ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মার্ক স্ট্রান্ডের দীর্ঘ কবিতা | ভাষান্তর : ইমরুল হাসান

অনুবাদ কবিতা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৫
মার্ক স্ট্রান্ডের দীর্ঘ কবিতা | ভাষান্তর : ইমরুল হাসান

আমাদের জীবনের গল্প
(হাওয়ার্ড মস-এর জন্য)

১.
আমরা আমাদের জীবনের গল্প পড়তেছি
যা একটা ঘরের ভিতর ঘটছে।
ঘরটা থেকে একটা রাস্তা দেখা যায়।


সেইখানে আর কেউ নাই,
কোনোকিছুর কোনো শব্দ নাই।
গাছগুলি পাতায় ভরা,
পার্ক করা গাড়িগুলি কখনোই নড়ে না।
আমরা পৃষ্ঠাগুলি ওল্টাই,
একটাকিছুর আশায়,
একটাকিছু দয়া অথবা পরিবর্তনের মতো,
একটা কালো লাইন যা আমাদেরকে বেঁধে রাখবে
অথবা আলাদা করে দিবে।
এটা এইরকম, মনে হবে যে
আমাদের জীবনের বইটা শূন্য।
ঘরের আসবাবগুলি কখনোই নাড়ানো হয় না,
আর গালিচাগুলি প্রতিবার আরো অন্ধকার হয়ে আসে
আমাদের ছায়াগুলি তাদের উপর দিয়ে চলে যাওয়ার সময়।
এটা অনেকটা এইরকম মনে হয় যেন ঘরটাই ছিল দুনিয়া।
আমরা সোফায় একজন আরেকজনের পাশে বসি,
সোফা সম্পর্কে পড়ি।
আমরা বলি এইটা আদর্শ।
এটা আদর্শ।

২.
আমরা আমাদের জীবনের গল্প পড়তেছি
যদিও আমরা এর মধ্যে ছিলাম,
যদিও আমরা এটা লিখছিলাম।
এটা বারবার আর বারবার আসে।
একটা চ্যাপ্টারে আইসা
আমি পিছনে হেলান দেই আর বইটা পাশে রাখি
কারণ বইটা বলে
আমি এটা করতেছি।
আমি পিছনে হেলান দেই আর বইটা নিয়া লিখতে শুরু করি।
আমি লিখি যে আমি যদি বইটার বাইরে চলে যাইতে পারতাম,
আমার জীবনের বাইরে আরেকটা জীবনে।
আমি কলমটা রেখে দেই।
বইটা বলে: সে কলমটা রেখে দিয়েছে
আর ঘুরে আর তারে পড়তে দেখে
তার (মেয়ে) একটা অংশ প্রেমে পড়তেছে।
আমরা যা কল্পনা করতে পারি বইটা তার চাইতেও নির্ভুল।
আমি পিছনে হেলান দেই আর তোমাকে পড়তে দেখি
রাস্তার ওইপাশের মানুষটা সর্ম্পকে।
তারা ওইখানে একটা বাড়ি বানাচ্ছে,
আর একদিন একজন মানুষ ওইটার ভিতর থেকে হেঁটে আসছিল।
তুমি তার প্রেমে পইড়া গেলা
কারণ তুমি জানতা সে (ছেলে) কখনোই তোমার সাথে দেখা করতে আসবে না,
কখনোই জানবে না যে তুমি অপেক্ষা করতেছিলা।
রাতের পর রাত তুমি বলবা যে
সে (ছেলে) ছিল আমার মতো।
আমি পিছনে হেলান দেই আর দেখি তুমি আমাকে ছাড়াই বুড়া হয়ে যাইতেছো।
তোমার রুপালি চুলে সূর্যের আলো পড়ে।
গালিচাগুলি, আসবাবটা,
এখন অনেকটা কাল্পনিক মনে হইতেছে।
সে (মেয়ে) পড়াটা কনটিনিউ করতেছিল।
মনে হইতেছিল সে (মেয়ে) তার (ছেলে) অনুপস্থিতিটাকে
তেমন গুরুত্ব দিতেছিল না,
যেমনটা একটা নিখুঁত দিনে কেউ ভাববে
সফলভাবে পার হতে পারাটা একটা ব্যর্থতা
কারণ এইটা তার (ছেলে) মনকে পরিবর্তন করে নাই।
তুমি তোমার চোখগুলিকে সরু করে ফেলো।
তোমার প্ররোচনা আছে বইটা বন্ধ করার
যা আমার প্রতিরোধকে বর্ণনা করে:
কখন, কিভাবে আমি পিছনে হেলান দেই আমি কল্পনা করি
তোমাকে ছাড়া আমার জীবন, কল্পনা করি চলে যাওয়া
আরেকটা জীবনের ভিতর, আরেকটা বইয়ে।
এটা বর্ণনা করে বাসনার ওপর তোমার নির্ভরতা
কিভাবে উদ্দেশ্যের ক্ষণস্থায়ী উন্মোচনগুলি
তোমাকে ভীত করে।
যতটা না করার কথা বইটা তার চাইতে বেশি বর্ণনা করে।
এটা আমাদেরকে আলাদা করে।

৩.
এই সকালে আমি জেগে উঠেছিলাম আর বিশ্বাস করেছিলাম
আমাদের জীবনে আর কিছু নাই
আমাদের জীবনের গল্প ছাড়া।
যখন তুমি অসম্মতি জানাইছিলা, আমি দেখাইছিলাম
বইটাতে কোন জায়গায় তুমি অসম্মত হইছিলা।
তুমি ঘুমে পড়ে গেলা আর আমি পড়তে শুরু করেছিলাম
ওই রহস্যময় অংশগুলি তুমি যা ধরে নিতা
যখন ওরা লিখতে শুরু করছিল
আর আগ্রহ হারাইয়া ফেলছিল যখন তারা
গল্পটার অংশ হয়া উঠতে শুরু করছিল।
এর মধ্যে একটাতে জোছনার শীতল পোশাকগুলি
সাজানো ছিল একজন মানুষের ঘরের চেয়ারগুলিতে।
সে (ছেলে) স্বপ্ন দেখছিল একজন মেয়ের যার পোশাকগুলি হারায়ে গেছে,
যে একটা বাগানে বসে থাকে আর অপেক্ষা করে।
সে (মেয়ে) বিশ্বাস করে যে প্রেম হইল একটা বিসর্জন।
এই অংশটা তার (মেয়ে) মৃত্যুর বর্ণনা
আর তার (মেয়ে) কখনোই কোনো নাম ছিল না,
এটা হলো অনেকগুলির একটা জিনিস
যা তুমি তার (মেয়ে) সম্পর্কে নিতে পারতা না।
একটু পরে আমরা জানতে পারি যে
স্বপ্ন দেখা লোকটা বেঁচে আছে
রাস্তার ওইপাশে নতুন বাড়িটাতে।
এই সকালবেলায় তুমি ঘুমায়ে পড়ার পরে
বইটার প্রথমদিকের পৃষ্ঠাগুলি উল্টাতে শুরু করেছিলাম:
এটা ছিল ছেলেবেলার স্বপ্নগুলির মতো,
কত কিছু মনে হইতেছিল উধাও হয়ে গেছে,
কত কিছু মনে হইতেছিল জীবনে ফিরে আসছে।
আমি জানতাম না আমি কী করব।
বইটা বলতেছিল: এই সময়টাতে এইটা ছিল তার(ছেলে) বই।
একটা বিবর্ণ মুকুট উৎকণ্ঠিতভাবে তার (ছেলে) মাথায় বিশ্রাম নিতেছিল।
সে (ছেলে) ছিল ভিতরের আর বাইরের অমিলের ক্ষণস্থায়ী শাসক,
তার নিজের রাজ্যের ভিতর চিন্তিত।

৪.
তুমি জেগে ওঠার আগে
আমি আরেকটা অংশ পড়তেছিলাম যেইখানে তোমার অনুপস্থিতির বর্ণনা ছিল
আর বলতেছিল কিভাবে তুমি ঘুমাও
জীবনের অগ্রগতির বিপরীতে।
যখন আমি পড়তেছিলাম আমি আমার নিজের একাকীত্বের ছোঁয়া পাইতেছিলাম,
এটা জানতে পাইরা যে যা আমি ফিল করি সেটা অনেকসময়
একটা গল্পের অশোধিত আর অসাফল্যের ফর্ম
যা কখনোই হয়ত বলা হবে না।
আমি পড়তেছিলাম আর চালিত হইতেছিলাম নিজেরে
তোমার ঘুমের বাড়ি অফার করার একটা বাসনা দিয়া।
সে (ছেলে) তারে (মেয়ে)বিবস্ত্র আর অসহায় দেখতে চাইতেছিল,
দেখতে চাইতেছিল তারে (মেয়ে) প্রত্যাখ্যানের ভিতর, বাতিল হয়ে যাওয়া
পুরান স্বপ্নগুলির কাহিনীগুলিতে, অসাধ্য পরিস্থিতিগুলির
সাজ-পোশাক আর মুখোশগুলিতে।
এইটা এইরকম যেন তাকে (ছেলে) টেনে নেয়া হইছিল
অনিবার্যভাবে পরাজয়ের ভিতর।
পড়তে থাকাটা খুবই কঠিন ছিল।
আমি ক্লান্ত ছিলাম আর ছেড়ে দিতে চাইতেছিলাম
বইটা মনে হইতেছিল এই বিষয়ে সচেতন ছিল।
এটা বিষয় পরিবর্তন করার ইঙ্গিত দিতেছিল।
আমি অপেক্ষা করতেছিলাম তোমার জেগে ওঠার না জেনে যে
কতক্ষণ ধরে আমি অপেক্ষা করতেছিলাম,
আর মনে হইতেছিল যে আমি আর পড়তেছিলাম না।
আমি শুনতে পাচ্ছিলাম বাতাস বয়ে যাচ্ছে
একটা দীর্ঘশ্বাসের প্রবাহের মতো
আর আমি শুনতেছিলাম পাতাদের মর্মরধ্বনি
জানালার বাইরের গাছগুলিতে।
এটা হয়ত বইটাতে ছিল।
সবকিছুই ওইখানে থাকার কথা।
আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম
আর আমি পড়তেছিলাম তোমার চোখ, নাক, মুখ…

৫.
যদি বইটাতে কোনো একটামাত্র নিখুঁত মুহূর্ত থাকতে পারত;
যদি আমরা ওই মুহূর্তটাতে বেঁচে থাকতে পারতাম,
আমরা বইটা আবার শুরু করতে পারতাম
যেন আমরা এটা লিখিই নাই
যেন আমরা এটার ভিতর ছিলাম না।
কিন্তু অন্ধকার নেমে আসে
যে কোনো পৃষ্ঠাতে এত প্রবলভাবে
আর পালানোর পথ এত সরু।
আমরা সারাদিন ধরে পড়ি।
প্রতিটা পৃষ্ঠা ওল্টানোটা একটা মোমবাতির মতো
মনের উপর দিয়ে চলে যায়।
প্রতিটা মুহূর্ত হইতেছে একটা অসহায় কারণের মতো।
যদি আমরা পড়াটা বন্ধ করতে পারতাম।
সে (ছেলে) কখনোই আরেকটা বই পড়তে চাইত না
আর সে (মেয়ে) রাস্তাটার দিকে তাকায়ে থাকত।
গাড়িগুলি সেখানে থেমে ছিল,
গাছেদের গাঢ় ছায়া তাদের ঢেকে রাখছিল।
ছায়াগুলি নত হয়েছিল নতুন বাড়িটার দিকে।
হয়ত যে মানুষটা ওই বাড়িটাতে থাকে,
যে মানুষটাকে সে (মেয়ে) ভালোবাসে, পড়তেছিল
অন্য কোনো জীবনের গল্প।
সে (মেয়ে) কল্পনা করতেছিল একটা খালি বৈঠকখানার,
একটা ঠাণ্ডা ফায়ারপ্লেসের, একজন পুরুষ বসে
চিঠি লিখতেছে একজন মহিলার কাছে
যে তার (মেয়ে) জীবন উৎসর্গ করেছে প্রেমের জন্যে।
যদি বইটাতে একটা নিখুঁত মুহূর্ত থাকত,
এটা হয়ত শেষে থাকত।
বইটা কখনোই প্রেমের কারণগুলি নিয়া আলোচনা করে নাই।
এটা দাবি করে কনফিউশন থাকাটা আবশ্যিকভাবেই ভালো।
এটা কখনোই ব্যাখ্যা করে না। এটা শুধুমাত্র উন্মোচিত করে।

৬.
দিনগুলি চলে যায়।
আমরা অধ্যয়ন করি যা আমরা মনে রাখি।
আমরা ঘরের ওইপাশের আয়নাটার ভিতরে তাকাই।
আমরা একা থাকাটা নিতে পারি না।
বইটা চলতেই থাকে।
তারা চুপ করে গেছিল আর জানত না কিভাবে শুরু করতে হবে
সংলাপটা যা জরুরি ছিল।
এটা ছিল শব্দগুলি যা প্রথম বিভেদগুলি তৈরি করেছিল,
যা একাকীত্ব তৈরি করেছিল।
তারা অপেক্ষা করেছিল।
তারা হয়ত পৃষ্ঠাগুলি উল্টাইতো, এইটা ভাইবা যে
একটাকিছু হয়ত ঘটবে।
তারা হয়ত তাদের জীবনগুলি জড়াইয়া ফেলতে পারবে গোপনে:
প্রতিটা পরাজয় মাফ করা হইত কারণ এটা কখনোই পরীক্ষা করা যাইত না,
প্রতিটা কষ্ট পুরস্কার পাইত কারণ এটা ছিল অবাস্তব।
তারা কিছুই করত না।

৭.
বইটা বাঁইচা থাকতে পারবে না।
আমরা এর জীবন্ত প্রমাণ।
বাইরে অন্ধকার, ঘরের ভিতর আরো বেশি অন্ধকার।
আমি তোমার নিঃশ্বাস শুনতে পাই।
তুমি জিজ্ঞাসা করতেছো আমি ক্লান্ত কিনা,
আমি আর পড়তে চাই কিনা।
হ্যাঁ, আমি ক্লান্ত।
হ্যাঁ, আমি পড়তে থাকতে চাই।
আমি সবকিছুতেই হ্যাঁ বলব।
তুমি আমাকে শুনতে পাও না।
তারা সোফায় একজন আরেকজনরে পাশে বসত।
তারা ছিল নকল, ক্লান্ত ভূতগুলি
তারা আগে যা হইতে চাইত এইরকমকিছুর।
যে আচরণ তারা করত তা ছিল শ্রান্ত।
তারা বইয়ের ভিতর তাকাইতো
আর তাদের নিষ্পাপতা, তাদের ছেড়ে দেয়ার
অনিচ্ছা দেখে ভয় পাইত।
তারা সোফায় একজন আরেকজনরে পাশে বসত।
তারা সত্যকে মেনে নিতে দৃঢ়ভাবে রাজি ছিল।
এটা যা-ই হোক তারা মাইনা নিত।
বইটা লিখতেই হইত
আর পড়তেই হইত।
তারা হইল বইটা আর তারা
অন্য কিছুই না।

___________________________________

মার্ক স্ট্রান্ড (১১ এপ্রিল ১৯৩৪ – ২৯ এপ্রিল ২০১৪) একজন কানাডা বংশোদ্ভূত আমেরিকান কবি, প্রবন্ধকার ও অনুবাদক। ১৯৯০ সালে তিনি কবিতায় লাইব্রেরি অব কংগ্রেস পুরস্কার জয় করেন। ২০০৪ সালে সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে দেওয়া হয় ওয়ালেস স্টিভেনস অ্যাওয়ার্ড। ২০০৫ সালে ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে মার্ক স্ট্রান্ড কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন। ২০১৪ সালে পরলোকগমনের আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন।
___________________________________

মূল ইংরেজি কবিতাটি পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।