ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

লাল ষনুমা নীল ষনুমার দেশে | আখতার মাহমুদ

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৫ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৫
লাল ষনুমা নীল ষনুমার দেশে | আখতার মাহমুদ

ঊনত্রিশ বছরের দামড়া হয়ে এমন বেআক্কেলের কাজ করেছি ভাবতেই নিজেকে ঝেড়ে লাথি কষাতে ইচ্ছে করল। এই গহীন বনে একা বেড়ানোর মতো গাধামি কী করে করলাম? এ কি আর বাড়ির পাশে বাগান যে গেলাম আর বেড়িয়ে আসলাম? এটা সুন্দরবন।

গাইড ছাড়া এক পা-ও ফেলা মুশকিল। সব রাগ পড়ল গিয়ে জব্বারের ওপর। হারামজাদা আর্কিওলজিস্ট কোত্থেকে একটা ম্যাপ যোগাড় করেছে। ওটা অনুসরণ করে গেলে নাকি সুন্দরবনেই অতি প্রাচীন সভ্যতার দেখা মিলবে। একবার বের করতে পারলে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাব। আজ চারদিন হয় বনে বনে ঘুরছি বদমাশটার পিছু পিছু। গাইড পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে গেছে। বনের ভেতর এতদূর নাকি তার দাদার দাদাও আসেনি। কোন কুক্ষণে যে অসুরটার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল! একা একা ঘুরতে বেরিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছি। এলোমেলো অনেকক্ষণ হাঁটলাম। কিন্তু কোন পথে এসেছি সেটা ঠাউর করতে পারলাম না। যেদিকেই যাই সব দেখতে একইরকম লাগে। হতাশ হয়ে একট প্রকাণ্ড গাছের গুঁড়িতে বসে ইতিকর্তব্য ভাবলাম। দিনের আলো মরে আসছে। এখানে এভাবে বসে থাকলে কোনও গতি হবে না বরং বাঘের পেটে যেতে হবে। খানিক পরেই উঠে পড়ে হাঁটতে শুরু করলাম একটা দিক ঠিক করে। কপালে যা থাকে থাকুক। হাঁটতে হাঁটতেই রাত হয়ে এলো। হাতে ঘড়ি নেই। বনে মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করবে না ভেবে মোবাইলও আনিনি সাথে। তাই কতক্ষণ হেঁটেছি বুঝতে পারলাম না। একসময় ক্লান্ত হয়ে গোগ্রাসে বিস্বাদ স্যান্ডউইচ গিললাম। পানির ক্যান্টিন থেকে পানি খেলাম পেট পুরে। তারপর রাত কাটাবার জন্যে অনেক কষ্টে একটা গাছে উঠে চওড়া ডালের সাথে নিজেকে বেঁধে নিলাম।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুম ভাঙল মানুষের গলার আওয়াজে। খুশি হয়ে বাঁধন খুলে উঠে বসলাম। নিচে তাকিয়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আমার। পনের-বিশেক গাধা আমি যে গাছটাতে আছি তার চারদিকে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। কে যেন বলে উঠল, ‘এটা বানর নয়। দেখে মনে হচ্ছে গাধার মতন কিছু একটা। ’

আরেকজন বলে উঠল, ‘না না বানরই। দেখছো না কেমন পা ঝুলিয়ে বসে আছে? এটা নিশ্চই বিরল প্রজাতির কোনও বানর। ’

চমকে উঠে চারদিকে তাকালাম। নিশ্চই মানুষ আছে! আবার কেউ একজন বলল, ‘বানরটা আশেপাশে কি দেখছে?’

কী ভূতুড়ে কাণ্ডরে বাবা! মানুষ নেই অথচ মানুষের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। নিচে তাকালাম আবার, গাধাগুলো একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। একটি বড় আকারের গাধা আমার দিকে তাকিয়ে উঁচু কান নাড়িয়ে দাঁত খিঁচিয়ে স্পষ্ট মানুষের গলায় বলল, ‘ওই গাধা কী দেখস এদিক-ওদিক?’

গাধা কথা বলছে মানুষের ভাষায়! বোঁ করে মাথা চক্কর দিয়ে উঠল, বুঝতে পারলাম জ্ঞান হারাচ্ছি। জ্ঞান হারানোর আগে এটুকু বুঝলাম, গাছ থেকে কোনও গাধার পিঠের পড়েছি আর গাধাটা মরণ চিৎকার দিয়ে উঠেছে।

জ্ঞান ফিরে পাবার পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা খাঁচায়। লতা-পাতা গাছ দিয়ে তৈরি খাঁচাটা বেশ অদ্ভুত। বিশাল গোলাকার একটা ঝুঁড়ির মতো। খাঁচার বাইরে অগণিত গাধার ভীড়। চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলছে ওরা পরস্পরের সাথে। আমি কি স্বপ্ন দেখছি না অন্যকিছু? নানান আকারের গাধা খাঁচার সামনে জড়ো হয়ে ড্যাবড্যাব করে দেখছে আমাকে। যেন আমি চিড়িয়াখানার কোনও প্রাণী। হঠাৎই গাধার দল সুশৃঙ্খলভাবে দুপাশে সরে গেল। অবাক হয়ে দেখলাম তাগড়া তাগড়া আটটা গাধা লাল বর্ণের বেশ বুড়ো একটা গাধাকে মাঝখানে রেখে এগিয়ে আসছে, অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাউকে পুলিশ এসকর্ট করে নিয়ে আসার মতন। লাল গাধাটি তীব্র দৃষ্টি ফেলে অনেক্ষণ দেখল আমাকে। তারপর সামনে জড়ো হওয়া গাধাদের উদ্দেশ্যে ভরাট গলায় বলল, ‘এটা গাধাই। এরা ভীষণ পাজি হয়। ’

দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললাম, ‘আমি গাধা নই গাধার দল, আমি মানুষ!’

লাল বর্ণের গাধাটি চোখ লাল করে চারিদিকে চেয়ে হুংকার দিয়ে উঠল, ‘কে কথা বলে?’

আমি পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়ে বললাম, ‘ওই গাধার বাচ্চা গাধা, আমি কথা বলি, আমি আমি!’

লাল গাধাটির মনে হলো যেন চোখ উল্টে পড়ে যাবে। দাঁত কপাটি লেগে গেছে তার। ‘ত্ব..তুত....তুমি কথা বলছো!’

বোঝা গেল সে চরম ভয় পেয়েছে। অন্যান্য গাধাদের এক অংশ লেজ দেখিয়ে ঝেড়ে দৌড় দিয়েছে। আর বাকিরা দাঁড়িয়ে ঠকঠক কাঁপছে। লাল গাধাকে এসকর্ট করে নিয়ে আসা গাধাগুলো ভয় পেয়েছে কিনা বুঝলাম না তবে চার পা পিছিয়ে গেল ওরা।

আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘আমি তোমাদের ভাষায় কথা বলছি না, বরং তোমরাই আমার ভাষায় কথা বলছো। কী ঘটছে এসব? আমাকে তোমরা কোথায় এনেছো?’

লাল গাধা ভয় সামলে নিয়ে বলল, ‘তুমি আবোল-তাবোল বকছো। তুমি আমাদের ষনুমাদের দেশে অনুপ্রবেশ করেছ। তুমি গাছ থেকে লাফিয়ে আমার দেশের একজন সুশীল ষনুমাকে আহত করেছ। তুমি এখন আমাদের বন্দী। ’

‘আমি ইচ্ছে করে লাফিয়ে পড়িনি, জ্ঞান হারিয়ে গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। ’

লাল গাধা ডানে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘তুমি ইচ্ছে করেই লাফিয়ে পড়েছো। তুমি নিশ্চই নীল ষনুমার নতুন চাল। আমাদের ষনুমাদের দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে তোমাকে এনেছে, কিন্তু আমি লাল ষনুমা বেঁচে থাকতে নীল ষনুমার কোনও চক্রান্ত সফল হতে দেব না। আমার বাবাও দেয়নি, আমিও দেব না। ’ বলেই চারপায়ে গটগট করে ফিরে গেল।

আমার সব ভজঘট পাকিয়ে গেল। লাল ষনুমা, নীল ষনুমা? কী আজগুবি দুনিয়ায় এসে পড়লাম রে বাবা।



দেখতে দেখতে সাতদিন কেটে গেল। আমাকে খাঁচা থেকে মুক্ত করা হয়নি। এসময়টাতে অংডং নামে এক গাধার সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেললাম। তার কাছ থেকে ষনুমাদের দেশ সম্পর্কে খুঁটিনাটি অনেক বিষয় জানলাম। এরা ঠিক গাধা নয়, গাধার মতো দেখতে বিচিত্র এক প্রাণী। এরা মানুষের ভাষায় কথা বলে, এবং এদের রীতিনীতি চালচলন প্রায় মানুষের মতোই। এরা সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে। কেউ সমাজের আইন ভঙ্গ করলে শাস্তি দেয়া হয়। ওই শাস্তি দেয়ার বিষয়টা নির্ধারণ করে লাল গাধা। তাকে ষনুমাদের বর্তমান সরকারও বলা যেতে পারে। এখানে দুটো বড় দল আছে—লাল ষনুমার দল, নীল ষনুমার দল। আরও ছোটখাট কিছু দল-উপদলও আছে। যাদের, আমার বন্ধু গাধার ভাষ্যমতে, কেউ পাত্তা দেয় না।

প্রতি বছর ভোটের মতো একটা ব্যাপারের মধ্য দিয়ে শাসক নির্বাচিত হয়। যে জয়ী হয় সে লাল রঙে গোসল করে নিজের রং বদলে নেয়। আবার পরাজিত জন নীল রঙে গোসল করে নীল ষনুমা হয়ে যায়। তবে যে পরাজিত হয় সে সবসময় হট্টগোল আর ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করে। কখনও কখনও নিরীহ ষনুমাদের ওপর হামলা করে নতুন নির্বাচনের দাবি তোলে। কিন্তু যে একবার লাল ষনুমা হয়ে যায় সে কখনওই বছর ঘোরার আগে ক্ষমতা ছেড়ে দেয় না। এতে কত নিরীহ ষনুমারা বিপদে পড়ল বা মারা গেল সেটা তার মাথা ব্যথার বিষয় নয়। যুগ যুগ ধরে এ নিয়ম চলে আসছে। লাল ষনুমা, নীল ষনুমার মূল কাজ হলো একে অপরের নিন্দা করে বেড়ানো আর নিজ নিজ বংশের মর্যাদা বড় করে দেখানো। নীল ষনুমা একদিন এসে দলবল সমেত আমার খাঁচার সামনে মিছিল করে গেছে গলা ফাটিয়ে, “মানি না! মানব না। লাল ষনুমার শিয়ালী বুদ্ধি চর্চা বন্ধ করতে হবে... করতে হবে! বিজাতীয় প্রাণীকে দেশে রাখা চলবে না... চলবে না! লাল ষনুমাকে কেউ চায় না..... চায় না! লাল ষনুমা ভুয়া... ভুয়া!”

কেউই “লাল ষনুমা” হবার আগে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা রাখে না। মজার ব্যাপার হলো, কোনও ষনুমাই পরপর দুবার লাল ষনুমা হতে পারে না। সাধারণ ষনুমারা একজনকে জিতিয়ে দেবার পর যখন দেখে সব সেই আগের মতোই চলছে, তখন তারা পরেরবার অন্যজনকে জয়ী করে।

একদিন অংডং আমার কাছে তার ক্ষোভ জানাল, “সুখ নাইরে ভাই। আগের মতো ঘাস আর নাই। অথচ আগে কি তাজা তাজা ঘাস খেতাম। লাল ষনুমা বলেছিল এবার সে আমাদের আগের চেয়ে বেশি তাজা ঘাসের সন্ধান এনে দেবে, কিন্তু এ লাল ষনুমাও আগের জনের মতো এসব কথা ভুলে গেছে। সবসময় দোষ দেয় কেবল নীল ষনুমার। নীল ষনুমা যখন লাল ষনুমা ছিল তখন সে-ও একইভাবে নীল ষনুমার দোষ দিয়ে গেছে। বুঝি না বাপু কে কী চায়। সামনের বছর নতুন চাঁদে নতুন লাল ষনুমা বাছাই করব আমরা। তখন আমাদের কদর বেড়ে যায়। ইনিয়ে বিনিয়ে কত ভালো কথা বলে তখন ওরা! সবাইকে তখন তাজা তাজা ঘাস খাইয়ে নিজের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করে। বলে আমাদের সেবা করার জন্যই তারা বেঁচে আছে। আমি বুঝি না বাপু, আমাদের সেবা করার জন্য তাদের কে বাঁচতে বলেছে। নিজের তাজা ঘাস বিলিয়ে তারা এমনিতেই আমাদের সেবা করতে পারে। কিন্তু তার জন্য লাল ষনুমা হতে হবে কেন?”

আমি বললাম, “ভাই অংডং, আমাকে এখান থেকে বের করলে তোমাকে অনেক তাজা ঘাস এনে দেব। ”

অংডং সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি গাধা আমাকে দেশের আইন ভঙ্গ করতে বলছ?!”

পায়ের গোড়ালি থেকে মাথার চুল পর্যন্ত রাগে জ্বলে উঠলেও মুখে মিষ্টি হাসি ধরে কণ্ঠ মোলায়েম করে বললাম, “ভাই অংডং, আমাদের মতো দেখতে যারা, তাদের মানুষ বলে, নিজেদের যেমন তোমরা ষনুমা বলো। আমাকে তোমরা আঁটকে রেখেছো কেন? এই দেখো আমার ধারালো দাঁত নেই, বড়বড় নখ নেই, শিং নেই। আমি কোনও বিপদজনক প্রাণী নই। ”

“তুমি যা-ই হও। তোমাকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত একমাত্র লাল ষনুমা দিতে পারে। কাল দুপুরে তোমার ব্যাপারে সুশীল ষনুমাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে লাল ষনুমা। অবশ্য আলোচনাটা সবাইকে দেখানোর জন্য, লাল ষনুমার সিদ্ধান্ত নিতে কারও সাথে আলোচনার দরকার পড়ে না। ”

চাপা গলায় বললাম বাঘের পেটে যা গাধার বাচ্চা গাধা কোত্থাকার। কিন্তু সে সম্ভাবনাও নেই। অংডং বলেছে হিংস্র-মাংসাশী প্রাণীরা এই ষনুমাদের অঞ্চল এড়িয়ে চলে, কেন তা ওরা জানে না। আচমকা স্থির হয়ে গেলাম। অংডংয়ের পেছনে একটা সাপ ফণা তুলে আছে। যেকোন মুহূর্তে ছোবল দেবে। চাপা গলায় বললাম, “অংডং একদম নড়ো না, তোমার পেছনে সাপ!”

অংডং ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে একেবারে নট নড়নচড়ন হয়ে গেল। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখছে সাপটাকে। পায়ের কাছে একটা মরা ডাল পড়ে ছিল, সন্তর্পণে ওটা তুলে নিয়ে খাঁচার ফাঁকফোকর দিয়ে বের করে উঁচু করে ধরলাম সাপটার মাথার ওপর। সাপটার কোনও দিকে খেয়াল নেই। সে তার পুঁতির মতো চোখে স্থির তাকিয়ে আছে অংডংয়ের চকচকে পাছার দিকে। মনে মনে গুনলাম এক... দুই... তি....ন। সর্বশক্তিতে ডালটা নামিয়ে আনলাম সাপের মাথায়। থেতলে গেল মাথাটা। লম্বা দুফুটের শরীরটা মোচড়াচ্ছে মৃত্যু যন্ত্রণায়।

অংডং খাঁচার ভেতর মুখ গলিয়ে দিয়ে আমার হাত চেটে দিল কৃতজ্ঞতায়। বলল, “আজ তুমি না থাকলে”... যেন কল্পনা করে শিউরে উঠল সে।

নানান ঢংয়ে নানা কসরতের মাধ্যমে অংডং তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে একসময় বিদায় নিল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আমি লাল ষনুমার অনুচরদের দিয়ে যাওয়া একপ্রকারের সুমিষ্ট ফল পেট ভরে খেয়ে শুয়ে পড়লাম খাঁচার একপাশে শুকনো ঘাসের উপর। অনেকভাবে চেষ্টা করে দেখেছি খাঁচা থেকে মুক্ত হওয়া যায় কিনা। কিন্তু, অদ্ভুত শক্ত করে বানানো এই খাঁচা, ধারাল করাত না হলে বেরিয়ে যাওয়া অসম্ভব। পরদিন লাল ষনুমার একজন অনুচর এসে বলল, “তোমার ব্যাপারে ষনুমা সমাজ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামীকাল এখান থেকে দুক্রোশ দূরে নিয়ে তোমাকে কুমিরের নদীতে ফেলে দেয়া হবে। লাল ষনুমা বলেছে, তুমি নীল ষনুমার চক্রান্তের অংশ হতে পারো। আর ভবিষ্যতে আমাদের জাতির জন্যে হুমকির কারণ হতে পারো। আর আমাদের মুরুব্বি সুশীল ষনুমারা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলছে তোমরা সোজা হয়ে হাঁটারা বিপদজনক গাধার প্রজাতি। তাই ষনুমা সমাজের স্বার্থে তোমাকে কুমিরের নদীতে ফেলে দিতে হবে। লাল ষনুমা এতে সায় দিয়েছে। তোমার শেষ কোন ইচ্ছে থাকলে বলতে পারো। ”

“আমার শেষ ইচ্ছে তোদের সবকটার পাছায় একটা করে লাথি দেব। ”

ষনুমাটি দুদিকে মাথা নাড়ল। “সেটা সম্ভব নয়। ” বলেই সে হেলেদুলে চলে গেল। আমি দিশেহারা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এলো না। ফেলে আসা মানুষগুলোকে খুব মনে পড়ছে। কাউকে খুব পাত্তা দিতাম না। কারও মতামতের ধার ধারতাম না। নিজের খেয়াল-খুশিমত চলতাম। মা-বাবাকে কত কষ্ট দিয়েছি! আর জীবনে একটাও প্রেম এলো না... ভাবতে ভাবতেই চোখ জলে ভরে উঠল। ভোররাতের দিকে চোখ খানিকটা লেগে এসেছিল হঠাৎ চাপা গলায় কেউ যেন ডাকল, “ও গাধা, ও গাধা!”

তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। একটা গাধার অবয়ব দেখলাম আবছা অন্ধকারে। হায় খোদা! এই ভোররাতেই হারামজাদারা চলে এসেছে? ভয়ার্ত গলায় বললাম, “কে?”
“আমি অংডং। তোমাকে বের করতে এসেছি। ”
“কী করে?”
“তুমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। ”

সে খাঁচার পেছনে চলে গেল। কী করল জানি না, তবে মৃদু শব্দ করে খাঁচার সামনের দিকটা খুলে গেল। অপেক্ষা না করে বেরিয়ে এলাম। আবার আস্তে আস্তে খাঁচার দরজা বন্ধ হয়ে গেলে অংডং সামনে চলে এলো। বলল, “দেরি করো না। আমার পিঠে উঠে বসো। ”
“কোথায় নেবে আমাকে ভাই? কুমিরের নদীতে ফেলে দেবে?”
“আহ, বেশি কথা বলো তুমি। আমি তোমাকে বের করে নিয়ে যাচ্ছি। ”
“কোথায়?”
“এখান থেকে দশ ক্রোশ দূরে তোমার মতো দেখতে কিছু প্রাণীর দেখা পেয়েছে আমার বাবা। তোমাকে সেখানে নিয়ে যাব। লাল ষনুমা আর সুশীল ষনুমারা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। কারণ তুমি আমাদের ভাষায় কথা বলো। আর যারা আমাদের ভাষায় কথা বলে, তারা নিশ্চয়ই আমাদের মতোই বুদ্ধি রাখে। যদি তুমি ছাড়া পেয়ে যাও তাহলে হয়তো পরে কখনও দলবল নিয়ে ফিরে এসে আমাদের ক্ষতি করতে পারো। ”
“তুমি কেন আমাকে বাঁচাতে চাইছো?”
“তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ। কেউ যদি আমাদের জীবন বাঁচায়, আমরা সারাজীবন তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকি। দেশের স্বার্থ বিবেচনায় কাজটা অনুচিত হচ্ছে, তবে তোমাদের  গাধাদের আছে কিনা জানি না, আমাদের বিবেক বলে একটা ব্যাপার আছে। তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে মরতে দিলে নিজের বিবেকের কাছে আমি অপরাধী হয়ে থাকব। বাবার সাথে এ নিয়ে কথা হয়েছে আমার। বাবা খুব জ্ঞানী ষনুমা। বাবা বলেছে, জীবনটা ফাঁপা একটা গাছের গুঁড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়, যদি আমরা কর্তব্য থেকে দূরে থাকি। আর তোমাকে বাঁচানো আমার কর্তব্য। ”

অংডং আমাকে পিঠে তুলে নিয়ে ছুটল ঝড়ের গতিতে। আমি অংডংয়ের গলা জড়িয়ে ধরে কোনও রকমে তার পিঠে সেঁটে রইলাম। সূর্য ওঠার আগেই ষনুমাদের সীমানা থেকে বেরিয়ে এলো অংডং আমাকে নিয়ে। কেবল ছুটতেই থাকল। কখনও সে কোনও জলা পেরিয়ে যাচ্ছে, কখনও কোনও পশুর ট্রেইল ধরছে। তবে সবসময়ই গাছগাছালির আড়ালেই থাকল সে। মাঝে মাঝে খোলা জায়গা পেলেও সেটা এড়িয়ে গাছগাছালির ভেতর দিয়েই ছুটতে থাকল। সূর্য যখন প্রায় মাথার উপর, তখন একটা সরু খাঁড়ির সামনে এসে থামল। আমাকে পিঠ থেকে নামিয়ে বলল, “এটা পেরিয়ে সিকি মাইল হেঁটে গেলে তোমার মতো গাধার দেখা পাবে। ”

বুঝতে পারলাম না কিভাবে কৃতজ্ঞতা জানাব অংডংকে। তবে ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম পরম আবেগে। বোধহয় সে বুঝতে পারল আমার অনুভূতি। লেজ নেড়ে নিল বার কয়েক। বললাম, “তোমাকে আমার সারাজীবন মনে থাকবে অংডং। ”

“তোমাকেও আমার মনে থাকবে। এখন বিদায়। ” বলেই একবার আমার গাল জিব দিয়ে চেটে দিল। তারপর একছুটে হারিয়ে গেল ঘন বনের আড়ালে। আমি সরু খাঁড়ি পেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। মিনিট পনের পর দেখতে পেলাম মানুষগুলোকে। খুশিতে লাফ দিয়ে উঠল মন। আমাদেরই লোক! ক্যাম্প করেছে জঙ্গলের মাঝখানে। জব্বারকে দেখতে পেলাম চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে। ওই বদমাশটার জন্যেই আমার এই দশা। আমি চেঁচিয়ে ডাকলাম, “জব্বাইর‌্যা!” এরপর দু’পা এগোতেই অতিরিক্ত উত্তেজনায়, খুশিতে না বদমাশ জব্বারকে দেখে কে জানে, মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। জ্ঞান হারানোর আগমুহূর্তে দেখলাম জব্বার আমার দিকে ছুঁটে আসছে উদ্বিগ্ন মুখে।



বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৬ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।