ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

গালাগালির অনুত্তেজক পাঠ | আসিফ আজিজ

বুক রিভিউ / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৫
গালাগালির অনুত্তেজক পাঠ | আসিফ আজিজ

অভিধান যে জ্ঞানলব্ধ, শ্রমসাধ্য, তপস্যাসাধ্য, সৃষ্টিশীল এবং অপরিসীম ধৈর্যের সমন্বয় ও আত্মনিয়োগের ফল তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ একটি ‘অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি’ অথবা বঙ্গীয় শব্দকোষ।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ২৭ বছর টানা কাজ করে ১৯৩২ সালে প্রকাশ করেন বঙ্গীয় শব্দকোষের প্রথম খণ্ড।

অক্সফোর্ডের প্রকাশ ১৯২৮-এ। কাজ শুরু হয় ১৮৭৯ সালে। আর, কাজ শেষ হওয়ার ১৩ বছর আগে মারা যান এর প্রধান সম্পাদক জেমস মারে। হরিচরণের শব্দের সংগ্রহ, অর্থান্তর বুৎপত্তি, প্রয়োগবাক্য অবাক করে আজও। গোটা জীবনের বড় একটি অংশ শুধু অভিধানের পিছনে ব্যয় করা এযুগে অনেকটা ‘অসম্ভব’—বলাই যায়।

জ্ঞানেন্দ্রমোহনের একলাখ পনের হাজার শব্দের বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (১৯১৭) কম কিছু নয়। আর ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে ড. গোলাম মুরশিদের সম্পাদনায় প্রকাশিত সোয়া লাখের কিছু বেশি শব্দের ‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’কে বলা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি শব্দের বাংলা অভিধান।

ভাষা ও শব্দ—দুটোই প্রবহমান। কাল, যুগ, বছরের ব্যবধানে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তাই যতদিন যাবে তৈরি হবে নতুন শব্দ,পরিবর্তিত হবে ভাষা। হালের ‘মোবাইল’, ‘ইন্টারনেট’ প্রভৃতি শব্দকে এখন আর ইংরেজি মনে হয় না। বাংলায় এগুলোর আত্তিকরণ হয়ে গেছে।

অভিধানের শ্রেণীকরণও কম নয়। শুধু আমাদের দেশে প্রচলিত কতগুলো অভিধানের কথা ধরলে—বাংলা-ইংরেজি, ইংরেজি বাংলা, ব্যবহারিক বাংলা, আঞ্চলিক অভিধান, তৎসম শব্দের অভিধান, অ-তৎসম শব্দের অভিধান, বুৎপত্তি অভিধান, পালি-বাংলা অভিধান, বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দের অভিধান থেকে রয়েছে স্ল্যাং অভিধানও।

দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহৃত বা প্রচলিত slang শব্দ নিয়েও যে অভিধান হতে পারে—এ ধারণা নতুন নয়। ইংরেজি ভাষায় slang সংকলিত হয়েছে সেই ষোড়শ শতকে। এছাড়া ফরাসি, জার্মান প্রভৃতি ভাষায় রয়েছে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ অভিধান। তবে এ কাজটি করবার বাকি ছিল বাংলা ভাষার। কলকাতা থেকে slang নিয়ে যে অভিধানটি প্রকাশিত হয়েছে—আমাদের দিক থেকে সমস্যা ছিল—তাতে এসেছে কেবল কলকাতাকেন্দ্রিক slang শব্দগুলো।

অবশেষে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কঠিন এ কাজটি সম্পন্ন করেছেন লেখক ও সম্পাদক আবদুল মান্নান স্বপন। তাঁর সম্পাদনা ও সংকলনে গত বছর ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত হলো গালি অভিধান। গালি শুনতে খারাপ লাগলেও আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এর উপস্থিতি ও প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করা যায় না। সেই চর্যাগীতিকা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, চৈতন্য চরণামৃত, রামায়ণ ও মনসামঙ্গলের মত প্রাচীন রচনা থেকে শুরু করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা বুদ্ধদেব বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামন ইলিয়াস—কারও রচনায় বাদ যায় নি গালি বা স্ল্যাং শব্দের ব্যবহার।

এ অভিধানে সম্পাদক প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালীন গ্রন্থের পাশাপাশি বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা, কলকাতা, আসাম ও ত্রিপুরার বাংলাভাষাভাসি এবং বাংলাদেশের ১১টি আদিবাসী গোত্রের গালি সংকলিত করেছেন। তবে তাঁর সম্পাদিত লিটলম্যাগ ধমনি’র জন্যই প্রথম এ কাজটি তিনি শুরু করেন বলে ভূমিকাংশে জানিয়েছেন।

মুখবন্ধে—অভিধানের অপূর্ণতাগুলোকে স্বীকার করে পাঠক ও সমালোচকদের প্রতি পরবর্তী সংস্করণে সেগুলোকে ঠিকঠাক করবার  আশা দিয়েছেন সম্পাদক।

কাকে আমরা গালি বলছি, আর গালি মানেই কি খারাপ কিছু?—ভূমিকায় এ জিজ্ঞাসার জবাব দেওয়া হয়েছে এভাবে: “মানুষ প্রাত্যহিক কথনে যেমন স্বাভাবিকভাবে শব্দ, শব্দগুচ্ছ ও বাক্য ব্যবহার করে তেমনি ক্রোধ-ক্ষোভে প্রতিপক্ষের ওপর রাগ প্রকাশের জন্য শব্দকে বিকৃত করে ভিন্ন ধরনের শব্দ-বাক্য ব্যবহার করে থাকে। সে শব্দকে অশ্লীল শব্দ, ইতর শব্দ, গালি, বদকথা, বদবুলি, অকথ্য ভাষা, জনবুলি, অপভাষা ইত্যাদি নানা অভিধায় ভাষাবিদগণ অবিহিত করেছেন। তবে শব্দগুলো বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। অর্থাৎ, যে শব্দটি slang হিসাবে বেশি পরিচিত—তার একটি যথার্থ প্রতিশব্দের আজও সন্ধান মেলেনি। এখানে লক্ষ করলে গালি শব্দটির সাথে অন্যান্য শব্দের পার্থক্য সহজেই অনুমেয়। গালি মূলত sence কেন্দ্রিক। গালিতে সব সময় অশ্লীল শব্দ নাও থাকতে পারে। একজন ক্ষুব্ধ মানুষ যখন ভাষার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে এবং বিপক্ষও ক্ষুব্ধ হয় তখনই সে ভাষা বা শব্দ গালি রূপে গণ্য হয়। ”

অঞ্চল, সম্প্রদায়, ভাষা, ব্যাকরণ, গ্রন্থ সংকেত দেখে নিয়ে অভিধানে ঢুকলে বুঝতে সুবিধা হবে।

অনেক সময় বাগধারা ও প্রবাদবাক্যে রূপান্তরিত হওয়া কিছু শব্দ বা বাক্যকেও সম্পাদক অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যেমন, আঙুল ফুলে কলাগাছ। এগুলো গালি অভিধানের শিরোনামের সঙ্গে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ সেটি বিবেচ্য বিষয়।

অভিধানে শব্দের অর্থ, পদ ও প্রয়োগবাক্য দেখতে পারলেও বুৎপত্তি দেখাতে পারেন নি সম্পাদক। তবু তার প্রচেষ্টা এবং শেষ পর্যন্ত অভিধানাকারে প্রকাশ করতে পারাকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হবে।

দেখে নেওয়া যাক অভিধানে ব্যবহৃত কয়েকটি গালি:
* কুত্তার বাইচ্চা শব্দটি চট্টগ্রামে ব্যবহৃত। নিকৃষ্ট অর্থে। কুত্তার বাইচ্চা এতাইন কাণ্ড কিল্লাই গরদ্দে।

* গতরখাঁকি খুলনা অঞ্চলের শব্দ। অলস নারী বা চারিত্রিক অধোগতির জন্য যে নারীর শরীর নষ্ট হয়ে গেছে। আমার শাশুড়ি জাত গতরখাঁকি।

* চোদন মূলত বগুড়া, পাবনা ও বরিশালের ব্যবহার থেকে এসেছে। অর্থ প্রহার, শাস্তি, রমণ। বরিশালের ভাষায়: খায় খয়রাত কইর‌্যা চোদে ল্যাম জ্বালাইয়া।

এরকম অসংখ্য চেনা-অচেনা, জানা-অজানা গালি বা ইতর শব্দ জানতে, দেখতে সংগ্রহ করতে করতে হবে গালি অভিধান।

গালি অভিধান
সংকলন ও সম্পাদনা: আবদুল মান্নান স্বপন
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৪
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ / প্রকাশক: ঐতিহ্য / মূল্য: ৪০০ টাকা



বাংলাদেশ সময়: ১৪২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।