ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কাজলদিঘি (শেষ কিস্তি) | মণীশ রায়

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৭ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৫
কাজলদিঘি (শেষ কিস্তি) | মণীশ রায়

শুরুর অংশ পড়তে ক্লিক করুন

(শুরুর কিস্তির পর) একদিন বিকেলবেলায় অনন্ত আমাকে নিয়ে নদী পাড়ি দিয়ে চলে এলো কাশীপুর গ্রামে। দিগন্তের দিকে চোখ রেখে বলে উঠল, ‘দেখছস আকাশ কত বড়!’

একবার একটা মালগাড়িতে করে আমরা ভর দুপুরবেলায় চলে এলাম শিঙ্গারবিল এলাকায়।

নির্জন এক কাঁঠালবাগানের ভেতর ঢুকে গাছে ঝুলে থাকা কাঁঠালগুলোকে আদর করতে লাগল অনন্ত। আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘এরা গাছের পোলা-মাইয়া। এগো আদর করলে গাছগুলান খুব খুশি অয়। আদর কর না?’ ‘তুই ক্যামনে বুজলি গাছেরা খুশি অয়?’
‘এরা খুশি অইলে ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা শ্বাস ফেলায়, এই গরমের ভিতরে তোর শরীলডা এক্কেরে হিম অইয়া যাইব। দ্যাখ না। ’
এরকম যে কত অদ্ভুত খেলা ও জানত। রাস্তা থেকে একটা ছাগল টেনে এনে কোলে বসিয়ে এর মাথায় একটা কচুপাতা দিয়ে বলত, ‘দেখবি, এইটা আর মাথা তুলত না। খালি গুমাইব। ’

সে সারাদিন মগ্ন থাকত এরকম অজস্র  বানানো আনন্দ-বিনোদনে। একবার সবাইকে চমকে দেবার জন্য  পুকুরের তলা থেকে ডুব দিয়ে বালি তুলতে গিয়ে একটা নির্বিষ সাপ তুলে নিয়ে এলো হাতে করে। সে দৃশ্য দেখে ভয়ে-শঙ্কায়  ডাঙায় দাঁড়ানো আমাদের সে কী চেঁচামেচি। কিন্তু ও এতটুকু ভয় পায়নি; মনে হলো হাতে একটা শাপলার ডাঁটা। টের পেতেই ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে।

একবার একটা উঁচু আমগাছ থেকে একটা কাকের ছানা মাটিতে পড়ে ডানা ঝাপটাতে লাগল। কাকেরা সব একত্র হয়ে ছানাটার উপর উড়ে উড়ে কা-কা করতে থাকে। কেউ সেদিকে ভিড়ছে না কাকের ঠোকর খাবে বলে। কেবল অনন্ত ছানাটিকে হাতে নিয়ে আমগাছের মগডালে চড়ে ওর বাসায় রেখে এলো। হিংস্র কতগুলো কাকের উড়ন্ত ঠোকর খেল; তবু সে কাজটা করে এলো।

ঘন বর্ষায় স্কুল থেকে ফেরার  সময় ও একদিন আমাকে নিয়ে ভিজল। তুমুল বৃষ্টির ভেতর কাক-ভেজা হচ্ছি আমরা দুজন। অনন্ত লাফাচ্ছে। চেঁচাচ্ছে গলা খুলে। মাঝেমাঝে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টিবিন্দুগুলো গেলার চেষ্টা করছে; কখনও হাতের মুঠোয় সেগুলো ধরবার চেষ্টা করছে। আমার দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে বলে উঠছে, ‘ভগবান তানপুরা বাজাইতাছে আইজ। শোন বন্ধু। ’

সেই বন্ধুটাকে খুঁজে পেলাম  ফেইসবুকে, সম্বিৎ ফিরে পেতে একটুখানি তো সময় লাগবেই।

ফের ফেইসবুকে অনন্তকে ধরলাম, ‘বন্ধু তুমি কোথায়?’
‘আমি ঢাকায় একটা হোটেলে রয়েছি। তুমি চলে আস প্লিজ। ’

অনন্ত দাশ এখন ঢাকায়? ওরা বাড়িঘর বিক্রি করে যখন নিরুদ্দেশে যাত্রা করে তখন আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধপরবর্তী সময়। হিন্দু মানেই ভারতের চর; আমাদের শত্রু। এদেশে বসবাসের কোনও অধিকার এদের নেই। এরকমই এক মানসিকতা সবার অন্তর জুড়ে।

সেই সময়টায় অনন্তর চলে যাওয়াটা যে কীরকম কাঁদিয়েছিল আমায় তা এখনও উল্কি-কাটা স্মৃতি হয়ে আমার অন্তরে বেঁচে আছে। ওরকম নিঃস্বার্থ বয়স ছাড়া সম্ভবত আর কোনওকালেই মানুষ শত্রুর জন্যে এভাবে কাঁদতে পারে না। ওদের বাড়িটার সামনে দিয়ে আমার রোজ বাজারে যেতে হতো। চোখ পড়ে গেলেই বুকটা হু-হু করে উঠত। মনে হতো বাড়ির সামনে বড় পেয়ারা গাছটায় দু-পা দুলিয়ে বসে আছে সে; আমাকে চোখে পড়তেই বলে উঠছে, ‘গয়াম খাইবি শিমুল? পাকনা গয়াম। নে। ’ বলে ছুঁড়ে দিত আমার দিকে। আমি লুফে নিতাম সেই পেয়ারা। হাত ফস্কে গেলে সে বলে উঠত, ‘তুই একটা গাধা। একটা গয়াম লুফতে পারছ না?’

একই রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে কত যে ভাবের বশে হাত উঠে গেছে শূন্যে। আহ! যদি পেয়ারাটা হাত ফস্কে রাস্তায় পড়ে? সেই হারানো বন্ধুটা এখন ঢাকায়; আমি কি না গিয়ে পারি? আমি যখন বেরোচ্ছি তখন জুবায়ের ডেকে উঠল সেলফোনে। হ্যালো বলাটা ওর এমনি প্রাণবন্ত ও আন্তরিক যে মন ভরে ওঠে নিমিষে।

আমি বললাম, ‘কী খবর দোস্ত। ’
‘খুব খারাপ খবর। ’ জুবায়েরর কণ্ঠস্বর চিমসানো, যা সচরাচর ওর বেলায় হয় না। কারণ জুবায়ের বরাবরই বন্ধুবৎসল ও উষ্ণ। আমার মাথায় নানারকমের বাজে চিন্তা ওড়াউড়ি করতে শুরু করে। কয়েক সেকেন্ডের ভেতর অনেকগুলো নেগেটিভ সম্ভাবনা আমাকে  ম্রিয়মাণ করে রাখে।
‘কী ব্যাপার?’
‘কলির সঙ্গে দেখা হলো। ’—মনে হলো জুবায়ের একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল।
‘কী কইলি! কলির দেখা পেলি তুই? এভাবে বলছিস কেন? তোর তো চিৎকার করে আমাকে জানানোর কথা। হে আল্লাহ, তোমার পৃথিবীতে এমন ম্যাজিকও ঘটে? অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য, অচিন্ত্যনীয়। ’—ভাবের বিস্ফোরণ ঘটাতে গিয়ে যা-যা করা ও বলা  দরকার, আমার ঝুলি উগড়ে সব ঝেড়ে দিলাম। তবু মনে হচ্ছে অকিঞ্চিৎকর; বন্ধুর সাফল্য যেন আমার ভেতরকার কাঙাল সুনীলটাকে মাতাল করে দেয়; সমস্ত না-পাওয়ার যন্ত্রণা আর অবদমিত আবেগ একসঙ্গে একই সুরে কথা কয়ে ওঠে। হিপ-হিপ হুররে!

আমি তুমুল এক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করি জুবায়েরের পরবর্তী কথার।

‘দেখা না হলেই ভালো ছিল দোস্ত। না দেখা হওয়াটাই ভালো ছিল। ’ খুব মূহ্যমান সেই কণ্ঠস্বর। কোনও ট্র্যাজেডি ফিল্ম দেখার পর যে মানসিক অবস্থা দাঁড়ায়,  ওর কণ্ঠ সেকথাই বলছে।
‘মানে?’
‘বুঝে নে। আমি কোনও মধ্যবয়েসী নারীর আজেবাজে বর্ণনা দিতে চাই না। ’—বলেই লাইনটা কেটে দিল ও।

আমি হ্যালো -হ্যালো করে ওকে অনন্তর কথা বলতে চাইলাম। এর আগেই লাইনটা কেটে দেয়ায় আমি কিছুক্ষণ সেলটার দিকে বোকার মত তাকিয়ে রইলাম। তারপর হোঁচট খাওয়া কোনও পথচারীর মত ফের আনন্দ-ভরা মন নিয়ে এগিয়ে গেলাম আমার কৈশোরের বন্ধু অনন্তকে ফিরে পেতে।

ফেইসবুকে এরই ভেতর ওর ছবি ও বায়োডাটা দেখে নিয়েছি। ছবি দেখে ঠিক চেনা দায় এটা আমাদের অনন্ত। আমি কেবল ওর হাসিটা দেখে বুঝতে পারলাম। শরীর বেড়েছে, অভ্যেসও নিশ্চয়ই বদলে গেছে। সেই চেনা মানুষটাকে নিশ্চয়ই আমি আর এখন খুঁজে পাব না। কলিকে খুঁজে পাওয়ার মতই হয়ত আমাকেও জুবায়েরের মত বলতে হবে, দেখাটা না হলেই বরং ভালো ছিল। সেই এলোকেশী কৃষ্ণকলি তো এখন আর নেই। সে এখন মধ্যবয়সী  পৃথুলা এক নারীর ছবি।

মাথায় এসব বহন করেই আমি অনন্তর হোটেল-রুমে ঢুকে পড়লাম। এসি ছেড়ে শুধু একটা জাঙিয়া পরে  কম্বলের তলায় শুয়ে রয়েছে ও। আমাকে দেখে এক ঝটকায় সবকিছু উপড়ে ফেলে উড়ে এলো।
‘হ্যা রে ব্রাম্মণবাড়িয়াটা কি আগের মতই আছে?’
‘প্রচুর বাড়ি-ঘর হয়েছে। তোরা যখন ছেড়ে গেছিস তখন দোতলা বাড়ি ছিল দেখার বিষয় একটা। এখন কেউ পাঁচতলার কম বাড়ি বানায় না। মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত আছে। সব পাবি, শহরে এক ইঞ্চি জায়গা খালি পাবি না। এক গণ্ডা জায়গার দাম এক কোটি টাকা। তোদের বাড়িটাও এখন পাঁচতলা। ’

গলগল করে ওকে বলে দিলাম সবকথা। ওদের জন্মশহর ছেড়ে দেয়াটা যে একটা মস্ত ভুল সিদ্ধান্ত ছিল সেটা বোঝাতেই আমি এভাবে বললাম; আমার অবচেতনে লুকিয়েছিল কথাগুলো;  আপনাআপনি বেরিয়ে এলো।
একটু পর  বললাম, ‘তোরা কেমন আছিস?’
‘বাচ্চাদের খেলনার একটা কারখানা গড়ে ছ’তলা একটা বাড়ি করেছি কোলকাতার লেকটাউনে। একটাই মেয়ে; ও সরকারি কর্মকর্তা। ইঞ্জিনিয়ার জামাইর সঙ্গে থাকে বেঙ্গালুরুতে। আমার বউ তো টিচার। ওখারনকার মেয়ে। ’

আমি থ হয়ে ওর সব কথা শুনলাম। কেন যেন এরকম গল্প আমি শুনতে চাইনি। মনে হচ্ছিল ও আমাকে একটা দুঃখের গল্প শোনাবে, যা শুনে আমার ভেতরে করুণারসের উদ্রেক হবে। হয়ত বলে উঠব, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়াটা তোদের ঠিক হয়নি। এখানে থাকলে এরকম হতো না। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। ’
সেটা বলতে পারলাম না বলে উশখুশ করতে লাগলাম। একটু পর মিনমিন করে  জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এদ্দিন পর কী মনে করে এলি এদেশে?’
‘বারে, তোদের দেখতে ইচ্ছা করে না? এখন পড়ন্ত বয়স; বিদেশের মাটিতে অনেক যুদ্ধ করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করলাম। এখন তো শেকড়ের কাছে আসতে ইচ্ছা করবেই। তাছাড়া ফেইসবুকে তোকে পেয়ে সেই ইচ্ছাটা খুব চাগিয়ে উঠল। বিশ্বাস কর। ’—অনন্ত হাসল। হাসিটা কেন যেন মলিন মনে হলো এসময়। হয়ত বোঝার ভুল।
‘প্রোগ্রাম কী?’
‘তোকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাব। সময় দিতে পারবি তো ব্যাংকার সাহেব?’
আমি এতটুকু না ভেবে বলে উঠলাম, ‘বলিস কী? তুই মাতৃভূমি দেখতে এসেছিস আর আমি তেকে সঙ্গ দিতে পারব না? বাংলাদেশের লোকদের তোরা ভাবিস কী?’ মৃদু ধমকের সুর আমার গলায়।

একথা শুনে ও অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমার মনে হলো আমরা ফের আমাদের উচ্ছ্বল কৈশোরে ফিরে গেছি।

তারপর তো হৈ-হৈ রৈ-রৈ ব্যাপার। তিন-চারদিনের এক উথাল-পাতাল সময় কাটানো। তিতাসের ওপারে গিয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ভারতীয় রাম পান করা,  যাত্রাপালা দেখে নৃত্যরতার দিকে টাকা ছুঁড়ে মারা থেকে শুরু করে গভীর রাতে শ্মশানে গিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখা, নৌকায় তিতাসে ভেসে বেড়ানো আর সেই সঙ্গে  কত হাজার গল্প যে আমরা করেছি নিজেদের ভেতর তা বলতে পারব না।

রাতে হোটেল কক্ষে বসে কৈশোর জীবনের এক কিশোরীর কথা মনে পড়ে গেল আমাদের। কী মনে করে অনন্ত হঠাৎ বলে উঠল, ‘চল্ , খুঁজে বের করি মালবিকাকে। ’
‘এখন সন্ধ্যা আটটা। মফস্বল শহরের ঝাঁপি বন্ধ হয়ে যায় এসময়। ’
‘তবু চল। ’

বেরিয়ে পড়লাম মালবিকার খোঁজে। মাইছপাড়ার যে পুকুরটার পাড় ঘেঁষে ওদের মনোরম বাড়িটি ছিল, সেখানে এখন চারতলা। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ওদের পেলাম না। ঘোরাঘুরিটাই সার হলো।

হোটেলে ফিরে উদাত্ত গলায়  অনন্ত বলে উঠল, ‘যাঃ মাফ করে দিলাম তোরে মালবিকা। যেখানেই থাকো, নাতিপুতি নিয়ে  সুখে থাকো হে মালবিকা বুড়ি। আমেন। ’

হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলাম আমি। চোখের সামনে দোমড়ানো-মুচড়ানো এক বুড়ির ছবি। আমার তালে তালে অনন্তও হাসছে। দুজনার মিলিত হাসির গমকে হোটেল ঘরটা পুরো স্বর্গ হয়ে গেল। এত হাসি আর উচ্ছ্বাস লুকিয়েছিল আমাদের ভেতর? অনন্তর দেখা না পেলে হয়ত কোনওদিনই তা টের পেতাম না আমি।

ঢাকায় ফিরে মনে হয়েছে আমি পূর্ণ; আমরা আমাদের পুরো সত্তার সুষমা মেখে সময়কে বুড়ো আঙুল দেখাবার চেষ্টা করে গেছি সারাক্ষণ।

একসঙ্গে এতটা সময় কাটিয়েছি; কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্যেও মনে হয়নি এই অনন্ত  সেই অনন্ত নয়। ওর উচ্ছ্বাস দেখে আমি ঠিক বুঝতে পারছি মানুষ আসলে বদলায় না; বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে লুকোবার কূট-কৌশলগুলো শিখে অন্যকে বিভ্রান্ত করে বেড়ায়। সময়-সুযোগ আর বিশ্বস্ত মানুষ পেলে সে ঠিক পুরনো অবয়ব ফিরে পায়।

অনন্তর সঙ্গে আমার এই দু-তিনদিনের জমাট আড্ডা অনেকেটা নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মত আনন্দময়। নইলে আমি বুঝতেই পারতাম না আমার ভেতরকার কাজলদিঘিটার কথা। হয়ত ভাবতাম, ওটা মরে গেছে; বয়সের খরায় সেটি শুকিয়ে গেছে!

এয়ারপোর্টে এসে অনন্তকে তুলে দেবার সময় জুবায়েরকে একটা রিং দিলাম, ‘জুবায়ের?’
‘হ্যা। বল। ’
‘কাজলদিঘিটা আমি অবিকল সেরকমই পেয়েছি, বহুবছর আগে আমি উল্কি-কাটা স্মৃতি করে যেরকমটি রেখে দিয়েছিলাম সেরকমই ফিরে পেলাম। ’ আবেগ ঝরে আমার কণ্ঠ থেকে। অনন্ত আমার পাশে দাঁড়ানো; ওর মুখে মিটিমিটি হাসি।
‘ভালো থাক। তোর আনন্দ দেখে খুব ভালো লাগছে আমার। অনন্তকে শুভেচ্ছা দিস। ’
‘কথা বলবি ?’—প্রশ্ন করলাম।
‘নাহ। ’—বলে ও সেলটা কেটে দিল। আমি ওর সংগোপন দুঃখটা বুঝতে পারছি। মনে মনে বেচারা বলে জুবায়েরের প্রতি কিঞ্চিৎ করুণা করতে চাইলাম। পরক্ষণে ভুরু কুঁচকে নিজের দিকে তাকালাম। উত্তর এলো, ‘মানুষ আসলে এরকমই। নিজের পাওনা পুরোটুকু পেয়ে গেলে নিজের মা-বাবাকেও আর মনে রাখতে চায় না। ’ এসময়টায় নিজেকে বড় স্বার্থপর বলে মনে হলো আমার।

অনন্ত এয়ারপোর্টের দরকারি কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত ; বোঝা যায় নিয়মিত প্লেনে যাতায়াতের অভ্যেস রয়েছে ওর। ত্বড়িৎ গতিতে নিজের কাজগুলো সেরে ফেলে অনন্ত এসে আমার সামনে দাঁড়াল। মলিন মুখ; চোখ দুটো ছলছল।
‘এবার বিদায় দাও বন্ধু। আমার আর কোনও খেদ নেই মনে। ’
‘আমারও। বন্ধু, কবে দেখা হচ্ছে ফের?’

এ প্রশ্নে অনন্ত আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে  রইল। হয়ত এ প্রশ্নের যুঁৎসই জবাব কী হবে তা-ই ভাবছে মনে মনে।

কিন্তু একটু পর আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরে ছেলেমানুষের মত হু-হু করে কেঁদে উঠল অনন্ত। সব হারিয়ে গেলে মানুষ যেভাবে কাঁদে, ওর কান্নার রকম ঠিক সেই। আমি হতচকিত, হতভম্ব।

‘কী হলো তোর বন্ধু? কোলকাতা-ঢাকা মাত্র এক ঘণ্টার রাস্তা। তুই এমন ভেঙে পড়ছিস ক্যান? কী হলো?’—আমি ওর ভেতর আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি।

কিন্তু কিছুতেই ওর কান্না থামতে চাইছে না। ওর চশমা কান্নার ঝাপটায় ঘোলা দেখাচ্ছে; পোড়-খাওয়া তামাটে চেহারা বর্ষার মাটির মত অশ্রুজলে থৈ-থৈ। পাশ দিয়ে যারা যাচ্ছে সবাই তাকাচ্ছে ওর আর আমার দিকে। হয়ত পরস্পরের সম্পর্কটি মেলাতে পারছে না, সেজন্যে। আমি ফের বলি, ‘এত ভেঙে পড়বার কী আছে? আমি তোকে দেখে আসব। কথা দিচ্ছি। ’
‘আমি আর বাঁচব না রে বন্ধু। ব্লাড-ক্যানসার আমার। ডাক্তার বলে দিয়েছে ছ’মাসের আয়ু। চারমাস খরচ করে ফেলেছি। আমার শেষ সময়ের সবচেয়ে ভালো সময়টা আমি তোর সঙ্গে কাটিয়ে গেলাম। কোনও ভুল করে থাকলে আমায় মাফ করে দিস দোস্ত। বিদায়। ’—বলেই আর দাঁড়াল না; সুইংডোর ঠেলে হনহন করে ভেতরে ঢুকে মাইক্রোবাসে চেপে বসল। এসময় আমার দিকে একবারও ফিরে তাকাল না অনন্ত।

ভেতরকার সুনীল হু-হু করে উঠছে বারবার। চেঁচিয়ে বললাম, ‘এটা কী হলো সুনীলদা? এটা কী হলো দাদা?’—একটু আগের অনন্তর মত হাউমাউ করে উঠলাম আমিও।

‘আমিও আমার কাজলদিঘিটা খুঁজে পাইনি রে। একটা হাজামজা ডোবা দেখেছিলাম সেখানে। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। ওটা দেখতে না পেলেই বরং ভালো হত। বিশ্বাস কর। ’—সুনীলের কণ্ঠস্বর বাষ্পরুদ্ধ।
‘তুমিও?’
‘হ্যা, আমিও। ’
সুনীলদার কাছ থেকে উত্তরটা পেয়ে এই প্রথম আমি টের পাচ্ছি আমার দিকে বড় বড় দুটো চোখ মেলে অনন্ত তাকিয়ে রয়েছে; সমস্ত মুখাবয়ব জুড়ে কান্না মেশানো হাসির ছটা; স্বভাবসুলভ বেসুরো গলায় ও গুনগুন করছে, আমিও পথের মত হারিয়ে  যাব, আমিও নদীর মত আসব না ফিরে আর, আসব না ফিরে কোনওদিন...



বাংলাদেশ সময়: ১৩২৯ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।