ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ পৌষ ১৪৩১, ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০২ রজব ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

টাকার উপরে মেয়েটি | মঞ্জু সরকার

গল্প/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৪
টাকার উপরে মেয়েটি | মঞ্জু সরকার

ব্যাংকে ক্যাশ আগলে থাকা মেয়েটির ঠোঁটে গোলাপি রং ভেদ করে ফুটেছে সূক্ষ্ম এক কালো তিল। আসল না নকল? বোঝার জন্য তাকাতে হয়, ভাবতেও হয়।

দৃষ্টি নিচে নামালে ডেস্কের দেরাজে থরে থরে সাজানো নোটের বাণ্ডিলগুলো চোখে পড়ে। নগদ টাকার প্রতি সহজাত আকর্ষণ, টাকা গোনায় ব্যস্ত দুটি হাতের সুডৌল আঙুল, গোলাপি ঠোঁটের কালো তিল, নাকি টাকার দিকে একাগ্র চোখ-মুখ ও কালো চুলের ঢাল নিয়ে ক্যাশিয়ার মেয়েটার তাবৎ সৌন্দর্যই ভিতরে ভালোলাগার বোধ শিরশির জাগায়? আজমল ঠিক বুঝতে পারে না। মুখোমুখি মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটি তার দিকে তাকায় না। প্রতিটি নোট অপলক চোখে নেড়ে চেড়ে পরখ করে।

সপ্তাহে দু’তিনবার একইভাবে দেখা হয় মেয়েটাকে। যতো দেখে ততো বেশি সুন্দর লাগে। ভালোলাগা আরো উথলে ওঠে। সামনে দাঁড়ানো অবস্থান থেকে কাউন্টারে বসা মেয়েটির মাথার সিঁথিটিকে মনে হয় বুনোপথ। টাকাঅলা ব্যবসায়ী হওয়ার বদলে আজমল যদি একটা পিঁপড়ে হতো, ওই সিঁথিপথ ধরে ঘন চুলের অরণ্যে হারিয়ে গেলেও মনে হয় বেশি সুখ পেতো। মেয়েটির সিঁথির চামড়া যেন গায়ের রঙের চেয়েও ফর্সা। মাত্র তিন/চার ফুট ব্যবধানে সে, কিন্তু শ্যাম্পু-চুল বা শরীর থেকে কোনো ঘ্রাণ ছুটে আসে না কেন? কারণ মাঝখানে রয়েছে কাঁচের দেয়াল। লেনদেনের জন্য একটি ফাঁক। খদ্দের বেশি হলে মেয়েটার সামনে লাইন দিয়েও দাঁড়াতে হয়, টাকা তুলতে কিংবা জমা দিতে। কাঁচের দেয়াল ঘেরা ঘরটায় মেয়েটার পাশের ডেস্কে অবশ্য একজন পুরুষও আছে। দুজনের টেবিলে একইরকম কম্পিউটার-মনিটর, দেরাজে টাকার বাণ্ডিল, মাঝখানে নোট গোনার একটি মেশিন। ক্যাশ কাউন্টারে তাদের পেছনের টেবিলে বসে কম্পিউটারসহ বয়স্ক আরো একজন অফিসার। চেক পাশ করতে তার সাইন লাগে।

ব্যাংকের এই শাখায় আজমলের একাউন্টটি এখন দোকানের ক্যাশবাক্সের মতোই। দশ/পনেরো মিনিটের হাঁটা দূরত্বে তার ফার্নিচার দোকান। অদৃশ্য ক্যাশবাক্স সামলানোর দায়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ তার কাছে, প্রতি সপ্তাহেই অন্তত দু’তিনবার আসে ব্যাংকে। ফলে দারোয়ান থেকে শুরু করে ব্যাংকের অনেক অফিসারই চেনা। কিন্তু ক্যাশের মেয়েটি কয়েক মাস হলো এসেছে, সম্ভবত চাকরিও নতুন। একটি সামান্য ভুলকে ভিত্তি করে আজমলের সঙ্গে তার খানিকটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিংবা একতরফা ভালোলাগার সূচনা বলা যায়।    

একবার টাকা জমা দিতে এসে পঁচিশ হাজার টাকার বাণ্ডিলে এক হাজার টাকা বেশি দিয়েছিলো আজমল। ইচ্ছে করে নয় অবশ্যই। ভুলটা এখনো তার কাছে রহস্যময়। মেয়েটি মেশিনে গোনার পর, হাতেও গুণেছে দু’বার। টাকা জাল না খাঁটি তাও পরীক্ষা করেছে। তারপর জমা স্লিপের সঙ্গে হিসাবের ফারাক জানতে আজমলের দিকে তাকিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করছে, এক হাজার টাকা বেশি দিছেন মনে হয়?
বেশি দিছি নাকি! লেনদেনের হিসাবে আমার তো ভুল হয় নাই কোনোদিন। ভালো কইরা গুইনা দেখেন।

মেয়েটি আবার গুণে এক হাজার টাকা তাকে ফেরত দিয়েছিলো।
এইটুকু ভুল-সংশোধনের সম্পর্ক থেকে মেয়েটার জন্য আবার ভুল করে ভালোবাসা জন্ম নেবে, এতটা রোমান্টিক প্রেমিক নয় আজমল। নিজেকে সে পুরোপুরি ভদ্রলোক শ্রেণীর মানুষ ভাবেও না। গরিব কাঠমিস্ত্রীর পোলা, নিজেও বাপের হাতুড়ি-করাত-র্যাঁদা হতে জীবিকা শুরু করেছিলো। পৈতৃক পেশার উত্তরণ ঘটিয়ে ক্রমে স’মিলের ম্যানেজার, তারপর নিরস কাঠ-ব্যবসায়ী, অবশেষে এখন পান্থপথে নিজের দোকান ‘ইভা ফার্নিচার’।   মেয়েমানুষে বাড়াবাড়ি দুর্বলতা থাকলে কি গরিবি অবস্থা থেকে আজকের অবস্থায় আসতে পারতো? ভদ্রলোক শ্রেণীর কাস্টমার, বিশেষ করে মহিলারা কয়টা টাকা জেতার জন্য কিরকম ন্যাকাবোকা আপত্তি-আবদার করে, জানে সে। ক্যাশিয়ার মেয়েটি অবলীলায় এক হাজার টাকা ফিরিয়ে দেয়ায় আজমল তাই অবাক হয়েছিলো। ইচ্ছে করলে টাকাটা সরিয়ে রেখে জমাস্লিপ সাইন করে দিতে পারতো। সেদিন বাজারে মাছঅলা ভুলে আজমলকে ৫০ টাকার একটা নোট বেশি দিয়েছিলো। টের পেয়েও না গোনার ভান করেই টাকাটা রেখে দিয়েছে সে। অপরাধবোধ তো জাগেইনি, বরং মাছঅলার কাছে বহুবার ঠকার একটুখানি অসুল হয়েছে ভেবে খুশিই হয়েছিলো আজমল।

নিজের দোকানে অল্পবয়সী মহিলা কাস্টমার এলে তাকেও সাধারণত আপা সম্বোধন করে আজমল। কিন্তু ব্যাংকের চেনা এক অফিসার মহিলাকে যেমন, তেমনি নিজের তুলনায় কমবয়সী ক্যাশিয়ার মেয়েটাকেও সে ম্যাডাম বলে সম্মান দেখায়।
ভুল যখন হইছেই ম্যাডাম, টাকাটা রাইখা দেন আপনে, মিষ্টি খাইয়েন।
না, তা কেন! মিস্টি খাওয়ার জন্য তো এখানে বসিনি।

মেয়েটার সততার অহঙ্কার, প্রকাশ্যে টাকা নিতে তার আপত্তি কিংবা শরম দেখে আজমল যাকে বলে বলে যুগপৎ মুগ্ধ ও বিস্মিত। টাকা দিলে কেউ ফিরিয়ে দেয়, এমন অভিজ্ঞতা তার হয়নি। মিষ্টি খাওয়ানো নির্দোষ দানের পেছনে কোনো তিতা মতলব ছিলো কি? তীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসা ঝিলিক দিয়েছিলো মেয়েটির চোখে। একইরকম কৌতূহল ফুটেছিলো পাশের ক্যাশ কাউন্টারের সহকর্মী ও পেছনে দাঁড়ানো অচেনা এক কাস্টমারের চোখেও। আজমল কোনো মতলব নেই বোঝাতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হেসেছিলো। আর ঠিক তখন কামিজ-ওড়নার আড়াল ঠেলে জেগে ওঠা তার বুকের গড়ন দেখে আজমলের ভিতরে উথালপাতাল ভালোলাগা চোখের মধ্যে কতোটা ছলকে উঠেছিলো কে জানে, তার বদ মতলব আন্দাজ করেই হয়তো চোখ সরিয়ে নিয়েছিলো মেয়েটি।

ঘরে সুখশান্তির আকাল বলেই হয়তো-বা গতরাতেও একটি পুরনো ইচ্ছেপূরণের কথা ভেবেছিলো আজমল। বিদঘুটে বৈধ স্ত্রীর সঙ্গে শোয়ার বদলে হাজার টাকা খরচ করে কোনো নষ্ট মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক অনেক বেশি সুখের হবে। এ লাইনে অভিজ্ঞ আজমলের এক পুরনো দোস্ত প্রেরণাও দেয় প্রায়ই। টাকা ছড়াইলে অভাব নাই মালের, যেমন চাস তেমনই পাবি। অতএব এই চিন্তা থেকেই কি চোখে ধরা ক্যাশিয়ার মেয়েটিকে সে অনিচ্ছাকৃত ভুলে এক হাজার টাকা বেশি দিয়েছিলো?  গোপন ফিকির ছিলো বলেই কি বোকার মতো ঘুষ দিতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে? না। যতোই ভালো লাগুক মেয়েটাকে, সেদিনের ভুলের পেছনে অন্তত শিকারি মতলব খুঁজে পায় না আজমল। তবে ভুল বা ভালোলাগার কারণ খুঁজতে গেলেও ঘুরে ফিরে ক্যাশ আগলানো মেয়েটার কথা মনে পড়ে।

পান্থপথের গলিতে ইভা ফার্নিচারের দোকানে বসলেও কাস্টমারদের মাঝে ভদ্র ফ্যামিলির নানা বয়সী মেয়েমানুষ দেখা হয়। তাদেরকে আপা বা ম্যাডাম সম্বোধন করে খাতির জমানো মেলা কথাও বলে। গাড়িঅলা কাস্টমাররা অবশ্য বড় রাস্তার পাশের ব্র্যান্ড দোকানগুলিতে যায় বেশি। কিন্তু নির্ভেজাল সার কাঠের ফার্নিচার ব্যবসায়ী হিসেবে আজমলের কিছু সুনাম আছে। অবশ্য সন্দেহকারী অবিশ্বাসীরাই দলে ভারী। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাপ্লাইয়ের কাজ পেলে দুই নম্বরি করাটা সেখানে ফরজ হয়ে দাঁড়ায়।

নইলে ব্যবসা হয় না। বিভিন্ন অফিসের টেন্ডার-সাপ্লাইয়ারে কাজ ধরার ধান্ধায় থাকে বলে আজমল এখন দোকানে বসার সময় পায় কম। বাইরে বেরুলেও অবশ্য পথেঘাটে, চেনা-অচেনা অফিসে আকর্ষণীয় মেয়েমানুষ বিস্তর চোখে পড়ে। দৃষ্টির আড়াল হলেই বিস্মরণের অন্ধকারে হারিয়ে যায় সবাই। কিন্তু ব্যাংকের ক্যাশিয়ার মেয়েটিকে যখন তখন হঠাৎ মনে পড়ে কেন? মনে পড়লে মন কেমন কেমন করেও।

ভুল করে এবং পরে ইচ্ছে করে মেয়েটাকে এক হাজার টাকা দিতে চাওয়ার পেছনে আজমলের যে কোনো বদ মতলব ছিলো না, সেটা বোঝাতে পরের সপ্তাহে টাকা জমা দিতে গিয়ে ভুলের প্রসঙ্গটি তোলে আবার।

আপা, সেইদিন গোনার ভুলে পকেটের টাকা ভইরা খেসারত দেন নাই তো? মেয়েটি চকিতে চোখ তুলে তাকালেও কোনো জবাব দেয় না। মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজ করে। ম্যাডামের বদলে আজমলের খাতির জমানো আপা ডাক শুনে, নাকি মেয়েদের পকেট না থাকা সত্ত্বেও ভুলে ‘পকেটের টাকা’ বলে আবার ভুল করায়? জমা বই ফেরত দিয়ে মেয়েটি কঠিন উপেক্ষা দেখাতেই যেনবা কম্পিউটারে আবার মনোযোগী হয়।

এর পরের সপ্তাহে ব্যাংকে টাকা তুলতে গেলে মেয়েটার কাউন্টারে ভিড় দেখেও লাইনে দাঁড়িয়েছিলো আজমল। কিন্তু তার প্রতি চোখ পড়তেই বিরক্ত হয়ে পরামর্শ দেয় সে, এই যে, আপনি ঐ কাউন্টারে দাঁড়ান।

এরকম উপেক্ষা তো অপমানেরই নামান্তর। তবু গায়ে মাখে না আজমল। পাশের পুরুষ ক্যাশিয়ারের কাউন্টারে দাঁড়ালেও আজমলের মনোযোগ যে মেয়েটার দিকে আঠার মতো লেগে থাকে, তা কি বুঝতে পারে না সে? পেছনের অফিসারটি মেয়েটাকে রেহানা বলে ডাক দেয়ায় আজমল তার নামটি জানতে পারায় মূল্যবান কিছু কুড়িয়ে পাওয়ায় মতো খুশি হয়। কিন্তু অফিসারটির দিকে ঘাড় ফেরানোর সময় রেহানার চোখে আজমলের প্রতি বিরক্তি ঝরে কেন?
কাস্টমারদের হাসিমুখে সেবা দেয়াই তার দায়িত্ব। হতে পারে রেহানার চোখে কাস্টমার হিসেবে আজমল এবং তার একাউন্টের ব্যালেন্স তেমন আকর্ষণীয় নয়। ব্যাংকের এই শাখায় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের লাখ লাখ টাকা নগদে গ্রহণ বা বিতরণ করে সে। ব্রিফকেস ভরা টাকার বান্ডিল নিয়ে সরাসরি ক্যাশ কাউন্টারের ভিতরেও ঢোকে কেউ কেউ। এমন দৃশ্য আজমল নিজের চোখেও দেখেছে।

কিন্তু তাই বলে ইভা ফার্নিচারের মালিক কি এতাই তুচ্ছ? ক্যাশিয়ারের চাকরি করে রেহানা যা বেতন পায়, তার চেয়ে বেশি টাকা আজমল দোকান ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন দেয়। আল্লাহর রহমতে ব্যবসার গতি যদি উন্নতির দিকে আরো বেগবান হয়, তবে দু’চার বছরের মধ্যে এই মেয়েটার মতো কম্পিউটারঅলা ক্যাশিয়ার নিজ দোকানেও বসাতে পারবে। আপা-ম্যাডাম নয়, নাম ধরেই ডেকে কামের হুকুম দেবে কড়া গলায়।

দোকানে বসে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য ক্যাশবাক্সের কথা ভাবলে ক্যাশিয়ার মেয়েটার কথা যখন মনে পড়ে, ব্যাপারটাকে ব্যবসায়িক স্বার্থ হিসেবেই দেখে সে। আজমলের সঞ্চয়ের গোপন খবর ঘরের বউ পর্যন্ত জানে না, অথচ মেয়েটা কম্পিউটার টিপলে সবই দেখতে পায়। কোন মাসে কেমন আয় হলো, ব্যয়ের পরও মাসে কতো জমল, মেয়েটা মনে হয় সে হিসাব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেও। আজমলের মূলধনের আসল খবর একমাত্র রেহানা সঠিক জানে বলেই কি তাকে মনের আরো সব একান্ত কথা জানাতে ইচ্ছে করে? কিন্তু ব্যাংকে কাজের সময় বাড়তি কথা শোনার বা বলার উপায় নেই মেয়েটার।  

একদিন দুপুরের দিকে টাকা জমা দিতে গেলে কাউন্টার ফাঁকা পায় আজমল। ঐ সময়ে পাশের পুরুষ ক্যাশিয়ারটিও অনুপস্থিত। সুযোগটির সদ্ব্যবহার করতে টাকা এগিয়ে দেয়ার আগে লম্বা সালাম দিয়ে আজমল বলে, ম্যাডাম, ভালো আছেন তো?
আজমলের হাসিধোয়া মুখ দেখেও রেহানা হাসে না, মাথাটা সামান্য ঝাঁকায় মাত্র। টাকা নিয়ে জানতে চায়, আজো বেশি বা কম দেন নাই তো?
বেশি-কম যাই দেই, আপনি তো আমর মুখের কথা বিশ্বাস করবেন না, গুইনাই নেবেন।
রেহানা হিসাবের কাজে পুরো মাথা খাটায়। আর আজমল মুগ্ধ হয়ে দেখে। মুখে যাই বলুক, মেয়েটা ভুলের কাস্টমারকে মনে রেখেছে এখনো। সেইরকম ভুল মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতও আছে। শ্যামলা গড়ন রেহানার দাঁত বড় ঝকঝকে, চোখ দুটি ধারালো। এই ধরনের সংযত মেয়েকে হিসেবের কাজেই মানায়।

সিল-স্বাক্ষর দিয়ে জমা বই ফেরত দেয়ার পরও কাউন্টার ফাঁকা। আজমল পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে এগিয়ে দেয়, ম্যাডাম, কাছেই আমার ফার্নিচার দোকান। যদি কখনো দরকার মনে করেন, আসলে খুশি হবো।

দোকানের নাম-ঠিকানা লেখা কার্ড তো আসলে ব্যবসার বিজ্ঞাপন বিশেষ। নতুন লোকজনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হলেই আজমল কার্ড দিয়ে দোকানে আমন্ত্রণ জানায়। ১০০টি কার্ড বিলিয়ে যদি ২/১জন কাস্টমার বাড়ে, সেটাই লাভ। আজমল এই ব্যাংকের অনেক অফিসারকেও কার্ড দিয়েছে। একজন গিয়েছিলো, মেয়ের বিয়েতে দেওয়ার জন্য একটা খাটও কিনেছিলো।

কিন্তু ক্যাশিয়ার রেহানা আজমলের মৌখিক ও কার্ডের আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করে সাফ সাফ জানিয়ে দেয়, আমার দরকার হবে না। কারণ ফার্নিচার রাখার মতো বাসা  নেই। কেনার মতো অবস্থাও নেই।
এখন নাই, কিন্তু ভবিষ্যতে নিশ্চয় হবে ম্যাডাম।

ইভা কে, আপনার মেয়ের নাম?
শ্বশুরের দেয়া পুঁজির বরকতে স্ত্রীর নামে ফার্নিচার ব্যবসা শুরু করেছিলো বলে কাঠমিস্ত্রীর পোলা বড় ব্যবসায়ী হইছে। ইভা স্বামীকে খোঁচা দিতে এবং গর্ব দেখাতেও এমন দাবি প্রায়ই করে। স্ত্রীর এই দাবিকে অগ্রাহ্য করে আজমল ভাবে, ওরকম বেহিসেবি বউ থাকার কারণেই বোধ হয় ব্যবসায় শনির আছর লাগে প্রায়ই, ঘরেও সুখশান্তির আকাল। এমন অলক্ষ্মী বউকে ভালোলাগা মেয়েটার সামনে এনে সকল সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করবে, এতোটা আহম্মক নয় সে। রেহানাকে জবাব দিয়েছে,  আমার মাইয়া নাই, ইভা কেউ না, হুদা একটা নাম।

স্ত্রীকে গোপন রেখে মুখচেনা রেহানার সঙ্গে মিনিট খানেকের ব্যক্তিগত আলাপেও মনটা যেন ভ্রমরের মতো গুঞ্জন করতে থাকে। ভাগ্য বলে পাওয়া স্ত্রী ইভার সঙ্গে সারা রাত গল্প করলেও কি দেহমনে এমন উৎফুল্ল ভাব আসতো! বরং উল্টোটা ঘটতো সন্দেহ নাই।

সকালে বাসা থেকে বেরুনোর পর রাতে না ফেরা পর্যন্ত সারাটা দিন তো ব্যবসায়ের ধান্ধায় ব্যস্ত থাকে আজমল। সারাদিনের কর্মকাণ্ডে স্ত্রীর নামটি উপস্থিত থাকে বটে, নামধারীকে মনে পড়ে না ভুলেও। মোবাইলে বাসা থেকে কল আসলেও আওয়াজটা বিরক্তিকর লাগে। খারাপ খবরের আশঙ্কায় বিরক্তি নিয়ে জানতে চায় কী হইছে? অথচ কাণ্ড দেখে, ব্যাংকের রেহানা ফোন ছাড়াই চাপা হাসি নিয়ে বা হাসি ছাড়াই যখন তখন স্মৃতির পর্দায় জ্বলজ্বল করে। স্মৃতিতে কি কল্পনায় যেমন, বাস্তবে কি মেয়েটা সেরকম নয়? মিলিয়ে দেখতেও ঘন ঘন ব্যাংকে যায় আজমল। টাকা জমানোর নেশা আর রেহানাকে ভালোলাগার টান একাকার হয় যেন। আরো আশ্চর্য যে, ব্যবসায় উন্নতির স্বপ্ন-পরিকল্পনার মধ্যে রেহানা হাজির হয় হঠাৎ। দোকানে হিসাবের গড়বড় দেখলেই ম্যানেজারকে ধমক দিয়ে বলে সে, দোকানেও কম্পিউটার বসিয়ে ব্যাংকের ক্যাশিয়ারের মতো শিক্ষিত মেয়েকে চাকরি দেবে।

কাজের অছিলায় ঘন ঘন ব্যাংকে যায়, কিন্তু ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সুযোগ তেমন আসে না। রেহানা চোখ তুলে তাকায় বটে, কিন্তু ব্যক্তিগত অনুরাগ-বিরাগের চেয়ে তার টাকা সামলানোর চাকরি যে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটাই বুঝিয়ে দিতে চায় যেন। টাকা আজমলের কাছেও তুচ্ছ নয়। কিন্তু সাময়িক হলেও, ব্যবসায়ের লাভক্ষতিকে তুচ্ছ করে মেয়েটার প্রতি ভালোলাগা এতটা প্রবল হয়ে উঠতে চায় যে, অন্তরের ভালোলাগা কোনো জাল-ছাকনি ছাড়াই মুগ্ধতাবোধ আজমলের চোখেও জ্বলজ্বল করে। রেহানা কি দেখতে পায় না? মেয়েটা পাত্তা দেয় না বলেই বোধহয় তাকে দেখে নেয়ার ইচ্ছেটিও ক্রমে জোরালো হয়ে ওঠে। এক রাতে স্ত্রীর পুরনো শরীরের সবটাই দখলে থাকার পরও তার জায়গায় রেহানাকে প্রায় পষ্ট দেখে ফেলে এবং রেহানার ঠোঁটের কালো তিলটাতে চুম্বনের তৃষ্ণা অনেক রাত জাগিয়ে রাখলে, আজমলের সন্দেহ থাকে না যে রেহানের জালে সে আটকে পড়েছে। এই জাল থেকে বেরুনোর জন্য নিজের উপর রাগও হয়।

রেহানার জাল থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য একদিন অভিজ্ঞ ও পুরনো বন্ধুকে তার গল্প শুনিয়ে পরামর্শ চায় আজমল, কী করি কও তো! আমি না হয় ভুল কইরা এক হাজার টাকা দিছিলাম। তাই বইলা এমন অপমান করবো, দোকানে ডাকলাম একদিন, মুখের উপরেই কইয়া দিলো, জীবনেও আইবো না।

অভিজ্ঞ বন্ধু হেসে জবাব দেয়, বুঝছি,মনে ধরছে তোর। ওইটারে না লাগা পর্যন্ত শান্তি পাইবি না। তয় এক হাজারে কাম হইবো না দোস্ত। এক কাম কর, ভুল কইরা মাগীরে আর একদিন পাঁচ হাজার দে, ঠিক নিবো। আর দোকানে না, ছুটির দিনে কোনো চাইনিজে দাওয়াত দে একদিন, তারপর দোকানে ডবল বেতনের চাকরির লোভ দেখা। চাকরিজীবী মাইয়ারা প্রোমোশন-ইনক্রিমেন্টের টোপ না দিলে ধরা দেয় না রে বেআক্কেল!

বন্ধুর পরামর্শ কোনোটাই পছন্দ হয় না আজমলের। তবে নিজেকে রক্ষার জন্য কিংবা শান্তি লাভের পথে অভিযানে নামাটা জরুরি হয়ে ওঠে নিজের কাছেও। সুযোগটা আসে একদিন সহসাই। ব্যাংকে রেহানাকে তার আসনে অনুপস্থিত দেখে আজমল তার পাশের সহকর্মীর কাছে জানতে চায়, রেহানা ম্যাডাম কই?

ছুটিতে আছে শুনে সাহসটা সরাসরি রেহানাকে দেখানোর আগে তার সহকর্মীদের কাছে দেখায় আজমল, রেহানা ম্যাডামের লগে পারিবারিক বিষয়ে একটা জরুরি কথা আছিলো। ওনার ফোন নাম্বারটা আছে আপনাদের কাছে?

ক্যাশিয়ার ছেলেটি রেহানার পাশে বসলেও নারী-পুরুষের অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে মনে হয় তেমন আগ্রহী নয়। রেহানার ডেস্ক থেকে একটি কার্ড কুড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে দেয়, তাতে  রেহানার অফিসিয়াল পরিচয় ছাড়াও ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারটাও লেখা আছে।

দোকানে ফিরেই কোনোরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব জাগার আগেই রেহানাকে ফোন করে আজমল। ব্যাংকের কাস্টমার হিসেবে নিজের পরিচয় বিস্তারিত দেয়ার পরও হাজার টাকার ভুলের প্রসঙ্গটি তোলার পর রেহানা চিনতে পারে আজমলকে। ফোন করার কারণ জানতে চায়।
ম্যাডাম, কারণটা তো ফোনে বলতে পারবো না। তবে ব্যাপারটা একটু ব্যক্তিগত মানে আমার ব্যবসা সংক্রান্ত। আপনার মতো একজন সৎ অফিসারের পরামর্শ আমার আর্জেন্ট দরকার। ব্যাংকে আপনার এতো ব্যস্ততার মধ্যে কথাবার্তা বলা তো ইম্পসিবল। সামনাসামনি বুঝিয়ে বলতেও একটু সময় লাগবে। দয়া কইরা যদি একদিন ছুটির দিনে আমার দোকানে আসেন, না হয়তো যদি সময় দেন কোনো চাইনিজ হোটেলেও বসতে পারি।

রেহানা তাৎক্ষণিক আপত্তি জানিয়ে বলে, বাইরে যাওয়ার সময় হবে না আমার। তার চেয়ে খুব দরকার মনে করলে আমার বাসাতেই আসুন একদিন। ফোন করে আসবেন।
আজমল তাৎক্ষণিক সম্মতি দিলে রেহানা ফোনে তার বাসার ঠিকানা ও লোকেশনও বুঝিয়ে দেয়।

কঠিন মেয়েটির এমন সহজ সম্মতি এবং বাসায় সাদর আমন্ত্রণ পেয়ে বিহ্বল বোধ করে আজমল। মনে হয়, মালিকের বিশাল জয়ের আনন্দে দোকানের পলিশ ফার্নিচারগুলিও আজ বড় বেশি ঝিকমিক করে। কর্মচারীকে পাশের হোটেল থেকে সবার জন্য ডালপুরি ও চা আনার আদেশ দিয়ে মোবাইলে রেহানার নাম ও নম্বর সেভ করে। সিদ্ধান্ত নেয়, আগামী শুক্রবার অবশ্যই তার সঙ্গে দেখা হবে, একান্তে অনেক কথাও হবে। তারপর যা ঘটতে পারে, সেইসব সম্ভাবনা নিয়ে আকাশকুসুম ভাবতেও ভালো লাগে তার।

অফিস ছুটির দিনে রেহানার দেয়া ঠিকানা পকেটে নিয়ে রওয়ানা দেয়ার আগে অবশ্য ফোন করে আজমল রেহেনার আমন্ত্রণ আদায় করে নেয়। পরপুরুষকে বাসায় আহ্বান করায় আজমল শতভাগ নিশ্চিত মেয়েটা এখনো বিয়ে করেনি। কিন্তু রেহানা বাসায় একা থাকে, বাবা-মাও সঙ্গে আছে, নাকি আত্মীয় বাসা? কিছুই জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে একা থাকুক অথবা সপরিবার, পরবর্তী সাক্ষাৎ যাতে আরো একান্তে হয়, তার ব্যবস্থা পাকা করবে আজমল। ফলে যে হাজার টাকা ফিরিয়ে দিয়েছিলো মেয়েটি, তার চেয়েও দুশ’ টাকা বেশি মিষ্টি ও ফল কিনতেই ব্যয় করে।

চাইনিজ রেস্তোরাঁ বা দোকানের আমন্ত্রণ উপক্ষো করে রেহানা বাসায় ডাকায়, বাসার পরিবেশ আরো নিরিবিলি ও নিরাপদ হবে ভেবেছিলো। ফার্নিচার রাখার জায়গা নেই শুনেও তাকে অবিবাহিতা এবং নিজস্ব সংসার ছাড়া একা একটি মেয়ে ভেবেছিলো। কিন্তু বাড়িটি দেখে হতাশ হয় সে। আজমলের ভাড়াবাড়ির চেয়েও নিম্নমানের কম ভাড়ার বাসা। বারান্দায় গুচ্ছের কাপড় শুকাতে দেয়া হয়েছে, সেখানে রেহানার একটা ব্রেসিয়ার পর্যন্ত চোখে পড়ে না। দরজায় নক করতেই দরজা খুলে দেয় অচেনা এক যুবক। হাতে মিষ্টি ও ফলের প্যাকেটকে পাত্তা না দিয়ে, কিংবা এগুলিকে বিপজ্জনক কিছু ভেবেই যেন সে আজমলের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরিচয় জানতে চায়। রেহানার ব্যাংকের ক্লায়েন্ট ও রেহানার সঙ্গে ফোনে এ্যাপোয়েন্টমেন্ট করে এসেছে শুনেও তার ভাবান্তর হয় না। একটু দাঁড়ান— বলে ভিতরে অদৃশ্য হয় আবার। রেহেনা আসে হাসিমুখে, ওহ, আপনি এসেছেন! আসুন।

কারো বাড়িতে গেলে ফার্নিচার খুঁটিয়ে দেখাটা অভ্যাস। ফার্নিচার দেখেও গৃহকর্তার আর্থিক অবস্থা ও রুচি সহজেই আঁচ করতে পারে আজমল। রেহানার বসবার ঘরের অবস্থা বাড়ির বাহ্যিক চেহারার মতো করুণ। চারটি মামুলি চেয়ারের পাশে ঘরে একটি কড়ই কাঠের পুরনো খাট। তাতে শুয়ে আছে একজন অসুস্থ বৃদ্ধ মানুষ। আগন্তুকের দিকে লোকটার কৌতূহলী চোখ দেখে আজমল সালাম দেয়, আর মেয়েটি পরিচয় করিয়ে দেয়, বাবা, আমার ব্যাংকের লোক।

ওহ, আমাকে দেখতে এসেছে! কী দেখবেন, আজ ৩৭দিন ধরে শয্যাশায়ী। ডাক্তার বলেছে জরুরি অপারেশন করাতে, কিন্তু আজ পর্যন্ত ওরা টাকা পয়সা যোগাড় করতে পারলো না।  

লোকটার যন্ত্রণা-বিকৃত মুখ দেখে সহজে বোঝা যায়, কী পরিমাণ শরীরী কষ্ট শরীরের মধ্যে চেপে রাখার চেষ্টা করছে সে। এরকম অবস্থায় ডাক্তার না হয়েও রোগীর অবস্থা জানতে চাওয়াটাই রীতি, আজমলও রেহানার কাছে জানতে চায়, কী হইছে ওনার? মেরুদণ্ডের হাড়ে সমস্যা। ফিজিওথ্যারাপি অনেক হলো, শেষ পর্যন্ত অপারেশনই করাতে হবে। বাবা, তুমি না হয় আর একটু অষুধ খেয়ে ঘুমাও।
অষুধ বা ঘুমে আপত্তি বোঝাতে লোকটা মুখ ফিরিয়ে শোয়। আজমলের মুখোমুখি বসে রেহানা মিষ্টিটিস্টির প্যাকেট দেখে বিরক্ত না বিস্মিত বোঝা য়ায় না। জানতে চায়, এগুলি এনেছেন কেন?

রেহানাকে নিভৃত বাসায় একা পাওয়ার কামনা গোপন করে জোর গলায় বলে আজমল, বাসায় একা থাকলে এগুলি আনতাম না, আসতামও না। এগুলা ভিতরে নিয়া যান।

আপনার সমস্যার কথা শুনি আগে। লোনটোন নেওয়ার ব্যাপার হলে তো আমি তেমন হেল্প করতে পারবো না, ম্যানেজার বা সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
না, সেরকম সমস্যা না।

রেহানার চোখে তীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসা দেখে আজমলের ভিতরের সাহস যখন টলমল, বিছানার অসুস্থ বৃদ্ধই আবার তাকে রক্ষা করে। তীব্র ব্যথা হজমের চেষ্টায় মুখ ফিরিয়ে বলে, জামাই কি উত্তরা গেছে? আমাকে না হয় গ্রামের বাড়িতেই রেখে আয় রেহানা, আবারো কবিরাজি চিকিৎসা করায় দেখি।

অসুস্থ পিতার কথা আমল না দিয়ে রেহানা জানতে চায়, বলুন আপনার আর্জেন্ট কথা আগে শুনি।

না, মানে দেখেন, আমি তো ব্যবসার কামে মেলা অফিসে ঘুরি। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না, পারলে পকেটের পয়সা কাইড়া নিতে চায় সবাই। আর আপনি ম্যাডাম  আমারে সেইদিন এক হাজার টাকা ফেরৎ দিলেন! ঘটনাটা আমি ভুলতে পারি না।
রেহানা সত্যি কথা শুনে এবার একটু সহজ হয় যেন, একটু হাসেও। ঠিক আছে, এবার বেশি দিয়েন, ফেরত দেবো না।

জামাই কি গেছে রেহানা?

ওনার যে অবস্থা দেখি, তাতে ওনাকে হাসপাতালে ভর্তি করালেই তো মনে হয় ভালো হইতো ম্যাডাম। অপারেশনে অনেক টাকা লাগবে, যোগাড়ের চেষ্টা করছি।
আপনি ব্যাংকে চাকরি করেন, লোনফোন নেয়ার মেলা সুবিধা।
ব্যাংকে লোন নিলে তো শোধ দেওয়ার মতো এ্যাবিলিটি থাকতে হয়, আমরা তো আপনাদের মতো বড় ব্যবসায়ী নই।

রেহানার কম্পিউটারে কতো বড় বড় ব্যবসায়ীর বিশাল অংকের একাউন্ট! বিনা লাভে তারা কেউ রেহানার এই বিপদে একটি টাকাও ধার দেবে না, কিন্তু বিপদে রেহানার পাশে দাঁড়ানোর সদিচ্ছা জাগে কেন হঠাৎ আজমলের ভিতরে?

বিপদ-আপদে মানুষ তো আত্মীয়-স্বজনদের কাছেও হাত পাতে। মানে, যেমনেই হউক আপনার বাবার সুচিকিৎসাই তো এখন জরুরি মনে হইতাছে।
আত্মীয়স্বজনরা টাকা দেবে কেন বলেন। ব্যাংকে রাখলেও সুদ পাবে, কিন্তু আমরা হয়তো আসলটাও শোধ করতে পারবো না, ভাবে সবাই।
আত্মীয়রা না দিক, কতো বড় লোক ব্যবসায়ী আপনার কাস্টমার, তাদের কারো কাছে চাইলেও তারা না করবো না।

রেহানা আবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে আজমলকে, সরাসরি জানতে চায়, আপনি দেবেন?
নিশ্চয়ই, দিতে পারলে খুশি হবো।
এ সময় ঘরে আসে দরজায় দেখা যুবকটি। প্যান্ট-সার্ট পরে বাইরে যাচ্ছে, রেহানা যুবকের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে, আমাদের ব্যাংকের এজন বড় ব্যবসায়ী ক্লায়েন্ট। আর এ আমার হাজব্যান্ড।
যুবকটি এবার হাসিমুখে হ্যান্ডশ্যাক করে আজমলের সঙ্গে। স্ত্রীকে আদেশ দেয়, ওনাকে চাটা দিতে বলো। আমি উত্তরা থেকে ঘুরে আসি।

স্বামী বেরিয়ে যাওয়ার পর মিষ্টির প্যাকেটগুলি নিয়ে ভিতরে যায় রেহানা। অসুস্থ লোকটা আবার যন্ত্রণাকাতর চোখমুখ আজমলের দিকে একাগ্র করে। তাকে সান্ত্বনা-সহানুভূতি দেখানোর ভয়েই যেন আজমল অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। টাকা দিতে চাওয়ার আকস্মিক মহত্বটা ভুল হলো কি না ভাবে। ভিতরের ঘর থেকে ভেসে আসা শিশুর কান্না শুনে চমকে ওঠে। স্বামী, তার ওপর বাচ্চাও আছে রেহানার? আশ্চর্য, দেখে একবারও মনে হয়নি। এরকম সমস্যাবিদির্ণ যার সংসারের চেহারা, সেই মেয়ে সেজেগুজে ঠোঁটে গোলাপি রঙ মেখে অফিসে যায় কিভাবে? অফিসেও কি কারো সঙ্গে নিকট সম্পর্ক আছে মেয়ের? থাক বা না থাক, রেহানার জন্য মনে উথালপাতাল ঢেউ জাগিয়ে কী লাভ হবে আজমলের? হিসাব মেলাতে না পেরে হতাশ বোধ করে সে।
একজন বয়স্কা মহিলা, সম্ভবত কাজের মেয়ে আজমলকে চা দিয়ে যায়। সঙ্গে তারই আনা মিষ্টি, পিরিচে বিস্কুট ও চানাচুর। আজমল শুধু চা নেয়।

রেহানা তার মেহমানের কাছে ফিরে আসে আবার। মুখোমুখি বসে, কথাও বলে হাসিমুখে।
আপনি কেন যে এসেছেন, মানে আপনার জরুরি কথাট কী, এখনও বলেননি কিন্তু।
কেন যে এসেছি, সেইটা নিজেও ভুইলা গেছি। দেখি মনে পড়লে আবার বলবো, আজ চলি।
বিদায় দেয়ার সময় ক্যাশিয়ার রেহানা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। আজমল হাঁটা শুরু করলে রেহানা পিছু থেকে ডাকে, এই যে শুনুন।

আজমল ফিরে তাকালে তাকে রহস্যময় হাসি উপহার দিয়ে বলে, মনে পড়লে আবার আসবেন কিন্তু।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।