ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সাদী ইউসেফ-এর কবিতা | তর্জমা : মঈনুস সুলতান

অনুবাদ কবিতা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৫
সাদী ইউসেফ-এর কবিতা | তর্জমা : মঈনুস সুলতান

সাদী ইউসেফের জন্ম ১৯৩৪ সালে দক্ষিণ ইরাকে; বসরার কাছাকাছি আবু আল খাসেব নামক স্থানে। এ অব্দি রচনা করেছেন পয়তাল্লিশটি কবিতা ও সাতটি গদ্যগ্রন্থ।

বাগদাদে তাঁর পড়াশুনার বিষয়বস্তু ছিল আরবি সাহিত্য। প্রথম জীবনে শিক্ষকতা করেন কিছুকাল। পরে পেশাগতভাবে সাংবাদিক ও প্রকাশক হিসাবে কাজ করেন। রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট হিসাবেও তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ বয়সে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে শামিল হন, এবং বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন সমাজতন্ত্র ও সম্পদের সুষম বন্টনে। প্রভাবিত হন প্যান-আরব ভাবধারায়। রাজনৈতিক অ্যাক্টভিজমে যুক্ত থাকার পরিণামে ইরাকে কারাবরণ করেন। পরে স্থায়ীভাবে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন ১৯৭৯ সালে। প্রবাস জীবনে স্বপ্ল মেয়াদে বাস করেছেন আলজেরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন, ফ্রান্স, গ্রিস, সাইপ্রাস প্রভৃতি দেশে। অবশেষে স্থায়ীভাবে থিতু হোন বিলাতে।

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। কবিতায় মৌলিক অবদান ছাড়াও আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন ফেদরিকো গার্সিয়া লোরকা, ওয়াল্ট হুইটম্যান প্রমুখের কবিতা। সমালোচকরা সাদী ইউসেফকে আরবি সাহিত্যের সাম্প্রতিককালের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসাবে বিবেচনা করে থাকেন। তাঁকে আধুনিক আরবি কবিতার পায়োনিয়ারও বলা হয়। জনপ্রিয় এ কবি তাঁর কিছু কিছু কবিতার জন্য বিতর্কিতও হয়েছেন। যেমন— কুর্দিদের নিয়ে রচিত একটি কবিতার জন্য কুর্দিস্থানের স্থানীয় প্রশাসন তাঁর তাবৎ রচনা স্কুল কারিকুলামে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

২০১২ সালে কবি অত্যন্ত মর্যাদাবান নাগিব মাহফুজ পুরস্কারে ভূষিত হোন। ২০০৪ সালে তাঁকে আল কায়েস পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করা হলেও সংযুক্ত আরব আমিরাতের শাসক শেখ জায়েদ বিন আল নাহিয়ানের সমালোচনা করার জন্য তাঁকে পুরস্কার গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা হয়। ২০০২ সালে খালেদ মাত্তাওয়ার ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয় তাঁর নির্বাচিত কবিতার বই— উইদআউট অ্যা এলাফাবেট, উইদআউট অ্যা ফেইস। নিচে উপস্থাপিত কবিতাগুলো এ গ্রন্থ থেকে বাছাই করা হয়েছে।


নিশাচর

যে গলিপথের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পথভুলে হারিয়ে যাওয়া—ওখানে নিভু নিভু হয়ে আসা সর্বশেষ মশালটি পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হবে। দুয়ারগুলোর কড়ায় শিকল জড়িয়ে বন্ধ করে দেয়া হবে সব। কী ধরনের সন্ধ্যাতারা এটি— যা কেবলই হারিয়ে যাচ্ছে মেঘের অন্তরালে? কী গান আমরা গাইছি বাকরুদ্ধ স্বরে? বাগিচায় গলছে মোমবাতি ফোঁটায় ফোঁটায়। এই মাত্র একটি শিশু মুখে পুরে দিলো কাদা। উড়ছে ভনভনে মাছি, ডাকছে একটি ঘুঘু করুণ স্বরে। যে শাখাটি ধরে আছো তা-ও থাকবে না আর হাতের নাগালে।
মুখ থুবড়ে পড়লো মোমের শিখা। নিজের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে দিনযাপন করতে করতে আমি ক্লান্ত। পাথরে তৈরি এক মুখ ঘুরছে চক্রাকারে। যে গালিগুঁজি হারিয়ে গেছে তার বিশেষ সব বৈশিষ্ট্য এখন ডুবে যাচ্ছে তীব্র আঁধারে। আমার চোখের সামনে তা ধুলি হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে মেঘে মেঘে। আমি তার ভাঙ্গাচোরা নুড়িপাথর দিয়ে মোজেকে বাঁধি আমার স্মৃতিময় সরণী।
বানভাসিতে ডুবছে তার কবর, সমাধি ফলকে লেগেছে নুনের প্রলেপ। বালক এক পর্যবেক্ষণ করছে ধুমকেতুর বর্ণালী বিস্ফোরণ। নারীরা রোদন করছে আকুল হয়ে। আর দ্যাখো— এতিম শিশুটি গাড়ি চড়লো পয়লাবার। মেয়েরা কেন তার পিতার নাম উল্লেখ করছে। ইউসেফ ইউসেফ? এক মহিলা তাকে শনাক্ত করতেই সে চুমো খায় তার গণ্ডদেশে। বানের জল লবণাক্ত, খেজুরের গাছগুলো সাদাটে ধূসর, আর বালকটি বিভোর ধুমকেতুর রঙিন রশ্মিময় ছত্রখানে। মেয়েটিকে জাদুটোনার মায়ায় ভুলানো পুরুষ হচ্ছে তোমার পিতৃব্য। তিনি হাতে স্রেফ তীরধনুক নিয়ে বিদ্ধ করতেন ধুমকেতু। দুপুরের দিকে মেয়েরা ইউসেফের নাম ধরে চিৎকার করে। তার কাদামাটিতে গড়া কবর চীৎকার ও ধুমকেতুর বিস্ফোরণের ভেতর ডুবছে বন্যার বিপুল জলে।
যদি একটি মিনারের সত্ত্বাধিকারী হতাম— ওখানে বাস করতাম সম্পূর্ণ একাকী আমি। প্রাসাদের রাজকুমার হলে কুকুর পোষতাম নিরাপত্তার প্রয়াশে। যদি সুযোগ হতো যুগল নারীর সহচর্যে— বেঁচে থাকতাম কেবলমাত্র একজন নারীর জন্য। যদি আমার পথ চলাচলের সিঁড়ি সাজানো থাকতো সমুদ্র জলের উপর— একাকী হেঁটে চলে যেতাম পৃথিবীর প্রান্ত অব্দি।


দুপুর

তোমাকে চাওয়ার বাসনা ও একত্রে হেঁটে যাওয়ার মাঝখানে
পড়ে আছে দ্বিধা... প্রতিফলন ও একগেঁয়েমির বিপুল প্রান্তর,
ভাবি— কখনো কি একসাথে বাঁধা হবে ঘর?
নদীতীরে বসে ডুবাতে পারি না আমাদের জোড়া হাত বাহিত জলে,
রেস্তোরাঁয় বসে কথা কি বলতে পারি না কোন ছলে?
শুধু কি সন্তুষ্ট থাকবো আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের বৃত্তে?
অথবা মৌন হব একটি প্রশ্নের শরাঘাতে
যদিও নানাকথা খানিক ব্যথা জমে থাকবে যুগল চিত্তে;
তারপরও যখন আমি দেখি তোমাকে—
দুশ্চিন্তা হয় দারুণ,
লাজুকভাবে সুইয়ে সুতো পরিয়ে অপেক্ষা করছো তুমি ছায়াতলে
কপোলে অশ্রু শুকিয়ে হয়েছে নুন।


স্বদেশ

একটি দেশ বলে বিবেচিত হওয়ার কোন গুণাবলীই
ছিলো না এ অঞ্চলের,
তবে আমাদের মানসের শীলাপাথরে তার ইমেজকে
লিপির আকারে কুঁদে দেয়ার ক্ষমতা ছিলো ঢের।
আমরা যারা কাদামটিতে গড়া শিশু সন্তান,
তার চিত্র নীলিমা নিসর্গ নিচয় তাবৎ সময় ছড়িয়েছে ত্রাণ।
দেশ ছিলো না বটে— তবে এ ভূভাগ— তার নদীজল কাকলী
মুছে দিতে সক্ষম ছিলো আমাদের ললাটে লেখা লিপি,
কীভাবে তার স্মৃতি আমাদের রক্তমেঘে ছড়াচ্ছে বিজলি
অবচেতনের বনানীতে ডাকছে তার পোষা জলপিঁপি।

বিস্মৃত হয়েছি— এবং বলা হচ্ছে আমরা আর কখনো
এমনকী স্বপ্নেও দেখবো না তার ঐতিহ্যময় প্যাপিরাস,
সত্যিই চলে গেছে সে বিস্মরণের অন্তরালে
বিলুপ্ত হয়েছে বসরাই গোলাপের সুরভীময়  সুবাতাস।
যেমন করে সেনানিরা ভুলে যায় তাদের চুম্বনের প্রথম স্পর্শরাগ,
এমনকী পালঙ্কও রাখে না মনে মেঝের শক্ত ভীত
মোজেকে কাঠের পায়ার কঠোর দাগ।
যে রকম ঊর্মিমালার কাছে থাকে না মহিসোপানের শৈবালের খবর,
বিস্তৃত হয়েছি আমরা যে ভূখণ্ডে ছিলো আমাদের পূর্বপুরুষের ঘর।
এবং বলা হচ্ছে— কিছুতেই ফিরে পাবো না সে হারানো ভুবন
কিন্তু কে তাকে আসতে দিলো জানালা দিয়ে চুপিসারে,
দুয়ারের নিচে চৌকাঠের সামান্য ফাঁক গলে,
কে তাকে ফিরিয়ে আনলো অজান্তে অহেতুক ছলে
তার রক্তাক্ত হাতে আমাদের তুলে নিয়ে বাঁধে সে হৃদয়ের বিজুলিময় তারে,
তারপর ছুড়ে মারে মাংসের ভাগাড়ে শকুনের জন্য
যে ভুবন ছিলো প্রিয়—কীভাবে তার বাতবরণ হলো আজ বন্য?
নিঃসঙ্গতা

খুব ভোরে দেখি আমি তাদের— হেঁটে যাচ্ছে একত্রে দ্রুত
মনে হয় দূরের মানবী তারা অতীব অধরা,
বাদামের গন্ধে ভরে ওঠে সড়ক
ভাবি— মেয়ে দুটি কী সহোদরা?
খেয়াল করে দেখি—
পোষা বিড়ালের মতো মাপা পদক্ষেপ তাদের— নিঃশব্দ,
বাদামের গন্ধ আমাকে করে অনুসরণ
যেন আমারই বাসনালব্দ,
মেয়ে দুটি জানাশোনা কাউকে করেছে কি বরণ?

প্রতিদিন ভোরে ঘড়িতে যখন বাজে বেলা দশ
প্রতীক্ষা করি— উপেক্ষা করে আমার খ্যাতি ও যশ,
বাদামের গন্ধে বিভোর হয়ে
আঁকড়ে ধরি বিড়ালের থাবা সজোরে
তবে কি তারা নীরবে সড়ক অতিক্রম করে
চলে গেছে আজ আমার অগোচরে?

না, যায়নি তারা একেবারে অনেক দূরে
দেখি— গাছের আড়ালে বাঁক নিচ্ছে ছায়ায় ম্রিয়মান,
আমার ভেতরে ঝড়েজলে কাদায় পুঞ্জিভূত হয় অভিমান
জানালায় দাঁড়াতেই দেখি—
তাকাচ্ছে তারা গ্রীবা বাঁকিয়ে পেছন ফিরে,
আলোর এক সুতো এসে আমাকে জড়ায়
হেঁটে যায় তারা ছায়াময় সবুজে অতি ধীরে।

 
বনভূমি

বনানীর সাথে আমার মিথস্ক্রিয়া হয়েছে জীবনে মাত্র দু’বার
ছেলেবেলা যখন বন্ধুদের সহচর্য ছিলো জীবনের সারাৎসার,
আমাদের চোখে প্রচ্ছন্ন ছিলো গোপন তথ্য সে সময়ের রহস্যময়তা
কর্দমাক্ত কাপড়চোপড়, গানের কলি আর তালগাছের সবুজ পাতা।
তারপর বনভূমির খাস মহলে গড়ে উঠলো আমার নিজস্ব নিবাস,
যে চোখ ব্যবহার করেছি আমি পুস্তক পাঠে
কীভাবে যেন তা থেকে দূরে সরে গেলো শৈশবের আকাশ।
আমার হাতে শোভা পেলো বৃক্ষের যন্ত্রণায় তৈরি যষ্টি,
শাখাগুলো বন্দুকের নলে ছড়ালো সন্ত্রাস।
কোথায় আমাদের কর্দমাক্ত কাপড়চোপড়
গানগুলো কি ছেড়ে গেলো একেবারে,
হৃদয়ের সুচারু কুসুমরাজি ঝরে গেছে
ক্রমাগত কুচকাওয়াজের প্রহারে।

শৈশবের হে বনভূমি—
কীভাবে তোমার পত্রালিতটে করেছি আমি আত্মসমর্পণ,
একবার মেতেছিলাম বান্ধববাসরে
আরেকবার নিমজ্জিত হয়েছি— স্রেফ নিজের অভ্যন্তরে।


পলাতক নিশাচর

নিমজ্জিত অতীত থেকে ওঠে আসে তাবৎ বস্তুনিচয়। মে মাসের আজ রাতে একটি মোমের মৃদু শিখা কাঁপে এলোমেলো বাতাসে। আমার সাথে দুটি পুস্তক আর একজোড়া পুরানো ট্রাউজার্স।
বিষয়টি আদতে এরকমই। মৃদু কাঁপে মোমের আলো। ছায়ায় খেজুর পাতার রঙ পরিবর্তিত হয় গাঢ় সবুজে। নদীতে ভাসমান জাহাজ এক, এগিয়ে আসছে খুব ধীরে বালুচরের কাছাকাছি।
বিষয়টি আদতে এরকমই। নক্ষত্র থেকে ছড়াচ্ছে তোমার চোখের মতো নীলাভ বিচ্ছুরণ। এ হচ্ছে বেদনার গভীরে তীব্র ঝড়ের নকশা। মে মাসের এ নিশীথ কেটে যাবে হে সুহৃদ। আঁকড়ে থাকো আরো সামান্য কটা দিন, সঙ্গে দুটি বই আর এক জোড়া ট্রাউজার্স।
একদিন ফিরবে কি তুমি কাঁধে কবুতর নিয়ে?
এখন তাবৎ কিছু উঠে আসছে ডুবে যাওয়া অতীত থেকে। কেটে গেছে দুটি বছর, সে ফেরেনি কিন্তু।
একদিন শিশুটি জড়িয়ে ধরবে আমাদের তার ছোট্ট নরম দু’হাতে। সে ফিরে আসবে দুটি বই ও নতুন একজোড়া ট্রাউজার্স নিয়ে। সব সময়ই ফিরবে সে নিরাপদে।



বাংলাদেশ সময়: ১২১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।