ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রং আছে, রং নেই | মণীশ রায়

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ৫, ২০১৫
রং আছে, রং নেই | মণীশ রায়

ধীরে ধীরে একজন মানুষের আকৃতি স্পষ্ট হচ্ছে ক্যানভাসের শরীরে।
একটা ভাঙা বাড়ির দাওয়ায় উবু হয়ে বসে রয়েছেন মানুষটি।

চোখে চশমা; লম্বাটে মুখ জুড়ে ক্ষুরধার দুটো চোখ; খড়ের মতো সফেদ ঝাকড়া চুলের ঠিক মাঝখান বরাবর পাহাড়ি রাস্তার মতো চিকন  সিঁথি। গায়ে পাঞ্জাবী আর পরনে ধুতি।
রেজা মাসুদের খুব চেনা লাগছে লোকটাকে। তবু তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না এ কার মুখ।
মানুষটার হাতে ধরা একটা সোনালি রঙের পুরনো দিনের  ঝর্না কলম। রোল করা দামি কাগজের উপর ক্যানভাসের চরিত্রটি ঝুঁকে রয়েছেন।
কিছু কি ভাবছেন মানুষটা?
মুখাবয়বের রেখাগুলো সেকথা বলছে না; বরং বিষণ্ণ লাগছে তাকানোটা; কোনো কিছু হাতছাড়া হয়ে পড়লে মানুষকে যেরকম রিক্ত-নিঃস্ব দেখায় সেরকম।
মানুষটার কী এমন হারিয়ে গেছে যে কলম নিয়ে ঝুঁকে রয়েছেন সাদা কাগজের উপর?
রেজা মাসুদ ঘুরে-ঘুরে দেখছেন  আর মাঝে মাঝে শিল্পী-লেখকদের উৎসাহ দিয়ে মৃদু কণ্ঠে এক-দুটো কথা বলছেন। তার গলায় জড়িয়ে রয়েছে লাল উত্তরীয়; পরনে গেরুয়া রঙের মুগার পাঞ্জাবী আর পাজামা। ফোঁটা-ফোঁটা ঘাম জমেছে উজ্জ্বল গৌরবর্ণ টাকে। চশমা দেয়া গোল-গাল মুখের চেহারা আর টাকের রং এক।
মুখ জুড়ে স্মিত হাসি; মাথার চারপাশে ভাড়া করা স্টিল ও মুভি ক্যামেরা সক্রিয় থাকায় তিনি সদা সচেতন। কোনোভাবেই যেন অযাচিত হাঁচি-কাশি আর মুখ-ভেংচি চ্যানেলের আয়নায় নিজের ভারচুয়াল-ইমেজ ক্ষুন্ন করতে না পারে সেদিকে তার সতর্ক নজর ।

মাসুদ এককালে গান-টান করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানগুলোয় প্রায়শই তাকে কোরাসে সবার সঙ্গে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে গান গাইতে দেখা যেত। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ কিংবা ‘তীর হারায়ে ভবের সাগর পাড়ি দেবরে’ জাতীয় দেশাত্মবোধক গানে জোরালো কণ্ঠে হাত তুলে কোরাসে গলা মেলানোটাই ছিল সেই জীবনে ওর প্রধান কাজ। কখনো কেউ তাকে সলো কোনো গান করতে দেখেনি।



“আপনি কী কী করতে পারেন আমার জন্যে? বউ ছেড়ে দিতে পারেন?” ফের হাসিতে ভেঙে পড়ে সে।
“আপনি বললে তাও চেষ্টা করে দেখতে পারি। ” বলে সাহসী চোখে ওর চোখে চোখ রাখেন। তিরিশ ছুঁই-ছুঁই লাবণ্যময়ী এক নারী। চোখে চশমা। হাইট পাঁচ-পাঁচ। আভিজাত্য ও লাবণ্য মিলেমিশে একাকার ওর আচার-আচরণে।



তা সত্ত্বেও রেজা মাসুদ  নিজেকে একজন সংগীতশিল্পী হিসাবে পরিচয় দিতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আর এই তাড়না থেকেই তিনি ক’বছর ধরে কবি-লেখক-শিল্পীদের একত্র করছেন গাজীপুরে, সবুজ ক্যানোপিতে ঢাকা নিজের বাগানবাড়িতে। শিল্পীদের গাড়ি দিয়ে বাসা থেকে বয়ে আনা থেকে গাড়ি  করে বাসায় পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত সব দায়িত্ব তার কাঁধে। তাদের খাওয়ানো ও দামি-দামি সব গিফট দিয়ে তৃপ্ত রাখার এক অমলিন খায়েস তার মাথায় চেপে বসে রয়েছে ক’বছর ধরে।

এ উপলক্ষে গাজীপুরের বাগানবাড়িটা জমজমাট সাজে সেজে উঠেছে। পায়ের নিচে কোমল ঘাস আর মাথার উপর রকমারি গাছের ছায়া সত্যি-সত্যি মনোমুগ্ধকর এক আবহ তৈরি করে। স্টেজে অবিরাম চলতে থাকা একের পর এক প্রিয় গান আর হাতের সবদিকে ছড়ানো চর্ব-চুষ্য-লেহ্য-পেয় এমন করে ডাকতে থাকে যে দীর্ঘদিনের ডায়বেটিস রোগী-শিল্পীটিও রেজা মাসুদের দাওয়াত পেলে আবেগে একেবারে ছলকে ওঠেন, “ছেলেটা আসলে খুবই ভালো। শিল্পের এরকম সমজদার আজকালকার যুগে পাওয়া সত্যি মুশকিল। ”

রূপা সবে ডায়াস থেকে দুটো গান গেয়ে নামল। রেজা মাসুদকে কাছে পেয়ে  গলে একেবারে আইসক্রিম, “এই জায়গাটা এত সুন্দর! আচ্ছা রেজাভাই , পুকুরপাড়ে নাকি চন্দন গাছও আছে? প্লিজ, একটু নিয়ে চলেন না?”
রেজা ওর গানের খুব ভক্ত। মহিলার একটা গায়কী আছে, নজরুলের গানে টান দিলেই বোঝা যায় এটা রূপা। রেজা ওর কথায় শান্তিনিকেতনী বিনয় দেখিয়ে উত্তর দিলেন, “চলুন না। ”
ওরা হাঁটতে হাঁটতে পুকুরপাড়ের দিকে গেল।
রূপা বলছে, “আচ্ছা রেজাভাই একটা সত্যি কথা বলবেন?”
“বলুন। আমি কমই মিথ্যা বলি। ”
“আপনি কি চ্যানেল নামাচ্ছেন?”
“কে বলছে?”
‘বাজারে চালু আছে। নইলে আপনি ক’বছর ধরে অত শিল্পী-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের তোয়াজ করে বেড়াচ্ছেন কেন?” বলে সে ওর মাড়ির একটি বাড়তি দাঁত দেখিয়ে মিষ্টি একখানা হাসি উপহার দিল রেজা মাসুদকে।
রেজা তাকালেন রূপার দিকে। এই মহিলার একটা প্রধান গুণ হচ্ছে ঠুসঠাস কথা বলে ফেলা। অন্যদের মতো পিঠ চাপড়ে পিঠে ছোরা বসায় না সে। তাছাড়া, খুব মিলে যায় ওর সঙ্গে।
পুকুরপাড়ে এসে রেজা মাসুদ একটি গাছ দেখিয়ে বললেন, “এই হলো চন্দন গাছ। ”
রূপা গাছটির ডালপালা হাত দিয়ে ধরে ধরে কিছুক্ষণ পরখ করার পর শিশুসুলভ সারল্য নিয়ে বলল, “আমাকে কিন্তু একটি ডাল দিতে হবে। ”
“বাসায় পাঠিয়ে দেব। আপনি বললে কি না করতে পারি বলুন? তাছাড়া, আপনি নিজেই তো চন্দনবৃক্ষ। যে এমন সুন্দর গান করে সে তো চন্দনই। ” কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারায় রেজা মাসুদ বেশ তৃপ্তি বোধ করেন মনে মনে।
রূপা খিলখিল করে হেসে ওঠে। ওর গালে টোল পড়ে হাসতে গিয়ে।
“আপনি কী কী করতে পারেন আমার জন্যে? বউ ছেড়ে দিতে পারেন?” ফের হাসিতে ভেঙে পড়ে সে।
“আপনি বললে তাও চেষ্টা করে দেখতে পারি। ” বলে সাহসী চোখে ওর চোখে চোখ রাখেন। তিরিশ ছুঁই-ছুঁই লাবণ্যময়ী এক নারী। চোখে চশমা। হাইট পাঁচ-পাঁচ। আভিজাত্য ও লাবণ্য মিলেমিশে একাকার ওর আচার-আচরণে।
“আচ্ছা, ওই যে শিল্পী জগন্ময়, উনি আসলে কী আঁকছেন বলতে পারেন?”
“একটা কিছু তো আঁকছেন। উপমহাদেশের এত বড় শিল্পী; যা আঁকবেন তাই সুষমামণ্ডিত হবে। ”
“আপনি বোঝেন সব?”
‘চেষ্টা করি। যেমনিভাবে আপনার গান শুনে মুগ্ধ হই। ”
“বাজে কথা। আপনি সবসময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলেন। ” রূপার এলোচুলে দিঘির বাতাস খেলা করে।
“ফের বলছি। আমি কম মিথ্যা বলি। ”
“ভাবী জানলে ঠ্যাং ভেঙে দেবে। ফ্লারটিং করা ছাড়াবে। ”
“তাই?”
“ঠিক তাই। ” বলেই ও আবার হেসে ওঠে খোলা প্রকৃতির মাঝখানে।
এসময় রেজা মাসুদের সেলটা বেজে ওঠে। কানে লাগাতেই শীলা মাসুদ, “কোথায় তুমি? রূপাও নেই, তুমিও নাই—ব্যাপারটা কী? ফ্লারটিং করছো?”
“কই, না তো। ” আমতা আমতা করে ওঠেন তিনি।
“যেখানেই থাকো চলে এসো সভায়। সবাই এখানে তোমার খোঁজ করছে। ”
রূপার চোখে চোরা হাসির ঝিলিক। তড়িঘড়ি করে অনুষ্ঠানস্থলের দিকে এবাউটটার্ন করতেই সে বলে উঠল, “ভাবী, না?”
“হুঁ। ”
এবারও রূপা বাধভাঙা হাসি হেসে নেয় একচোট। এটা ওর প্রতি বিদ্রূপ কিনা বুঝতে পারেন না তিনি। তার তখন একটাই লক্ষ্য। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সভাস্থলে চলে যাওয়া; কারণ স্ত্রীর চোখে সে ধরা পড়ে গেছে। প্রতি পদে এখন নাকাল হবার আশঙ্কা।

শীলা কখনোই কোনোকালে ওকে সরাসরি অক্রমণ করে না। ওটা ওর স্বভাবে নেই। ওর স্বভাবসুলভ ন্যাকা-ন্যাকা আহ্লাদী ভঙ্গিমায় নিজের বিরক্তি-ক্ষোভ এগুলো প্রকাশ করে থাকে। থার্ড পারসন হয়ে রং চড়ানো এসব শুনতে খুব উপাদেয় মনে হলেও বিশ বছরের দাম্পত্যে এগুলো এখন বড়ই বিরক্তি-উদ্রেককারী আচরণ বলে মনে হয় ওর। স্রেফ প্যানপ্যানানি ছাড়া আর কিছু নয়। তিন বাচ্চার মাকে এখন আর এসবে শোভা পায় না। তবু সহ্য করতে হয়।

তিনি ত্রিপল টাঙানো আঙ্গিনায় প্রবেশ করেন। চারপাশে এতসব গাছেদের ছায়া যে রোদ খুব একটা কাবু করতে করতে পারে না কাউকে। পাশেই বাংলো বাড়ি; চাইলেই কেউ গিয়ে শরীরে এসির বাতাস লাগিয়ে আসতে পারে। হার্ড ড্রিংক -সফট ড্রিংক আর দেদার স্ন্যাকস ছড়িয়ে রয়েছে প্রতিটি থামের কোণায়-কোণায়। যে কেউ হলরুমে ঢুকে তা উপভোগ করতে পারেন।

জগন্ময় শীল নিরামিষাশী মানুষ। বয়স প্রায় সত্তর। কুঁজো হয়ে হাঁটেন। ফর্সা লম্বা চেহারা। কণ্ঠস্বর পাতলা; বিনয় মিশে রয়েছে কণ্ঠনিঃসৃত প্রতিটি শব্দে। রেজা মাসুদের এক ভারতীয় বন্ধুর সুবাদে তার সঙ্গে পরিচয়। তখন থেকেই মানুষটাকে নিয়ে একটা জমায়েত করার ইচ্ছে গাজীপুরের এই  বাগানবাড়িটিতে।
জগন্ময় শীলের নাম ওর এক শিল্পীবন্ধুকে জানাতেই সে  হৈ-হৈ করে ওঠে, “খুব ভালো হয়। উনার ছবি আমার কাছে তো খুব ভালো লাগে। এমন বিষণ্ণ যে ছবিটার দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকলে নিজের ভেতর কেন যেন এক পরিত্যক্ত বোধ জন্ম নেয়। আহা!”
রেজা মাসুদ বেশ উদ্দীপ্ত বোধ করেন একথায়। শিল্পীকে পেতে নিয়মিত যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।



“গুরুজি, আমি বিক্রমপুরের ছিনগর থেকে এসেছি। ”
মানুষটা সঙ্গে সঙ্গে মিইয়ে গেলেন। আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল নিজেকে ভদ্ররূপে প্রকাশ করার। একসময় বলেই ফেললেন, “নিয়ে যাবি আমায়? খুব টানে পদ্মার পাড়। নিবি? থাকা-খাওয়ায় আমার কোনো বায়না নেই রে। আমার রান্না আমিই রেধে খাই।
মানুষটা এমনভাবে কথা বলছেন যে রেজা মাসুদ একেবারে থ। চিত্রশিল্পী এস.এম. সুলতানের কথা মনে হলো ওর। সারল্যের দিক দিয়ে দুজনার বিস্তর মিল লক্ষ্য করছেন তিনি।



বোলপুরে কোপাই নদীর তীরে একটা মাটির ডেরায় তিনি থাকেন। নেশার ভেতর শুধু হুকো টানেন আর মাঝে মাঝে মহুয়া পান করেন সাঁওতালীদের পরব-পার্বণে।   নিয়মিত মদ্যপানের  নেশা-টেশা নেই বললেই চলে; অকৃতদার মানুষটি মাঝে মাঝে চাঁদের নেশায় বুঁদ হয়ে কোপাই-ময়ূরাক্ষী নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ায় রাতের বেলায়। পাগলাটে স্বভাবের মানুষ হিসাবেই তাকে সবাই জানে ও চেনে।
ভারতীয় সেই বন্ধুটি বলেছিল, “ ম্যানেজ করতে পারবেন তো দাদা?”
“কেন পারব না? আমার বাগানবাড়িটি পুরো খুলে দেব তাঁর জন্যে। দিনের বেলায় শ্যামল প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াবেন আর রাতে চাঁদ দেখবেন। কোনো অসুবিধা নেই। ”
“ঠিকাছে। দেখি রাজি হয় কিনা। একবার লসএঞ্জেলসের একজন বাঙালি এসেছিলেন তাঁকে সেখানে নিয়ে যাবেন বলে নেমন্তন্ন করতে। লোকটি টাকা পয়সা নিয়ে কী সব উল্টাপাল্টা বলে ফেলেছিলেন যে জগন্ময়দা খুন্তি নিয়ে লোকটিকে তাড়া করেছিলেন রাস্তা পর্যন্ত। কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে বেঁচেছিল সেই যাত্রায়। হাঃহাঃহাঃ। ’
সব শুনেও রেজা মাসুদ দমে যাননি। নিজে ব্যবসায়ী মানুষ। তার ওপর শিল্পী-লেখকদের ঘিরে রয়েছে তার অপার কৌতূহল।
তিনি এর ভেতর শিল্পী জগন্ময় শীল সম্পর্কে খবরাখবর নিতে লাগলেন। খবর বলতে ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি আর কি। আর কিছু বাংলাদেশের মুগ্ধ তরুণ বন্ধুবান্ধব, যাদের কাছে অনেকদিন থেকে এই শিল্পীর গুণগান শুনে আসছেন তিনি।
যেখানে শিল্পী থাকেন, সেখানকার পুরোটাই গাছে ঢাকা। সামনে একটা বিশাল উঠোন। তারপর শনছাওয়া মাটির কুঁড়েঘর। ঘরটার উপর দুটো সজনে গাছ একসঙ্গে হুমড়ি খেয়ে রয়েছে। একটা বয়স্ক বড়ই গাছ  আর কলাগাছের সারি অন্যপাশে।
রেজা লক্ষ্য করলেন, উঠোন একেবারেই সাফসুতরো। কোথাও একটা পাতা পর্যন্ত পড়ে নেই।
তিনি যখন উঁকিঝুকি মারছেন তখনি হঠাৎ করে হাতে খুন্তি নিয়ে জগন্ময় শীল বেরিয়ে এলেন, “হুলো বেড়ালের মতো কাকে খুঁজছিস?”
“গুরুজি, আমি বিক্রমপুরের ছিনগর থেকে এসেছি। ”
মানুষটা সঙ্গে সঙ্গে মিইয়ে গেলেন। আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল নিজেকে ভদ্ররূপে প্রকাশ করার। একসময় বলেই ফেললেন, “নিয়ে যাবি আমায়? খুব টানে পদ্মার পাড়। নিবি? থাকা-খাওয়ায় আমার কোনো বায়না নেই রে। আমার রান্না আমিই রেধে খাই।
মানুষটা এমনভাবে কথা বলছেন যে রেজা মাসুদ একেবারে থ। চিত্রশিল্পী এস.এম. সুলতানের কথা মনে হলো ওর। সারল্যের দিক দিয়ে দুজনার বিস্তর মিল লক্ষ্য করছেন তিনি।
“আপনি যাবেন তো?”
“কেন যাব না? নদীটা তো এখনো আমায় ডাকে। সেই অশ্বত্থ গাছটা তো এখনো আমার মাথার ভেতর। এই জীবনে কত অশ্বত্থ আর বটবৃক্ষ দেখেছি। কিন্তু ওই পদ্মাপাড়ের নিঃসঙ্গ বৃক্ষটির কি তুলনা হয়? আমার পুরো কৈশোরটাই তো ওই বৃক্ষটার নাড়িভূড়ির সঙ্গে পেঁচিয়ে রয়েছে। বুঝতে পারছিস?”
প্রথম দর্শনেই এরকম তুই-তুকারি কারো কারো মুখে বেশ আলগা লাগবার কথা। কিন্তু জগন্ময় শীল উচ্চারিত এই তুই-তুকারি মোটেই রেজা মাসুদকে অপমানিত করছে না, বরং মানুষটির প্রতি নিজের ভেতর একধরনের গভীর আত্মীয়তাবোধ জাগিয়ে তুলছে। বড় ভালো লাগছিল তখন।
“আমি আপনাকে সেই বৃক্ষটাই দেখাতে নিয়ে যাব। যাবেন তো?”
“আজ শজনের ডাঁটা দিয়ে মুগ ডাল আর ভাত রেধেছি। তুই খেয়ে যাস? অকৃতদার মানুষ হলেও আমার রান্নার হাতটা অংকনের মতোই মন্দ নয় রে। ”

রেজা মাসুদ দুঁদে ব্যবসায়ী মানুষ। মানুষের ভালো-মন্দ মুখোশ-অমুখোশ অবয়বের  অনেকখানিই ওর জানা। কাউকে তুষ্ট করতে গেলে কিভাবে এগোতে হয় তা ওর জানা-বোঝার বাইরে নয় বলেই তিনি আজ এত টাকার মালিক। নইলে সামান্য পুঁজি সম্বল করে বস্ত্র-বিস্কুটের এরকম নামজাদা শিল্প-কারখানার মালিক হতে পারত? ওরই বানানো বস্ত্র বিদেশীরা গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর ওর কারখানায় তৈরি বিস্কুট সৌদি আরব-দুবাই-সিংগাপুর-মালয়েশিয়াসহ পুরো উপমহাদেশ জুড়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে; এ কি কম কথা?
সেই রেজা মাসুদ মানুষটার সারল্যে এতটাই মুগ্ধ যে তিনি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে তার সঙ্গে লাঞ্চ করলেন।
সেই তো শুরু। তারপর এদেশে শিল্পী জগন্ময় শীল এলেন। যেদিন এলেন সেদিনই চলে গেলেন পদ্মাপাড়ে। একটা মরোমরো অশ্বত্থ গাছ পেয়েও গেলেন সেখানে। মানুষটির অবসেশনের সঙ্গে একেবারেই মিলে গেল জায়গাটা।
রেজা মাসুদ গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছেড়ে দিলেন শিল্পীকে। একছুটে জগন্ময় চলে গেলেন বৃক্ষের কাছে।
একটু বাদে তিনি  দূর থেকে লক্ষ্য করলেন,  মানুষটি বৃক্ষটিকে জড়িয়ে ধরে পরম মমতায়  হাত বুলিয়ে আদর করে চলেছেন। রেজার বড় কৌতূহল হলো; কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী খুঁজছেন অমন করে?”
“আরে এইখানটায় একটা লেখা ছিল। গাছখোদাই আর কি। ওটা কই?”
রেজা  হেসে ফেললেন এই পাগলামো কাণ্ড দেখে। পঞ্চাশ বছর পর কেউ গাছ-খোদাই ফিরে পায়?
“কী লেখা  ছিল ওখানে?”
“জগা মধু। হেঃ হেঃ হেঃ । মধু আমার কৈশোরের প্রেম। একটা বাহারি কবুতর। হেঃ হেঃ হেঃ। ”

[দ্বিতীয় কিস্তিতে শেষ হবে]



বাংলাদেশ সময়: ১৮০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।