ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রতন | জয়শ্রী সরকার

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৮, ২০১৫
রতন | জয়শ্রী সরকার

কী মিয়া খাইবেন না? খান মিয়া, খান। খাওয়নের রুচি কই গেল? আপনের কি শরীরটা খারাপ? কথা কন মিয়া।

কথা না কইলে বুঝব কেমনে কী হইছে?

রতন কোনো কথা বলে না। মাটি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দূরে বয়ে যাওয়া নদীটির দিকে তাকায়। ফজর আলী বলতেই থাকে। ঐ দিকে কী দেখেন? ফিরেন এইদিকে। শুনেন, সারাদিন তো দানা পানি পড়ে নাই পেটে। ঐ নদী দেইখ্যা পেট ভরবে? দেখেন শুকাইয়া চৌচির হইয়া গেছে। গোসল করন যায় না, করলেও শইলের ময়লা কাটে না। শুকনা নদী এত দেখনের কিছু নাই মিয়া। আমার কথা শুনেন। খাইয়া নেন।

রতন চোখ ফিরায়। ফজর আলীর দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে। এমন সময় একটি পাখি উড়ে এসে খড়ের গাদার ওপর বসে। সঙ্গে সঙ্গে রতনের দৃষ্টি চলে যায় পাখিটির দিকে। ফজর পাখিটিকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে।



মমিনের বন্ধুরা একদৌড়ে বাড়ির সীমানা পেরিয়ে মাঠে গিয়ে বসে। ফজর আলীকে রাগাতে পেরে উৎফুল্ল হয়। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে একজন অন্যজনের ওপর। বলাবলি করে ফজর আলীর কাণ্ডকারখানা।
- কি পাগলারে মমিনের বাপ। পশুপাখিরে আপনি ছাড়া কথা কয় না। আর মাইনষেরে করে তুই তুকারি।



এই যে আপনে কই থেক্কা আইলেন? আইবার আর সময় পাইলেন না? এমনিতে উনি খাইতেছেন না। তার মধ্যে আপনি আইসা দিলেন উনার মন ঘুরাইয়া। কী যে করেন! প্রায় তো বুঝাইয়া ফেলাইছিলাম। এখন কি আর কথা শুনবে!

ফজর আলীর কথা পাখিটা বুঝল কিনা তা পাখিটাই ভালো জানে। তবে দৃশ্যত পাখিটা উড়ে চলে গেল। ফজর আলী আবারও রতনকে খাওয়ানার চেষ্টায় মন দিলেন।

মমিনের বন্ধুরা মমিনকে খুঁজতে এসেছিল। আম গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে তারা ফজর আলীর সব কথাই শুনছিল। ফজরের এহেন কথোপকথনের সাথে তারা পূর্বপরিচিত। পরিকল্পনা মাফিক ফজর আলীকে বিরক্ত করার জন্যে সবাই  হুড়মুড় করে রতনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রতন ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে। ফজর আলী রেগে যায়।
- ঐ এইখানে কী?
- চাচা মমিন নাই? ওর কাছেই আইছি।
- অসভ্যের দল জানি কোনখানকার। কাম কাজ নাই? খালি ভরঙ চরঙ। দেখতাছে একটা কাম করতাছি। আইসা দিল আমার চেষ্টার মইধ্যে পানি ঢাইল্যা। মমিন বাড়িত নাই। যা ভাগ।

মমিনের বন্ধুরা একদৌড়ে বাড়ির সীমানা পেরিয়ে মাঠে গিয়ে বসে। ফজর আলীকে রাগাতে পেরে উৎফুল্ল হয়। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে একজন অন্যজনের ওপর। বলাবলি করে ফজর আলীর কাণ্ডকারখানা।
- কি পাগলারে মমিনের বাপ। পশুপাখিরে আপনি ছাড়া কথা কয় না। আর মাইনষেরে করে তুই তুকারি।


২.
তরকারিতে বলক উঠছে। লতিফা হাতের তালুতে ঝোল চেখে দেখে। সব ঠিকই আছে। লতিফা চুলায় জ্বলতে থাকা কাঠটি তুলে আগুন নিভায়। এমনিতেই ঘর লেপতে গিয়ে রান্নার দেরি হয়ে গেছে। মমিন শিং মাছ ধরে এনেছে অবেলায়। মাছ কাটতে বাছতে গিয়ে বেলা সারা। লতিফা তরকারির পাতিল নামিয়ে মাচায় রাখে। শিলপাটা জায়গামতো রাখে। উল্টে রাখা ভাতের হাড়ি তুলে ঝাঁকুনি দিয়ে ঠনায় বসায়। শাক-ডালের বাটিটি ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়। কটা শিং মাছ সাতলে রেখেছে আগামীকালের জন্যে। সেগুলো ছিক্কায় তুলে রাখে। এমন সময় ফজর আলী দরজায় এসে দাঁড়ায়।
- লতিফা,  রতন তো কিছু খায় না!
- খায় না কেন?
- বুঝি না তো। মন কয় শরীর সুবিধার না।
- এ নিয়া আপনে এত চিন্তা করেন কেন? একটু জিরান দেন। শুনেন রান্ধন শেষ। গোসল দিয়া আসেন। বেইন্না বেলায় খান নাই। আইসা ভাত খান।
- কী কও? সে না খাইলে আমি কেমনে খাই? তোমার দেহি আক্কল বুদ্ধি কমতাছে!



- আম্মা আমি কাম করি না! বিকালে অত্তটি মাছ ধইরা তো দিয়া গেলাম। সেইটা কাম না?
- তা মাছ ধইরা দিয়া গেলেই কি কাম সারা? সারাদিন রতন খায় নাই। রতনরে দেখাশুনা করলেও তো হয় নাকি? 
এই বলে রাগে গজগজ করতে করতে কল পাড়ের দিকে চলে যায় ফজর আলী।  
- দেখছেন? আমি খাইলাম কিনা খবর নাই! গরু খাইলো না এই নিয়া আব্বার কত চিন্তা!
- না না তোরে নিয়াও চিন্তা করে। চিন্তা করে দেইখাই তো কয়।



লতিফা কথা বলে না। চুলার পাশ ঝাড়তে থাকে। ফজর আলী বুঝতে পারে লতিফার বিষয়টা পছন্দ নয়। পছন্দ না হলে লতিফা কথা বাড়ায় না। সুতরাং এখন কিছু বলা বৃথা আস্ফালন। ফজর আলী  দরজা থেকে সরে গিয়ে বারান্দার বসে। ছেলেকে ডাকে।
- মমিন, ও মমিন কই গেলি?
মমিনের সারা মেলে না।
- ডাকলে পাওয়া যায় না। বাড়িত সব ভাইসা যাক। তার তাতে কী? টইটই কইরা ঘুইরা বেড়াইতেছে। মারবেল খেলে, লাটডুম খেলে। বুইরা পোলা; হিরিম তিরিম যায় না। আস্কারা দিয়া বাদাইম্যা বানাইতাছে। বানাক।

স্বামীর কথা শেষ হতে না হতেই লতিফা এসে উঠানে নামে।

- শুনেন পোলা তো মাছ ধইরা দিয়াই গেল। কাম তো করে। খালি পেচাল করেন। গোসল দিয়া আসেন। রান্ধা শেষ।

লতিফার কথায় ফজরের রাগ হয়। সে বিড়বিড় করতে করতে উঠে চলে যায় রতনের কাছে। রতনকে মাঝে রেখে চারপাশ ঘুরে-বসে-দাঁড়ায়। গায়ে হাত বুলায়। মন ভুলানো কথা বলে। খাওয়ার জন্যে আকুতি মিনতি জানায়।

- শুনেন মিয়া আপনের আম্মার রান্ধন শেষ। আমারে খাইতে ডাকতেছে কিন্তু আপনে না খাইলে আমি কেমনে খাই? আপনে তো জানেন আমার না খাইলে শরীল খারাপ করে। রাগ যদি কইরা থাকেন কোনো কারণে তাইলে মাপ করেন। খাইয়া নেন।

সন্ধ্যা প্রায়। লতিফা বেগম ভাতের মাড়ে দুই চামচ ভাত নেয়। বয়াম থেকে লবণ ঢালে। এরপর বালতি নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

ফজর আলী রতনের পাশে বসে আছে। লতিফা বালতি নামিয়ে রাখে।
- মমিনের বাপ সরেন। আমি দেখতেছি।
ফজর আলী সরে দাঁড়ায়। লতিফা মাড় চাড়িতে ঢালে। রতনের মুখটা চাড়ির দিকে ঠেসে ধরে। রতন অল্পক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এরপর চুকচুক করে সবটা মাড় খেয়ে নেয়। ফজর আলী খুশিতে লাফিয়ে ওঠে।
- একি! সারাদিন এত্‌তো তেল মাখলাম কাজ হইল না? এখন ঠিক খাইয়া ফেললেন!
- তেল না মাইখা বুদ্ধি খাটাইলেই হইত। বইসা খালি ঝামেলা করেন। সারাদিন যখন খায় নায় তখন খাওয়নডা একটু বদলাইয়া দিলেই তো হইত।
- তা তুমি অত জান, একটু আইসা ঘুইরা গেলে হইত কী?
- আমার তো আর কাজ কাম নাই। আইচ্ছা, পেচাল রাখেন। যান গোসল দিয়া আইসা ভাত খান।

ফজর আলী থা বাড়ায় না। বারান্দা থেকে গামছা-লুঙ্গি নিয়ে নদীর দিকে চলে যায়।

গোসল শেষ। বারান্দায় বসে তেল মাখছে ফজর আলী। লতিফা রান্না ঘরে পাটি পেতে রাখে। কুপির সলতে বাড়িয়ে মাঝখানে রাখে। থালায় ভাত বাড়ে। ভাতের পাশে শাক আর শুকনা মরিচ পোড়া দিয়ে স্বামীকে ডাকে। ফজর আলী খেতে বসে। লতিফা ভাতের থালাটি এগিয়ে দেয়। বাটিতে করে দেয় শিং মাছের ঝোল। সারদিন খাওয়া হয়নি ফজরের। চিন্তায় খাওয়ার কথা মনে ছিল না। চিন্তা কমে যাওয়ায় ফজর আলীর খিদে সপ্তমে এখন। সে ঝটপট ভাত মাখে। লতিফা পাশে বসে স্বামীর খাওয়া দেখে। শাক দিয়ে খাওয়া শেষ করে ফজর আলী মাছের তরকারি ঢেলে নেয়। এমন সময় মমিন বাড়িতে ঢোকে।
- আম্মা ভাত দেন।
- হাত পাও ধুইয়া আয়। ভাত দিতেছি।
- ধোওয়া ধোয়ির সময় নাই আম্মা। কয়ডা ভাত দেন। খাইয়া যাই।
- জমিদারের বেটা আইছেন। দেন ভাত দেন।  
লতিফা ছেলের দিকে ভাতের থালা এগিয়ে দেয়।
- খা বাজান। তা সারা বিকাল কই ছিলি? তোর বাপে তো খোঁজ করে। ঘুরাঘুরি কম করলে বাপে খুশি হয়।
- আম্মা আমি কাম করি না! বিকালে অত্তটি মাছ ধইরা তো দিয়া গেলাম। সেইটা কাম না?
- তা মাছ ধইরা দিয়া গেলেই কি কাম সারা? সারাদিন রতন খায় নাই। রতনরে দেখাশুনা করলেও তো হয় নাকি? 
এই বলে রাগে গজগজ করতে করতে কল পাড়ের দিকে চলে যায় ফজর আলী।  
- দেখছেন? আমি খাইলাম কিনা খবর নাই! গরু খাইলো না এই নিয়া আব্বার কত চিন্তা!
- না না তোরে নিয়াও চিন্তা করে। চিন্তা করে দেইখাই তো কয়।
- হু! দুপুরে দোস্তরা আইছিল আমারে খুঁজতে। হেরা কইল তোর বাপে গরুরে কয় আপনে, পক্ষিরে কয় আপনে আর মানুষরে কয় তুই। বুঝেন আম্মা কী শরম ডা পাইছি!
- শরমের কী আছে? তোর বাপেরে কি আর তারা চিনে না। মানুষটা একটু পশু পক্ষি ভালোবাসে।
- হু বুজছি! আপনে তো আব্বার পক্ষেই থাকবেন। আম্মা, আর কয়ডা ভাত দেন।
- অত্ত তাড়া কেন বাপ?
- বটতলা আইজ গান আছে। শহর থেইক্কা অনেক বড় বড় শিল্পী আনছে। দুইদিন ধইরা চলতাছে গান। আইজ শেষ দিন। সারারাইত গান মাতবাম আইজ।
- তোর আব্বারে কইয়া যা।
- আম্মা কী বলেন! আব্বারে কইলে যাইতে দিব নাকি? আপনি কইয়া দিয়েন।

লতিফার আপত্তি মমিন শোনে না। সে তড়িঘড়ি থালায় হাত ধুইয়ে উঠে দাঁড়ায়। এমন সুযোগ জীবনে আর পাবে না—এই বলে হনহন করে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।

৩.
ভাইসব। ভাইসব। দুই দিনব্যাপী মেলার শেষ দিন আজ। আমাদের সকলের নয়নের মণি, অত্র অঞ্চলের গর্ব, আমার ভাই, তোমার ভাই, সকলের প্রিয়, সকলের ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যান আলহাজ মোহাম্মদ ফটিক চাঁনের একান্ত প্রচেষ্টায় আয়োজিত আজকের মেলা। ভাইসব এক্ষুণি শুরু হবে গরম গানের সাথে ঝুমুর ঝুমুর নাচ। প্রিয় গ্রামবাসী, এই গ্রামে, এই প্রথম এমন মেলা। ভাইসব চলে আসুন! আসুন! বটতলায় বসে সবাই গান শুনুন, নাচ দেখুন। তালিয়া বাজান। একসাথে বলুন। আমার ভাই, তোমার ভাই, ফটিক ভাই, ফটিক ভাই। ফটিক ভাই যেখানে, আমরা আছি সেখানে।

মমিন বন্ধুদের সাথে দৌঁড়ে ছোটে। বড় রাস্তা থেকে নেমে জমির আইল ধরে হাঁটে। বটতলা যত কাছে আসে মাইকের আওয়াজ ততই স্পষ্ট হয়।   সবাই শর্টকাট পথে জোরসে হাঁটে।
 
মঞ্চে হারমোনিয়াম, ড্রাম বাজছে। প্যান্ডেলজুড়ে লাল নীল মরিচ বাতি জ্বলছে। বাতির আলোতে গায়িকাদের মুখগুলো জ্বলজ্বল করছে। সবাই ঝলমলে পোশাক পরা, সেজেগুজে বসে আছে। আহ! কি সুন্দরই না দেখতে। সিনেমার নায়িকা ফেল। এমনটাই বলছে দর্শকরা। সবাই ধন্যি ধন্যি করছে চেয়ারম্যানের। অনেক টাকা খরচ করেছে। শহর থেকে জেনারেটর, মরিচ বাতি, শিল্পী ভাড়া করে আনা- চাট্টিখানি কথা নয়।



- ভাইসব! এখন আপনাদের সামনে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন ঢাকার টিভিচ্যানেল কাঁপানো গায়িকা মিস লুসিয়া। রাতভর গাইতে থাকবে ঢাকা কাঁপানো অনেক শিল্পী। অপেক্ষা করুন। গান শুনুন। সবাই একসাথে বলুন—ফটিক চাঁন ভাই আছে?
- আছে।
দর্শকসারির শ্লোগান শেষ হলে মঞ্চে প্রবেশ করে মিস লুসিয়া। পাথরখচিত একটা লেহেঙ্গা পরেছে মিস লুসিয়া। চুলটা অনেক উচু করে বাঁধা। হাতে পায়ে গলায় পাথরের গহনা।



তিন চার গ্রামের লোক জড়ো হয়েছে মেলা প্রাঙ্গণে। সবার মুখে একটাই কথা চেয়ারম্যানের ক্ষমতা আছে বটে। তা না হলে গানের জন্যে এত পয়সা খরচ করে কেউ! এ শুধু টাকা হলে হয় না, এর জন্যে হিম্মত লাগে।  
বাজতে থাকা ক্যাসেটটি এই মাত্র বন্ধ হলো। মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছে ভাড়া করে আনা সঞ্চালক।
- ভাইসব! ভাইসব! কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের প্রধান অতিথি, এই গেরামের অহঙ্কার, নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান আলহাজ মোহাম্মদ ফটিক চাঁন ভাই এসে উপস্থিত হবেন। সবাই ধৈর্য সহকারে বসুন।
এমন সময়ই একদল স্বেচ্ছাসেবক ফটিক চাঁন চেয়ারম্যানকে নিয়ে ঢোকে। মঞ্চের মাইকটি আবারও উছলে ওঠে।
- ভাইসব আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হয়েছেন সকলের নয়নের মণি... ফটিক চাঁন ভাই। সবাই তালিয়া দেন। আরো জোরে...জোরে দেন তালিয়া। আমি সম্মানিত চেয়ারম্যান, অত্র অঞ্চলের মাথা...ফটিক চাঁন ভাইকে মঞ্চে আসার জন্যে আকুল আবেদন জানাচ্ছি।
ঘোষকের আকুল আবেদনে আলহাজ ফটিক চাঁন গিয়ে মঞ্চে ওঠে। মঞ্চে একজন সুসজ্জিত গায়িকা দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি চেয়ারম্যানের গলায় মালা পরিয়ে দেয়। মাল্যবরণ শেষ চেয়ারম্যান আগত গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্য বক্তৃতা দেন। বক্তৃতা শেষে মঞ্চ থেকে নেমে আসন গ্রহণ করেন। মঞ্চের মাইকটি আবারও উছলে ওঠে।
- ভাইসব! এখন আপনাদের সামনে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন ঢাকার টিভিচ্যানেল কাঁপানো গায়িকা মিস লুসিয়া। রাতভর গাইতে থাকবে ঢাকা কাঁপানো অনেক শিল্পী। অপেক্ষা করুন। গান শুনুন। সবাই একসাথে বলুন—ফটিক চাঁন ভাই আছে?
- আছে।
দর্শকসারির শ্লোগান শেষ হলে মঞ্চে প্রবেশ করে মিস লুসিয়া। পাথরখচিত একটা লেহেঙ্গা পরেছে মিস লুসিয়া। চুলটা অনেক উচু করে বাঁধা। হাতে পায়ে গলায় পাথরের গহনা। যেদিকে তাকানো যায় ঝিলিক মারে। মিস লুসিয়া মঞ্চে উঠেই হিন্দি গানে টান দেয়। সে কি গান! গানের চেয়ে বাজনা! বাজনার চেয়ে নাচনা! আগত দর্শকরা অভিভূত। কিঞ্চিত উত্তেজিত। উত্তেজনায় কেউ শিস, কেউ করতালি দেয়।

গান চলছে। হিন্দি বাংলা মিশ্রিত। ভিসিআর-এ সিনেমায় যেমন দেখা যায় তেমন আকষর্ণীয়, মনোহর। গায়িকাদের দুলুনির সাথে গ্রামের বেটাছেলেরা দুলতে থাকে। হৈ হৈ করে। সে এক এলাহিকাণ্ড।

এমন সুযোগ জীবনে এক আধবারই মিলে। তাই রাত বাড়লেও মেলায় ভাটা পড়ে না। উৎসুক গ্রামবাসী এক ঠাঁয় বসে থাকে।

প্যান্ডেলের ফোঁকর দিয়ে জোড়া জোড়া দৃষ্টি উপচে পড়ছে শিল্পীদের ওপর। একদল আসছে, একদল ফিরছে। ফিরে এসে গল্প করছে। অমুক সিনেমায় একজনকে দেখছিল যার সাথে অমুকের মিল আছে। ব্যাস এই শুনে কৌতূহলী অন্যজন ছুটে যাচ্ছে। সে ফিরলে অন্যজন। কিন্তু গায়িকাদের কাছে কেউ যেতে পারছে না। প্যান্ডেলের সামনে চারজর প্রহরী। অবাধ্য দর্শকদের নিয়ন্ত্রণে তারা সদা তৎপর। তবে কাঁচা বয়সের কৌতূহল নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়। ফলে দর্শক আর প্রহরীদের মধ্যে ঘনঘনই তর্কবিতর্ক হচ্ছে। কোনো পক্ষই পিছুবার নয়। উভয়ই যার যার লক্ষ্যে সংকল্পবদ্ধ।

মঞ্চে গান চলছে। রাত বাড়ছে।

শেষ রাতের দিকে তিন চারজন দেখতে যায় মিস লুসিয়াকে। অতি আবেগে একজন ফুল ছুঁড়ে দেয়। মিস লুসিয়া ক্ষুন্ন হয়। এতে প্রহরীরা অপমানবোধ করে। শিল্পীর অপমান মানে গাঁয়ের অপমান। প্রহরীরা ফুল ছুড়ে দেয়া ছেলেটির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। দুইপক্ষ তুমুল লেগে যায়। চেয়ারম্যানের চেলা চামুণ্ডারা ছুটে আসে।

দুই গ্রামের দুইপক্ষ। চোখের পলকে লাঠি, চেয়ার নিয়ে ছুটাছুটি শুরু হয়। ধরপাকর-মারামারি-ছুটাছুটি। চারদিকে চিৎকার। যে যেভাবে পারে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করে। গায়িকাসহ চেয়ারম্যানকে সরিয়ে নেয়া হয় নিরাপদ দূরত্বে। মেলা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।

থমথমে চারদিক। ছয় সাতজন আহত। একজনের অবস্থা শোচনীয়। সেই একজনের নাম জানা যায়নি। চারদিকে চাপা উৎকণ্ঠা। সবাই যার যার মতো বিলাপ করছে। কেউ উপরওয়ালার নাম নিচ্ছে। কেউ মনে মনে চেয়ারম্যানের গুষ্ঠী উদ্ধার করছে।

সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটি ট্রলি বের হয়ে আসছে। সবাই আৎকে উঠল। দিশেহারা স্বজনরা ছুটে গেল লাশের কাছে। লতিফা বেগম ঝট করে লাশের মুখের কাপড়টি সরিয়ে ফেলে হাঁউমাউ করে কেঁদে ওঠে। সরে আসে লাশের পাশ থেকে।

নাঃ মমিন নয়। মমিন বেঁচে আছে।

লাশের আত্মীয় স্বজনদের আহাজারিতে হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।

লাশ ঘরে পোস্টমর্টেম চলছে। থানায় ডায়েরি হয়েছে। গুঞ্জন চলছে আহতদের মধ্যে কারো একজনের আঘাতে মারা গেছে ছেলেটি। নিজ জনের বেঁচে থাকায় যতটা খুশি হয়েছিল তার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় পরে যান অভিভাবকরা এ কথা শুনে।
 
মৃত ছেলেটির নাম জলিল। উত্তর গাঁয়ে ঘর। স্ত্রী ছাড়া তিন কূলে কেউ নেই। জলিলই মিস লুসিয়াকে ফুলটি ছুঁড়েছিল। জলিলকে উত্তর গাঁয়ের কেউ মারবে না। সুতরাং এ গাঁয়ের যারা আহত হয়েছে তারাই মেরেছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে সব প্রমাণ হয়ে যাবে বলে জানিয়ে দিয়েছে চেয়ারম্যান।

চেয়ারম্যান পক্ষ দফায় দফায় জলিলের বাড়ি যাচ্ছে। স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। বোঝানোর চেষ্টা করছে বিরোধীরাই ঘটনাটি ঘটিয়েছে। তবে চেয়ারম্যান ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। জলিলের স্ত্রীর ভরনপোষণের ব্যবস্থাও করবেন তিনি।
 
দশ বারোদিন পরের কথা। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এসেছে। চেয়ারম্যান মমিনের বাবাসহ সকল আহত পরিবারকে ডেকে পাঠায়। খবর পেয়ে সবাই ছুটে যায় চেয়ারম্যানের বৈঠকখানায়।

৪.
সন্ধ্যার পরপর ফজর আলী বাড়িতে ঢোকে। লতিফা নামাজ পড়ছিল। নামাজ শেষ করে স্বামীর পাশে এসে বসে।
- চেয়ারম্যান কী কয়?
- টেকা লাগবে বারো হাজার।
- কিসের টেকা?
- পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট পায়ছে।
- ও আল্লাহ! খারাপ কিছু?
- যারা মারামারি করছে তারাই ব্যথা পাইছে। সুতরাং জলিল এদের আঘাতেই মরছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে সেইরকমই লেখা! একলক্ষ টেকা দিলে মীমাংসা। তা না হইলে জেলের ভাত।
- মেলা তো জুটাইলো চেয়ারম্যান। তার কোনো দায় নাই?
- একলক্ষের মধ্যে বিশ হাজার সে দিবে। বাকি টেকা যাদের ছেলেরা হাসপাতালে ভর্তি ছিল তারা দিবে।
- মামা বাড়ির কলা। কইলেই হইল।
- চেয়ারম্যান কইলে সব হয়।
- এত টেকা! কই পাইবেন।
ফজর কিছু না বলে অন্ধকারে উঠানে নেমে যায়। গোয়াল ঘরে রতনের কাছে গিয়ে বসে।
- রতন, রতন। আপনের মমিন ভাই ভয়ানক বিপদে পড়ছে। তারে বাঁচাইতে হইলে বারো হাজার টেকা লাগবে। সবই চেয়ারম্যানের কারসাজি। কইয়ের তেলে কই ভাজা। কোনো উপায় নাই আমার!
মনিবের কথা শুনে রতন চিৎকার করে উঠল।
- হাম্বা! হাম্বা!
- রতন আপনেরে যে বেইচা দিতে হবে। টাকা না দিলে আপনের ভাইরে পুলিশ ধইরা নিবে। আপনের আম্মা তো ছেলে ছাড়া বাঁচবে না। আমি কী করি মিয়া?



ছোট্ট ট্রাকে বারো তেরটি গরু। চাপাচাপি গাদাগাদি অবস্থা। রতন শিং দুটো রাখবার জায়গা পাচ্ছে না। একজনের সাথে অন্যজনের পা, লেজের সাথে লেজ জড়িয়ে যাচ্ছে। পাশে দাঁড়ানো গরুর শিং রতনের কানের কাছে এসে বিঁধছে। রতনের শিং আবার অন্য গরুর পায়ে বিঁধছে। ক্ষত হচ্ছে। রক্ত ঝরছে।   রতনের মুখটি নিচের দিকে নুইয়ে আছে, চোখ দুটি আরো নিচে। যেখান থেকে কারো মুখ দেখা যায় না। রতনের চোখ বেয়ে জল পড়ছে। রতন ডাকছে হাম্বা...হাম্বা...



এই বলে হু হু করে কেঁদে ওঠেন ফজর আলী। লতিফা হারিকেন নিয়ে এসে গোয়াল ঘরের সামনে দাঁড়ায়। বুকের ভিতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে যেতে থাকে।

পরদিন ভোর বেলা। ফজর আলী রতনকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘাস ভরা মাঠে রতনকে ছেড়ে দেয়। রতন ঘুরে ঘুরে ঘাস খায়। ফজর আলী বসে দেখে। হঠাৎ পাশের বাড়ির ছোট্ট একটি ছেলে দৌড়ে আসে।
- চাচা চাচী ডাকে। বাড়িতে কেডা আইছে।
রতনকে নিয়ে ফজর আলী বাড়ি ফিরে। বাড়ি ঢোকার মুখেই বেপারী দাঁড়িয়ে ছিল। ফজর রতনের খুঁটিটি বেপারীর হাতে দেয়। বেপারী গুনে গুনে দশ হাজার টাকা ফজরের দিকে বাড়িয়ে দেয়। এরপর খুঁটির দড়িটি টানতে টানতে নিয়ে যায় বড় রাস্তার দিকে।

চঞ্চল রতন চুপসে যায়। লাফায় না। ধীর পায়ে হেঁটে যায়। কিছুক্ষণ পরপর বেপারী হেঁচকা টানে। রতনের শরীরটা সামনের দিকে আঁছড়ে পরে। ফজর আলীর বুকটা কেমন করে ওঠে। সে দৌড়ে যায় বেপারীর কাছে।
- বেপারী দড়িটা দেও।
- কেন ফজর ভাই?
- দিয়া আসি পাকা সড়ক পর্যন্ত।
- না না। আমি থাকতে আপনি কষ্ট করবেন কেন?
- না বেপারী। দেও। আর তো দেখা হবে না। যাই বিদায় দিয়া আসি।

বেপারী আপত্তি করে না। দড়িটা দিয়ে দেয়। রতনকে নিয়ে ফজর আলী হাঁটে। রতন একবারের জন্যেও ফজর আলীর গা চাঁটে না, তাকায় না, ডাকে না।

পাকা রাস্তায় ট্রাক দাঁড়ানো। রতন এখন বেপারীর হাতে। কয়েকজন মিলে ট্রাকে তুলছে।

ছোট্ট ট্রাকে বারো তেরটি গরু। চাপাচাপি গাদাগাদি অবস্থা। রতন শিং দুটো রাখবার জায়গা পাচ্ছে না। একজনের সাথে অন্যজনের পা, লেজের সাথে লেজ জড়িয়ে যাচ্ছে। পাশে দাঁড়ানো গরুর শিং রতনের কানের কাছে এসে বিঁধছে। রতনের শিং আবার অন্য গরুর পায়ে বিঁধছে। ক্ষত হচ্ছে। রক্ত ঝরছে।   রতনের মুখটি নিচের দিকে নুইয়ে আছে, চোখ দুটি আরো নিচে। যেখান থেকে কারো মুখ দেখা যায় না। রতনের চোখ বেয়ে জল পড়ছে। রতন ডাকছে হাম্বা...হাম্বা...

ফজর আলী শুনতে পায় রতন আব্বা আব্বা বলে ডাকছে। ট্রাকটি তখনও চোখের আড়ালে যায়নি। রতন আলী জোরসে দৌড় দেয়।
- বেপারী দাঁড়াও। দাঁড়াও। রতনরে দিয়া যাও। এই যে তোমার টেকা, দিয়া যাও। আমার পোলারে দিয়া যাও।



বাংলাদেশ সময়: ১৩২০ ঘণ্টা, আগস্ট ৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।