ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রুবীর কালো চশমা: ইতিবাচক জীবনের আখ্যান

বুক রিভিউ / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৬ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০১৫
রুবীর কালো চশমা: ইতিবাচক জীবনের আখ্যান

মিল্টন বিশ্বাস | মোস্তফা কামাল প্রধানত কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি বিচরণ করছেন সাহিত্যের নানান শাখা-প্রশাখায়; গল্প, উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, নাটক, শিশুতোষ, রম্যরচনা, প্রবন্ধ, কলামসহ নানা মাধ্যমে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে।

বর্তমানে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭৬। অবশ্য সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও কথাসাহিত্য তাঁর বেশি পছন্দের। ২০১৫-এর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একাধিক গ্রন্থ।

মোস্তফা কামালের অনেকগুলো গ্রন্থের মধ্যে ‘রুবীর কালো চশমা’ এবারের বইমেলার গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। সত্য ঘটনা অবলম্বনে পারিবারিক ক্রাইসিসকে কেন্দ্র করে এর আখ্যান বিন্যস্ত হয়েছে। বর্তমান সময়ের একটি সামাজিক সংকট হলো সেপারেটেড ফ্যামিলি; মা-বাবার বিচ্ছিন্নতা। আর এই দাম্পত্য জীবনের সংকট সন্তান কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের ওপর প্রভাব ফেলে। সন্তান বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক বিপর্যয় সূচিত হয়। এমনকি এ ধরনের সংকট-দীর্ণ পরিবারের ছেলে-মেয়েদের অন্যরা এড়িয়ে চলে। নর-নারী সম্পর্কের ভেতর মহিমান্বিত সংযোগ হিসেবে প্রেম ও বিবাহের পথে কাঁটা বিছানো থাকে। ‘রুবীর কালো চশমা’ উপন্যাসে এসবই ব্যক্ত হয়েছে।

এর মধ্যে আছে প্রেম, আছে স্বামী-স্ত্রীর সাংসারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। সব মিলিয়ে উপন্যাসটি নাগরিক সংকটের কাহিনী। প্রেমের উপন্যাস লেখার সময় প্রেমের সঙ্গে সমাজের দ্বন্দ্ব-সংঘাতগুলোও মোস্তফা কামাল তুলে আনেন। সাংসারিক জীবন, পারিবারিক জীবনে চলার সময় যা কিছু থাকে সব মিলিয়ে নিতে চান তিনি। তাঁর মতে, প্রেম তো সব জায়গাতেই আছে। সেই প্রেম কেবল নিরেট নর-নারীর প্রেম নয়। তাকে সমাজ-সংসার যুক্ত করে দেখা দরকার। অর্থাৎ এই ঔপন্যাসিক প্রেম কাহিনী লিখতে পছন্দ করেন তবে তা সমাজজিজ্ঞাসা বিচ্যুত প্রেমকাহিনী নয়।

মোস্তফা কামাল আলোচ্য উপন্যাসে রুবীর ব্যক্তিমানুষের অতল গহীনে ডুব দিয়ে একজন নারীর যন্ত্রণা, কষ্ট, ভয়, হতাশা, সংশয়, সাহসিকতাকে পরিস্ফুট করেছেন অসামান্য আলোকসম্পাতে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো—নিয়াজ, নিগার সুলতানা, জামিল আহমেদ, রওশন আরা, রুবাইয়াত হাসান একদিকে যেমন নাগরিক রুচি এবং আবেগকে লালন করে তেমনি অন্যদিকে নাগরিক সভ্যতার নেতিবাচক অবদান—সংশয়, বিচ্ছিন্নতাবোধ, কপটদাম্ভিকতা, নিঃসঙ্গতা, আত্মানুসন্ধানের আত্মদহন প্রভৃতি মনোজগতের অতল গহ্বরের অন্ধকারের পুঞ্জীভূত উপাদানসমূহ তাদের মনের মধ্য থেকে উঠে আসে।



ফলে নাগরিক পুঁজিতন্ত্রের অভিঘাতে যেখানে ব্যক্তির সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো অস্বীকৃত হয়েছে, অনিকেত সঞ্চারী করে তুলেছে তার দৈনন্দিন জীবন, সেখানে যন্ত্রণাদগ্ধ সেই ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের বিবরণ ও বিশ্লেষণ হয়ে উঠেছে প্রধান। নাগরিক সভ্যতাও যে পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার আবেষ্টন থেকে ব্যক্তির যন্ত্রণা ও অবচেতনার কামনাকে অগ্রাহ্য করতে চায় এবং এরই ফলে ব্যক্তি মানুষ কিভাবে প্রতিবাদী সত্তায় জাগরিত হয় তারই শিল্পরূপ ‘রুবীর কালো চশমা’ উপন্যাসের গতিচঞ্চল প্রান্ত।

মূলত মোস্তফা কামাল নাগরিক জীবনের পারিবারিক সংকটকে ব্যক্তির বহুমাত্রিক চেতনার সংস্পর্শে দৃশ্যমান করেছেন। ব্যক্তি তো শুধু গণ্ডিবদ্ধ পরিবারের সংকটের চূড়ান্তসীমায় ক্ষয়ে গিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। সচেতন শিক্ষিত নাগরিক জীবনযন্ত্রণার মূলে থাকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাস্রোত। মোস্তফা কামাল এসব প্রসঙ্গ সংবাদপত্রের কলামে উপস্থাপন করলেও এখানে সযত্নে তা থেকে দূরে থেকে মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের অবয়ব নির্মাণ করেছেন।

তবে তিনি সংহত বিবরণ ও একঘেঁয়েমী কাহিনীসূত্র উপন্যস্ত না করে নাগরিক বৃত্তের জীবনদগ্ধ উপন্যাস উপহার দিতে পেরেছেন, যার মূল সুর ইতিবাচক। এই ইতিবাচক জীবনদৃষ্টি ও সাবলীল গদ্যে শিল্প সম্মত কাহিনী বর্ণনার কারণে ‘রুবীর কালো চশমা’ পাঠকপ্রিয়তা পাবে।

রুবীর কালো চশমা: মোস্তফা কামাল, পার্ল পাবলিকেশন্স, বইমেলা ২০১৫, প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ, মূল্য: ১৬০ টাকা।



বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৫ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।