‘১৯৮৪’ (নাইনটিন এইটি ফোর)—বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
অধ্যায় এক
এপ্রিলের উজ্জ্বল ঠাণ্ডা দিন। ঘড়ি তখন একটার কাঁটায় ঘণ্টা পেটাচ্ছে। বুকের ওপর থুতুনি ঠেসে হিম বাতাসের কবল থেকে মুখ বাঁচিয়ে ভিক্টরি ম্যানসন্সের কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকলো উইনস্টন স্মিথ। এরই ফাঁকে গাদাখানেক ধুলো ঘূর্ণি খেয়ে ঢুকে পড়লো। চটজলদি ঢুকেও উইনস্টন ওদের ঠেকাতে পারলো না।
হলওয়েতে পা ফেলতেই নাকে এসে লাগলো সিদ্ধ বাঁধাকপি আর ছাতরাপড়া পুরনো মাদুরের গন্ধ। বেঢপ একটি রঙিন পোস্টার একদিকের দেয়ালে সাঁটা। তাতে এক মিটারের বেশি প্রশস্ত আরও বেঢপ আকারের একটি মানব চেহারা। ৪৫ বছর বয়স হতে পারে এমন একটি পুরুষের মুখ। কালো বড় গোঁফে দশাসই লাগছে।
লিফটের চেষ্টা বৃথা, তাই সিঁড়ির দিকেই পা বাড়ালো উইনস্টন। খুব প্রয়োজনেও কদাচই কাজ করে লিফট। আর এখনতো দিনের আলোয় বিদ্যুতের লাইন কাটা। মূলত ‘ঘৃণা সপ্তাহ’র অর্থনৈতিক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এই বিদ্যুৎ সাশ্রয়। সাত তলায় ফ্ল্যাট। ৩৯-এ পা ফেলে আর ডান গোঁড়ালিও ওপরে ঘাঁ নিয়ে একটু ধীরে ধীরেই সিঁড়ি ভাঙতে হচ্ছে উইনস্টনকে। একটু পর পর জিরিয়েও নিচ্ছে। প্রতি তলায় লিফটের উল্টোদিকের দেয়াল থেকে একই বেঢপ পোস্টার থেকে একই বেঢপ ছবি চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে। মনে হবে প্রতি তলায় বসে আপনি কোথায় যাচ্ছেন কি করছেন তা নজরে রাখছে। মনে কেন হবে, লিখেই দেওয়া আছে ছবির ক্যাপশানে ‘বিগ ব্রাদার তোমাকে দেখছেন’।
সাত তলার ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলো ভিতর থেকে ভরাট কণ্ঠ ভেসে আসছে। কণ্ঠটি কতগুলোর নামের তালিকা পড়ছে। লোহা উৎপাদনকারীদের নাম। লম্বাটে ধাতব পাতের মতো দেখতে ঝাপসা একটা কাঁচের ভেতর থেকেই কণ্ঠটি আসছে। ডান দিকের দেয়ালের সঙ্গে সাঁটা ওটি। উইনস্টন সুইচ ঘোরালে কণ্ঠটি কিছুটা দমে ক্ষীণ হয়ে আসলো। বস্তুটি (বলা হয় টেলিস্ক্রিন) আরও ঝাপসা হলো তবে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলো না। জানালার দিকে এগুলো সে। ছোটখাটো, শীর্ণকায় দেহখানি নীল রঙা আলখাল্লায় বাড়তি কোনো ভাব প্রকাশ করছে না। ওটিই দলের ইউনিফর্ম। চুলগুলো ধূসর, চেহারায় প্রত্যয়ের ছাপ আছে, সাধারণ সাবান, ভোতা রেজরব্লেডের ব্যবহার আর সদ্যসমাপ্ত শীতের প্রকোপে খসখসে ত্বক।
ঝাপসা কাচের জানালা থেকেও যতটুকু বোঝা যায় তাতে মনে হয় বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। নিচে রাস্তায় ছোট ছোট ঘূর্ণি বাতাসে ধুলো আর ছেঁড়া কাগজগুলো ঘুরে ঘুরে উড়ছে। কড়া রোদ আর নীল আকাশও কোনো কিছুকে রঙিন করে তুলতে পারেনি। কেবল এখানে সেখানে সেঁটে রাখা পোস্টারগুলোই কিছুটা রঙিন।
কালো গোঁফওয়ালা চেহারাটি প্রতিটি কোনায় তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলো। ঠিক উল্টোদিকের বাড়িটির সামনেও একটি পোস্টার সাঁটা। ক্যাপশানে বলা আছে—‘বিগ ব্রাদার তোমাকে দেখছে’ আর কালো চোখ দুটো যেনো পাকিয়ে রয়েছে উইনস্টনের চোখের গভীরে।
নিচের রাস্তায় এক কোনা ছিঁড়ে যাওয়া আরেকটি পোস্টার চোখে পড়লো। ওই অংশটুকু বাতাসে ঝাপটা তুলে নড়ছে। এতে পোস্টারের ‘ইংসক’ শব্দটি একবার ঢাকা পড়ছে একবার দেখা যাচ্ছে। অনেক দূরে একটি হেলিকপ্টার দুই ছাদের মাঝখান দিয়ে নিচের দিকে নামছিলো। এরপর একটি বাঁক নিয়ে আবার উড়ে গেলো। ওটি পুলিশের টহল হেলিকপ্টার। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে জানালা দিয়ে নজরদারি করছে। টহল দেওয়া কোনো বিষয় নয়, তবে ‘থট পুলিশ’ আদতেই একটা বিষয়।
উইনস্টনের পেছনটাতে টেলিস্ক্রিন তখনও লোহা উৎপাদন আর নবম ত্রি-বার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে তার বকবকানি চালিয়ে যাচ্ছিলো। টেলিস্ক্রিনটি একইসঙ্গে শব্দ ধারণ ও সম্প্রচার করে। খুব আস্তে ফিসফিস করে না বলে সামান্য জোরে শব্দ করলে ওই যন্ত্রে ধারণ হয়ে যাবে, আর ওই ধাতব পাতের মতো দেখতে যন্ত্রটির নির্ধারিত দৃষ্টিসীমার মধ্যে পড়ে গেলে দেখাও যাবে, কোনো শব্দ করলে শোনাও যাবে। এটা অবশ্যই বোঝার উপায় নেই ঠিক কোন মূহূর্তে আপনি সে দৃষ্টিসীমায় পড়ে যাবেন। কতবার কোন পদ্ধতিতে ‘থট পুলিশ’ ঢুকে পড়বে তা আন্দাজ করা কঠিন।
এটাও মেনে নেওয়া যায় যে ওরা আপনাকে সারাক্ষণ নজরদারিতে রাখছে। কিন্তু যখন তখন চাইলেই যে ওরা আপনার ওয়্যার সিস্টেমে ঢুকে পড়ছে! আপনাকে এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে বাস করতে হচ্ছে যেখানে টু-শব্দটি করলেও তা অন্য কেউ শুনে ফেলছে আর অন্ধকার না হলে আপনার প্রতিটি নড়াচড়াও দেখে ফেলছে।
টেলিস্ক্রিনের দিকে পিঠ রেখেই দাঁড়িয়ে থাকলো উইনস্টন। এটাই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। যদিও সে ভালো করেই জানতো পেছনের দিক থেকেও তাকে চিনে ফেলা কঠিন হবে না।
সত্য মন্ত্রণালয় (মিনিস্ট্রি অব ট্রুথ) এখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে। ওখানেই উইনস্টন কাজ করে। নোংরা দৃশ্যপটে একটি সাদা উঁচু ভবন। এটাই!... বিস্বাদ লাগার মতো একটি অভিব্যক্তি উইনস্টনের চোখে মুখে, এটাই লন্ডন—প্রধান নগর এয়ারস্ট্রিপ ওয়ানের, যেটি আবার ওসেনিয়ার তৃতীয়-বৃহত্তম জনবহুল প্রদেশও বটে। ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি হাতড়ে উইনস্টন বোঝার চেষ্টা করলো লন্ডন কি আগেও ঠিক এমনটাই ছিলো। এই যে পচন ধরা উনবিংশ-শতাব্দীর বাড়িগুলো, কাঠের বেড়া, কার্ডবোডে ঘেরা জানালা, ঢেউটিনের ছাদ আর বাগানের অবিন্যস্ত দেয়াল—আগেও কি এমনটাই ছিলো? আর বোমা হামলার এলাকাগুলো—যেখানে পলেস্তারার ধুলো বাতাসে মিশে উড়ছে, আর উইলো গাছের অঙ্কুরগুলো পাথরের স্তুপের মাঝে উঁকি দেওয়ার কসরত করে যাচ্ছে, আর সেসব স্থানে বোমা পড়ে বড় বড় গর্ত হয়ে আছে, আর ঠিক মুরগীর খাঁচার মতো ছোট ছোট কাঠের নোংরা কলোনিগুলোতে গড়ে উঠছে আবাসন? এসব ভেবে খুব একটা ফায়দা হলো না, উইনস্টন কিছুই মনে করতে পারলো না। পেছনে দৃশ্যপটহীন, অর্থহীন স্রেফ কিছু উজ্জ্বল আলোকিত ছবি ছাড়া শিশুবেলার আর কিছুই মনে পড়ে না তার।
মিনিস্ট্রি অব ট্রুথ। নিউস্পিকে যার সংক্ষিপ্ত রূপ মিনিট্রু (নিউস্পিক ওসেনিয়ার দাপ্তরিক ভাষা)। আশে পাশে চোখে পড়ে এমন অন্য যেকোনো বস্তুর চেয়ে ভিন্ন রকম। ঝকঝকে সাদা কংক্রিটে পিরামিড কাঠামোয় তৈরি ৩০০ ফুট উঁচু ভবনের সারি। উইনস্টন ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকেও ওই ভবনের সামনে জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা তিনটি স্লোগান পড়া যাচ্ছে—
যুদ্ধই শান্তি
স্বাধীনতা দাসত্ব
অবহেলাই শক্তি
সত্য মন্ত্রণালয়ের গ্রাউন্ড লেভেলের ওপরের অংশে তিন হাজার কক্ষ, এমনটাই বলা হয়। আর নিচেও একই সমান কক্ষ। গোটা লন্ডনে আরও তিনটি একই আকার ও চেহারার ভবন রয়েছে। ভিক্টরি ম্যানসন্সের ছাদ থেকে তাকালে আশেপাশের স্থাপনাগুলোকে ক্ষুদ্রাকায় করে দিয়ে ওই চারটি ভবনই একসঙ্গে চোখে পড়ে। চার ভবনে চারটি মন্ত্রণালয়ের আস্তানা। আর পুরো সরকারও এই প্রধান চারটি ভাগে বিভক্ত। সত্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সংবাদ, বিনোদন, শিক্ষা ও চারুকলা। মিনিস্ট্রি অব পিস বা শান্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কেবলই যুদ্ধ। মিনিস্ট্রি অব লাভ বা ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আইন-শৃংখলা। আর মিনিস্ট্রি অব প্লেন্টি বা প্রাচুর্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে অর্থ সম্পর্কিত বিষয়। নিউস্পিকের ভাষায় এগুলো পরিচিতি পেয়েছে- মিনিট্রু, মিনিপ্যাক্স, মিনিলাভ ও মিনিপ্লেন্টি নামে।
২য় কিস্তির লিংক
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
শিল্প-সাহিত্য
প্রতিদিনের ধারাবাহিক
১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল || অনুবাদ : মাহমুদ মেনন
অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।