ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

পাঙ্গাসের চোখ | এনামুল রেজা

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১, ২০১৫
পাঙ্গাসের চোখ | এনামুল রেজা

ওইহেনে কেন যাইস? যাতি মানা কললাম না হারামি...
আদেশ যাকে করা হলো তার ভালো নাম নূরুল হক। বেহকের মত বাপ-মা থেকে পড়শী পাড়ার, সবাই সে নামটা ভেঙ্গে তাকে নুরা ডাকে।

আদতে সে নুরের মতই ঝলমলে। সারা অঙ্গে দিনের পর দিন ময়লা ধুলা জমেও ধবল সাদার দবদবা এতটুকু মলিন দেখায় না। সহদোরাগণের মাঝে নুরা মেজো। চার বোনের সে একমাত্র ভাই। সব মিলিয়ে ওর মা সমীরণের পাঁচজন ছেলেমেয়ে। আর সবকজনের গায়ের রঙ কালো এবং বাড়াবাড়ি রকমের কালো। নুরা কিভাবে এমন ফর্সা হলো তার রহস্য পরিষ্কার না। জন্মের পর প্রথম কয়েক মাস তো পাড়ার লোকে আড়চোখে চাইত। কানাঘুষাটা হতো প্রকাশ্যেই। সমীরণ, ঘটনা আসল চাইপা গেলি? বদুর পোলা এত্ত ধবলা হয় কেমনে? ছ’মাস যেতে না যেতেই নুরা তার বাপ বদরুল, যাকে সবাই বদু নামে বুলায়, সেই বদুর মত দেখতে লাগা শুরু করল।

তখন চারপাশের মানুষদের সুর বদলে গিয়েছিল আচানক। আরে আরে, এই পুলা বদুর না হইয়া যায় না। কিসব কুকথা তুমরা কইলা এতদিন? একদম বাপের লাহান দ্যাখতে হইসে।

বদু বরাবর নির্বিকার রকম লোক। কে কী বলল, কে কী করল এসব তার গায়ে আঁচ ফেলতে পারে না কখনও। সে নিজের ভালোটা খুব ভালো বোঝে। সমীরণ আরেক ব্যাডার লগে যদি শুইয়ে থাকে, শুলো। গতরের মদ্যি তো আর ল্যাখা থাহে না, এই সমীরণ তুই বদুর বান্দি। আর কারও লগে শুলি জাত চইলে যাবে! সে নিজেও কম যায় কিসে?

নুরার যেদিন জন্ম হলো তার আগের দিনই সে আরেকটা বিয়ে করে ফেলেছিল। কমলাপুর বস্তির বেদানাকে। তার মতে একদম হুরের মত্তন। টইস্যা বেদানার চাইতেও সরস মাল। সারা রাত তার নতুন শ্বশুরবাড়ির ছাপড়ার মাঝে সেই টইস্যা বেদানার রস আকণ্ঠ পান করেছিল বদু। পরদিন দুপুরে আগারগাঁও বস্তির কাছে এসে শুনল, তার বউ সমীরণ একটা পোলা বিয়াইছে। ধবলা চান্দের লাহান পোলা।

বদু ঘরে প্রবেশ করে দেখেছিল এতটুকুন, কাঁথা মোড়ানো নুরাকে। সমীরণ বলেছিল—নেন কোলে আলোর বাপ। আপনের পুলা। বদু বিরক্ত স্বরে জবাব দিয়েছিল—হুস, হুস! শুচি নাই তোর সুয়ালরে ধরবো কী!

সমীরণ সেদিন বোঝেনি। বদুও বলেনি কেন সে অশুচি। মূলত, তার নতুন বউয়ের বিছানা থেকে উঠে শুধু মুখ ধুয়ে, রাতের বেচে যাওয়া খিচুড়ি, ডিমভুনা খেয়ে চলে এসেছিল সে। গোসল করেনি তো!

বড় টনটনে ধর্মজ্ঞান বদুর। জুম্মার নামাজে সে কতবার শুনেছে—নবিজি বলেছেন সদা সর্বদা পবিত্র থাকিবে। পবিত্রতা কিসের যেন চাবি কাঠি বদুর মনে থাকে না। আবার সে এও শুনেছে, আল্লাপাক কুরানে বলেছেন—হে মানব সন্তান, তোমরা সীমা লংঘন করিও না। তবে মাঝে মাঝে সে সীমা লংঘন করে ফেলে। উপায় কী? তার মতে এ নাকি রক্তের টান। এজন্য সমীরণকেও সে ছাড় দিতে চায়। মনে মনে বলে—সব সমান সমান মওলা। দোজখ দিলে নুরার মায়ও যেন সেটা পায় তার ব্যবস্থাও বদু করতে চায়। তবে বদু জানে, মাগী তার সরেস। দুই নম্বরি নাই কোনও।

বদু আবার ঝাড়ি মারল নুরাকে। ওইহানে যাতি মানা কললাম, ফের যাইস? পুঙ্গার মদ্যি বাঁশ ঢুয়োই দিবানে হারামজাদা..

মুখ খারাপ সে করতে চায় না। কিন্তু এই নুরা আদতে হারামির হারামি। বিশাল কলিজা। এত সাহস কিভাবে তার ছেলে পেয়েছে, বদু ভেবে পায় না। সে নিজে খুবই ভিতু রকমের। কিন্তু নুরা অন্য জিনিস। গালিতে না তার কানে কথা সিঁধায়, না ধোলাইয়ে।

আজ শুক্রবার। নুরাকে নিয়ে কৃষি মার্কেটের দিকে এসেছে বদু। হাতে আচম্বিত কিছু নগদ নারায়ণ এসেছে। সেটার সদ্গতি সে করতে চায়। কতদিন পাঙ্গাস মাছ খাওয়া হয় না। এই বাজারে ভালো পাঙ্গাস মাছ ওঠে। গত সপ্তাহে সে এসে দেখে গেছে। এত লোভ লাগল সেদিন। পাহাড় ভেঙ্গে লাভার উদ্‌গীরণের মত তার মুখবিবর অবশ করে সেদিন এমন জ্বলের ধারা বেরুচ্ছিল। ভদ্র সমাজে এ বড়ো অসামাজিক হতে পারে, বদুদের সমাজে এ নৈমিত্তিক। কিন্তু বরাবরের মত সেদিনটাতেও হাত খালি ছিল তার। আজ অন্য কথা।

ভালো-মন্দ খাওয়ার তেমন ঠিক নেই তাদের। অবশ্য নুরার মা শেষ বাজার থেকে ভেঙ্গে যাওয়া ডিম, পোকা ধরা সবজি এসব খুব কমদামে কেনে। কখনও বা মাংসের দোকানের জড়ো করা ছিঁট মাংস বা আধাপচন ধরা মাছ। আমিষ বঞ্চিত তারা এটা বলা যায় না।

দুইটা কুকুর রাস্তার একপাশে জোড়া লেগে আছে। নুরা বারবার সেদিক চলে যেতে চায়। তার শিশুমন কারণ খোঁজে ব্যাপারটার। কুকুর দুটো এমন আজব ভাবে জোড়া লাগিসে কিসির জন্যি? তার মনে পর্বতসমান কৌতূহল। কিন্তু তার বাপ বড়ো বেরসিক। নুরা ছোট একটা ইঁটের টুকরা নিয়ে কুকুর দুইটার দিকে ছুঁড়ে মারে। রাস্তায় যেতে যেতে অনেকেই এ বেওয়ারিশ নাগরিক প্রাণী দুটির দিকে তাকাচ্ছে। কলেজ পড়ুয়া দুই তরুণী রিকশা করে যেতে যেতে বলে—অই সামিরা, দেখ দেখ.. রিকশা দ্রুত গতিতে পাশ কাটায়। সামিরা মেয়েটি কী বলল সেটি আর শোনা যায় না।
নুরা আরেকটা ইঁটের টুকরা ছুঁড়ে মারল।
কেউ কেউ.. কেউ কেউ.. এই রকমের আওয়াজ তুলে কুকুর দুটি সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। তবু তাদের মৈথুনে ভাঁটা পড়ে না। বদু ঠাস করে নুরার মাথায় চাঁটি মারে একটা। শুয়োরের বাচ্চা! মানা কল্লি কানে যায় না কতা?

দুইশ’ টাকা দিয়ে বদু সাড়ে তিন কেজি ওজনের একটা পাঙ্গাস মাছ কিনে ফেলল। মাছ ওয়ালা বলেছে টাটকা নদীর পাঙ্গাস। বদু মনে করেনি তার কোনও জবাব দেওয়া উচিত। সে মাছের চেহারা দেখেই বুঝেছে, চাষের পাঙ্গাস। তাদের বড় গাঙ্গের পাঙ্গাস সে তো কম দেখেনি। চাষের কোনটা আর কোনটা নদের—চেহারা দেখে সে বলে দিতে পারে। আহা কী মধুর ছিল বদরপুরের সেই দিনগুলো! নদীর ভাঙ্গন আজ কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে তাদের!

বদুর লুঙ্গির গাঁটে এখনও শ’ দেড়েক টাকা আছে। কৃষি মার্কেট থেকে বের হয়ে তারা দেখল—অবলা প্রাণী দুটোর জোড়া ছুটেছে। নুরা ফিক করে হেঁসে দিল। আব্বা জোড়া ছুটিসে.. হিহি..

বদু বিরক্ত হলো। তার ছেলেটা শয়তানের হাড্ডি দিয়ে তৈরি যেন। তিনবেলা এরে মারের উপরে রাখা গেলে কাজে দিত। খানিক আগে সে এত বড় একটা মাছ কিনল, সেইডে নিয়ে শয়তান সুয়ালের নজর নাই? সব নজর ওই কুত্তার দিকে? হারামির হারামি!

পরিবারটির দিনকাল যায় গুলির মতন। সমীরণ সিটি করপোরেশনের ঝাড়ুদার। স্থায়ী চাকরি না। তার পরিচিত এক খালার বদৌলতে মাঝে সাঝে সে ডাক পায়। পঞ্চাশ, একশ’—কোনও কোনদিন বা দেড়শ’ও হাতে আসে। সারা মাস যা কামাই হয় সংসার চলতে চায় না। নিজের ভাতারকে নিয়ে একসময় তার মনে বিশাল রকম হতাশা ছিল। কোনও কাজ কর্ম সে করে না কখনও। লোক মুখে শোনা যায় এখানে সেখানে মিলিয়ে সারা শহরে নাকি দুতিনটা আরও বউ আছে বদুর। সমীরণ যেটুকু জানে, সেটুকুই সে বিশ্বাস করে।

বদু ঘরে ফিরল মাছ নিয়ে। ঘর বলা ভুল। টিনের ছাপড়া। দরজা হাট করে খোলা। ব্যাপার কী? আলো আজ কামে যায় নাই নাকি? কাছের এক কারচুপির কারখানায় কাজ করে আলো। মাঝে মাঝে স্ত্রী ভাগ্যে, কন্যা ভাগ্যে মনটা প্রসন্ন হয়ে ওঠে বদুর। কাজ কাম সে করে না ঠিক। কিন্তু তিনবেলা পেট পুরে খায়। আবার এটাও বজায় থাকে যে—সে এই সংসারের কর্তা!

বেদানা মাগীর কথা ভাবলে আজও তার খারাপ লাগে। বিয়ের এক মাসের মাথায় বদু একদিন টের পেল—বেদানার পেট কেমন জানি উঁচু লাগে। হাঁটাচলা কেমন ধীর। এক মাসের নতুন বউ তার পেট উঁচু কিভাবে হয়? ব্যাপার কী? ব্যাপার পরবর্তী কয়েক দিনের মাঝেই প্রকাশিত হয়েছিল। যে বাচ্চা বেদানার পেটে, সেটি বদুর ছিল না। কার ছিল বদু জানতেও চায়নি। খুব এক দুঃখ পেয়েছে এমন ভাব নিয়ে সে ওদিন চলে এসেছিল কমলাপুর থেকে। আসার আগে অবশ্য ছাপড়ার লুকানো জায়গা থেকে লুকিয়ে হাজার তিনেক টাকা সরিয়ে নিতে ভুল করেনি। বেদানার জমানো টাকা। তার ক্ষতি বিশেষ হয়নি। সে ওই রাতটা কাটিয়ে দিয়েছিল চন্দ্রিমা উদ্যানের কোনও এক অন্ধকার গাছের নিচের নির্জনতায়।

জীবনে তারপর থেকে আর কোনওদিন বেদানামুখো হয়নি বদু। আচ্ছা, বেদানা কি আজও তাকে খুঁইজে বেড়ায় নাকি? মাঝে মাঝে সামঞ্জস্যহীন এক উদাসীনতা গ্রাস করে তাকে।

দুই.
আলো যে বাসা থেকে পালিয়েছে এই খবর বদুকে তেমন বিস্মিত করতে পারে না। সে কি জানত এমন কিছু একটা এই মেয়ে করবে? কার সাথে পালিয়েছে এইটা সে জানে না। কারচুপি কারখানায় গিয়ে খবর নিতে হবে। অবশ্য খবর নিয়েও কিইবা লাভ আছে বদু বোঝে না। যাদের বদনে চুন কালিই চিরদিন প্রসাধনী, নতুন করে সেটা তাদের মানের হানি করার ক্ষমতা বিশেষ রাখে না। সমীরণ সারাটা দিন বিলাপ করে কাটাল। তার তো আরও তিনটা মেয়ে আছে। গোলাপি নুরার চাইতে মোটে বছর দুয়েকের ছোট। তিন-চার বছর পর সেও যদি এমন করে?

বদু ঘরের বায়রে বেরিয়েছিল সেই কখন! আজ আর ফিরবে না সে বাড়ি। মন উদাস হলেই সে তার রক্তে চিরচেনা এক বন্যতা টের পায়। সস্তা উপায় খুঁজে ফেরে রাতের নাগরিক অরণ্যে। রাতের নগরী তো অরণ্যই। তার মত আরও কত বুনো পশুরা যে ঘোরে ফেরে! শিকার আর শিকারীর ব্যস্ততা বাড়ে—একে অপরের তরে। এও আরেক জীবন হয়ত বা.. আজ বদুর হাতে শ’ দেড়েক টাকা আছে। সমীরণের গোপন জায়গা থেকে গোপনে সরানো টাকা। পাঙ্গাস মাছটা রান্না হওয়ার ফুরসত পায়নি। পঁচে গন্ধ বেরুচ্ছিল। প্রাণহীন চোখ জোড়ায় কোনও অনুযোগ ছিল না।

তিন.
বর্ষার মেঘলা এক দিন। সেই সাত সকাল থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পেছন দিকের এই জায়গাটায় চারপাঁচ জন ছেলেমেয়ে মিলে হল্লা করছিল। এদের কারও বয়সই ছ-সাত বছরের উপরে না। এই দলে নুরা আছে, নুরার তিন বোন আছে। জায়গাটা ডোবা মতন, চারপাশে ময়লার স্তূপ, বর্ষার পানি জমে প্যাচপ্যাচে হয়ে আছে। আশপাশে কয়েকটা কলাগাছও আছে। নুরার তিন বোন পঁচা ডোবাতে পাঁকের ওপর মনের আনন্দে লাফাচ্ছে। কোয়ার্টারের কতগুলি হাঁসমুরগিও সেই পাঁক হাতড়ে হাতড়ে কী যেন খুঁজতে থাকে। ধবলা নুরা আর তার কালো বোনদের পরোয়া করে না তারা।

সকাল থেকেই কারও পেটে কিছু পড়েনি। কিন্তু সেটা নিয়ে এই মিসকিন শিশুগুলির মনে কোনও চিন্তা আছে এরকম মনে হয় না। এমন সময় বৃষ্টি নামে আকাশ ভেঙ্গে। ধবলা নুরা তার তিন বোনকে নিয়ে দৌড়াতে থাকে। কোথায় গিয়ে উঠবে তারা?

জীবনের এই খণ্ডচিত্রগুলির মাঝখানে আমাদের গল্পের শেষ হয় কখনও। আবার এগুলির মাঝেই গল্পের শুরু। আকাশের মেঘমালা সে কথা বোঝে না। সে শুধু ঝরে চলে বৃষ্টি হয়ে, অবিরাম আর অবিরাম।



বাংলাদেশ সময়: ১৫২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।