ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রেডিও শোনার সকালবেলাটা | টোকন ঠাকুর

শ্রদ্ধাঞ্জলি / জাতীয় শোক দিবস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৫
রেডিও শোনার সকালবেলাটা | টোকন ঠাকুর

পিতাকে খুন করে পুত্র আসলে কিসের প্রতিশোধ নিতে চায়? পিতৃহত্যার পর, উন্মাদ পুত্রের জয় কোথায়? ক্ষমতা অর্জনের? তাহলে ক্ষমতাই সেই মধু, যা পুত্রকে বিভ্রান্ত, বর্বর করে তোলে? অবশ্য এই খুন, এই হত্যা যতটা রাজনৈতিক, ক্ষমতালোভের, ততটা পারিবারিক নয়।
হুম!
না, এতটা খটমটো বাক্য আমার ভালো লাগে না।

একটি সহজ বাক্য লিখতে চাই। সহজ একটি কথা। সেই বাক্যে বলতে চাই, সারল্য-নির্ঝর এক ছোটবেলার কথা। বড় হচ্ছিলাম একটি গ্রামে, গ্রামের নাম মধুপুর। তখন মধুপুর এমন একটি গ্রাম, যেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। সংবাদপত্র পৌঁছয় না। টিভি-টেলিফোন দ্যাখেনি কেউ। মানুষ শুধু রেডিও শোনে। গ্রামের কারো কারো বাড়িতে তখন রেডিও ছিল। আমাদের বাড়িতেও একটা টু ব্যান্ড রেডিও ছিল। অবশ্য তখন আমার যা বয়স, নিজ থেকেই যে রেডিও শুনব, তাও নয়।   গ্রামের পাঁচ বছরের বাচ্চার রেডিও শোনার তো কিছু নেই। আমারও ছিল না। তখন হয়ত বাড়ির বড়রা সবাই রেডিও শুনছিল, মা বাড়ির গেরস্থালি কাজ করছিল আর হয়ত রেডিও শোনা বড়দের দিকে নজর রাখছিল। ফলে, আমার দিকে আর কারোর নজর নেই। আমি কি কিছু খেয়েছি, না না-খেয়েই আছি সকালবেলায়, তার দিকেও যেন কারো নজর নেই! তবু হয়ত খেয়েছি কিম্বা খাইনি। আর কী কারণে যেন তখন সুযোগ বুঝে ভ্যা করে দিলাম কেঁদে। আমার কান্না শুনেও কেউ আসছে না দেখে, কান্নাকে প্রলম্বিত করার দিকে খেয়াল রাখলাম। মা ছুটে এলো। সন্তানের কান্না মাকে স্থির থাকতে দেয় না। আমার মাও ছুটে এলো এবং সম্ভবত আমার কান্নার কোনো বিশেষ কারণ না পেয়ে সে আবার তার কাজে যাবার বা রেডিও শোনার দিকে চলে যাচ্ছে দেখে আমি কান্নার শব্দমাত্রা বাড়াতে চেষ্টা করলাম।



১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর সকালটা ছিল বাঙালি জাতির কিছু উন্মাদ-ক্ষমতালোভী ফৌজ-অফিসার-সন্তানের পিতৃঘাতি সকাল। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। এতে করে কী হলো?

অভিভাবকহীনতায় পড়ে গেল বাংলাদেশ। অভিভাবকহীন শিশুরা কিভাবে বড় হয়ে ওঠে? কোন নৈতিকতা সে পায় তার চরিত্রে?



আসলে কান্নার উদ্দেশ্য ছিল হয়তবা, বাইরে খেলতে যাব, কিন্তু বাড়ির কারো অনুমতি পাচ্ছি না। আবার বাড়ির বড়রাও কেউ আমার দিকে নজর দিচ্ছে না, সেটি পষ্ট। মা বলল, কান্নাকাটি বন্ধ কর।

আমার কান্না থামে না। মা এবার ভয় দেখাল, বাইরে মিলিটারি। বেরুলেই গুলি করে দেবে। চুপ করে থাক।

২.
অনেক বছর পর, বাড়ির বড়দের সেই রেডিও শোনা এবং আমার দিকে নজর না দেওয়া ছোটবেলার সেই কান্নাময় সকালকে আমি আবিষ্কার করি। সেই সকালটা ছিল ১৫ আগস্টের সকাল। মা বলছিল, “বাইরে মিলিটারি, বেরুলেই গুলি করে দেবে। ”

৩.
১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর সকালটা ছিল বাঙালি জাতির কিছু উন্মাদ-ক্ষমতালোভী ফৌজ-অফিসার-সন্তানের পিতৃঘাতি সকাল। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। এতে করে কী হলো?

৪.
অভিভাবকহীনতায় পড়ে গেল বাংলাদেশ। অভিভাবকহীন শিশুরা কিভাবে বড় হয়ে ওঠে? কোন নৈতিকতা সে পায় তার চরিত্রে?

৫.
তাকাও, দ্যাখো, ভাবো, নিজেকে প্রশ্ন করো। তারপর করণীয় ঠিক করো। আর ধরো  হুমায়ুন আজাদের একটি বই, পড়ো আর না-ই পড়ো, বইটার নামটাই শুধু উচ্চারণ করো মনে মনে, “আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?”



বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।