ঢাকা, শুক্রবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ মে ২০২৪, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

সোয়াজিল্যান্ডে ভ্রমণ

নারিনা ত্রগন ও মাবুদা ফার্ম | মঈনুস সুলতান

ভ্রমণ / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৫
নারিনা ত্রগন ও মাবুদা ফার্ম | মঈনুস সুলতান

পাখি-ভাগ্য বলে কোনও শব্দবন্ধ আছে কি না আমার ঠিক জানা নেই। তবে আজ সকালে আমার অদৃষ্টে চমৎকার কিছু পাখি পর্যবেক্ষণের বিষয় লেখা আছে বলে আমার ধারণা হয়।

খুব ভোরবিহানে আমি তাঁবু থেকে উঠে বাইরে এসে হ্যামোকে পা ঝুলিয়ে বসেছি। সূর্যের আলো সবুজ পাতায় সোনালি রঙে ঝলমলিয়ে উঠলে দেখি শুকা নদীর পাড়ের প্রকাণ্ড গাছটির ডালে বসে সাদাকালো পালকের বিশাল ডানাঅলা একটি ঈগল পাখি। বিপুল এ খেচরটি প্রাজ্ঞ দার্শনিকের কায়দায় রীতিমত বিজ্ঞ নজরে তাকিয়ে থাকে দিগন্তের দিকে। আমি জার্নালের নোটবুক খুলে গতকালকের সন্ধ্যার কথা ভাবি।

মি. ককোসোর যথারীতি ক্যাম্পফায়ারের আগুন জ্বেলে কিছু ইয়াম পোড়ান। ইয়োরগান ফুডবাস্কেট থেকে বের করে স্মোক করা দুটি ট্রাউট মাছ, ও এক বোতল পিনো ব্লাংকো নামের ড্রাই হোয়াইট ওয়াইন। আমি কিছু শুকনা এপ্রিকট নিয়ে সামিল হই নৈশভোজে। ডিনারে খাবারের কোয়ালিটি ভালো হলেও কার্লা উৎপাত শুরু করে। সে বারবার দুধদানি আগুনের দিকে ছুড়ে দিলে বিরক্ত হয়ে ব্রিজিত উঠে বাচ্চাকে নিয়ে স্টোন কটেজে চলে যায়। ইয়োরগানও আমাকে গুডনাইট বললে আমি তাঁবুতে ঢুকে পড়ে লণ্ঠন নিভিয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু বিকালবেলা অনেকক্ষণ দিবানিদ্রায় বিভোর ছিলাম বলে চোখে সহজে ঘুম আসে না। নেটের জালি দেয়া জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে, তাই এক পর্যায়ে উঠে পড়ে বেরিয়ে আসি।

দেখি মাঁচার উপর বসে ইয়োরগান। সে ‘কাম অন আপ হিয়ার’ বলে ডাকলে আমিও সিঁড়ি বেয়ে উঠি মাঁচায়। সে একা বসে ড্রিংক করছে। ‘ব্রিজিতের খুব মাথা ধরেছে। স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে’—বলে ফ্লাস্ক থেকে প্লাস্টিকের পেয়ালায় ঢেলে আমাকে সে পানীয় অফার করে। মিষ্টি স্বাদের ঘন এ তরলটি কী তা জানতে চাইলে সে বলে, ‘এ ড্রিংককে এক ধরনের বিয়ার বলা যেতে পারে। তানজানিয়াতে বেড়াতে আসা পর্যটকরা এর নাম দিয়েছে বি-ব্রু। মাসাই গোত্রের লোকজন শিকড় বাকড়ের জারিত রসের সাথে চাকভাঙ্গা মধু মিশিয়ে জ্বাল দেয়, বলকানোর সময় তাতে মেশায় চুলা থেকে তুলে নিয়ে কিছু তাজা ছাই। ’ আকাশে নদীর চরের মত ছড়িয়ে আছে মেঘমালা। আড়াল থেকে চাঁদের আলো পড়ে তাতে তৈরি হয়েছে পালতোলা জাহাজের আকৃতির একটি বিমূর্ত নকশা। ইয়োরগান পান করতে করতে মৃদুস্বরে কবিতা পড়ার মত উচ্চারণ করে বনিএম-এর ‘আফ্রিকান মুন’ লিরিকের কয়েকটি চরণ, ‘ফিল দ্য উইন্ডস অ্যাজ উই সেইল অন আফ্রিকান মুন..। ’ চাঁদের কিরণে ঝলসানো মেঘ উড়ে গেলে মনে হয় পাইরেটদের একটি জাহাজ যেন সত্যি সত্যি ভেসে যাচ্ছে জানজিবার মোম্বাসার উপকূলে সমুদ্রজল কেটে কেটে।

শুকানদীর ওপারে করচোরাস বুবাতি ঝোপের উপবনে ভয় পেয়ে বিড়ালের বাচ্চার মত চিঁউমিঁউ করে ওঠে কিছু প্রাণী। ইয়োরগান আমার দিকে পানীয়ের পেয়ালা বাড়িয়ে দিতে দিতে বলে, ‘আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে এগুলো চিতাবাঘের শাবক। বাঘিনী বোধহয় গুহা ছেড়ে বেরিয়েছে শিকারের ধান্দায়। ’ ভয়ার্ত আর্তনাদ আবারও অস্থিরতা ছড়ায়। সাথে সাথে হেসে ওঠে কয়েকটি হায়না। ইয়োরগান উদ্বিগ্ন স্বরে বলে, ‘হোয়ার হ্যাভ ইউ গন মামি চিতা? কাম ব্যাক কুইকলি অ্যান্ড ফাইট দ্য হায়েনাজ। ’ ঝটাপটিতে চিঁউমিঁউ আওয়াজ বিবর্তিত হয় অসহায় আর্তনাদে। ক্রমশ মৃদু হয়ে আসা আর্তস্বরের ভেতর হাসতে হাসতে হায়নাগুলো ছুটে যায় প্রান্তরের দিকে। ইয়োরগান ‘দিস ইজ সো ওয়াইল্ড, স্টুপিড হায়নাজ আর ইটিং আপ দ্য বেবি চিতাস্’—বলে নিশ্চুপ হয়ে যায়। রাতের আকাশে সুসসান নীরবতা নেমে আসলে আমরাও বসে থাকি চুপচাপ।

হঠাৎ করে খেয়াল হয় ইয়োরগান যেন আমাকে কিছু বলছে। তীব্র ঘোরের ভেতর অত্যন্ত ফোকাস করে তার বক্তব্যের বিষয় কী তা আমি বোঝার চেষ্টা করি। সে যেন কোনও কিছুর কৈফিয়ত দিচ্ছে এমন স্বরে বলে, ‘ব্রিজিত কিছু করতে চাইলে, নেভার এভার সে নো। তার কোনও ইচ্ছায় বাধা দিলে সে ডেসপারেট হয়ে উঠবে। আর ডেসপারেট হলে সে নিজেকে ধংস করে দিতে পারে। ’ এবার তার গলার স্বরে ফুটে ওঠে অনুনয়, ‘জাস্ট ইমাজিন ম্যান, ক্ষেপে গিয়ে সে নিজের ধংস ডেকে আনলে আমি ছোট্ট মেয়ে কার্লাকে নিয়ে যাব কোথায়?’ আমি প্রসঙ্গ ভালো করে বুঝতে না পেরে জানতে চাই, ‘টেল মি ইয়োরগান, আমি এই যে তোমাদের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছি তাতে তোমার অসুবিধা হচ্ছে কি? আই নিড টু নো দিস ক্লিয়ারলি, বি ফ্র্যাংক ম্যান। ’ সে জবাব দেয়, ‘নট রিয়েলি, তুমি আমাদের সাথে থাকো আরও কয়েকদিন। তোমার সঙ্গ আমাদের সম্পর্কের মাঝে নিয়ে আসছে এ রকমের ভারসাম্য। সো স্টে উইথ আস, বাট প্লিজ নেভার সে নো টু এনিথিং ব্রিজিত ওয়ান্টস। ’ আকাশ থেকে নীলাভ সবুজ আলো ঝলসিয়ে একটি নক্ষত্র প্রান্তরের দিকে ছিটকে পড়লে ঝিক করে মনে পড়ে ব্রিজিতের অভিব্যক্তিতে এক ধরনের গাঢ় সংকল্পের রেখা। জানতে চাই, ‘হোয়াই ব্রিজিত ইজ সো ডিটারমাইন্ড? কোনও কিছু পছন্দ না হলে সে এত স্ট্রংলি রিয়েক্ট করে কেন? হোয়াই?’ ইয়োরগান বি-ব্রু’র পেয়ালা খালি করে হেঁচকি সামলাতে সামলাতে বলে, ‘ইট ইজ হার অপব্রিংগিং। তানজানিয়ার খুব রিমোট এলাকায় ধর্মযাজক বাবার কড়া নজরদারিতে সে বড় হয়েছে। তার পরিবারের রোমান ক্যাথলিক পরিবেশে নিয়মকানুনের নড়চড় করার কোনও উপায় ছিল না। তাই সে বারবার বিদ্রোহ করত খুব নীরবে। ধংস করতে চাইত সর্বশক্তিমান প্রভুর দেয়া তার নিজস্ব প্রাণ। ’

ব্রিজিতের ব্যাপারে আমার কৌতূহল তীব্র হয়ে উঠলে আমি সরাসরি জানতে চাই, ‘নিজেকে ধংস করা, হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দ্যাট, সে কি কখনও সুইসাইডের এটেমপ্ট নিয়েছে?’ ‘ইয়েস ম্যান, মেনি টাইমস্, এ বিষয়টাই তো আমি তোমাকে বলার চেষ্টা করছি..। ’ ইয়োরগান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘আমার বাবাও তানজানিয়ার আরেকটি রিমোট এলাকায় চালাতেন মিশনারি হাসপাতাল। পনের বছর বয়সে ব্রিজিত অনেকগুলো স্লিপিং পিল খেলে তার স্টমাক ওয়াশ করার জন্য নিয়ে আসা হয় হাসপাতালে। সুইসাইড এটেমপ্টের কারণে আরও দু বার তাকে আনা হয় এ হাসপাতালে। ওখানেই তার সাথে আমার পরিচয়। অ্যান্ড ইউ নো আই ফেল ইন লাভ উইথ হার টেরিবলি। আমরা ডেট করতে শুরু করি। উই গট ম্যারিড আফটারওয়ার্ডস। তারপর কার্লা আসল, অ্যান্ড আওয়ার লাইফ টুক অ্যা ডিফরেন্ট রুট। ’ ধড়মড় করে ইয়োরগান উঠে পড়ে বলে, ‘আই গট টু গো ম্যান। ঘুম ভেঙ্গে ব্রিজিত আমাকে কাছে শোয়া না দেখলে লোডেড রাইফেল নিয়ে খুঁজতে বেরোবে। ’ সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সে বলে, ‘আই হোপ ইউ উইল হেল্প আস টু গো টু সুন্দরবন। চিত্রল হরিণ শিকার করতে পারলে ব্রিজিতের খুব ভালো লাগবে। আই অ্যাম কাউন্টিং অন ইয়োর হেল্প ম্যান। ’

হ্যামোকে বসে বসে ভাবি এ বিষয়গুলো নোটবুকে লিখে ফেলতে হয়। কিন্তু ভোরের বাতাসে জড়িয়ে আছে মৃদু শীত শীত অনুভূতি, বেজায় আলসে লাগে। ঠিক তখনই তাকে দেখতে পাই, জবুথবু হয়ে বসে আছে গাছের ডালে। নিজের দৃষ্টিকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। লাল সবুজ পালকের পাখিটিকে বিমর্ষ দেখায়। কিন্তু দূরত্ব এত কম, আর ভিজিবিলিটি এত স্পষ্ট যে, সবুজ পালকে বুকে লোহিত রঙের ঝিলিক পাড়া নারিনা ত্রগন পাখিটিকে শনাক্ত করতে আমার কোনও অসুবিধা হয় না। বার্ড ওয়াচারদের মধ্যে পেশাদাররা এ বর্ণাঢ্য খেচরকে ‘ইল্যুসিভ’ বা সহজে দর্শন পাওয়া যায় না এ রকমের রহস্যময় বলে অভিহিত করে থাকেন। নারিনা ত্রগনকে দেখতে পেয়ে—অবচেতনে যাকে চেয়েছি সে যেন অপ্রত্যাশিতভাবে এসে দাঁড়িয়েছে আমার দাওয়ায়—এ ধরনের অনুভূতি হয়। খানিক দূরের সসেজ ট্রি’র কান্ডে বেশ খানিকটা বাকল সম্ভবত বুনোহাতির কাঁধের ঘষায় উঠে এসেছে। ওখানে হাঁটাচলা করছে তেলাপোকার মত তেলতেলে কালো কিছু পতঙ্গ। খানিক অনিচ্ছায় উড়ে গিয়ে নারিনা ত্রগন পাখিটি তাদের একটি ঠোঁটে নিয়ে ফিরে এসে ডালে বসে পায়ের নখ দিয়ে পরিষ্কার করে তার অর্ধ-প্রসারিত ডানা।

বছর দুয়েক আগে আমি যখন সোয়াজিল্যান্ডে ভ্রমণের কথা ভাবছি তখন একটি ফ্লোরা ও ফোনা জাতীয় সচিত্র পুস্তকে এ পাখিটির কথা বিস্তারিতভাবে পড়ি। কিছু তথ্য এ মুহূর্তে স্মৃতির কুয়াশা কেটে ফিরে আসছে মনে। খোয়খোয় বা হটেনটট সম্প্রদায়ের মৌখিক জবানে নারিনা শব্দের অর্থ হচ্ছে রঙচঙে ফুল। ফ্রান্সিস লে ভিলিয়েন্ত বলে সুরিনামে বসবাসকারী এক ফরাসী পক্ষীতত্ত্ববিদ ১৭৮১ সালের দিকে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে আসেন পাখি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাকে বিশেষভাবে বার্ড স্প্যাসিম্যান বা মৃত পাখির রাসায়নিকে সংরক্ষিত নমুনা সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়। ভিলিয়েন্ত সাহেব পেশাগতভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন জাদুঘরে রকমারি সব পাখির নমুনা পাঠিয়ে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। আফ্রিকার এ এলাকায় তিনি কাটিয়ে দেন বছর সাতেক। পাখি ছাড়াও আদিবাসি নারীদের বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল অদম্য। তাদের সাথে সহবতের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তিনি রেখে গেছেন তার জার্নালে। এ বিবরণগুলোর মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নারিনা নামের খোয়খোয় গ্রোত্রের এক যুবতীর কথা। তার সাথে ঝোপঝাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশে অন্তরঙ্গতার মুহূর্তে লোহিত সবুজে ঝলমলে এ পাখিটি উড়ে এসে বসে গাছের ডালে। তৎক্ষণাৎ তিনি বিরল প্রজাতির এ খেচরের নামকরণ করেন তার প্রণয়িনী নারিনার কথা ভেবে। আমি এসব তথ্য পড়েছি সেকেন্ডারি সোর্স থেকে। মুদ্রিত জার্নালের আদি ভার্সনটি দেখার আমার কোনও সুযোগ হয়নি। কিন্তু নারিনা ত্রগন পাখিটিকে দেখতে পেয়ে অনমনে ভাবি—আজ আমার পাখি-ভাগ্যের সাথে একটি তেলতেলে কালো পতঙ্গের ভক্ষিত হওয়ার কোনও যোগসূত্র আছে কি?

মি. ককোসোর এসে ট্রেলার থেকে নামিয়ে ক্যাম্পফায়ারের পাশে রাখেন ক্যানভাসের কটি চেয়ার ও একটি কলাপসিবোল টেবিল। তিনি আগুনের উপর চায়ের কেটলি রাখলে ইয়োরগান এসে প্যারাফিন স্টোভে পাউডার দুধ মিশিয়ে রান্না করে ঔটমিল পরিজ। কার্লা বেবিস্ট্রলারে তার টয় মোটরকারকে বসিয়ে দিয়ে প্রাণপণে ঠেলছে। ঘুমে খানিকটা ফোলা ফোলা মুখ নিয়ে এসে ব্রিজিত টিপটে চায়ের আয়োজন করে। আমি এক প্যাকেট ক্রিমক্রেকার বিস্কিট নিয়ে যোগ দেই তাদের সাথে। সুরভিত তানজানিয়ান চায়ে বিস্কিট ভিজিয়ে খেতে ভালোই লাগে। ব্রিজিত স্কার্টের সাথে সুতি টপ পরেছে বলে তাকে ভোরের আলোয় অত্যন্ত কমনীয় দেখায়। কার্লাকে চামচে পরিজ খাওয়াতে খাওয়াতে তার কপাল কুঁচকে ওঠে। বিড়ালের মত আশেপাশে কোথাও জোরালো আওয়াজে চিঁউমিঁউ করে ডাকছে একটি চিতাবাঘ। আওয়াজটি ঘরঘরে রাগি স্বরে রূপান্তরিত হলে শুকানদীর ওপারে করোচোরাস বুবাতি ঝোপে এসে লাগে দীর্ঘ টিকিবোড়া লেজের ঝাপটা। প্রাণীটি এখন ‘ইহন.. ইহন..’ ধ্বনি তুলে যেন অনুনয় করে কিছু বলছে। মি. ককোসোর মন্তব্য করেন, ‘দ্য পুওর চিতা ইজ কলিং হার বেবিজ্ , কালরাতে মাদিচিতা শিকারে বেরোলে তার শাবকগুলোকে হায়েনারা ধরে নিয়ে যায়। মা চিতা আজ সারাদিন অস্থিরতা ছড়াবে, ঝোপে ঝোপে লেজ আঁচড়িয়ে খুঁজবে তার শাবকদের। ’ ঠোঁট কামড়ে খুব অন্যমনষ্কভাবে ব্রিজিত আমার পেয়ালায় টিপট থেকে ঢালছে চা। মাদি চিতা আবার ‘ইহ ইহ ইহন’ ধ্বনিতে হাহাকার ছড়ালে বুকের ভেতর কেমন খালি খালি লাগে। হঠাৎ করে ব্রিজিত রেগে ওঠে, সে যেন এখনই লিপ্ত হবে ইয়োরগানের সাথে তুমুল ঝগড়ায়, এমন ভঙ্গিতে চিৎকার করে বলে, ‘সাম ওয়ান শুড শুট দ্য ড্যাম চিতা ডাউন। এ অপদার্থ জানোয়ারকে এখনই গুলি করে মারা দরকার। স্টুপিড এনিম্যাল, বাচ্চাদের গুহায় একা রেখে কেন শিকারে বেরোবে?’ মি. ককোসোর রেসপন্স করেন, ‘বিকজ দ্য চিতা ওয়াজ হ্যাংরি মেম। ’ ‘ইউ শাট দ্য ফাক আপ’—বলে ব্রিজিত অযথা মি. ককোসোরকে দাবড়ে দেয়। তখনই স্টোন কটেজে হ্যাম রেডিওতে ক্র্যাকলিং সাউন্ড হলে সে কার্লাকে বুকে চেপে ধরে চলে যায় ওদিকে। মি. ককোসোরের দিকে তাকিয়ে অপরাধীর মত হেসে ইয়োরগান বলে, ‘লেটস্ হোপ, রেডিওতে ভালো কোনও ম্যাসেজ আসবে। যদি সুখবর কিছু আসে তাহলে ব্রিজিতের মেজাজ প্রফুল্ল হতে দেরি হবে না। ’
___________________________________

মঈনুস সুলতানের আরও ভ্রমণ:
___________________________________

** বনানীতে বর্ণিল ভ্রমণ


** বনানীতে বর্ণিল ভ্রমণ (২)

** স্টোন কটেজ

** স্টোন কটেজ (২)

___________________________________


ক্যাম্পফায়ারের পাশে নিশ্চুপ বসে আমরা আরেক পেয়ালা চা খাই। খুশিমনে ব্রিজিত ফিরে এসে বলে, ‘গট ভেরি গুড নিউজ। মাবুদা ফার্মের কাছে একটি গেম রিজার্ভে প্রফেশন্যাল শিকারী খুঁজছে। হরিণের সংখ্যা বেড়ে গেছে বেহদভাবে। কালিং করতে হবে। শুট করে কমাতে হবে কিছু হরিণ। ’ সংবাদ শুনে ইয়োরগান নড়েচড়ে বসে। ব্রিজিতের আশেপাশে ঠিরঠিরিয়ে হাঁটছে কার্লা। তার চুলের রিবন ঠিক করে দিতে দিতে ব্রিজিত শিস দিয়ে মোরগের বাঁকের মত ‘কক এ ডোডোল ডু’ ধ্বনি তুলে বলে, ‘কাম অন লেজি গাইজ। টেন্ট ডিসম্যান্টেল করো, ক্যাম্পের সব কিছু গুছিয়ে তুলে ফেল ট্রেলারে। এখন রওয়ানা দিতে পারলে বিকালের দিকে ডিয়ার হান্টিংয়ের সব বন্দোবস্ত করা যাবে। ’ মি. ককোসোর ও ইয়োরগান সবকিছু গোছগাছ করতে শুরু করলে আমি বিরক্ত হয়ে বলি, ‘তোমাদের কথায় আমি এখানে আসলাম, মখাইয়া রিজারভেশনটি ভালো করে আমার দেখা হয়নি। এখনই অন্য কোনও জায়গায় শিফ্ট করতে চাচ্ছি না। তোমাদের তাঁবু তোমরা নিয়ে যেতে পারো। আমি এখানেই থাকছি। এরপর কোথাও যেতে হলে আমি বর্ডার ক্রশ করে সোজা পাড়ি দেব মোজাম্বিকে। ’ ‘খুব তেড়িয়া হয়ে রূঢ়ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ব্রিজিত বলে, ‘ট্রাভেল জিনিসটাকে তুমি সিলেবাসের মত দেখছো, যেন প্রথম চাপ্টার পড়া শেষ হলে ধরবে দ্বিতীয় চাপ্টার। রিমেমবার.. তুমি ব্যাকপ্যাকিং করছো। বেরিয়ে আসতে পারো না আগে থেকে মনের মধ্যে স্থির করা জায়গায় যাওয়ার এ ছককাটা ফরম্যাট থেকে। মাথায় তোমার মোজাম্বিক ঢুকেছে। ওদিকে দুদিন পরে গেলে হয় না। ’ কিন্তু মাবুদা ফার্মের বিষয়টি আমার সম্পূর্ণ অজানা, সুতরাং ওই দিকে কোনও পরিকল্পনা ছাড়া অগ্রসর হতে আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি। বলি, ‘ব্রিজিত ইট ফিলস্ আনসারটেইন। কোথাও যাওয়ায় আগে আমার মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়। ইউ আর নট এলাওয়িং মি এনি টাইম টু প্রিপেয়ার মেন্টালি। ’ খুব রহস্যময় হাসি হেসে সে বলে, ‘দিন কয়েক আগে আমার সাথে যে তোমার দেখা হবে এ ধরনের কোনও পরিকল্পনা তোমার মাথায় ছিল কি?’ আমি সরাসরি জবাব দিতে থাকুমুকু করলে সে বলে, ‘ইউ হ্যাভ টু চয়েসেস নাউ। চাইলে এখানে থেকে যেতে পারো, একা শুকানদীর তীরে বসে বসে শুনবে চিতবাঘের কান্না। সারারাত বাঘিনী হাহাকার ছড়াবে। আর আমাদের সাথে মাবুদার দিকে গেলে... গেস হোয়াট, আই উড বি ক্লোজ টু ইউ। ’ চোখে মরমী মায়া ছড়িয়ে আমার দিকে তাকালে আমার দৃষ্টি এবার তার চোখে লক হয়ে যায়।

মাবুদা ফার্মের অবস্থান লেবোমবো প্লাটোতে। লেবোমবো পাহাড়ের দিকে নিশানা করে ল্যান্ডরবার ছোটালে সড়ক উঠে যায় উপরের দিকে। সমতল ভূমি থেকে প্রায় পনের শত ফুট উপরে দেখা যায় পাহাড়ের শীলাময় ঢেউ খেলানো রেখা। দুপুর হওয়ার আগেই আমরা ছেড়েছি মখাইয়া রিজারভেশন। মোরাম বিছানো সড়ক ধরে বেরিয়ে আসার সময় চিতাবাঘটি বিভ্রান্ত পদক্ষেপে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ে। হর্ন বাজালে সে ঝোপের দিকে সরে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে ঘুরে তাকায়, ‘ইহ ইহ ইহন..’ ধ্বনিতে কাতর স্বরে যেন বলে, ‘খুঁজে দাও আমার শাবকদের। ’ ইয়োরগান গাড়িতে স্পিড দেয়। পিছনের সিটের দিকে গ্রীবা বাঁকিয়ে ব্রিজিত বলে, ‘মাবুদা ফার্ম হচ্ছে জাস্ট অ্যা লাভলি প্লেস। ওখানে তুমি প্রচুর পাম ট্রি দেখতে পাবে। চাইকি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হেঁটে সিটেকি শহরে একবার ঢু মেরে আসতে পারো। ’  অন্যমনষ্ক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম হাল্কা বনানীতে ছাওয়া লালমাটির মেঠো পথের দিকে। আর কেন জানি মনে হচ্ছিল, ব্রিজিত মূলত পালাচ্ছে শিশুহারা বাঘিনীর আর্তিময় হাহাকার থেকে। দেখতে দেখতে বেশ দূরে চলে আসলেও বাচ্চাহারা চিতাবাঘের বিভ্রান্ত স্বর কেবলই বেজে যেতে থাকে আমার বুকে।

ঠিক খেয়াল করিনি, কখন যেন ঢুকে পড়েছি মাবুদা ফার্মের চত্বরে। ‘ইজন্ট দিস প্লেস রিয়েলি স্টানিং?’—বলে ব্রিজিত পেছন দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে আমি তার আঙ্গুলে আংটির দ্যুতি ছড়ানো হীরাটি স্পর্শ করতে করতে দেখি সড়কের পাশের জলাশয়ে ফুটে আছে লাল ও নীল বর্ণের শাপলা ও শালুক। মাঠে চরছে চিত্রাপাকরা কিছু জার্সি গরু টিলার উপর পর্যটকদের সাময়িক আবাস হিসাবে আছে কতগুলো বাংলো ও দু তিনটি শৌখিন শ্যালে। আমরা সরাসরি চলে আসি ফার্ম হাউসের মূল দালানে। ১৯৩০ সালে তৈরি গৃহটি আহামরি গোছের আলিশান কিছু না। বরং বলা চলে সাদামাটা। তবে আঙ্গিনায় ছাটা সবুজ ঘাসে রাখা কয়েকটি মরচে রঙের ডলারাইট রক ও ছনের ছাউনিতে ঔপনিবেশিক আমলের স্মৃতিময় কথকতা যেন বাঙ্ময় হয়ে আছে।

ফার্ম হাউসের ভেতরে ঢুকতেই গ্র্যান্ডফাদার ক্লক, মেহগিনি কাঠের পিয়ানো ও ইতালিয়ান মার্বেলের মেঝেতে মনে হয় সময় যেন স্থির হয়ে আছে। সত্তর আশি বছর আগে হার্ডউডে তৈরি ইনটিরিওর ডেকোরেশন পুরানো হয়েছে, উজ্বল আভা মিইয়ে আসাতে স্ক্রিন ও প্যানেলে এসেছে আভিজাত্য। ক্ষীণ কটি কৃষ্ণকায় এক মহিলা এটেনডেন্ট আমাদের দেখভাল করতে আসেন। তার মাথায় পরচুলার বাহার মৌচাকের ঘন বুনটকে হার মানায়। ইয়োরগান একটি শ্যালে ভাড়া নেয়ার বিষয়ে তার সাথে কথাবার্তা বলে। শ্যালেতে খরচ একটু বেশি পড়লেও তাতে আছে দুটি বড়সড় বেডরুম। তার একটিতে অনায়াসে আমি থাকতে পারি। মেইডের জন্য আলাদা কোনও টাকা পয়সা দিতে হবে না। সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সে কার্লার জন্য বেবিসিটিংও করতে পারবে।

ব্রিজিতের পাশে দাঁড়িয়ে আমি হলরুমের আবলুস কাঠের বিশাল ক্যাবিনেটটি দেখি। ইতালীয় রাজবংশের এক নির্বাসিত কুমার ১৯২৫ থেকে ১৯৩০ সালে মধ্যে গড়ে তোলেন এ ফার্মটি। স্থানীয় ভাষায় মাবুদা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘অ্যা প্লেস অব ড্রিম’। সোয়াজি রাজার সাথে ইতালির কুমার শিকারে আসেন এখানে। পরে ইতালিতে রাজনৈতিক অবস্থা তার জন্য দুরূহ হয়ে উঠলে তিনি আর ফিরে যাননি রোমে। মাবুদা নামের স্বপ্নপুরিতে তিনি গড়ে তোলেন খামার ও পাশাপাশি অভয়ারণ্য। কাবিনেটটিতে সযত্নে রাখা আছে তার ব্যবহৃত শটগান, ফটোফ্রেম, স্মোকিং পাইপ, পানপাত্র, মনিরত্ন খচা কাফলিংস্ ও কিছু বইপত্র। আমি দেয়ালে ঝোলানো ইতালির রাজা প্রথম উমবারতো’র তৈলচিত্রের দিকে নির্দেশ করে মন্তব্য করি—সম্ভবত এ রাজার আমলে ইতালিতে ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনির উত্থান হয়। ব্রিজিত চিত্রের খুব কাছে গিয়ে প্রায় মিটে যাওয়া রাজার জীবনকালের সন তারিখ তথা ১৮৪৪ থেকে ১৯০০ সাল তথ্যটি পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি নিচের দিকে দিয়ে বলে মুসোলিনি তখন ফুটপাতে ডাংগুলি খেলত। তারপর পাশের তৈলচিত্র রাজা প্রথম উমবারতোর পুত্র ভিক্টোর ইমানুয়েলের (১৯০০-১৯৪৬) তৈলচিত্রের দিকে দেখিয়ে সে বলে, ‘মুসোলিনি স্ক্রুড আপ দ্যা ইতলিয়ানস্ ডিউরিং দিস কিংস্ টাইম। ’

কথা বলতে বলতে আমরা বেরিয়ে আসি ভেতর দিকের একটি খোলা বারান্দায়। ওখানকার ব্যাকইয়ার্ডে আছে আরেকটি ছনে ছাওয়া ঘর, তার সামনে চরছে সাবেক রাজকুমারের কয়েকটি ঘোড়া। এদিকে দুই সারি পুরানো গাছের ছায়ায় চুলের সিঁথির মত সোজা একটি পথ চলে গেছে লেবোমবো পাহাড়ের শিরদাড়ার দিকে। এ পথের দিকে তাকালে ইচ্ছা হয় মুঠোয় কারও সফ্ট হাত চেপে ধরে অনামিকায় ওয়েডিং রিংয়ের কোমল হীরাটি ছুঁতে ছুঁতে হেঁটে যাই পর্বতের সানুদেশে। খানিক দূরে ঘোড়ায় চেপে এক পর্যটক তরুণ ছায়াবিথীকা ধরে ছুটছে কদমচালে। ওদিকে তাকিয়ে ব্রিজিত বলে, ‘ঘণ্টা খানেক ঘোড়া ছোটালেই পৌঁছে যাবে মোজাম্বিক। ’ ফিকফিক করে হেসে সে এবার বলে, ‘তুমি কি আমার সাথে হর্স রাইড করে মোজাম্বিকে যেতে চাও?’ আমি আস্তে করে বলি, ‘নট রিয়েলি। ’ ব্রিজিত রিয়েক্ট করার কোনও সুযোগ পায় না, কার্লা শিশুতোষ গিটারে টুংটাং ধ্বনি তুলে ছুটে এসে তার স্কার্টে ঘষে ইয়োগার্ট মাখা মুখ।



বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।