ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আহমদ ছফার প্রার্থনা : মানুষ ও নিসর্গ ০১

সাখাওয়াত টিপু | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১০
আহমদ ছফার প্রার্থনা : মানুষ ও নিসর্গ ০১

কৈফিয়ত

পাছে লোকে কবি বলে
এই ভয়ে
বহুদিন কবিতা লিখিনি।
উহারা অকর্মা জীব
লাগে না সংসারে কাজে
অনর্থক বাড়ায় ঝামেলা।


ভীষণ একরোখা চিত্ত
গ্রানিটের মতন কঠিন,
জেগে থাকে নিশিদিন
আকাশের স্তবে কাটে বেলা।
কী আস্পর্ধা,
সদর্পে ঘোষণা করে
গোধূলি গেলাস ভরে
নীলিমাকে করবে নাকি পান।
কুপথ্যে অরুচি নেই
মজে থাকে নেশা ভাঙে
চঞ্চল মেজাজ
ঠিক নেই কখন কি করে।
কবিদের ঘর নেই
ঘরেতে ঘরণী নেই
নড়বড়ে তক্তপোষে চামচিকা উড়ে।
সমাজ করুণা করে,
কেউ কেউ কখনো-সখনো
আহ্লাদে বাজিয়ে পিঠ
দন্তপাটি ব্যক্ত করে বলে
বাহা বাহা বেশ বেশ
এই তো লিখেছো তুমি
আনকোরা একখানি উজ্জ্বল সনেট।
ফিনফিনে প্রশংসা শুনে
চঞ্চলিত প্রাণ
অথবা নিন্দার হুলে
হৃদয়ের বিরস সঙ্গীত
যেন ঝরে প্রান্তরের পথহারা হাওয়া।
শব্দ চরিয়ে বাঁচে
শব্দমন্ত্রে প্রাণ
বংশীরব শুনে নাচে যেমন সাপিনী।
নরম নারীর মত শব্দের জঙ্ঘায়
বুলোয় ব্যাকুল হাত
ডুবুরির মত ডুবে অগাধ সলিলে;
অকান্ত বেড়ায় খুঁজে সারা দিনমান
কোথায় শব্দের স্তন, পুঞ্জীভূত ননী
সেই আকাক্সিত তীর্থ তনুর গৌরব।
কোন্ গৃহে দিব্যি শুয়ে সুখে নিদ্রা যায়
জাতিস্মর অগ্নিবর্ণ শব্দের হৃদয়।
শুধুই খোঁজাই সার
অর্থহীন নিছক খ্যাপানো
দৃষ্টিতে পড়ে না ধরা পরশ পাথর।
এই ব্যথা বুকে নিয়ে কবিকুল মরে
যেন লোক লোচনের অগোচরে ঝরে
আলোলাগা একবিন্দু তরল শিশির।
ইত্যাকার পরিণতি ভেবে আমি
বহুদিন কবিতা লিখিনি।
            (ছফা ২০০৮[ক])

জীবন জীবনের ভিতর হইতে এমন অপর কিছুর রফাদফা করিতেছে, খোদ জ্ঞানের কাছে, যাহা জীবনের ঐক্য অথবা নবজন্ম হইয়া বিরাজ করিতে পারে।
-ফ্রিদরিক হেগেল (১৯৭৭: ১০৯)


সেও এক ইসাপূর্ব শতাব্দীর কথা। চীনদেশের ছু রাজ্যে জন্মিয়াছিলেন দুনিয়াজাদা পণ্ডিত লাও-ৎস। শুদ্ধ জীবনের নীতিতে শাস্ত্র করিয়া আজ অব্দি বাঁচিয়া আছেন তিনি। আপন নামে, পরের বাজারে চালু তাঁহার কেতাবের নাম লাও-ৎস (বর্তমানে তাও তে চিং নামে পরিচিত)। জীবন নীতিশাস্ত্রের কেতাবে লাও-ৎস বলিতেছেন, ‘মরার পর যার ধ্বংস নাই, তিনিই দীর্ঘায়ু। ’ (লাও-ৎস ২০০৭: ৩৩) প্রশ্ন উঠিতে পারে, দেহ বিগত হইলে জগৎ সংসারে কী আর আগত থাকে? পহিলা বলা যায়, দেহ গত হইলে যাহা থাকে তাহার নামই নামপদ। আর নাম পদে পদে ডাকিলে হয় তাহার পরপদ। ছু রাজ্যের বাসিন্দা লাও-ৎসের ছুতা ধরিয়া আমরা বলিতেছি, মরিবার পর যাহা বাঁচিয়া থাকে তাহা নিগূঢ় কথা। নিগূঢ় কথা মানে গুরু কথা নহে, মানে কথার গুরু। ইহাই পুরাণকথার নতুন নিয়ম। লোকে যাহাকে বলিতেছে মিথ ওরফে পুরাণ।
 
ফরাসি বাড়ির ভাবুক রলাঁ বার্থ তাঁহার পুরাণকথামালা বহিতে প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন, ‘কলিকালে “মিথ” ওরফে পুরাণ কি জিনিস?’ জবাবে বার্থ নিজেই বলিতেছেন, ইহা ‘এক ধরনের পদ। ’ (বার্থ ২০০০: ১০৯) বার্তের পদে খানিকটা ফাঁক আছে। আর আছে ফোকর। ফাঁকের নাম সত্যের বাড়া আর ফোকরের নাম মিথ্যার কম। জিজ্ঞাসা জাগিতেছে, ধরন এক হইলে কি পদ এক হইবে? হালকা চালে কহিলে, তাহা হইবে না। কেননা নামপদ খালি খালি পদ নহে। পদের অর্থ তাহাকে বামপদও বানাইয়া ছাড়ে। বান্দার নাম ভাঙাইবার পর তো পুরাণকথা ফুটিতেছে নতুন কথা রূপে। কেননা কথা যদি পদ হয় তাহাতে তাহার পদাবলিও থাকিতেছে। আর পদের পদাবলিতে বিরাজ করিতেছে নানা অর্থের ধরন। ফলে বার্তের মিথের ধারণাখানি খানিক খাটো অর্থে পর্যবসিত। তাহার পরও কথা থাকিতেছে। পুরাণকথার নতুন রূপ কিভাবে ফলে?

বঙ্গদেশে আহমদ ছফা নামে একজন পণ্ডিত জন্মিয়াছিলেন। ছফার জীবদ্দশায় কাহিনীখানি সম্প্রচার করিয়াছিলেন তাঁহার সাক্ষাৎ শিষ্য। শিষ্যের ভাষ্য মোতাবেক, একদিন সকালে শিষ্য ছফার বাংলামটরের চিলেকোঠায় হাজির হইয়াছিলেন। ছফা বারান্দায় বসিয়া আছেন। সামনে রুটির থালা। ছফা রুটি ছিঁড়িয়া টুকরা টুকরা করিতেছেন। টুকরা টুকরা রুটি চিলেকোঠার পুবদিকের ছাদে ছুড়িয়া ফেলিতেছেন। আর ডাকিতেছেন তু তু তু তু করিয়া।

এ সময় একজোড়া চড়–ই আসিয়া খাবারের উপর হুমড়ি খাইল। চড়–ইজোড়া খাবারের দখল লইতে কামড়া-কামড়ি করিতে লাগিল। এহেন দৃশ্য দেখিয়া ছফা শিষ্যকে জিজ্ঞাসিলেন, আচ্ছা পাখিজোড়া খাবার লইয়া সংঘাতে মাতিল কেন?
শিষ্যের জবাব, নিশ্চয়ই ইহারা ক্ষুধার্ত।
ছফা বলিলেন, না, না, না, নারী পাখিটা না পুরুষ পাখিটারে খাইতে দিতেছে না।
শিষ্য বলিল, কেন?
উত্তরে ছফা, নারীবাদী পাখি।
শিষ্যের প্রশ্ন, খাবারের দখল লইলেই কি নারীবাদী হয়?
ছফার জবাব, নারী পাখি বাচ্চা ফুটাইয়াছে তো, তাই। তাহার লাগিয়া সে খাবারের দখল লইতে মত্ত।
শিষ্য বলিল, সাংঘাতিক ঘটনা!
ছফা বলিলেন, দেখো আমার কাছে দুইটা পাখিই সমান। খাবার তো দিলাম দুইটারে।
আমরা কাহিনীখানি পাঠকের সামনে তুলিলাম। দেখি মুখে মুখে তাহার কি অর্থ দাঁড়ায়। তবে ভরসার কথা, ইহা লইয়া তত্ত্ব করিলে অর্থের সন্ধান পাওয়া যাইতে পারে।

আশ্চর্যজনক হইলেও সত্য, আহমদ ছফার গল্পখানি যত না গল্প, তাহার অধিক প্রাণ। জীবন সাধনার এহেন দৃষ্টান্ত সহজে নিঃশেষ হয় কি? ছফা এক সাক্ষাৎকারে বলিতেছেন, ‘আমি একটা ইতিহাসের ভিতর থেকে উঠে এসেছি। ’ (ছফা ১৯৯৬: ১৬) খোদ ইতিহাসের ভিতরের উত্থান, সেও এক ইতিহাস। দেহ অবসানের পর ছফা কি গত হইয়াছেন? না, তাহা হইবে কেন? ছফার চিন্তা তো আগত। উত্তর আগায় নহে, গোড়ায়।

ছফার ইতিহাসের নাম ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’। আমরা ইহার নাম দিয়াছি মানুষ ও নিসর্গলীলা। ছফার প্রার্থনা:

আমার কর্ষিত ক্ষেত্রে প্রবল স্ফুরণ
চেয়ে দেখো তরুরাজ শুদ্ধ অঙ্কুরণ।
অমৃতে আকাক্সা রেখে যতোদূর যাই
তোমার অমর শিশু সযত্নে ফলাই।
পিতামহ বনস্পতি;
বিনীত সন্তানে তুমি দাও এই বর
সূক্ষ্ম শরীর ধরে এই মাঠে
যেনো আমি বেঁচে থাকি অনেক বছর।
        (ছফা ২০০০: ৩১)

লাও-ৎস কথিত চরণের যদি অর্থগৌরব হয়, ছফার বাঁচিয়া থাকিবার প্রার্থনায়ও গৌরব আছে। এ গৌরব দেশমাতার, এ গৌরব সমাজের, এ গৌরব শ্রেণীহীন রাষ্ট্রের, এ গৌরব জীবন সাধনার।

জাত বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার প্রার্থনা যদি সত্য হয় তো বলিতে হইবে, মহাপ্রয়াণের পরও আশ্চর্যজনকভাবে দীর্ঘায়ু হইতেছেন তিনি। ছফার এহেন দীর্ঘায়ুর ফল বঙ্গদেশে পোষা বুদ্ধিজীবীদের আয়ু স্বল্প করিয়া তুলিবে নিশ্চয়। তাহার কারণ, বাংলাদেশের পোষা বুদ্ধিজীবীরা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের খোদকারী করিতে ওস্তাদ।


জাঁ জাক রুসো ৩৭ বছর বয়সে দিজোঁ আকাদেমির রচনা প্রতিযোগিতায় সামিল হইয়াছিলেন। শিল্প ও বিজ্ঞানের শুদ্ধ রীতিনীতির প্রশ্নে রুসো বলিয়াছিলেন, ‘রীতিনীতির কথা ভাবিতে গেলে আদ্দিকালের রীতিনীতির সরলতার কথা না ভাবিয়া উপায় নাই। তাহাও এক অপরূপ কুল, প্রকৃতির হাতেই তাহা সজ্জিত। ’ (গ্রাৎসিয়ানস্কি গয়রহ, ১৯৮৭: ১৬৫) জিজ্ঞাসা করিতে দোষ নাই, রুসো গত হইবার (১৭৭৮) দুইশত বৎসর পর বাংলার মনীষী আহমদ ছফা একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনায় (১৯৭৭) মাতিলেন কেন? কি গ্রীষ্ম কি বর্ষায়, কি শরৎ কি হেমন্তে, কি শীত কি বসন্তে এহেন জিজ্ঞাসা জাগাই স্বাভাবিক। রুসো অভিযোগ করিতেছেন, ‘শিল্প ও বিজ্ঞান প্রকৃতিবিরোধী। আদমসন্তানের খাসলত হইতে বাঁচিবার বাসনায় তাহার উদ্ভব। ’ (গ্রাৎসিয়ানস্কি গয়রহ, ১৯৮৭: ১৬৫; ভাষা সামান্য পরিবর্তিত) রুসোর অভিযোগ যদি সত্যি হয় তো আমরাও দেখিব প্রকৃতির নিসর্গ। ওহে প্রবীণ বট, সেও এক আদ্দিকালের সরলতার কথা। অপরূপ কুলের জাতি। প্রকৃতি তাহাকে সাজাইয়া রাখিয়াছে জ্ঞাতি সম্বোধনে। অর্থবিদ্যা মতে, নিসর্গ মানে দান বা অর্পণ। জাতি মানে যাহা জন্ম দেয়। আর জ্ঞাতি মানেই তো মিলনকোঠা।

জনে জনে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, ছফা প্রণীত ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’ কেতাবখানি কী মাহাত্ম্য বহন করিতেছে? শুধু দেশ আর জাতির মাহাত্ম্য ইহাতে ভর করে নাই, অতীত হইতে বর্তমান, সমাজ হইতে রাষ্ট্রের মসনবি তাহাতে প্রোথিত। মহাকাব্যের আলামতে ছফা বলিতেছেন, ‘... কাব্য তরুটির অঙ্কুরণ মঞ্জুরণে একাধিক যোগাযোগ বর্তমান। ’ (ছফা ২০০০: ৫) পটভূমির গোড়ায় রহিয়াছে বাঙালি জাতির উত্থান, নবীন চেতনাবোধ, চিত্তের শান্তিনাশা বস্তু। মহাকাব্যের সাক্ষাৎ কারণ দেশের অনন্য প্রতিভাশালী চিত্রশিল্পী এস. এম. সুলতানের ‘নিসর্গ ও মানুষ’ চিত্রাবলির প্রদর্শনী। কাব্যে আবেগের বশে তিনি ‘চিত্তের শান্তিনাশা বস্তু’ নাশ করেন নাই। বরং গ্রামবাংলার নিসর্গের সরল চিত্তকে প্রসারিত করিয়াছেন জীবন সাধনায়। আর করিয়াছেন জীবন সংগ্রামের মর্মমধুর বন্দনা। বাংলা কবিতার ধর্মসভায় ইহা মামুলি ঘটনা নহে, আমুলি ঘটনা বটে। সরল বিদ্যায়, কেতাবের কেন্দ্রস্থলে ‘প্রবীণ বট’ বা দীর্ঘবৃরে প্রতিমা। কথিত বট কি খালি খালি বৃ? না, বট খালি খালি বৃ নহে, রূপকের ক্রিয়ায় ইহা নানা অর্থে ফলে। অর্থবিদ্যা মতে বট মানে বণ্টন। বটের অপর অর্থ বর্তমান থাকা। তাহা কী রূপে?

ইতিহাসে দেখা মিলিতেছে, কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ হইতে বাংলা পদাবলির বিস্তার ঘটিয়াছে। তাহা হইলে পদাবলি কি পদার্থ? পদাবলির কথা উঠিলে আগে ‘পদ’ কি বস্তু তাহা দেখা দরকার। পদকে শব্দ বলিলে হয়তো বলিতে হইবে পদ মানে ভাব। অপর অর্থে চরণ বা বাক্য। তবে বৈষ্ণব যুগে পদ্য বা গীতকেই বলা হইত পদ। আর পদ্যগুচ্ছ বা গীতমালাকে বলিত পদাবলি। এখন আর বৈষ্ণব পদাবলির যুগ নাই। নাই হইতেছে বাঙালি মুসলমানের হৃদয় হইতে বাহিত জারি, সারি, পুঁথি, মুর্শেদি আর গাজনের পদাবলি।

বাঙালি কি ‘চিত্তের শান্তিনাশা বস্তু’ নামক কীর্তি পদে পদে নাশ করে নাই? এখন চলিতেছে মৌলিক ভাবের শ্রাদ্ধের কাল। তাহার পদ দখল করিয়াছে আধুনিকতার বিকট রুচি। যে ‘রুচি’ মানুষ হইতে মানুষের বিচ্ছেদ (অর্থাৎ বিদেশ) ঘটাইতেছে। এও এক ‘এলিয়েন’ যুগ। আমরা ইহাকে ছপ্পর মারিতেছি ‘অবয়ী আধুনিকতা’ ওরফে ‘ঔপনিবেশিক কাঠামোর ফল’ বলিয়া। এখন আদম সন্তান ‘মানুষ’ না হইয়া হইতেছে ‘আলোকিত মানুষ’ বা ‘অতিকায় মানব’। পথ হারাইয়া কেবল শপথ শপথ করিতেছে সে।

জিজ্ঞাসা জাগে, পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ যেইখানে আদম সন্তানকে প্রভু আর দাসে পরিণত করিতেছে সেইখানে ‘আলোকিত মানুষ’ কি বস্তু? দাস মানে ‘মানুষ’ নহে, দাস মানে তো ‘ঊনমানুষ’। কথিত ঊনমানুষ প্রভুতে মন দিলেই ‘মানুষ’ হইয়া উঠিতে বাধ্য। কিন্তু মানুষ ছাড়িয়া আদমসন্তানকে ‘অতিকায় মানব’ বা ‘আলোকিত মানুষ’ হইতে হইবে কেন? তাহা হইলে মানুষ মালটা কি খাটো? বলা হইতেছে, আদম সন্তানের এখন আর ‘মানুষ’ হইলে চলিবে না। হইতে হইবে অভ্যস্ততার দাস ওরফে ‘আলোকিত মানুষ’ প্রকাশ বুর্জোয়া মানুষ। নয়া উপনিবেশবাদীদের ‘আলোকিত মানুষ’ নামক পদার্থের ঠেলাটা এমনি নিষ্ঠুর!

এহেন মুশকিলের গোড়ার কথা খানিকটা বলিয়াছেন মহামতি কার্ল মার্কস। শ্রীমতি আনেনকবের কাছে লেখা পত্রে তাহার ভাষ্য, ‘পাতি বুর্জোয়া তত্ত্ব-তালাশিদের ভুলের কারণ এই- তাহাদের নিকট ‘বুর্জোয়া মানুষ’ (ওরফে আলোকিত মানুষ) হইতেছে প্রত্যেক সমাজের একমাত্র সম্ভবপর ভিত্তি। তাহারা এমন সমাজের কল্পনাই করিতে পারে না যেইখানে মানুষ আর বুর্জোয়া নহে। ’ (উদ্ধৃত, রনো ২০০৭: ৬৮; ভাষা সামান্য পরিবর্তিত) প্রশ্ন জাগিতেছে, আলোকিত মানুষের নিষ্ঠুরতার গোড়া কোথায়? উত্তর মিলিতেছে ছফার কাব্যে:

শীর্ণ কান্তি বছর বিয়ায়
হস্তীর বিষ্ঠার মতো স্তূপাকার শতেক বছর
নিদ্রা যায় অচেতন মাটির উপর,
যেইখানে ইতিহাস করুণ গোঙায়
কুয়াশার মতো এসে
চুপিসারে ঘুমন্ত অতীত
অতর্কিতে আগামীরে খুন করে যায়।
        (ছফা ২০০০: ৬)

করুণের গোঙানি ইতিহাসের কোন পাতায়? ঔপনিবেশিক প্রভুর শাসন-শোষণের খেরোখাতায়? নির্যাতিত দাসের করুণ মুখের রক্তাক্ত আভায়? কেহ কেহ কহিতে পারেন- না না, তাহা হইবে কেন? উপনিবেশ তো এখন গায়ে গতরে নাই। গতরে তবে কি আছে? নয়া-ঔপনিবেশিক যুগে যাহা আছে তাহা মার্কিনি আব্বাজান নয় কি?
তো, ছফা বর্ণিত ঘুমন্ত অতীত কি? কুয়াশার মতো কাহারা আসিয়া অতর্কিতে আগামীরে খুন করিতেছে? এইখানে খুন অর্থে রক্তারক্তিও চলিতে পারে। কুয়াশার মতো যাহা আসে তাহা দেহহীন বা নয়া-উপনিবেশ। আর ঘুমন্ত অতীতের পরাকাষ্ঠা উপনিবেশের করালগ্রাসের অন্ধকারে জাতির ঘুমিয়ে পড়ার ইতিহাস। বাঙালি জাতি যে জাগে নাই, তাহা নহে। কিন্তু হস্তীর বিষ্ঠার মতো রোগবালাই যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়াছে এহেন রোগ-বালাইয়ের লণ কি? উত্তর মিলিতেছে গিনি বিসাউ ও সবুজ অন্তরীপ দ্বীপপুঞ্জের জাতীয় নেতা আমিলকার কাব্রালের রচনায়। ‘গিনির বিপ্লব: আফ্রিকার মানুষের সংগ্রাম’ রচনায় কাব্রালের কথা আমরা পড়িতেছি কলিকালে:

সাম্রাজ্যবাদের রীতিনীতি হইল ঘুমন্ত উপনিবেশের দেশে দেশে সাহায্যের কর্মনীতি সরণ করিয়া চলা। যাহাতে জাল বুর্জোয়া শ্রেণী তৈয়ার হয় আর জাগাইয়া রাখা হয় পাতি বুর্জোয়া সমাজের (বা মধ্যবিত্ত সমাজের) সম্ভাবনা। ইহারা সহায় হইবে বিপ্লবের গতিরোধ করিতে। (কাব্রাল ১৯৬৯: ৬৯)


লজ্জাজনক হইলেও সত্য, পাতি বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্তের গোড়াই তো এখন উন্নয়ন ব্যবসায়। এহেন উন্নয়ন ব্যবসার বড় ভাগীদার নয়া-সাম্রাজ্যবাদ নয় কি? সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলাকে একদা বলা হইত নদীমাতৃক দেশ। আর এখন দুখিনী বাংলার নাম হয়তো ‘এনজিওমাতৃক দেশ’। আজিকে হে প্রবীণ বট, তুমি ইতিহাসের কোন সাক্ষ্য বহন করিতেছ?

বাংলা সাহিত্যের নবরত্ন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘এয়ুরোপের তিন বছর’ বা ‘থ্রি ইয়ার্স ইন এয়ুরোপ’ বহির সমালোচনায় বলিতেছেন:

গুণবতী মাতার প্রতি পুত্রের যে স্নেহ, সে স্নেহ কোথায়? এই বঙ্গদেশের প্রতি সে স্নেহ কাহার আছে? সে স্নেহ কীসে হইবে? যে মনুষ্য জননীকে ‘স্বর্গাদপী গরীয়সী’ মনে করিতে না পারে, সে মনুষ্য মনুষ্য-মধ্যে হতভাগ্য। যে জাতি জন্মভূমিকে ‘স্বর্গাদপী গরীয়সী’ মনে করিতে না পারে, সে জাতি জাতি-মধ্যে হতভাগ্য। আমরা সেই হতভাগ্য জাতি বলিয়া রোদন করিলাম।                                                                                  (উদ্ধৃত, মজুমদার ১৯৯৫: ১৫)


আমাদের বিশ্বাস, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘হতভাগ্য জাতি বলিয়া’ রোদন করিবার দায়ভার আহমদ ছফা খানিকটা আপন কাঁধে লইয়াছেন। প্রবীণ বটই ইহার বড় সাক্ষী। ইতিহাসের দরজায় কড়া নাড়িয়া কবি নির্মম বাস্তবতায় নিজেকে ভাঙিতেছেন। ভাঙিয়া ভাঙিয়া নিজেকে নিজেই অপরূপ রূপে সৃজন করেন। নব সৃজনের সেই ভার ছফার বয়ানে:

যাদের কাছে আমি রক্তের ঋণে ঋণী
এবং যাদের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছি বলে গর্বিত।
সার্থক করো জন্ম আমার।
আমাকে পান করতে দাও বেদনার তীব্র হলাহল।
পূর্বসূরী স্রষ্টা পুরুষদের মতো
দহিত করো দুঃখের দহনে।
কঠিন করুণ খণ্ড খণ্ড নির্মম বাস্তবতার আঘাতে
আমাকে ভাঙো, আমাকে ছিন্ন ভিন্ন করো।
ভেঙে-ভেঙে নতুন করে সৃজন করো।
দাও এমন প্রাণ যা অনায়াসে নিতে পারে
স্বজনের সমস্ত দুঃখের ভার।
            (ছফা ২০০০: ২৬)


কেহ কেহ কহেন, বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কাল নাকি যৌগিক সাহিত্যের কাল। মৌলিক সাহিত্য ভাগের মা গঙ্গা পাইতেছে না। ভাগের মা গঙ্গা পাইতেছে কোথায়? গঙ্গায় যদি মীন না থাকে গঙ্গার তো তি নাই- গঙ্গা তো থাকিতেছে অন্তত। ক্ষতি তাহা হইলে কাহার? তি তো আদম সন্তানের। ক্ষতি প্রকৃতির, প্রাণবৈচিত্র্যের। কিন্তু গঙ্গায় যদি পানিপ্রবাহ না থাকে তবে তো গঙ্গা পদবাচ্য নদীর অস্তিত্বও নাই হইয়া পড়িবে। ভাগের মায়ের গঙ্গার অস্তিত্ব নাই হইয়া পড়িবার নামই তো আধুনিক বাংলা সাহিত্য। নয় কি?


উপনিবেশের করতল পাইয়াই জন্ম লইয়াছে আধুনিক বাংলা সাহিত্য। যে সাহিত্য আপন মাটির সহিত বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে, যে সাহিত্য সমাজের দ্বন্দ্বমুখর সঙ্কটের সুরাহা করে না, যে সাহিত্য নতুন চিন্তার জন্ম দেয় না, যে সাহিত্য সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না, যে সাহিত্য প্রকৃতির সহিত আনন্দযজ্ঞে লীলা করে না, যে সাহিত্য সদানন্দে রক্তের সহিত সম্বন্ধ করে না, যে সাহিত্য আগামীর স্বপ্নে মানুষকে কল্লোলিত করে না তাহাকে সাহিত্য বলা যায় কি? প্রশ্নখানি কেবল সাহিত্যের বেলায় নহে, শিল্পের বেলাও খাটে।

তো আধুনিকতা যদি সমাজের ভিতর হইতে স্ফূরিত হয়, তাহাতে সমাজ বিকাশের একটা পথ মেলে। আর যদি ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোর ফল হয় তাহাতে মেলে অবয়। বাংলার তিরিশি আধুনিকতা সেই ফসল নয় কি? বলিতে পারেন, অবয় আধুনিকতার বিলক্ষণ নহে, লক্ষণ বটে। তাহা হইলে অবয়ের লক্ষণ কি? ‘অবয়ের সংজ্ঞা’ রচনায় ছফার ভাষ্য:

একটি সমাজে যখন কোনোকিছু সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক নয়; সবটাই নকল এবং ভঙ্গি-সর্বস্বতায় পর্যবসিত হয়েছে, বুড়োরা চ্যাংড়ার মতো আচরণ করে, যুবকেরা প্রৌঢ়ত্বের ভান করে, শিশু-কিশোরেরা এঁচড়ে পেকে যায়, ধীমান পাঠক ইত্যাকার লণ বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে, ওই সমাজে ঝাঁকঝাঁক পঙ্গপালের মতো অবয় নখ-দাঁত মেলে আক্রমণ করতে ছুটে আসছে। (ছফা ২০০২: ১২)

আহমদ ছফার কথার পর অবয় লইয়া কথা বাড়াইতে চাহি না আর। শুদ্ধ প্রশ্ন তুলিব, আধুনিকতা-জারিত ব্যক্তি বা ‘আমি’ কি বস্তু? ব্যক্তি ‘আমি’ আদতে আত্মরতির ভোগব্যায়াম। ব্যক্তি আমি কিন্তু ‘তুমি’ আর ‘সে’ পদে লীন হইতে জানে না। জানে শুদ্ধ ব্যক্তিসর্বস্ব ভোগদখলের নৈরাশ্যের যোনি খুঁজিতে। ছফার বট লীন হইয়াছে আমি, তুমি আর সে পদে। ছফার ‘আমি’র মিলন ঘটিয়াছে ‘তোমা’তে। আর শেষ সর্বনাম ‘সে’ পদে ঢুকিয়া বলিতেছে প্রকৃতির স্বভাব বা আমরার ভাব। ছফা তাহাকে বলিতেছেন তরুর ভাষার অর্থ জানার গৌরব। খোদ একত্রে থাকিবারই ভাব। একত্রে থাকিতেছে কে? মানুষের সহিত মানুষ। মানুষের সহিত প্রকৃতি। তাই কি বলা হইতেছে ‘সাহিত্য’ মানে সহিত? সাহিত্যের অপর কোঠা সম্পর্ক উৎপাদন। কেমন সেই উৎপাদিত সম্পর্ক? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য অর্থে ‘মানবের সহিত থাকিবার ভাব, মানবকে স্পর্শ করা, মানবকে অনুভব’ করিবার কথা বলিতেছেন। (ঠাকুর ১৪১১: ১৭৭) রবি ঠাকুরের সাহিত্যের সংজ্ঞায় শুদ্ধ মানবই বর্তমান।

নিখিল সংসারে অপরাপর প্রাণীর ভিতরে ‘মানব’ এক ধরনের প্রজাতি। প্রাণজগতে বান্দা বা মানুষ শুদ্ধ মানুষের সহিত ভাব করিতেছে না। করিতেছে প্রকৃতির অপরাপর পদ ও পদার্থের সহিত ভাব। ইহাতে এক অর্থে মানুষের সহিত প্রকৃতির জীবনজ্ঞানের ভাব আর অপর অর্থে মানুষের সহিত প্রকৃতির বস্তুজ্ঞানের ভাব গড়িতেছে। তাই তো আহমদ ছফা রবি ঠাকুরের সাহিত্য সংজ্ঞার পাটাতনে বসিয়া সাহিত্য করেন নাই। ছফার সাহিত্যে সংজ্ঞা খানিকটা বাড়া। কেননা ইহা শেকড় বাহিয়া কাণ্ড, কাণ্ড বাহিয়া প্রকাণ্ড, প্রকাণ্ড বাহিয়া লতায়, লতা বাহিয়া পাতায় পাতায় বিস্তার লাভ করিয়াছে। ছফার পদাবলিতে:

আমি তোমার পাঠশালাতে
পাঠ নিয়েছি শব্দধ্বনির
রঙ লেগেছে চোখের তারায়
স্বাদ পেয়েছি কথার ননীর।
মর্মরিয়ে দখিন হাওয়া
পাতায় পাতায় ফোটায় বাণী
পরান মন উদাস করা
তরুর ভাষার অর্থ জানি।
    (ছফা ২০০০: ১৩)

[বাকি অংশ পড়ুন আগামী সপ্তাহে]

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২০৫৫, জুলাই ২৮, ২০১০  


বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad