আকাশ, পৃথিবী, ঐশ্বরিকতা, এবং নশ্বরতা, এই চতুষ্টয়কে নিয়ে যে ঐক্য, তাকেই জার্মান দার্শনিক হাইডেগার কবি হ্যোল্ডারলিনের কবিতার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন এবং কবিতা হয়ে ওঠার জন্য এক অনন্য শর্ত হিসেবে জেনেছেন ; এবং তিনি তাঁর দার্শনিক চিন্তার পূর্ণতর পরিণতি দেখেছেন রোমান্টিক কবি হ্যোল্ডারলিনের (খ্রিষ্টাব্দ ১৭৭০-১৮৪৩) মধ্যে, যে কবির অন্তিম বত্রিশ বছর কেটেছে উন্মাদ আশ্রমে । উন্মাদদশাই, বোধকরি, রোমান্টিকদের জন্য এক যৌক্তিক পরিণতি ; ইতিহাসের সাক্ষ্যও তো তাই ।
বিত্তশালী এক বনিকের সুন্দরী স্ত্রী সুসেৎ গনটার্ড, যাকে তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মে জেনেছেন দিওতিমা নামে, যার সাথে তাঁর ব্যর্থ প্রেম, নিজ জীবনে বন্ধুত্বহীনতা, প্রায় জীবিকাহীন জীবনযাপন, জীবন নিয়ে গভীর দার্শনিক উপলদ্ধি, ইত্যাদি তাঁকে নিয়ে গেছে উদ্ভ্রান্তিতে, পরিশেষে উন্মাদগ্রস্থতায় । হ্যোল্ডারলিনের সমসাময়িক কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিকঃ শেলিং, ফিক্টে, জ্যাপল, লুদ্ভিগ, হফম্যান, বেটিনা, রিটার, নোভালিস প্রমুখের কাজের মধ্যে নষ্টালজিয়া এবং বিক্ষুদ্ধ রাত তাড়া করে ফিরেছে ; এবং যেই রাতের পথ চলে গেছে বিস্মৃতি, রহস্যময় স্বপ্ন, এবং উন্মাদনার দিকে । তবু এই রাত উন্মুখ হয়ে আছে ভোর এবং সূর্যের প্রত্যাশায় । সূর্যের তীব্র আলো এবং প্রখর বাতাস যেমন তাঁর শেষ জীবনের কবিতার জন্য সত্য, তেমনি তা সকল বিষাদ এবং হতাশাকে অতিক্রম করেই অনাগত ভবিষ্যতের দিকে হয়ে আছে উন্মুখ ।
আকাশ, জানালা, পাহাড়, উপত্যকা, প্রান্তর, জলাশয়, এইসব তাদের অনন্যতায় বিশিষ্ট হয়েই জীবনের অন্য অস্তিত্বের সাথে যে ঐক্য অনুভব করে, তাই প্রকাশিত হয়েছে হ্যোল্ডারলিনের কবিতায় । চার ঋতু নিয়ে হ্যোল্ডারলিনের কবিতায় মানুষ প্রকৃতির ভিতরে তাঁর অনন্যতা নিয়েই অন্য সত্তার সাথে ঐক্য অনুভব করে । অনূদিত এবং এখানে সন্নিবেশিত এই চারটি কবিতায়--হেমন্ত, শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম-- অনাগত ভবিষ্যতের সেই সত্যই প্রতীয়মান হয়েছে ।
হেমন্ত
চৈতন্যের পৌরাণিকগাথা এখন ছেড়ে যায় পৃথিবী
একদিন চেতনার অধিষ্ঠান ছিল, আবার হবে তার প্রত্যাবর্তন
এইসব গল্পগাথার অভিমুখ নিহিত আছে মানবতার দিকে ; সময়কে
আমরা জেনেছি অনেক, যার দ্রুত অপসৃয়মানতা আছে ।
অতীতের দৃশ্যপট যায় না ছেড়ে প্রকৃতি
এবং যখন গ্রীষ্মের উচ্চকিত দিন লুপ্ত হতে থাকে
পৃথিবীতে তখন হেমন্ত নেমে আসে
এবং দূর আকাশে দ্রষ্টার চৈতন্য আকাশে পুনরায় অঙ্কিত হয়ে উঠে ।
এই অল্প সময়ে অনেক কিছুর হয়েছে পরিবর্তন
যে কৃষক লাঙ্গল হাতে গিয়েছে মাঠে
সে দেখে নেয় প্রতি বছর কীভাবে আনন্দে নিমজ্জিত হতে থাকে
এইসব দৃশ্যপটে একজন মানুষের দিন পূর্ণ হয়ে আসে ।
পাথরে সজ্জিত গোলাকার এই পৃথিবী
নয় সেই মেঘের মতো, সন্ধ্যায় যা দ্রবীভূত হতে থাকে
যা কোনো এক সোনালী দিনে আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়ে উঠে
এবং দেখি পূর্ণতার নেই কোনো অভিযোগ ।
শীত
যখন মলিন বরফ সাজিয়ে দেয় গ্রামীণ জনপদ
এবং তার বিস্তৃত প্রান্তর প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে উজ্জ্বল আলোয়,
তখন অতিদূর থেকে গ্রীষ্ম আমাদের আমোদিত করে, বসন্তের
উষ্ণতা প্রায়ই অনুভবে আসে যখন প্রতিটি ঘণ্টার মৃত্যু হতে থাকে ।
সকল অবয়বই সুন্দর, আলোকিত এই বাতাস,
স্বচ্ছ এই বনাঞ্চল, এবং এতোদূর পথে
আসে না পথিক, এবং
হাস্যোজ্জ্বল সবকিছুর নিস্তদ্ধতায় প্রতিভাত হয়ে ওঠে ঐশ্বরিক কান্তি
বসন্তে হাস্যোজ্জ্বল ফুল করে না
ততো উজ্জীবিত এই মর্তের মানুষদের, আত্মহারা
আমরা উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখি, কিন্তু
দূরের আকাশ থেকে যায় অপরিবর্তনীয় ।
নদী, প্রান্তর, এবং সকল বস্তু ও প্রাণ
মনে হয় হয়ে আছে বিস্তৃত, এবং নগ্ন দৃষ্টিতে উজ্জ্বল,
জীবনের উষ্ণতা বহমান এবং শহরের উচ্চরোল
জীবনের অসীম বিস্তৃতিতে পূর্বক্ষণের থেকে অধিক সুন্দর ।
বসন্ত
আনন্দের পূণর্জ্জীবনে সূর্যের প্রত্যাবর্তন
ফুলের মতোই সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত দিন
যেন প্রকৃতির সজ্জা, হয়ে ওঠে অন্তরের আখ্যান-
জন্ম নিয়েই যেন স্তোত্র, যেন গান ।
উপত্যকার গভীরে প্রোথিত আছে নতুন পৃথিবী
বসন্তের সকাল মাধুর্যে শান্ত
এবং উচ্চতা থেকে বিকিরিত দিন, এবং রাতের জীবন
যেন ধ্যানস্ত হতেই নেমে আসে হৃদয় গভীরে ।
দূর থেকে এইসব নতুন দিন উচ্চকিত করে অবতরণ
গোধূলির কুয়াশা থেকে জেগে ওঠে এই ভোর
এবং মানুষকে লক্ষ্য করে হাসে এবং সজ্জিত, আনন্দিত মানুষ
অবগাহন করে মধুরতম আনন্দে ।
অনাগত দিনে উদ্ভাসিত হবে নতুন জীবন
এইতো প্রতীয়মান, বিস্তৃত উপত্যকা এবং এই পৃথিবী
ফুলের সম্ভারে হয়ে ওঠে পূর্ণতর, যেন আনন্দিত দিনের স্মারক
বসন্তের সমাগমে বিলাপের হয়েছে অবশেষ ।
গ্রীষ্ম
বছরের এই সেই ঋতু, গ্রীষ্মের আলো এবং উষ্ণতায়
আবর্তিত, মূখরিত গ্রামীণ জনপদ ;
যেখানেই নেমেছে ফেনাময় জলের প্রবাহ
সেখানেই সুন্দর প্রান্তর হয়েছে বিস্তৃত উচ্ছ্বসিত সবুজে
সুউচ্চ পর্বত এবং গভীর উপত্যকা জুড়ে দিন পদচারণায় দীপ্ত
শক্তিতে সংহত এবং আলোক-রশ্মিতে ব্যাপ্ত
অতিদূর উচ্চতায় ধীর গতিতে মেঘ ধাবমান
এবং বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায় অত্যুজ্জ্বল ধারাবাহিকতায়
বাতাস প্রবাহের ধীর শব্দে
দিন বয়ে যায় ; যখন তারা বদলে নেয়
মাঠের সম্ভারের সাথে আকাশের মেঘ
উপত্যকার প্রান্তবিন্দু পৌঁছে যায় পর্বতের গাত্রে আগত গোধূলির কাছে ;
পরিপার্শ্বে ব্যাপ্ত হতে থাকে অরণ্যের ছায়া-
দেখে নাও, দূরের স্রোতধারা কীভাবে নেমে যায় নীচে
অতিবাহিত প্রতি ঘণ্টায় আবর্তিত হতে থাকে দূরের ছবি
যখন মানুষ পেয়েছে তাঁর রহস্যময় অন্তরে বোধের অনুভব ।
ঋণ স্বীকারঃ
[১] Holderlin's Madness- Primary Source Edition, David Gascoyne, London: J. M. Dent & Sons Ltd.
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৪