ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

অগ্নিপুরুষ মলাটে বন্দি বিনোদ বিহারী

শিল্প সাহিত্য ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২২ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০১৫
অগ্নিপুরুষ মলাটে বন্দি বিনোদ বিহারী

এক মলাটে বিনোদ বিহারী চৌধুরীকে বাঁধা যায় না। তবে মলাটের ওপর যখন নামটি দেওয়া হয় ‘অগ্নিপুরুষ’ তখন ভেতরে যে বিনোদ বিহারীরাই থাকবেন সে কথা ধরে নেওয়া যায়।


 
বিনোদ বিহারী চৌধুরীকে ছবিতে-লেখায়-বর্ণনায়-আঁকায়-পৃষ্ঠাসজ্জায় দারুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে ‘অগ্নিপুরুষ’ গ্রন্থে। সাহসী ও সুচারু এই কাজটি করেছেন এ.এম. আব্দুল্লাহ।

গ্রন্থের রচনা, গবেষণা ও সম্পাদনা তিনটি গুরু দায়িত্বই বহন করেছেন এ.এম. আব্দুল্লাহ। আর ২০০ পৃষ্ঠার চাররঙা বইটির পাতার পর পাতা ওল্টালে গবেষণা ও রচনায় দক্ষতার ছাপ যেমন পাওয়া যাবে। তেমনি, এতে উপস্থাপিত একেকটি ছবি থেকে ‘হাজার কথা’ বুঝে নেওয়া যাবে।
 
বইয়ের পুরে নাম ‘অগ্নিপুরুষ বিল্পবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। ইংরেজিতে দ্য ফায়ারব্র্যান্ড রিবেল রেভল্যুশনারি বিনোদ বিহারী চৌধুরী। মলাটে বিনোদ বিহারীর যে ছবি তাতে চশমার ওপারে চোখের চাহুনি, মুখে চেপে রাখা গাম্ভীর্যে বিপ্লবের প্রকাশ স্পষ্ট। আর মলাট উল্টে মিলবে প্রফেসর এমেরিটাস আনিসুজ্জামানের অভিনন্দন বার্তা।

নিঃসন্দেহে এ.এম. আব্দুল্লাহকে অভিনন্দন জানিয়েছেন দেশের শ্রেষ্ঠ বরেণ্য শিক্ষাবিদ। বলেছেন, অনেক যত্ন ও পরিশ্রম করে বিনোদ বিহারী চৌধুরীর যে জীবনালেখ্য তৈরি করেছেন তা পড়ে বর্তমান প্রজন্ম দেশপ্রেমের প্রেরণা অনুভব করবে।

পরের পাতা উল্টালে সাংবাদিক কলামিস্ট কামাল লোহানীর কথাগুলো ক্ষুরধার। বলেছেন, তখন রক্তসাক্ষরে সিমন্তিনী এই বাংলার সমুদ্রকন্যা বীর চট্টলা জ্বলে ওঠে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে। যা ত্রাসের কাঁপন লাগিয়েছিলো বেনিয়া ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী মসনদে। এমন ঐতিহাসিক, বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের এক কিশোরযোদ্ধা বালকবীর ছিলেন অগ্নিপুরুষ বিনোদ বিহারী চৌধুরী।

এতেই বুঝে ফেলা যায় বিনোদ বিহারী চৌধুরী কে ছিলেন। তবে এরপর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওল্টালে মিলবে বিনোদ বিহারীর পরিচয়। পাতায় পাতায় ছবি, বিনোদ বিহারীর উদ্ধৃতি। বিনোদ বিহারীই নিজ হাতে আঙুল নির্দেশ করে দেখাচ্ছেন একটি বাড়ি, যে বাড়িতে তার জন্ম হয়েছে ১৯১১ সালে। সেখান থেকেই শুরু। নামকরণে জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর অবস্থানের যে সংশ্লিষ্টতা ছিলো তাও জানালেন। নামের অর্থ যার লোককে আনন্দ দেওয়া সে আনন্দ তিনি দিয়েছিলেন ভারতবর্ষ স্বাধীন করে।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর করলডাঙ্গায় তার গ্রামের বাড়ি, বাবা-মায়ের ছবি এসবই রয়েছে। তবে মূল বর্ণনা বিপ্লবকালের। ব্রিটিশ বেনিয়াদের ইতিহাসও স্থান পেয়েছে একজন বিনোদ বিহারীর কেনো প্রয়োজন ছিলো তার প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে।

দ্রোহকালের জাতক বিনোদ বিহারী চৌধুরী এই শিরোনামে উপস্থাপিত হয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিকথা। তাতে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্লচাকির‍া বাদ পড়েননি। তার বিপ্লবি হয়ে ওঠার গল্প বিনোদ বিহারীর নিজের মুখেই বয়ান হয়েছে এই বইয়ে। কিশোর বিনোদ বিহারী টিনের বাক্স ভরে পিস্তল রিভলবর ও বোমা তৈরির খোল গভীর রাতে বাড়িতে এনে পরে বৃষ্টি-ঝড় মাথায় নিয়ে কিভাবে তা চট্টগ্রাম পৌঁছে দিয়েছিলেন সে কাহিনী রয়েছে।

দুই হাতে বন্দুকের ট্রিগার চাপার যে ছবি এই বইয়ে স্থান পেয়েছে তাতে বিপ্লবীর চেহারাই স্পষ্ট করে। আর মাস্টারদার সঙ্গে তার পরিচয় পর্ব পরে তার কর্মী হয়ে ওঠারও ঘটনাপুঞ্জ দারুণভাবে উঠে এসেছে, কখনো উদ্ধৃতিতে কখনও বর্ণনায়।

গল্পের খাতিরেই এসেছে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন। তবে যখন যুদ্ধ শুরু হলো তখনকার বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রথমেই স্মরণ করলেন, মৃত্যুর দুয়ার থেকে কিভাবে ফিরেছিলেন সে কথা। জালালাবাদের পাহাড়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন গলায়। গলা উঁচিয়ে তা যখন দেখাচ্ছিলেন, সে ছবিও দারুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে এই বইয়ে।
 
হুলিয়া নিয়ে পলাতক জীবন, হুলিয়া সত্ত্বেও সাহসী যাত্রা সব এসেছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের পথে সেই সাহসেই বন্দি হলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। জেলখানায় তার জীবন কাটলো টানা পাঁচ বছর। একবছর গৃহবন্দি থাকেন। ১৯৪১ এ আবার বন্দি হন মুক্তিপান ১৯৪৫ এ। বিনোদ বিহারীর মতো বিপ্লবীকে আটকে রাখাই সেরা পথ হিসেবে দেখে ব্রিটিশ শাসক। তবে ভারত স্বাধীনের পরেও ‍তাকে বন্দি হতে হয়েছে। সেবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেফতার করে এক বছর আটকে রাখে। এভাবেই কাহিনী গড়ায়।

ছবিতে ছবিতে ভরে ওঠা ‘অগ্নিপুরুষ’ বর্ণনা করে বিনোদ বিহারীর প্রেমের উপাখ্যানও। বিয়ে, জীবনের বড় সহযোগী হিসেবে পাওয়া স্ত্রী বিভা চৌধুরীর কথা। যাকে তিনি ফ্রেন্ড ফিলোসফার ও গাইড হিসেবেই দেখেন।

পরে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিনোদ বিহারী চৌধুরীর সক্রিয় অংশগ্রহণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার যোগাযোগ ও সম্পর্ক এসবই উঠে আসে এই দারুণ দক্ষতায়। একটি উন্নত, প্রগতিশীল বাংলাদেশের পক্ষেও যে তার নিরন্তর লড়াই তাও রয়েছে।
 
আর ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। তার চশমা জোড়ার একটি ছবি যেনো সে কথাই জানান দেয়, বিনোদ বিহারী চৌধুরীদের মৃত্যু নেই।

এতকিছু তুলে ধরার পরেও এ.এম. আব্দুল্লাহ তার ‘লেখকের কথা’য় লিখেছেন- মানবপ্রেম-জারিত এবং স্বদেশপ্রেমে পড়া এক মহাজীবন সম্পর্কে যৎসামান্ন উপস্থাপন করতে পেরেছি মাত্র।

বিনোদ বিহারী চৌধুরীর জীবন‍ালেখ্য তুলে ধরতে এটুকু যৎসামাণ্য বটে, তবে এ.এম আব্দুল্লাহর এই প্রচেষ্টা যৎসামান্য নয়। এর গুরুত্ব তুলে ধরতে জামাল উদ্দিন যথার্থই লিখেছেন, এই গ্রন্থ ভবিষ্যতের ইতিহাস অনুসন্ধিৎসুদের কাছে এক অমূল্য গ্রন্থ হিসেবেই বিবেচিত হবে। তরুণ প্রজন্মের দেশাত্ববোধ, ঐতিহ্য-চেতনা জাগ্রত করতেও গ্রন্থটি সহায়ক হবে।



বাংলাদেশ সময় ১০১৯ ঘন্টা, মার্চ ০২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।