ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বৃষ্টির জন্মভূমি | ধ্রুব এষ (কিস্তি ৩)

ধারাবাহিক উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১০ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৫
বৃষ্টির জন্মভূমি | ধ্রুব এষ (কিস্তি ৩) অলংকরণ : মাহবুবুল হক

দ্বিতীয় কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন

৩.
আহারে!
ঈভা বলত।
কিছু হলেই বলত, ‘আহারে!’
‘তোমাকে পরীর মতো দেখাচ্ছে।


‘আহারে!’
‘আমার সারারাত ঘুম হয়নি। ’
‘আহারে!’
‘শক্তি চট্টোপাধ্যায় মারা গেছেন। ’
‘আহারে!’

ঈভা ছিল আহারে বিবি। ঈ দিয়ে ঈভা লিখত। বাংলা অভিধানে ঈভা শব্দটা নেই। ইভাও নেই। ইংলিশে আছে। ই ভি এ। কী? ই ভি এ কী? ইভা না ঈভা? ঈভা কী ঈভ?

ঈভা ছিল ঈভ।
কত বছর আগের ঘটনা?
দশ-বারো বছর। না, আরো কিছু আগের। এত ডিজিটাল হয়নি তখনও পৃথিবী। এনালগ ফোনের স্মৃতিবাহী দিন। তারা কয়েকজন তখন একসঙ্গে থাকে। ব্যাচেলরস ডেন। বাড়িঅলার বাসার ফোনে একদিন দুপুরে ফোন করেছিল ঈভা।
‘হেই! আপনি এখন বাসায় কেন? শোনেন, কাল দুপুরে আপনি বাসায় না থেকে কোথায় থাকতে পারবেন বলেন তো? টিএসসি? চারুকলার মোল্লার ক্যান্টিন? পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়ি? সিলভানা? কাল আমি আপনার সঙ্গে ডেট করব। ’
‘প্রকাশ্য দিবালোকে?’
‘তাহলে কী? প্রথমদিনই ক্লোজডোর ডেট? না, বাবা। আগে দেখি, শুনি কিছুদিন। ’
এ রকম করে হয় নাকি?
হয়েছিল।
আজব মনে হয়।

ঈভা এখন থাকে ব্রিটেনের কেন্টে। স্টোরিটেলার হয়েছে। বাচ্চাদের গল্প শোনায়। তিনবার বিয়ে করেছে। প্রথমবার এক আমেরিকানকে। দ্বিতীয়বার এক ইতালিয়ানকে। তৃতীয়বার এক বঙ্গসন্তানকে। বাচ্চা আছে একটা। বলেছে, বাচ্চাটা তার আইনসম্মত তিন জামাইয়ের কারোরই না। কার এটা সে বাচ্চাটাকে বলবে। বাচ্চাটার বয়স যখন ১৩ বছর হবে। আরো আগেও বলে ফেলতে পারে।

ফেসবুকে আছে ঈভা। ফ্রেন্ডলিস্টে আছে। এখন কী করছে? অনলাইনে আছে?
ফোনে ফেসবুক খুলে দেখল।
অ্যাকাউন্টই নেই ঈভার।
ঘটনা কী?
ফোন নাম্বার আছে।
কল দেবে?
কেন্টেও রাত এখন। সাড়ে সাতটা-পৌনে আটটা বাজে।
কল দিল।
ঈভা একবারেই ধরল, ‘হেই। ’
‘কী করো?’
‘কী র্করি? কি র্র্র্কব? হি! হি! হি!’
ঈভা মাতাল।
‘তুমি কি মাতাল?’
‘কিহ্? মাতাল! হি! হি! হি!
আমি তো বন্ধু মাতাল নই
মানুষ যদি মোরে নাই বলো
বেঈমান বলো বেঈমান...। ’
মাতাল না সে!
এখন এক গান থেকে এক গানে যাবে।
‘নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে
তাইতো মনে রঙ জমেছে
আজ কোনো কাজ নেই
নেই কোনো ভাবনা
এম্নি করে. এম্নি করে.. এম্নি করে... কী বলো তো?’
‘শোনো, তোমার কী সিক লাগছে?’
‘সিস্-সিক? সিক্ক্ক্ লাগছে। হি! হি! হি! স্যরি হুতুমসোনা, টেনশন করো না। হি! হি! হি! আমি সিক না, বাবা। মাতালও না। হি! হি! হি! তুমি কী করো? ঘুমাওনি এখনও?’
‘ঘুমিয়ে ছিলাম। উঠে পড়েছি। তোমাকে স্বপ্নে দেখে উঠেছি। ’
‘আমাকে স্বপ্নে দেখে উঠেছ? সত্যি! আহারে! কী স্বপ্ন, হুতুমসোনা? নকটারনাল ড্রিম? হি! হি! হি!’
‘তোমার ছানা কী করে?’
‘ঘুমায়। হি! হি! হি! তাকে আর ছানা বলা যাবে না বুঝেছ? সব বোঝে। বুঝে নিতে চায়। হি! হি! হি! জেননেক্সট বেবি। চার বছর বয়সও হয়নি, এই বয়সেই বিরাট চিন্তাবিদ হয়েছে। লিটল হাইপেশিয়া। কাল রাতে... কাল রাতেই তো, হ্যাঁ, আমাকে কী জিজ্ঞেস করেছে শুনবে? আমি কী করে হলাম, মাম্মা? হি! হি! হি!’
‘তুমি কী বললে?’
‘বলেছি! হি! হি! হি!’
‘কী বলেছ, বলা যাবে না। ’
‘যাবে না কেন? বলা যাবে। হি! হি! হি! বলেছি তার বাবার সঙ্গে দুইদিন থাকার পর আমি একদিন ডিম পাড়লাম। ডিম ফুটে সে হলো। খুব বুঝল, জানো? হি! হি! হি! গম্ভীরভাবে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, তোমার পেটের ভেতর ডিম ফুটল মাম্মা? চিন্তা করো! হি! হি! হি!’
‘তুমি ফেসবুকে নেই কেন?’
‘আছি তো। রাগ করে তোমাকে একদিন আনফ্রেন্ড করে দিয়েছিলাম। আবার ফ্রেন্ড করে নেব। হি! হি!’
‘রাগ করেছিলে? কেন?’
‘বলব না! হি! হি! হি! তোমার বউসুন্দরী কোথায়?’
‘ঘুমায়। ’
‘ও। ও কিন্তু ভীষণ সুইট দেখতে! চোখ দুটো এত মায়াবী। লিপসিংক করার মতো ঠোঁট। হি! হি! হি! তুমি একে কোথায় পেয়েছো, বলো তো?’
‘জঙ্গলে। পথ হারিয়ে জঙ্গলে বসে কাঁদছিল। ’
‘আহারে! তুমি জঙ্গলে গিয়েছিলে কেন?’
‘মাটি ভেজাতে। ’
‘কিহ? হি! হি! হি! তুমি না... তুমি একটা হ্যাটার! এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড মুভির হ্যাটার। তোমরা খুব হ্যাপি কাপল?’
‘লাইফ গোজ অন ব্রা। ’
‘কী বললে?’
‘আমার বউকে তুমি দেখেছ?’
‘দেখব না? আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড না সে? এল এ-র জায়গায় ভি এ হলে আমার নেমসেকও হতে পারত। তুমি তাকে আমার কথা বলেছো?’
‘হুঁ। ’
‘কী বলেছো, হুতুমসোনা?’
‘বলেছি তুমি একটা ছিট। তার সঙ্গে যদি বিয়ে না হতো তবে আমি তোমাকে বিয়ে করতাম। ’
‘সত্যি বলেছো? হি! হি! হি! সত্যি তুমি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে নাকি? আহারে! আমার তো মনে হয়নি কখনও। তোমার সঙ্গে বিয়ে হলে বলো আমি আর বিয়ে করতাম?’
‘তা করতে। ’
‘কী? হি! হি! হি! ঠিক। ঠিক। ঠিক। আমার হাতে চারটা বিয়ে আছে জানো? আরো একটা করতে পারি এখনও। তোমার হাতে কয়টা বিয়ে আছে?’
‘মানুষের বিয়ে কি হাতে থাকে নাকি?’
‘আরে বুদ্ধু! হাতের রেখায়! কেন্টে কিছুদিন আগে বাংলাদেশের এক এস্ট্রোলজার এসেছিলেন। মঈন জুবেরী। উনি আমার হাত দেখে বলেছেন। ’

মঈন জুবেরী! ভাই? ভাই কেন্টে গিয়েছিলেন, ঠিক। ফিরে নানা পদের কাহিনী বলেছেন। জ্যোতিষ অবতারের কাহিনী বলেননি এবং ঈভার সঙ্গে দেখা হয়েছে বলেননি। অবশ্য ঈভার কথা ওঠেওনি, তাও। ধরতে হবে ভাইকে।



‘কী? কথা বলছ না কেন?’
‘ভাই তোমার হাত ধরে দেখেছেন?’
‘ভাই? ভাই কে?’
‘ওই তো। মঈন জুবেরী। ’
‘উনি তোমার ভাই হন নাকি?’
‘আরে না! এমনি বললাম। লোকটার নাম আমি শুনেছি। তবে দেখা হয়নি কখনও। ’
‘তাই বলো। উনিও তাই বললেন। ’
‘কী বললেন?’
‘সেম থিং। তোমার নাম শুনেছেন, দেখা হয়নি। অবশ্য তোমার নাম কে না শুনেছে?’
কত বড় বদমায়েশ ভাই! ওফ্!
‘তবে উনি দেখলাম তোমার বন্ধু ঠাকুর, তরলদা, শুভঙ্কর, মামুনকে ভালোই চেনেন। ওদের কথা অনেক বলেছেন। তরলদা কেন তরলদা বলেছেন। হি! হি! হি! আমি কিন্তু সত্যি ভাবতাম মানুষটার নামই তরল। হি! হি! হি! ফানি ওল্ডম্যান। ’
‘ফানি ওল্ডম্যান! কে? ভাই? ভাই হলেন কাঁকড়া। দ্য ক্র্যাব। ’
‘বিড়বিড় করে কী বলো তুমি? ও, স্যরি। ’
‘স্যরি? কেন?’
‘একটু আগে বুদ্ধু বললাম না তোমাকে, তাই জন্য!’
‘অ। কেউ স্যরি বললে কী বলতে হয়?’
‘তুমি জানো না? হি! হি! হি! ইটস ওকে বলো। ’
‘ঠিক আছে। ’
‘ঠিক আছে। হি! হি! হি! এখন বলো তোমার উদ্দেশ্য কী? এতদিন পর ফোন করেছো কেন? আট মাস তেরো দিন পর। তুমি কি এখন আমাকে প্রপোজ করতে চাও? এটা বেডটাইম, হুতুমসোনা। তোমাদের রাত একটার বেশি এখন। তোমার বউয়ের ঘুম ভাঙছে না কেন? এতক্ষণ ধরে কথা বলছ তুমি। ’
‘অন্য ঘরে সে। ’
‘উঠে আসে যদি?’
‘আসবে না। ’
‘তুমি শিওর?’
‘হ্যাঁ। মঈন জুবেরী হাত দেখে আর কী কী বলেছেন তোমাকে?’
‘বলেছেন আমার আরো আট-নয়টা ছানাপোনা হবে। হি! হি! হি! তুমি কী একটার বাপ হতে চাও? তোমরা ছানাপোনা নিচ্ছো না কেন?’

বউ খাটে উঠে বসে আছে।
আড়চোখে দেখল সে।
বিভ্রম?
না। তাকিয়ে আছে এই যে।
টলটলে সবুজ চোখের মণি বউয়ের। কন্টাক্ট লেন্স না, অকৃত্রিম। বউয়ের বোন ধুমসীর চোখের মণি নীল। আজব ব্যাপার। দুই বোন দুই রঙের চোখের মণি নিয়ে জন্মেছে। তাও সবুজ এবং নীল।
ধুমসীকে ফোন করতে হবে সকালে। নিয়মমাফিক প্রাণী ধুমসী। এগারোটায় ঘুমায়, ওঠে ছয়টায়। বছরখানেক হলো বিয়ে হয়েছে। বিয়োয়নি এখনও। কিছুদিনের মধ্যে বিয়োবে।
কিন্তু বউ তাকিয়ে আছে!
উঠে বসে আছে!
ঈভা বলল, ‘অ্যাই-ই-ই?’
‘উঁ? হুঁ?’
‘কী হলো?’
‘এক মিনিট প্লিজ। হোল্ড করো। ’
‘ওক্কে!’
তাকাল সে।
কোথায় কী?
বউ খাটে উঠে বসে থাকবে কেন?
আজগুবি!
‘ঈভা!’
‘কী হয়েছে?’
‘কিছু না। ’
‘কিছু একটা হয়েছে, বাবা। তুমি কী ভয় পেয়েছো কিছু দেখে?’

হারামজাদী। ফোনে গলা শুনে কী করে বুঝল? ছিটদের সিক্সথসেন্স অত্যন্ত প্রবল হয়। ছিট। পাগল। পাগল না কে? বারাক ওবামা, রাখি সাওয়ান্ত, টিনটো ব্রাস, ডানিয়েল ওর্তেগা, বাংলাদেশি গার্ল নিশি, এভরি ওয়ান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড পাগল। পাগল! পাগল অ্যান্ড...।
‘কথা বলছো না কেন? অ্যাই। ’
‘এই তো বলছি। মঈন জুবেরী তোমার হাত দেখে আর কী কী বলেছেন শুনি? উনি কি তোমার হাত ধরে দেখেছেন?’
‘মানে কী? বললাম না ফানি ওল্ডম্যান। উনি তোমাদের মতো লুইস না। কোনো মেয়ের হাত ধরেও দেখেননি। ট্যাবে হাতের ছবি উঠিয়ে দেখেছেন। ’
‘কী সর্বনাশ!’

৪র্থ কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৩১০ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।