ঢাকা, বুধবার, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২, ১৪ মে ২০২৫, ১৬ জিলকদ ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ৩)

ধারাবাহিক রচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:৪৪, আগস্ট ২৭, ২০১৫
ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ৩)

পর্ব ২ পড়তে ক্লিক করুন

স্বপ্ন হলো সত্যি |
লহিত সাগরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক কথায় অপূর্ব। দিগন্ত বিস্তৃত শুধু নীল আর নীলের ছোঁয়া।

সেই নীল জলের ঢেউ কেটে কেটে বিলাতি নারীরা ভারতের উদ্দেশ্যে যেন আনন্দের সাথে যেতে পারে এর জন্য  ‘ইন্ডিয়া আওটফিট’ নামের পুস্তিকাটির জুড়ি মেলা ভার। পুস্তিকাটিতে বিভিন্নরকম মুখরোচক বিজ্ঞাপন দিয়ে বিলাতি নারীদের ভারতভ্রমণে উদ্ধুদ্ধ করা হতো। বিজ্ঞাপনের মূল বিষয় ছিল বিলাত থেকে ভারতগামী জাহাজের বর্ণনা। একটি বিজ্ঞাপনের নমুনা:

“ধীরে ধীরে এখন বসন্তের গরম বাতাস বইছে। বিলাতি নারীরা গরমের পোশাকে নিজেদের সজ্জিত করছেন, পুরুষরা হালকা আর খোলামেলা পোশাকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জাহাজের কর্মচারীরা সবাই সাদা রঙের ইউনিফর্ম পরেছেন। ফুরফুর বাতাসে জাহাজ চলছে ভারতের দিকে। সকাল এগারটার দিকে ঠাণ্ডা বরফ আর সেই সাথে তরমুজ দিয়ে যাত্রীদের আপ্যায়ন করছেন। ”

undefined



১৯৩০ সালে ডেনিস কিনকেইড তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ব্রিটিশ সোসাইটি ইন ইন্ডিয়া’তে লিখেছেন, “আমি বিলাতি নারীদের বলতে শুনেছি যে, তারা বিলেত থেকে ভারতে যেতে বিলাতি জাহাজকেই বেশি প্রাধান্য দিত কারণ সেখানে খেলাধুলার অনেক ভালো ব্যবস্থা ছিল। জাহাজের ডেকে টেনিস, দাবাসহ বিভিন্নরকম বুদ্ধিদীপ্ত খেলার আয়োজন থাকত। খেলাধুলার পাশাপাশি চলত বিভিন্নরকম সৌখিন কাপড় পরে মনের সুখে গান বাজনা, আবৃত্তি ও কৌতুক ইত্যাদির পর্ব। সেরা অংশগ্রহণকারীদের জন্য থাকত বিশেষ পুরস্কার। বিষয়টা ভারতে নতুন ভ্রমণকারীদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক ছিল বৈকি!”

undefined



এ কথা সত্য যে, বিলেত থেকে ভারতে আসা জাহাজগুলোর শুরুর দিককার দশা খুব একটা সুবিধের না হলেও ধীরে ধীরে জাহাজগুলোর চেহারায় রঙ লাগতে শুরু করে। দীর্ঘ যাত্রাপথে যাত্রীরা যাতে পর্যাপ্ত বিনোদন এবং ভালো খাবার পায় সেদিকে জাহাজ কর্তৃপক্ষ বিশেষভাবে নজর দিতে শুরু করে। তবে মূল লক্ষ্য ছিল ব্যবসা। ভারতের প্রতি বিলাতিদের অদম্য আগ্রহই এই ব্যবসার মূল চালিকা শক্তি। দেখা যায় জাহাজগুলোতে আগের তুলনায় অনেক বেশি বিনোদনমূলক ব্যবস্থার আয়োজন করা হয়েছে। কিছু কিছু জাহাজে সুন্দর সময় কাটানোর জন্য বিভিন্ন রকম খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ১৯৩০ সালে ডেনিস কিনকেইড তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ব্রিটিশ সোসাইটি ইন ইন্ডিয়া’তে লিখেছেন, “আমি বিলাতি নারীদের বলতে শুনেছি যে, তারা বিলেত থেকে ভারতে যেতে বিলাতি জাহাজকেই বেশি প্রাধান্য দিত কারণ সেখানে খেলাধুলার অনেক ভালো ব্যবস্থা ছিল। জাহাজের ডেকে টেনিস, দাবাসহ বিভিন্নরকম বুদ্ধিদীপ্ত খেলার আয়োজন থাকত। খেলাধুলার পাশাপাশি চলত বিভিন্নরকম সৌখিন কাপড় পরে মনের সুখে গান বাজনা, আবৃত্তি ও কৌতুক ইত্যাদির পর্ব। সেরা অংশগ্রহণকারীদের জন্য থাকত বিশেষ পুরস্কার। বিষয়টা ভারতে নতুন ভ্রমণকারীদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক ছিল বৈকি!”

অনেক সময় জাহাজের ডেকেই একজন আরেকজনের সঙ্গে পরিচিত হতেন; সেই পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব এবং বন্ধুত্ব থেকে মন দেওয়া নেওয়ার পর্যায় পর্যন্ত হয়ে যেত। মোটকথা বিলেত থেকে ভারতের দীর্ঘ একঘেয়ে পথে খানিকটা খেলাধুলা, নাচ-গানসহ বিভিন্নরকম বিনোদন জুড়ে দিয়ে বিলাতিদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করা হতো।

ভারতে পৌঁছানোর ঠিক আগের বন্দরটির নাম অডেন। অডেন বন্দরটি দেখতে খুব রুক্ষ ধরনের ছিল। সবুজের ছায়া মাত্র সেখানে নেই। চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়ের স্তূপ। অডেন অতিক্রম করার সাথে সাথেই আবহাওয়া গরম হতে শুরু হতো। সমুদ্রের জলের গরম বাতাস জাহাজের গায়ে এসে লাগত আর তাতে বিলাতি নারীদের প্রাণ চাঙ্গা হতে শুরু করত। অনেক সময় গরম এতই বেশি হতো যে জাহাজের ডেকের একপাশে বিলাতি নারীরা স্বল্প কাপড় চোপড় পরে তাদের বেডিংয়ে শুয়ে সময় কাটাতে চাইত। ভদ্রতার খাতিরে জাহাজের এক প্রান্তে মেয়েদের এবং অন্য পাশে পুরুষদের জন্য বিছানা পাতার ব্যবস্থা করা হতো। যারা প্রথমবারের মতো ভারতে ভ্রমণ করছে—তাদের উৎসাহটা অন্যদের চেয়ে বেশিই থাকত।

undefined



ভারতীয় বন্দরের কাছাকাছি পৌঁছানোর সাথে সাথেই জাহাজের নাবিক, ক্যাপটেন এবং যাত্রী—সবার মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসত। প্রথম কথা হলো দীর্ঘ সময় ধরে সমুদ্রজীবন যাত্রীদের মধ্যে এক ধরনের হাতাশা তৈরি করত, আর দ্বিতীয় কারণটি ছিল সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নতুন শহর নতুন দেশ ভারতের মাটি স্পর্শ করার অদম্য উৎসাহ। জাহাজ যখন ভারতের বন্দরে ভিড়বে ভিড়বে করত তখন সবাই আনন্দের সাথে জাহাজের ডেকে নেমে আসত এবং পরস্পর বলাবলি করত যে, ‘আহা! বাতাসে আমরা ভারতের ঘ্রাণ পাচ্ছি!’

undefined



১৯২০ সালে বিলাতি নারী মনিকা কেম্পবেল মার্টিন ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে ভারতে এসেছিলেন। তার বয়স ছিল অল্প এবং চোখে ছিল শুধু বিস্ময়। তিনি তার স্মৃতি হাতড়ে বলেছেন, “সারাদিনই উড়ন্ত মাছগুলো রূপকথার গল্পের মতোই চোখের সামনে উড়ছিল। আমরা জাহাজের ডেকে ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে জাহাজের পানির কলে মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে আবার সেই ডেকে উঠে শুধু অপেক্ষার প্রহর গোনা। ”

ভারতীয় বন্দরের কাছাকাছি পৌঁছানোর সাথে সাথেই জাহাজের নাবিক, ক্যাপটেন এবং যাত্রী—সবার মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসত। প্রথম কথা হলো দীর্ঘ সময় ধরে সমুদ্রজীবন যাত্রীদের মধ্যে এক ধরনের হাতাশা তৈরি করত, আর দ্বিতীয় কারণটি ছিল সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নতুন শহর নতুন দেশ ভারতের মাটি স্পর্শ করার অদম্য উৎসাহ। জাহাজ যখন ভারতের বন্দরে ভিড়বে ভিড়বে করত তখন সবাই আনন্দের সাথে জাহাজের ডেকে নেমে আসত এবং পরস্পর বলাবলি করত যে, ‘আহা! বাতাসে আমরা ভারতের ঘ্রাণ পাচ্ছি!’

কাছাকাছি পৌঁছানোর মুহূর্ত থেকেই জাহাজের যাত্রীরা সবাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে শুরু করত। কেউ কেউ প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা হওয়ার মুহূর্তটির জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনত। কারণ তাদের চোখে তখন শুধু স্বপ্ন আর স্বপ্ন। কেমন হবে সেই স্বপ্নদেখা কল্পনায় আঁকা ভারত নামের দেশটি? দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদে থাকা তাদের প্রিয় মানুষগুলো নিশ্চয়ই কত উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে! কিভাবে তাদের অভ্যর্থনা জানানো হবে? কেমন হবে ভারতে বসবাসের অনতিদূর অনাগত ভবিষ্যৎ? অজানা অচেনা পরিবেশে নিজেদের কতটুকু মানিয়ে নিতে পারবে তারা? ভারত সত্যি তাদের গ্রহণ করবে তো? সে এক অপার উৎকণ্ঠা এবং সেই সাথে বিস্ময়! শেষপর্যন্ত ভারতের মাটিতে বসবাস শুরু করার এক অদম্য আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। স্বপ্ন তাহলে সত্যি হতে চলল?

undefined




ভারত দর্শনের প্রথম অনুভূতি |
ভারত দেশটা কেমন? সে দেশের মানুষেরা সত্যিই কি সভ্য? তারা কী খায়? কেমন তাদের জীবন যাপন? ভারতে পৌঁছানোর আগেই বিলাতি নারীদের মনে এ ধরনের শঙ্কা উঁকি দিতে শুরু করত। কিন্তু একজন বিলাতি নারী তিনি যেভাবেই ভারতে পৌঁছান না কেন, ভারতের মাটিতে পা রাখার সাথে সাথেই তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া খুব একটা সুবিধের হতো না। ভারতের আবহাওয়া গরম আর সেই সাথে রয়েছে সে দেশটির নিজস্ব খাবার, ভাষা এবং সংস্কৃতি। সেখানকার আলো বাতাসে সে দেশের মাটি, ফসল এবং মানুষের ঘ্রাণ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে সেই ঘ্রাণটিকে একটি বিলাতি নাক কিভাবে স্বাগত জানাবে সেটাই হলো বড় কথা!

বিলাতিরা ভারতে পা রাখার সাথে সাথেই যে সমস্যাটি প্রথমেই টের পেত তা হলো ঘ্রাণ। ভারতের আকাশে বাতাসে বিচিত্র স্বাদের ঘ্রাণ! বাতাসের রকম, মশলাপাতি দিয়ে রান্না করা খাবার দাবারের ঘ্রাণ, তামাক, আদা, রসুন, গোবর—সব কিছুর মিশ্রণে সৃষ্ট এই নতুন ঘ্রাণকে বিলাতিদের নাক অত সহজে স্বাগত জানাতে পারত না। ঘ্রাণের পাশাপাশি ছিল ভারতীয়দের পোশাক আশাক, সামাজিক রীতিনীতি, শব্দ বিভ্রাট, রাস্তাঘাটে মানুষের হৈ চৈ, বাড়িঘরের গঠনশৈলি ইত্যাদি। আর যাইহোক, এইসব চিত্র বিলেতের চিরচেনা পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণভাবেই আলাদা ছিল।

১৯৩০ সালে পামেলা হিকসন নামের এক বিলাতি নারী ভারতের মাটিতে পা ফেলেই তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এইভাবে, “শাড়ি পরিহিত একদল ভারতীয় নারীদের দেখলে মনে হবে তারা বুঝি রঙকানা। কারণ তাদের শাড়িগুলো ছিল কমলা, লাল, হলুদ, পিঙ্গল, নীল—সব ক’টা রঙের বিচিত্র সমাহারে পূর্ণ, যা কাপড়গুলোতে উজ্জ্বল হয়ে মিশে আছে। ” তবে এ ধরনের নেতিবাচক মন্তব্যের পাশাপশি ইতিবাচক মন্তব্যও খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন মিসেস গুথরিয়ে ১৮৭০ সালে ভারতে ভ্রমণ করতে এসে বোম্বেতে এক উচ্চবিত্ত ভারতীয় নারীর কাপড় চোপড় দেখে রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি তার ডায়েরিতে লিখেন, “পরনে সাটিনের স্কার্ট আর তার-ওপর সবুজ এব্রয়ডারি করা অসাধারণ পোশাক, চিকচিক করা পেছনের চুলে শোভা পাচ্ছে ফুল এবং সেই সাথে গায়ে জড়িয়ে আছে অনেক দামি সোনার অলঙ্কার। ” (ওমেন অব দ্য রাজ: দ্য মাদারস, ডটারস, ওয়াইভস অ্যান্ড ডটারস অব দ্য ব্রিটিশ এমপায়ার ইন ইন্ডিয়া। লেখক মার্গারেট মেকমিলান, রেনডম হাউস ট্রেড, ২০০৫। )

undefined



বিলাতিরা ভারতে পা রাখার সাথে সাথেই যে সমস্যাটি প্রথমেই টের পেত তা হলো ঘ্রাণ। ভারতের আকাশে বাতাসে বিচিত্র স্বাদের ঘ্রাণ! বাতাসের রকম, মশলাপাতি দিয়ে রান্না করা খাবার দাবারের ঘ্রাণ, তামাক, আদা, রসুন, গোবর—সব কিছুর মিশ্রণে সৃষ্ট এই নতুন ঘ্রাণকে বিলাতিদের নাক অত সহজে স্বাগত জানাতে পারত না। ঘ্রাণের পাশাপাশি ছিল ভারতীয়দের পোশাক আশাক, সামাজিক রীতিনীতি, শব্দ বিভ্রাট, রাস্তাঘাটে মানুষের হৈ চৈ, বাড়িঘরের গঠনশৈলি ইত্যাদি। আর যাইহোক, এইসব চিত্র বিলেতের চিরচেনা পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণভাবেই আলাদা ছিল।

undefined



অন্যদিকে ছিল ভারতের রাস্তাঘাটের দৈন্য দশা। চলুন, আঠার শতক কিংবা ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের রাস্তাঘাট কেমন ছিল তার একটা খোঁজ নেওয়া যাক। শহরের প্রধান প্রধান রাস্তাগুলোতে মানুষের আনাগোনা ছিল, আর তার পাশাপাশি ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়িও চলত। রাস্তায় গোবর বা বাতাসে গোবরের ঘ্রাণ ভারতীয়দের নাকে খুব সাধারণ এবং স্বাভাবিক একটি বিষয় হলেও বিলাতি নাকের জন্য সেটি ছিল রীতিমতো ভয়াবহ অভিজ্ঞতা!

রোসামুন্ড লরেন্স বিলেত থেকে ভারতে এসেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। তিনি বোম্বের একটি ব্যস্ত রাস্তার বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে, “আমার জীবনে আমি এত বেশি বাদামি বর্ণের মুখকে একত্রে কখনো হাঁটতে দেখিনি। তাদের পরনে ময়লা সাদা কাপড়, সেনাদের পরিহিত উর্দিগুলো মোটামুটি পরিষ্কার। রাস্তায় ভিক্ষুক আর নেড়ি কুকুরের দল যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তার পাশে রয়েছে বিভিন্নরকম গাছপালা আর সেই গাছপালা থেকে কানে আসছে মিষ্টি কোকিলের ডাক। ”

বিলাতি নারীদের চোখে ভারত ছিল তাদের কল্পনার একটি দেশ। তবে কল্পনা এবং বাস্তবে সম্পূর্ণই দু’রকম বাস্তবতা। ভারতে পা রাখার পর বিলাতি নারীরা বাস্তবতার আয়না দিয়ে ভারতকে আবিষ্কার করেছেন ভিন্ন প্রতিক্রিয়ায়।

তৎকালীন বিলাতি বাজারে ভারতের পিতল, কাশা, চামড়া দিয়ে তৈরি করা বিভিন্নরকম তৈজসপত্র বেশ বিখ্যাত ছিল। বিলাতি নারীরা এইসব তৈজসপত্রের দোকানে সবসময়ই ঢুঁ মারতেন। বিভিন্ন মনোহারী রঙের এসব তৈজসপত্র গুণে এবং মানে ছিল সেরা। সেই সাথে ভারতের বিভিন্নরকমের বাহারি ফুলের সমাহার ছিল রীতিমত ঈর্ষণীয়। এমিলি মেটকালফে ১৮৪৭ সালে ভারত এসেছিলেন ভারতে অবস্থানরত তার বাবাকে দেখতে। তিনি বর্ণনা করেন, “গাছগুলো কত সুন্দর, কত সুন্দর সুন্দর ফুল, দেখলে মনে হবে যেন সাক্ষাৎ এক স্বর্গ। ”

undefined



ঊনিশ শতকের দিকে কলকাতা বন্দর হওয়ার পরপরই কলকাতা বিলাতিদের জনপ্রিয় শহরে পরিণত হয়। সেই সময় কলকাতায় ভিড়তে হলে অবশ্যই হুগলি নদী হয়ে বন্দরে আসতে হতো। হুগলি নদী দিয়েই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগ স্থাপনের কাজ চলত। তবে হুগলি নদীটি মোটেও শান্ত কোনো নদী ছিল না। ভয়টা ছিল সেখানেই। অনেক সময় নদীতে জাহাজ ডুবে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটত। এমিলি মেটকালফের বর্ণনায় তার একটি আভাস পাওয়া যায়। তার বর্ণনায়, “আমাদের স্টিমারটি কলকাতার উপকূলে থাকার কারণেই আমাদের উদ্বেগ বেড়ে গেল। কারণ আমাদের এখন ভয়াবহ রাস্তাটা পার হতে হবে। জেমস এবং মেরি নামে দুটো জাহাজ ঠিক এখানেই ডুবে গিয়েছিল এবং তাতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ”

undefined



এ কথা তো সবারই জানা যে, ভারত কখনোই বিলাতিদের ভালোবাসার কোনো দেশ ছিল না। ফলে ভারতের জীবনাচার বা জীবনব্যবস্থাও বিলাতিদের ভালো লাগার তেমন কারণ নেই। দুটো দেশের দু’রকম সভ্যতা। বিলেত এবং ভারতের মানুষের চিন্তার রঙকে এক করে দেখাটা সে কারণেই বিলাতি নারীদের প্রথম এবং সবচেয়ে কঠিন ভুল। বিলাতি নারীরা বেশিরভাগ সময়েই সেই ভুলের শিকার। তারা কল্পনায় যে ভারতকে দেখতেন, ভারতে এসে সে ভারতকে আর খুঁজে পেতেন না। মাদ্রাজের নৌকার মাঝিদের কথাই ধরা যাক। তারা তাদের দক্ষতা এবং ভদ্র আচরণ দিয়ে বিলাতি নারীদের মন জয় করেছিল। বিলাতি নারীরা সময় পেলেই মাদ্রাজে মনোরম পরিবেশে নৌ ভ্রমণে বের হতে ভালোবাসতেন। ১৮১০ সালে ভারতে আসা এক বিলাতি নারী তার অভিজ্ঞতার খাতায় মাদ্রাজের নৌকার মাঝিদের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন, “এদের মাথায় পাগড়িটা ছাড়া বলা যায় গোটা শরীরের সবটাই উলঙ্গ। ” তবে মাদ্রাজ সম্পর্কে বিলাতি নারীদের উচ্ছ্বাসও ছিল অনেক বেশি। তারা মাদ্রাজকে ভারতের অন্যান্য জায়গার চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। কোনো কোনো বিলাতি নারীকে মাদ্রাজ শহরের প্রেমে পড়তেও দেখা যায়। ১৮৪০ সালে ভারত এসেছিলেন মিসেস এসমোরে। তিনি তার স্মৃতিতে মাদ্রাজ সম্পর্কে লিখেছেন, “রাস্তাগুলো বেশ চওড়া, বাড়িঘর খুব সুন্দর এবং সেখানে হাঁটাও খুব আরামদায়ক। ”

ঊনিশ শতকের দিকে কলকাতা বন্দর হওয়ার পরপরই কলকাতা বিলাতিদের জনপ্রিয় শহরে পরিণত হয়। সেই সময় কলকাতায় ভিড়তে হলে অবশ্যই হুগলি নদী হয়ে বন্দরে আসতে হতো। হুগলি নদী দিয়েই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগ স্থাপনের কাজ চলত। তবে হুগলি নদীটি মোটেও শান্ত কোনো নদী ছিল না। ভয়টা ছিল সেখানেই। অনেক সময় নদীতে জাহাজ ডুবে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটত। এমিলি মেটকালফের বর্ণনায় তার একটি আভাস পাওয়া যায়। তার বর্ণনায়, “আমাদের স্টিমারটি কলকাতার উপকূলে থাকার কারণেই আমাদের উদ্বেগ বেড়ে গেল। কারণ আমাদের এখন ভয়াবহ রাস্তাটা পার হতে হবে। জেমস এবং মেরি নামে দুটো জাহাজ ঠিক এখানেই ডুবে গিয়েছিল এবং তাতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ”

এমিলির মতো অনেক বিলাতি নারীর এরকম ভয় আর উৎকণ্ঠা থাকলেও কেউ কেউ ঠিকই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা পুরো যাত্রাপথটাকে উপভোগ করার চেষ্টা করতেন। মিনি ব্লেন ১৮৫৬ সালে ভারতে এসে ভারতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। তার ভাষায়, “এখানকার প্রকৃতি অসাধারণ সুন্দর। ” তিনি তার মাকে লেখা এক চিঠিতে ভারতে আসার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন এভাবে, “খেজুর, নারকেল এবং কলার স্বাদ অসাধারণ, আর গাছগুলো দেখতেও খুব অসাধারণ সুন্দর। ”

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ঊনিশ শতকের দিকে বন্দরকে ঘিরে কলকাতা শহরের রাস্তাঘাট, মিল কারখানা, অফিস আদালত সব কিছুই বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। সঙ্গত কারণেই তখন বিলাতি নারীদের চোখ পড়ে কলকাতার দিকে। মিসেস ফে কলকাতা সম্পর্কে বলেন, “নদীর পাড়গুলো অসাধারণ। অট্টালিকায় ছড়াছড়ি, বাড়িগুলোর সামনে বিশাল পরিমাণ চত্বর। ”

তবে মোটকথা হলো কলকাতা হোক কিংবা মাদ্রাজ—ভারতের সংস্কৃতি এবং সেই দেশের আচারকে ধারণ করে নিতে বিলাতি নারীরা তখনও প্রস্তুত ছিল না। প্রথম কথা হলো ভারতে ছিল তারা নবাগত এবং ভারতে আসতে তারা ছিল অনেকটাই বাধ্য। আগেই উল্লেখ করেছি যে, কেউ ভারতে এসেছেন তাদের আত্বীয়স্বজনদের সাথে দেখা করতে, কেউ এসেছিলেন ভারতে তাদের নতুন জীবনের ঠিকানা তৈরি করতে। তবে তারা কেউই ভারতকে ভালোবেসে ভারতে আসেননি। ভারত সম্পর্কে তাদের ভাসা ভাসা একটি জ্ঞান হয়ত ছিল, কিন্তু সেই হালকা জ্ঞান নিয়ে কেউই ভারতকে উপলব্ধি করতে পারেন নি বা পারার কথাও নয়। আরেকটা বিষয় হলো ভারতের সংস্কৃতি ছিল বিলেতের ঠিক বিপরীত। আর সে কারণেই ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ভাষাভাষির একটি দেশে এসে বিলেতি মেমরা মানসিক এবং আত্মিক সুখ খুব একটা খুঁজে পাননি।

পর্ব ৪ পড়তে ক্লিক করুন

undefined



বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।