ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রুশ কথাসাহিত্যের সেই মায়াবী হাতছানি | আদনান সৈয়দ

বই / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১, ২০১৫
রুশ কথাসাহিত্যের সেই মায়াবী হাতছানি | আদনান সৈয়দ

বর্তমান প্রজন্মদের দিকে যতই চোখ রাখি ততই শুধু অবাক হই। তাদের হাতের মোবাইল সারাক্ষণ ঝনঝনিয়ে বেজেই চলছে, সেই সাথে রয়েছে ভিডিও গেম, টেবলেট, ফেসবুক, ইন্টারনেট আরো কত কী! তখন মনে করার চেষ্টা করি আমাদের ছেলেবেলার এই মায়াবী সময়টাকে।

কেমন ছিল সেই সময়? সেই রূপকথা ঘেরা গল্পের মতন সময়গুলো? আমাদের তো খুব বেশি কিছু ছিল না। বইয়ের নেশা যাদের ছিল—তাদের একমাত্র বিনোদন ছিল বই। আর সেই বই যদি হয় রুশ কথাসাহিত্যের, তাহলে তো কথাই নেই! খুব ছেলেবেলার কথা। বয়স কত আর হবে? টেনেটুনে আট কি নয়? হঠাৎ আব্বার হাতে দেখি রঙচঙা ছবি আঁকা কয়েকটা বই।

ছোট্ট সেই বইগুলোর প্রচ্ছদ ছিল রীতিমত লোভনীয় আর প্রাণ কাড়ার মতো। বেশ মনে আছে একটি বইয়ের প্রচ্ছদ ছিল অসংখ্য চড়ুই পাখি একত্রে বসে  কিঁচিরমিঁচির করছে—এ ধরনের। বইটার মলাটের নিচের দিকে বড় বড় করে লেখা ছিল ‘চড়ুইছানা’। লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি। সেই যে ছো মেরে বাবার হাত থেকে বইটা নিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিলাম তারপর থেকেই বাবার চারপাশে শুধু ঘুরঘুর করে বইয়ের বায়না। তারপর ধীরে ধীরে হাতে আসাতে শুরু করল নিকোলাই গোগলের ‘জ্যান্ত টুপি’, ম. মুচকিনের ‘কেন আমি বাবার মতন’, মিখাইল শোলখভের ’প্রশান্ত দন’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বলার অপেক্ষা রাখে না সেই সময় থেকেই রুশ সাহিত্যের প্রতি প্রেমের প্রাথমিক নিবেদন শুরু।



...শুধু রুশ কথাসাহিত্যের কথা বললেই হবে না সেই সাথে আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই সেসব কালজয়ী সাহিত্যগুলোর বাংলায় অসাধারণ অনুবাদের কথাটিও। আহা! সেই অনুবাদ যদি ননী ভৌমিক, হায়াৎ মামুদ বা দ্বিজেন শর্মার হাত দিয়ে হতো তাহলে তো কথাই ছিল না। এখন যখন সেই পুরনো স্মৃতি নিয়ে ভাবি পুরো বিষয়টাই নস্টালজিতে পেয়ে বসে। তখন তো আমাদের নাকের ডগার সামনে ফেসবুক ছিল না, অনলাইনে বইপড়ার কোনো সুযোগ ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না...



স্পষ্ট মনে পড়ে নাকের নিচে যখন হালকা গোঁফের রেখা তখন সে বয়সেই গোগ্রাসে আবিষ্কার করেছিলাম রুশ কথা সাহিত্যের সেই রহস্যময় ঝাঁপিটি। কী সেই টানটান উত্তেজনা! ঢাকার বাতাসে তখন রাদুগা আর প্রগতি প্রকশনীর হাত ধরে রুশ কথা সাহিত্যের ঘ্রাণ! পল্টনের সিপিবি অফিসের সামনে, নীলক্ষেত (অতি অবশ্যই), কিছু চকচকে বইয়ের দোকান(জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী), সর্বত্রই তখন রুশ সাহিত্যের জয় জয়কার। তখন গোগ্রাসে গিলছি চেঙ্গিস আয়াতমাতভের ‘পাহাড় ও স্তেপের আক্ষান’, নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ‘ইস্পাত’, বরিস পলভয়ের ‘মানুষের মতো মানুষ’, ইভান তুর্গেনিভের ‘পিতাপুত্র’ দস্তয়ভস্কির ‘মাকারচুদ্রাই’, বরিস পস্তারনেকের ‘ডক্টর জিভাগো’ আর কত কি! তখন রুশ সাহিত্য পড়তে পড়তে কল্পনার চোখ দিয়ে স্তেপকে দেখতে পেতাম। চোখ বুজলেই মনে হতো ওই তো দূরে দেখা যায় পপলার গাছ! সেই পপলার গাছের পেছনের যে ছোট্ট বাড়িটা সেখানেই থাকে আমার স্বপ্নের নায়ক পাভেল করচাগিন।

স্পষ্ট মনে আছে ‘ইস্পাত’ আমি একবার নয়, উপন্যাসটি পড়েছিলাম গুনে গুনে নয়বার। রুশ সাহিত্য পড়তে পড়তে মনে হতো যদি আবার জন্ম নিয়ে এই পৃথিবীতে আসি তাহলে যেন একজন রুশ হয়েই জন্মলাভ করি। আর শুধুই কি পড়া? মনে হতো আমিও বুঝি সেই বলসেভিক বিপ্লবের অন্যতম সৈনিক। আমিই তো পাভেল করচাগিন? মনে আছে ইস্পাত উপন্যাসের নায়ক পাভেল করচাগিন বলছেন, “জীবন মানুষের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময় আর সেই জীবন মানুষ পায় মাত্র একটি বার। অতএব এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত একজন মানুষ বলতে পারে আমি আমার জীবন ব্যয় করেছি মানুষের জন্যে, মানুষের মুক্তি সংগ্রামে। ” কী কথা! তারপর ডক্টর জিভাগোর কথাই ধরা যাক। আহা বুদ্ধদেব বসুর কন্যা মিনাক্ষী দত্ত বইটির কি অসাধারণ অনুবাদই না করেছিলেন! স্পষ্ট মনে আছে বইটি পড়ছি আর কল্পনার চোখে দেখছি সেই তুষার আবৃত রুশ দেশটাকে যেখানে মানুষের সাথে মানুষের কোনো ভেদাভেদ থাকার কথা ছিল না। বইটি পড়ছি আর  কল্পনায় দেখছি পুরাতন একটি রেল স্টেশন আর দূরে ছোট্ট একটি সাদা ছবির মতন গ্রাম। যে গ্রামটি তুষারে ঢেকে সাদা হয়ে গেছে। সেই গ্রামের পাশের জঙ্গল থেকে শুনতে পাচ্ছি নেকড়ের ডাক। যখন বড় হয়ে ডক্টর জিভাগো সিনেমাটা দেখার সুযোগ পেলাম তখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করি যে বই পড়ে আমার কল্পনার দেখার সাথে সিনেমাটা কত অদ্ভুতভাবেই না মিলে গিয়েছিল!

তবে হ্যাঁ, শুধু রুশ কথাসাহিত্যের কথা বললেই হবে না সেই সাথে আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই সেসব কালজয়ী সাহিত্যগুলোর বাংলায় অসাধারণ অনুবাদের কথাটিও। আহা! সেই অনুবাদ যদি ননী ভৌমিক, হায়াৎ মামুদ বা দ্বিজেন শর্মার হাত দিয়ে হতো তাহলে তো কথাই ছিল না। এখন যখন সেই পুরনো স্মৃতি নিয়ে ভাবি পুরো বিষয়টাই নস্টালজিতে পেয়ে বসে। তখন তো আমাদের নাকের ডগার সামনে ফেসবুক ছিল না, অনলাইনে বইপড়ার কোনো সুযোগ ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না। কিন্তু তাতে কী? আমাদের গোটা হৃদয় জুড়ে ছিল অসাধারণ সব—এই এই শিল্পকর্মগুলো। খুব জানতে ইচ্ছে করে এখনো কি সেই রুশ সাহিত্য বাজারে পাওয়া যায়? নাকি আমার স্বপ্নের সেই নায়করা ঘুমিয়ে আছে ঢাকার নীলক্ষেতের দামি চকচকে ঝকঝকে বইয়ের স্তূপের নিচেই? খুব জানতে ইচ্ছে করে।

তবে শুধু কি বই? তখন ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’, ‘সোভিয়েত নারী’ ও ‘উদয়ন’ নামের অসাধারণ, বহুরঙা ম্যাগাজিন আসত বাংলাদেশে। সেগুলোও গোগ্রাসে গিলতাম। মনে পড়ে, তখন সোভিয়েত বইপত্র ও ম্যাগাজিনে তাদের মহাকাশ অভিযান, বিভিন্ন জাতির লোককথা ও সাংকৃতিক জীবনযাত্রা নিয়ে প্রচুর আলেখ্য থাকত। ইউরি গ্যাগারিন, ভ্যালেন্তিনা তেরেশকোভা ও সভেৎলানা সাভিৎস্কায়ারা তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতীয় বীর। পাতার পর পাতা ভরা থাকত তাদের জীবন ও রোমাঞ্চকর অভিযানের ছবি ও বিবরণ দিয়ে। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের নানা জাতির শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার নানা বিবরণ পড়ে এত ভালো লাগত যে, সে মুগ্ধতার রেশ আজও রয়ে গেছে।



কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, আজারবাইজান—এসব দেশের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি ও নানা জাতি-উপজাতির জীবনযাত্রা আজও আমাকে টেনে সেই সময়ের কাছে নিয়ে যায়। সত্যি কী চমৎকার ছিল সেই মনোহরি রঙের উদয়ন! বাহারি রঙের কভার আর সেই সাথে চোখ আটকে থাকা অসাধারণ সব ছবিতে ঠাসা ছিল ম্যাগাজিনটি। কাগজের মান ছিল এক কথায় অপূর্ব! মনে আছে উদয়নটা হাতে নিয়ে এর কাগজের ঘ্রাণটা প্রাণভরে নিয়ে নিতাম। তারপর কল্পনায় সেই উদয়নের পাতায় ভর করে গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নে এক চক্কর ঘুরে আসা যেত। এখনো বেশ মনে পড়ে, উদয়নের একটি সংখ্যা কাজাখস্তানের মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির ওপর ছিল। সেখানে কাজাখ গ্রামবাসীরা তাদের কোনো একটি উৎসবে মেতে উঠেছিল। সেই উৎসবের মধ্যমনী ছিল এক কাজাখ নারী। আহা! কি অপূর্ব তার ভঙ্গী আর কত সুন্দর ছিল তার চেহারা! সেই ছবিটা মনের পর্দা থেকে কি এত সহজে দূরে সড়ানো যায়? নাকি তা সম্ভব?

এখন গোটা পৃথিবীটাই মানুষের হাতের তালুতে বন্দী হয়ে গেছে। কম্পিউটারের বোতাম টিপলেই সব তথ্য হাতের কাছে চলে আসে। তারপরও ভাবি, এই জীবনে কী যেন নেই! কী নেই? কোথায় যেন সেই নিখাদ এক চিলতের আনন্দটুকু মিলিয়ে গেছে। যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমুতে যাই, বালিশে মুখ গুঁজি, তখন চোখের সামনে সেই রঙ-বেরঙের লোভনীয় প্রচ্ছদে ভরা বইগুলো স্পষ্ট দেখতে পাই। তখন আমার নাকের সামনে ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো দুলতে থাকে ম্যাক্সিম গোর্কি, নিকোলাই গোগল, নিকোলাই অস্ত্রভস্কি, বরিস পলভয়, চেঙ্গিস আয়াতমাতভ—এঁরা সবাই। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি আমি তখন একা নই। আমি নিত্যই তখন তাঁদের সাথে কথা বলি, মনের দেওয়া-নেওয়া করি। তখন মনে হয় ডিজিটাল দুনিয়ার সাথে তো আমার কোনো দ্বন্দ নেই? আমি তো আমার সেই একান্ত জগতেই আছি। যখন খুশি সেই জগতে ডুব দিয়ে অবগাহন করা। তখন আমি আমার আমিটি হয়ে আমার আপন জগতে গুটি পোকার মতো বেশ চুপচাপ বাসা বেঁধে প্রাণের বসতটি গড়তে পারি। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, রুশ কথা সাহিত্যের সেই নস্টলজিতে ভরা বইগুলো আপনাকেও কি স্পর্শ করে না? নিত্য তাড়া করে না!



বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, আগস্ট ১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।