ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

একগুচ্ছ কবিতা | সিদ্ধার্থ হক

কবিতা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৫
একগুচ্ছ কবিতা | সিদ্ধার্থ হক

সাপ
___________________________________

      বৃষ্টিতে বিহ্বল সাপ ড্রেনের ভিতর দিয়ে একা একা চলে।
      এ সাপ নিঃসঙ্গ কেননা সে কেবল কম্পন নয়,
      মানুষের কথা শুনতে পায়।


      ড্রেন দিয়ে ক্লান্ত ভাবে যেতে যেতে যেতে,
      চারদিকে বহু কথা, বহু ধ্বনি শোনে
      দিনে দিনে ক্রমশ অস্বচ্ছ, বুজকুড়ি হয়ে পড়ে।
      যত দিন যায় তত তার মনে হয়
      কাল সত্য ছিল সব কিছু, সে নিজেও,
      আজ সব মিথ্যার অধিক অন্ধকার হয়ে গেছে
      নিভে যাওয়া গ্রহের গর্ভের মত কালো।

      একদিন ড্রেন থেকে বের হয়ে ধুলাতে গড়ায় ঐ সাপ, এক কষ্টে।
      টের পায়, ধূলাকে জানতে হলে, অবিরত হাতে তুলে
      নিতে হয়, বুকে নিতে হয়।
      গান, মুখ, ভালোবাসা স্পর্শ ছাড়া অসত্য ও মৃত।
      সাপও তো নয় ঠিক সাপ, স্পর্শ ছাড়া।
      যেহেতু সে সাপ, জানে, কথারা অপরিপূর্ণ সত্য।
      এসব জেনেও তার ধ্বনিদের সত্য লাগে কিছুদিন।
      পরে তাও মিথ্যা হয়, গভীর সন্ধ্যায়।
      ড্রেনের ভিতরে থেকে তাকে এক লাল অন্ধকার ডাক দেয়।
      সে তো এই পৃথিবীর একমাত্র সাপ, যে আসলে কথা শুনতে পায়

      আঁজলার মধ্যে মুখ ভেসে ওঠে, বলে, ‘পান কর। ’
      গভীর শরীর থেকে বহু দূরে সত্যহীন ধর্ম পাঠকের মত নয়
      সরীসৃপ। ওরকম হতে সে তো পারবে না কোনদিন। বরং
      এভাবেই ধীরে ধীরে সাপ হয়ে, ড্রেন-স্রোতে ভেসে চলে যাবে,
      যেন সে সাপও নয়, শব শুধু, নিমজ্জনে অধিকার নেই

      এখন অনেক রাত। উপেক্ষায় উবে গেছে নদী।
      বোকা শীর্ণ সাঁকো মুখ থুবরে পড়ে আছে অন্ধ মাঠে।
      কোনও স্রোত নেই প্রবাহিত।
      প্রকৃত ড্রেনের থেকে বহু দূরে সরে এসে সাপ, পাক খুলে,
      শান্ত এক বরফ কলের মত স্থবির, ধবল হয়ে আছে, মরে গেছে।
      কথা, প্রথম আগ্রহ, শেষ হয়ে গেছে কত আগে
 

রাতের সূর্য
___________________________________

      প্রতিনিয়তই সে আলোকে পেতে চাই।
      রাতের সূর্য হারায় তথাপি ভোরে।
      সারাদিন আজ অন্ধকারেই যাবে

      গভীর শ্রান্ত, দূর থেকে আসা ভুল—
      রাতের প্রশ্ন শীর্ণ মুখের মত,
      ফোটে কি ফোটে না, ঝরে যায় নিশ্চিত।

      প্রশ্ন কি বুঝি? জানা নাই। শুধু দেখি
      প্রশ্নকর্তা চলে গেছে পাশ থেকে।
      সারারাত ধরে নামে লোহা এই গ্রহে

      কোনও কোনও ধ্বনি জাগে শুধু থামা গানে
      অসম্ভবের নীরবতা ঘিরে আসে
      মৃত্যুর সুর পাতালে পাতালে ঘোরে

      ট্রাকের পিছনে চলে গেছে বহু ছায়া
      যে পথে এখন হাঁটছো কষ্টে তুমি
      কাল আমি যাব সেই পথে একা হেঁটে

      এ জীবন যদি পুনরায় পাই ফিরে
      তোমার কাছেই ফিরে ফিরে আমি যাব
      প্রতিদিন যাতে তোমাকে দেখতে পাই


প্রেম
___________________________________

      ওঠো, নীল বুদবুদ, ওঠো, চলে যাও।
      সারারাত শুয়ে শুয়ে চাকার গুঞ্জন শোন তুমি;
      জেনো, তাতে কারও কিছু হয় না। তোমার
      বুকের উপর দিয়ে ট্রাকের সুন্দর চাকা চলে যায় শুধু।
      বহু মানুষের স্বর ভেসে আসে তার সীমাহীন
      চোখ থেকে। তুমি শব্দহীন থাকো, নীরবে, অদূরে।

      অন্ধকার কীর্তনের মত এক ভোর, এক দিন।
      বাতাসের কি বিশাল পতাকা যে ওড়ে...
      ভেসে ওঠে নীল সমুদ্রের বাল্ব; জ্বলে, পুড়ে যায়।
      অনিদ্রিত দৃষ্টি খুলে দেখা যায় দূর। টের পাও
      নাগরিক সুইমিং পুলের এই জল,
      এই শান্ত বাতাসের মৃদু ও অপূর্ব শত ঢেউ,
      এসব তোমার নয়। তুমি শুধু অলীক রাত্রির।
      আবার রাত্রিতে ফিরে যাও, আর আলোকে চেও না।

      ধুম, ধুম, ধুম—এ শহর বয়ে চলে। সেও যায়
      তার স্বচ্ছ মানুষের কাছে, ভালোবেসে, রাত্রি ঘরে।

      ভুলো না যে তুমি এসবের কেউ নও। তুমি মাত্র
      নীল বুদবুদ, মুহূর্তের কসমিক বেদনায়।
      জেগে ওঠো স্বপ্ন থেকে। ওঠো, চলে যাও।
      আজ ভোরে ম্লান হেসে পতাকা যে ওড়ে।


ছবি খোঁজা
___________________________________

      পরে আর খুঁজে আমি পাইনি সে ছবি।
      দেখেছি কোথাও—মনে আছে। স্বপ্নে নয়, বাস্তবেরই
      কোনওখানে, চেতনার রূপে।
      ভেবেছি অবাক হয়ে নিশ্চয়ই তোমাকে চিনতাম কোনওদিন।

      কত আগে? হয়ত অনেক আগে, জানালার ওই পাশে, পথে।
      কিন্তু পরে জানালাকে হারিয়ে ফেলেছি।
      পৃথিবীকে বহুবার স্ক্রল করেছি এ আমি,
      তবু আর কিছুতেই পাইনি তোমাকে; বা সে ছবি

      কুয়াশায় এরকম হতে থাকে বারবার, জানি।
      যে মাঠ অনেক দূরে, যেখানে টানেল আর আকাশের পথে
      ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে দিগন্ত ও সিঁড়ি
      সেখানে হারিয়ে যায়—ছবিসহ—কেন্দ্রহীন শহরের সন্ধ্যা!

      তবু আমি স্ক্রল করে যাই—উদ্‌ভ্রান্ত ও অলীক—সড়কের
      শেষ প্রান্তে কুহেলিকা নেমে আসে অতিকায় স্পেস শিপ থেকে—
      তার চোখ পার হয়ে খুঁজি আমি কার ছবি চক্রাকার ঘোরে?
      দেখি যে হারায় ছবি মানুষ হারালে—ফলে তাকে
      খুঁজতে গিয়ে কেটে যায় দিন রাত—সম্পূর্ণ জীবন


পাশাপাশি
___________________________________

      দুটি বৃত্ত, পাশাপাশি আছে জেনে, পাশাপাশি আছে।
      অবচেতনার মত এই গান। যাকে পার হয়ে,
      অন্যের পরিধি স্পর্শ করে নি কখনও বৃত্ত-দ্বয়।
      গভীর এ অবরোধ। তা সত্ত্বেও, কী প্রকারে যেন
      বৃত্ত দুটি পরস্পর পরস্পরের বিষণ্ণতাকে জেনে গেছে।

      এর অর্থ, তুমি তোমার বৃত্তের মধ্যে রয়ে গেছো,
      আমিও আমার। দেখ, তবু যে দুজনে
      দুজনার বেদনাকে জানি, বুঝি... সে এক বিস্ময়

      এসব বিস্ময়সহ বৃত্তের ভিতরে বহুদিন পার হলো।

      স্বাভাবিক জীবনের মতন কখনও, তবু দেখি,
      সঙ্ঘের অপার বাঁধা পার হয়ে যেতে ইচ্ছা করে;
      কিন্তু তা কেবল ইচ্ছা, ভঙ্গুর স্বপ্নের হাতে অসীম বেদনা

      কেউ কেউ এসে বলে অপর বৃত্তের মধ্যে তুমি আর নেই
      বহু আগে চলে গেছ অন্য এক দূর দেশে, খেয়ালের বশে
      এখন কেবল এক শূন্যতাই ওঠে, বসে, থাকে ঐ খানে;

      আমার সে প্রজ্ঞা নেই, রাত্রে উঠে তাই, বিছানায়
      একা বসে, শূন্য করে ফেলে যাওয়া বৃত্তের রিক্ততা,
      বারবার অনুভব করি। মনে হয়, হয়ত আমিও বৃত্ত;
      আমাকেও শূন্য করে ফেলে গেছে কেউ। আমি শুধু
      বৃত্তের বেদনা জানি, তোমাকে জানি না



বাংলাদেশ সময়: ১২৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।