ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্রসঙ্গ : মর ঠেংগাড়ি | হাবিবুর রহমান

চলচ্চিত্র / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৫ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৫
প্রসঙ্গ : মর ঠেংগাড়ি | হাবিবুর রহমান

কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৯৯৩ সালে ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকার জুলাই সংখ্যায় একটি লেখা লিখেছিলেন। শিরোনাম ছিল ‘চাকমা উপন্যাস চাই’।

চাকমা ভাষায় উপন্যাস লেখার জন্য তিনি সে ভাষা-ভাষী লেখকদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সে রচনায় বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি ইলিয়াস যে মনোযোগ এবং ভালোবাসার দৃষ্টি দিয়েছিলেন তা বোঝা যায়। চাকমা কবিতা, গান, পত্রিকা, চিঠিপত্র, লোকসাহিত্য, প্রবন্ধের বৈচিত্র ও শক্তিমত্তা সম্পর্কে সচেতন থেকে তিনি উপন্যাসের দাবি করেছিলেন।

সেই রচনায় ইলিয়াস বলেছিলেন, ‘আধুনিক ব্যক্তির অনুভূতি প্রকাশের প্রধান মাধ্যম উপন্যাস, শুধু একক অনুভূতি নয়, কোনও একক মহাপুরুষের আধ্যাত্মিক উপলব্ধি নয়। রাজনৈতিক আন্দোলনের কালপঞ্জি নয়, কিংবা কেবল আত্মপ্রতিষ্ঠার সংকল্প ঘোষণা নয় বরং জীবনযাপনের মধ্যে মানুষের গোটা সত্তাটিকে বেদনায়, উদ্বেগে ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের দায়িত্ব নেয় উপন্যাস। ’

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ১২তম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও স্বাধীন চলচ্চিত্র উৎসব। এই উৎসবে ‘মর ঠেংগাড়ি’ নামে চাকমা ভাষার একটি চলচ্চিত্রের উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়। বলা হচ্ছে এটি বাংলাদেশে প্রথম চাকমা ভাষার চলচ্চিত্র। উদ্বোধনী প্রদর্শনীর পর এই চলচ্চিত্র এবং নির্মাতা সম্পর্কে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক আলোচনা হতে থাকে। উদ্বোধনী অধিবেশনে চলচ্চিত্রটি দেখার সুযোগ ঘটেছিল।

‘মর ঠেংগাড়ি’ চলচ্চিত্রটির নির্মাতার নাম অং রাখাইন। মর মানে আমার আর ঠেংগাড়ি হচ্ছে বাইসাইকেল। চলচ্চিত্রটি শুরু হয় কর্ণফুলী নদীতে। নৌকায় করে একটি বাইসাইকেল নিয়ে একজন চাকমা তরুণ শহর থেকে ফিরছেন। নৌকায় মাঝির সাথে তার কথোপকথনে জানা যায়, এই নদীর নিচে তাদের বসত-বাড়ি, সমাধি, ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়ি তলিয়ে রয়েছে। কর্ণফুলী নদীর সাথে চাকমা জাতির বঞ্চনা, অপমান আর পরাজয়ের ইতিহাস আজও সে অঞ্চলের মানুষের কাছে জ্বলজ্বলে। চলচ্চিত্রের শুরুতে এইভাবে জনগোষ্ঠীর সাধারণ স্মৃতির মধ্য দিয়ে জনগোষ্ঠীর পরিচয় নির্দেশিত হয়। সূচনা দৃশ্যে কর্ণফুলীর এই কান্না এবং তার বিষাদ পুরো চলচ্চিত্রের সারসংকলিত করে।

আজ থেকে শত বর্ষের কিছু আগে ১৮৯৫ সালে লুমিয়ের ভাইদের হাতে চলচ্চিত্রের যাত্রার গল্প আমরা সকলে জানি। ঊনিশ শতকের গোড়ায় শিল্পায়ন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে মানুষের চৈতন্যে সামষ্টিক বোধের এক অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। মানুষের এই সামষ্টিক বোধ বা উপলব্ধির সাথে, প্রযুক্তির বিকাশের হাত ধরে মানুষের শিল্পের ইতিহাসে নতুন একটি মাধ্যম যুক্ত হয়। সামষ্টিক চৈতন্যের বিকাশ চূড়ান্ত রূপ নেয় এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায় উপনিবেশের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অনেকগুলো স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীকে বলা যায় জাতিরাষ্ট্র, গণতন্ত্র এবং চলচ্চিত্রের; উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কাল। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের জন্য যে সামষ্টিক স্বপ্ন বা কল্পনা তাকে ভাষা দেয় সাহিত্য এবং তার সাথে সাথে আসে চলচ্চিত্র। যা এই সব দেশের কোটি কোটি নিরক্ষর, নিপীড়িত জনগণের মধ্যে জাতিরাষ্ট্রের ধারণা, স্বাধীনতা বা মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নির্মাণ বা তার পরাজয়ের স্মৃতিকে ধারণ করে।

ইলিয়াস চাকমা উপন্যাসের কাছ থেকে যা চেয়েছিলেন, ঠিক যেন তাকে অনুসরণ করে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘মর ঠেংগাড়ি’। শহরে কাজ না পেয়ে গ্রামে ফেরত চাকমা তরুণের, স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে জীবন-যাপনের মধ্যে মানুষের গোটা সত্তাটিকে যেন বেদনা, উদ্বেগে এবং আকাঙ্ক্ষার প্রকাশের দায়িত্ব নেয় এই চলচ্চিত্র।



বায়ান্নো সালের ভাষার লড়াই নিয়ে বাংলাভাষার অংহকারের সীমা নাই। মাতৃভাষার অধিকারের জন্য রক্ত ও জীবন দেয়ার গৌরব তার রয়েছে। ফলে সকল জাতির, বিশেষ করে বাংলাদেশের বাংলাভাষাভাষী ব্যতীত অন্য ভাষার মানুষের মাতৃভাষার অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতা এই, এই দেশে অন্যান্য ভাষার স্বীকৃতি আজও অর্জিত হয়নি। সকল শিশুর মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। চাকমা, মারমা, মান্দি, সাঁওতালসহ ৫৬টি ভাষার মানুষ এই দেশে বসবাস করে। সেই সকল জনগোষ্ঠীর ভাষার স্বীকৃতি, মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য যে সকল ভাষার সাহিত্যের পরিচর্যা অত্যন্ত জরুরি।

সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের জন্য ভারতীয় বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র আমদানি করা হয়েছে। যে রাষ্ট্র হিন্দি ভাষার নিম্নমানের বলিউডি সিনেমা আমদানি করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার হালকা করে, সে রাষ্ট্র কিন্তু কোনওদিন একটি চাকমা বা মান্দি ভাষার চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয় নি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ গঠনের পর অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, জাতিগত নিপীড়নসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই পূর্বের নিয়মগুলোই বহাল থাকল। যে বাংলাদেশ পাকিস্তানের স্বৈরতন্ত্র এবং জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে, সেই দেশে জাতিগত নিপীড়নের ঘটনা প্রতিদিনই প্রকাশিত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি বাংলাদেশের জনগণের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।

‘মর ঠেংগাড়ি’ চলচ্চিত্রে দেখা যায় এমন একটি জনপদ যারা পূর্বে বাই সাইকেল যন্ত্রটির সাথে পরিচিত নয়। এই নতুন বাহনটির মালিক পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য উপায়ে উপার্জনের একটি বন্দোবস্ত করেন। তার আয়-উন্নতি হয়, বউয়ের মুখে হাসি ফোটে। কিন্তু স্থানীয় ক্ষমতাবানদের নজরে পড়ে যায় লোকটি। ক্ষমতাবানেরা তাকে নানাভাবে উত্যক্ত ও আক্রমণ করতে থাকে। একদিন সকালে সে তার প্রিয় সাইকেলটি খুঁজে পায় না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেখা যায় দুবৃর্ত্তরা তার সাইকেলটি ভেঙ্গে ঝোঁপের মধ্যে ফেলে রেখেছিল। যে বিষাদযাত্রার শুরু কর্ণফুলী নদীতে হয়েছিল, ছবির শেষ দৃশ্যে কর্ণফুলী নদীতে ভাঙ্গা সাইকেল নিয়ে এবার শহরের দিকে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সেই বিষাদযাত্রার উল্টোরথ অনুষ্ঠিত হয়।

ইলিয়াসের আহ্বানের সাড়া দিয়ে চাকমা উপন্যাস লেখা হয়েছিল কিনা আমার জানা নেই। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও তার বুদ্ধিজীবী সমাজের নীরবতায় এদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সম্পর্কে জানার সুযোগ খুব কম। এই রকম পরিস্থিতিতে অং রাখাইন নির্মাণ করেছেন, চাকমা ভাষার প্রথম চলচ্চিত্র। কেবল ব্যক্তির স্বপ্ন ও সংকটকে প্রতিফলিত করেই এই চলচ্চিত্র ফুরিয়ে যায় না। বরং জীবনের চলমান এবং পরিবর্তনের নিয়মকে বোঝার চেষ্টা করে এই চলচ্চিত্র। শেষ দৃশ্যে যখন চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র ভাঙা সাইকেলটি নিয়ে নৌকায় করে শহরে যাচ্ছেন। অন্যদিকে অনেকগুলো নৌকায় মটরসাইকেল, টেলিভিশন, ফ্রিজ বোঝাই নৌকা পাহাড়ের দিকে আসতে থাকে। সামাজিক পরিবর্তনের এই বোধ, চলচ্চিত্রের দৃশ্যে দৃশ্যগত সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার এমন উদাহরণ সমসাময়িক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বিরল।

জায়মান সামরিক উপস্থিতিকে প্রকাশের জন্য এই চলচ্চিত্রে একটি দৃশ্য ব্যবহৃত হয়েছে। দৃশ্যটির কার্যকারণ, রূপক ও কৌশলের দুর্বলতা সত্ত্বেও সেল্‌ফ সেন্সরশিপের গণ্ডি অতিক্রমের যে সাহসিকতা অং রাখাইন প্রদর্শন করেছেন, তার জন্য, শুধু নিজ জাতির নয়, এদেশে শিল্পীর স্বাধীন সত্তার তিনি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন হয়ে থাকবেন।



বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।