ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

যৌথ খামার | পলাশ মাহবুব

রম্যরচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩০ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৫
যৌথ খামার | পলাশ মাহবুব

খাল কেটে আগে অনেকে কুমিড় আনতেন। এরকম অনেক গল্প আমরা শুনেছি।

দিন বদলেছে। এখন খাল বলতে তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নেই। খাল আছে নামে। যেমন ধোলাইখাল। নামটা আছে কিন্তু খালটা আর নেই। এরকম আরও অনেক খালের অস্তিত্ব শুধু নামেই টিকে আছে। নাম শুনে বোঝা যায় এখানে কোনো এক সময় খাল ছিল। আর হাতে গোনা দু-একটা খাল যা আছে তা হয়ে গেছে দখল। কিছু দখল করেছে মানুষ আর কিছু ময়লা-আবর্জনায়। আর কিছু নদী স্লিম হতে হতে এখন খালের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তাদের খাল বলা ঠিক হবে না। সাইজটা খালের মতো হয়ে গেলেও সেগুলো আসলে নদী। খালে পরিণত হওয়া এসব নদীর মধ্যে কিছু উচ্চবংশীয় নদীও আছে। এবং নদীগুলো যেহারে স্লিম হচ্ছে তাতে করে জিরো সাইজ হয়ে চরে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। তাই সেই অর্থে খাল খুব একটা দেখা যায় না। আর যেহেতু খাল নেই। কুমিড়ও নেই।

কুমিড়ের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। অনেকটা খালের মতো। কুমিড় আছে চিড়িয়াখানায় আর বাচ্চাদের ড্রয়িং বইয়ে। বাচ্চাদের আঁকাআঁকি শুরু হয় মাছ দিয়ে। আর সেটা পরিপক্ক হয় কুমিড় আঁকার মাধ্যমে। কালের বিবর্তনে খাল আর কুমিড় প্রায় হারাতে বসেছে। কিন্তু প্রবাদটা রয়ে গেছে আগের মতো। আমরা এখনো খাল কেটে কুমিড় আনছি। আমাদের এক বড় ভাই সত্যি সত্যি তাই করলেন। তবে খাল না। পুকুর কেটে কুমিড় আনলেন তিনি। বিপন্ন কুমিড় বাঁচানো উদ্দেশ্য না। তার উদ্দেশ্য ব্যবসা। আমরা বললাম, ভাই, এতকিছু থাকতে কুমিড়? ভাই বললেন, ‘আইডিয়াটা আমার না। সুমির। ’ সুমি হচ্ছে ভাইয়ের বউ। বউ ভক্ত হিসেবে ভাইয়ের সুনাম আছে।

‘কিন্তু তাই বলে বউয়ের বুদ্ধিতে পুকুর কেটে কুমিড় নিয়ে আসবেন!’
‘আরে শোন। যুগটা এখন আইডিয়ার। নতুন কিছু করতে হবে। যার আইডিয়া যত নতুন তার সম্ভাবনা তত বেশি। আমি যদি পুকুরে মাছ চাষ করতাম তাহলে কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামাত না। কারণ পুকুরে মাছ চাষ সবাই করে। ‘মজিদ মিয়া একজন সফল মৎস্যজীবী’—এ ধরনের আলোচনার দিন শেষ। আলোচনায় আসতে হলে নতুন কিছু করতে হবে। ’
‘তা আলোচনায় আসার কদ্দূর?’
‘অনেক দূর। ’

আমাদের প্রশ্নে বড় ভাই কাতলা মাছের মতো চোখ বড় করে হাসেন।

‘অলরেডি শাইখ সিরাজের লোক ফোন করেছে। তারা আমার কুমিড় খামার নিয়ে টিভিতে রিপোর্ট করবে। মাছ চাষ করে সেটা জীবনেও হতো না। রুই মাছ কোলে নিয়া নিজের ছবি নিজের তোলা লাগত। ’
‘এই ঘটনা। বলেন কী!’
‘হুমম। আমি প্রবাদটা উল্টে দিতে চাই। আগে মানুষ খাল কেটে কুমিড় আনাকে নেগেটিভ সেন্সে বলত। সামনে দিন আসবে যখন মানুষ ‘পুকুর কেটে কুমিড়’ আনাকে পজেটিভ সেন্সে বলবে। যাত্রা সবে শুরু। ’

এতটুকু বলে বড় ভাই তার পুকুরের দিকে আগান। আমরাও পেছন পেছন যাই।

‘তা ভাই, কুমিড় নিয়ে আপনার আর কী কী পরিকল্পনা?’
‘আছে আছে। ’

বড় ভাই হাসেন।

‘কুমিড় বিষয়ে সুমির আরো অনেক পরিকল্পনা আছে। আমরা আসলে একটা যৌথ খামার করতে চাই। ’
‘সেটা কেমন?’

আমাদের মধ্য থেকে একজন জানতে চায়।

‘মানে হচ্ছে কুমিড়ের সাথে অন্যকিছুও চাষ করতে চাই। এই যেমন ধরো ইলিশ মাছ।
ইলিশ মাছ!’
‘কুমিড় খেয়ে ফেলবে না? আর পুকুরে কি ইলিশ মাছ হয়?’
‘সেটা নিয়েই ভাবছি। ভেবে দেখলাম ইলিশ হচ্ছে গভীর জলের মাছ। কুমিড় ততটা গভীরে থাকে না। পানির ওপরের স্তরে থাকে না। এখন ইলিশ যদি গভীর জলে আর কুমিড় যদি উপরিজলে থাকে তাহলে কিন্তু একসঙ্গে চাষে কোনো সমস্যা দেখি না। এখন যেটা করতে হবে সেটা হলো সমঝোতা। ইলিশ-কুমিড়ে সমঝোতা ঘটাতে পারলেই হয়ে গেল। বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলব। কী বুঝলি?’

যা বোঝার আমরা বুঝে ফেলি। ‘খাল কেটে কুমিড়’ আনা প্রবাদের নতুন সংস্ককরণ আসছে। দাওয়াত দিয়ে বিপদ ডেকে আনার ক্ষেত্রে মানুষ খাল কেটে কুমিড় আনার বদলে ‘পুকুর কেটে কুমিড়’ আনা বলবে। আমাদের সান্ত্বনা, নতুন কিছু করতে না পারুক, অন্তত নতুন একটা প্রবাদ উপহার দিতে যাচ্ছেন বড় ভাই।

ছিলাম খাল প্রসঙ্গে। খাল বেয়ে চলে এলো কুমিড়। তারপর যৌথ চাষ প্রকল্পের আওতায় ইলিশ মাছ।

ইলিশ যেহেতু জাতীয় মাছ শেষটা তাকে দিয়েই হোক। এখানেও যুক্ত এক বড় ভাই।

সঙ্গীসহ হোটেলে খেতে বসেছেন এক বড় ভাই।
ওয়েটার বলল, ‘স্যার পদ্মার বড় ইলিশ আছে। ’

পদ্মার ইলিশের প্রতি বাঙালির দুর্বলতার কথা সবাই জানে। ইলিশের অর্ডার দেয়া হলো। টেবিলে ইলিশ যখন আসলো তখন দেখা গেল ইলিশের সাইজ মোটামুটি আছে। কিন্তু মাছের মধ্যে ইলিশের কোনো ঘ্রাণ নেই।

বড় ভাই বললেন, ‘কিসের পদ্মার ইলিশ! মাছে তো কোনো ঘ্রাণই নাই। ইলিশ খাইতাছি না মাটির দলা খাইতাছি বুঝতেছি না। আরে, পদ্মার ইলিশ খাইলে তো এই হোটেল পার হইয়া ঘ্রাণ ওই এটিএম বুথ পর্যন্ত চইল্যা যাওয়ার কথা। টাকা তো নিবা ঠিকই। ’
‘সেটা স্যার আপনি ঠিকই বলছেন। পদ্মার ইলিশের ঘ্রাণের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। কিন্তু স্যার, আমাদের এবারের এই ইলিশ মাছটা একটু প্রচারবিমুখ। নিজেকে জাহির করতে চায় না। মনে করেন যে, মাছটা নাইনটি নাইন পার্সেন্টই ইলিশ মাছ। শুধু প্রচারটা নাই। যে কারণে ঘ্রাণটা ঠিক পাচ্ছেন না। ’

বড় ভাই ভেবেছিলেন তার নাক বন্ধ। তাই ঘ্রাণ ঠিকঠাক পাচ্ছেন না। তারপরও ওয়েটারকে একটু ঝালিয়ে দেখতে কথাটা বলেছিলেন। কিন্তু জবাবে ওয়েটার যা বলল তা শুনে তার মুখও বন্ধ হয়ে গেল। কথা না বাড়িয়ে তিনি প্রচারবিমুখ ইলিশ খেতে লাগলেন।



বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।