষেপে, নিচু গলায় ওর কথার জবাব দিলো সে, একই সঙ্গে চেয়ার ঠেলে সরানোর শব্দও হলো। এক মুহূর্তের মধ্যেই সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শুনলাম। আমি লাফ দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়লাম, তবে দরজার চাবির ছিদ্র দিয়ে শোনা অব্যাহত রাখলাম। মুহূর্তের মধ্যেই আমার দরজার বাইরে পায়ের এগিয়ে এলো: কোনো নারীর পায়ের শব্দ। এরপর মনে হলো বেশ কয়েক ঘণ্টাই জেগে কাটলো আমার, কি ঘটছে সেসব নিয়ে নানা চিন্তা আর কানখাড়া বাইরের যেকোনো শব্দের জন্য। বাকি রাত আর কিছু শুনলাম না।
পুরো নির্ঘুম কাটলো রাতটা। চারপাশ থেকে এ সময় একের পর এক চিন্তা এসে পুরো ঘিরে ধরলো আমাকে, এসব ভাবনা আগে কখনও আমার মাথায় আসে নি। দ্রুতই বুঝলাম যে আমার আগের উপসংহার যথেষ্ট কাঁচা: আমি ধরে নিয়েছিলাম (সঠিকভাবেই) যে হান্তেরের ঈর্ষান্বিত হওয়ার জন্য মারিয়ার তাকে ভালোবাসতেই হবে এমন কোনো কথা নেই; এই উপসংহারে আমি নিশ্চিন্তও হয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমার এ রকম উপলব্ধি হচ্ছে যে, এমনই হবে তারও কোনো মানে নেই, কোনো কিছুই অসম্ভব না।
মারিয়াও হান্তেরকে ভালোবাসতে পারে, আর হান্তের তার পরও ঈর্ষায় ভুগতে পারে।
( চলবে )
বাংলাদেশ সময়: ১৬১২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৪