ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ৯)

ধারাবাহিক রচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৫
ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ৯)

পর্ব ৮ পড়তে ক্লিক করুন

ডিভাইড অ্যান্ড রুল |
শিল্প বিপ্লবের স্পর্শে ইউরোপ ততদিনে বেশ আলোকিত একটি বিশ্ব। নৈতিকতার দিক থেকে মানুষের চিত্ত আগের চেয়ে অনেক বেশি বিকশিত আর অর্থনৈতিকভাবেও গোটা পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর চাইতে ভালো একটি অবস্থানে রয়েছে।

ইউরোপিয়ানরা তখন ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে বের হয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টায় ব্রত। পাশাপাশি তুলনা করলে ভারত সেদিক থেকে অনেক পিছিয়ে পড়া একটি দেশ। প্রথমত দেশটিতে ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল প্রবল। বিধবা বিয়ে ছিল নিষিদ্ধ। বাল্যবিয়ে ছিল খুব সাধারণ একটি ঘটনা। ব্রাহ্মণদের দৌরাত্ম্য ছিল প্রবল। সতীদাহ প্রথার মতো ঘৃণ্য প্রথাও তখন ভারতীয় সমাজে বিদ্যমান। ১৮২৯ সালে ইংরেজরা ভারতে সতীদাহ প্রথার বিলুপ্ত ঘোষণা করে। সেই সাথে বিলুপ্ত হলো বর্ণবাদের মতো অভিশপ্ত একটি প্রথাও। ভারতীয় সমাজ সেই জাত প্রথার অন্ধকার জালে আটকা পড়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ব্রাহ্মণরা সমাজের সবচেয়ে উঁচু জাতের মানুষ হিসেবে গণ্য হতো। তারাই ছিল সমাজের গুরু। ইউরোপিয়ানরা ছিল সেদিক থেকে চতুর, সুবিধাভোগী এবং তুলনামূলক শিক্ষিত। তবে শিল্প বিপ্লব বলুন আর উন্নত শিক্ষার কথাই বলুন, কোনো কিছুই তাদের প্রাণকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি। বর্ণবাদ, দাসপ্রথা তো বটেই, জাতিগত বৈষম্যকে হৃদয়ে জিইয়ে রেখে সাম্রাজ্যবাদী ভাবনায় ইউরোপিয়ানরা তখনও নিমগ্ন ছিল।



ভারতের বর্ণপ্রথা ইংরেজদের জন্য ভয়াবহ রকমের একটি শিক্ষা। হিন্দু ধর্মের নানান জাতপাত এবং সেই সাথে মুসলমানদের সাথে তাদের সহঅবস্থান ইংরেজদের জন্যে ছিল এক অবাক বিস্ময়। হেনরি কোটন যিনি ১৮৮১ সালে আসিএস কর্মকর্তা ছিলেন তিনি তার রিপোর্টে লিখেন, “হিন্দু এবং মুসলমানরা তাদের নিজেদের খাবার একজন আরেকজনের সাথে ভাগাভাগি করে না খেয়েও কী সুন্দর দিব্যি সহঅবস্থানে রয়েছে!” সেই সময় অনেটি বেভারিজ নামের এক বিলাতি নারী ভারতের বানকিপুরের একটি রাতের খাবারের বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লেখ করেন, “বলতে পারি এটি ছিল একটি আন্তর্জাতিক বৈকালিক সন্ধ্যা যেখানে হিন্দু, মুসলমান এবং ইউরোপিয়ানদের জন্যে আলাদা আলাদা খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সবাই খুব সুন্দর সহঅবস্থানে বসে খাবার খেয়েছে। ”



মিসেস লিওপোড পাগেট ১৮৬০ সালে ভারতে এসেছিলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতের মানুষ সম্পর্কে তার কোনো পূর্ব ধারণা ছিল না। কোনো রকম বাস্তব ধারণা না থাকলে কী হবে, কল্পনার জালে ভারতীয়দের সম্পর্কে তার মন্তব্য ছিল “দ্বিতীয় শ্রেণীর মানসিকতার মানুষ। ” বেশ বোঝা যায়, ভারতীয়দের সম্পর্কে উচ্চ কোনো ধারণা নিয়ে বিলাতিরা ভারতে আসেনি। তারা তাদের চিন্তায় এবং চেতনায় ভারতীয়দের সম্পর্কে ভালো কিছু কখনোই আশা করতে পারেনি। কিন্তু অবাক করা ঘটনা হলো এই ইংরেজরাই ভারত নামের দরিদ্র দেশটিতে সুখের ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার জন্য এবং দেশটি দীর্ঘকাল শাসন করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ভারতকে দীর্ঘদিন পরাধীন রাখার কৌশল হিসেবে তারা ভারতীয়দের ধর্ম, আচার এবং সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা শুরু করল। লর্ড কার্জন যিনি ১৮৯৯ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত ভারতের ভাইসরয় ছিলেন, তিনি ইংরেজদের সবসময় ভারতীয় সমাজ এবং ধর্মকে ভালোভাবে হৃদয়াঙ্গম করে প্রয়োজনীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বোম্বের বাইকুলা ক্লাবের এক বক্তৃতায় কার্জন বলেন “সর্বশক্তিমান তার গভীর ইচ্ছানুযায়ী আপনাদের (ইংরেজদের) সুন্দরতম ভবিষ্যৎ, আইনের শাসন, দেশাত্ববোধের চর্চা, বুদ্ধির বিকাশ এবং সুখকে আরোহণ করার জন্য এখানে (ভারতে) প্রেরণ করেছেন। ”

ভারতের বর্ণপ্রথা ইংরেজদের জন্য ভয়াবহ রকমের একটি শিক্ষা। হিন্দু ধর্মের নানান জাতপাত এবং সেই সাথে মুসলমানদের সাথে তাদের সহঅবস্থান ইংরেজদের জন্যে ছিল এক অবাক বিস্ময়। হেনরি কোটন যিনি ১৮৮১ সালে আসিএস কর্মকর্তা ছিলেন তিনি তার রিপোর্টে লিখেন, “হিন্দু এবং মুসলমানরা তাদের নিজেদের খাবার একজন আরেকজনের সাথে ভাগাভাগি করে না খেয়েও কী সুন্দর দিব্যি সহঅবস্থানে রয়েছে!” সেই সময় অনেটি বেভারিজ নামের এক বিলাতি নারী ভারতের বানকিপুরের একটি রাতের খাবারের বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লেখ করেন, “বলতে পারি এটি ছিল একটি আন্তর্জাতিক বৈকালিক সন্ধ্যা যেখানে হিন্দু, মুসলমান এবং ইউরোপিয়ানদের জন্যে আলাদা আলাদা খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সবাই খুব সুন্দর সহঅবস্থানে বসে খাবার খেয়েছে। ” বিলাতিদের জন্যে বিষয়টা খুব সুখের ছিল না। কারণ তাদের মূল উদ্দেশ্য ভারতে অবস্থিত হিন্দু-মুসলমানদের মাঝে বিবাদের সৃষ্টি করা এবং সেই বিবাদ থেকে নিজেদের ফায়দা তোলা। শেষ পর্যন্ত ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’-এর মাধ্যমে বিলাতিরা তাদের স্বার্থ হাসিল করতে পেরেছিল বৈকি! এ কথা সত্য যে ভারতীয় নারীদের প্রতি বিলাতিদের কখনোই তেমন কোনো উচ্চ ধারণা ছিল না। ভারতীয় নারী মানেই বিলাতিদের চোখে ছিল পিছিয়ে থাকা একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে  বিলাতি সমাজে বিলাতি নারীদের অধিকার এবং তাদের জীবন যাত্রা নিয়ে তাদের চিন্তা ভাবনা ছিল বেশ টনটনে। ১৯১৫ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত  ‘ইংলিশ এটিকেট ফর ইন্ডিয়ান জেন্টেলম্যান’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, “ভারতীয় পুরুষরা যখন ইংরেজ নারীদের সাথে কথা বলবেন তখন তারা অবশ্যই কিছু কিছু শব্দ উচ্চারণে সতর্ক থাকবেন যেমন, পাকস্থলি, বয়সন্ধী, মিসকারেজ, চাইল্ডবার্থ ইত্যাদি। ” একই গ্রন্থে ভারতীয় পুরুষদের আরো সাবধান করা হয়েছে যে, “তারা যখন তাদের ধূতি পরে ইংরেজ সমাজে আসবেন ধূতির কাপড় যেন অবশ্যই তাদের পায়ের গোড়ালিটাকে ঢেকে রাখে। ”

এদিকে ভারতের নারীদের কথা চিন্তা করলে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, সে সময়ে ভারতীয় নারীরা—তিনি হিন্দু বা মুসলিম যেই হোন না কেন, বিলাতি নারীদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিলেন। সতীদাহ প্রথা বন্ধ হলেও ভারতীয় নারীরা বিধবা হলে তাদের জন্যে সম্পূর্ণ আরেক ধরনের জীবন ব্যবস্থা রচিত হতো। তাদের পরতে হতো সাদা কাপড়, মাথার চুল ছেটে ফেলা হতো, খাবার-দাবার এমনকি সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তারা ছিল অপ্রত্যাশিত। মুসলিম সমাজে নারীদের জন্য ছিল পর্দা প্রথার প্রচলন। মুসলিম অথবা হিন্দু যেকোন উচ্চবংশীয় নারীরা পর্দার বাইরে বের হতে পারতেন না। তাদের চলতে হতো পর্দার সামাজিক নিয়ম মেনে চলেই। বলার অপেক্ষা রাখে না এ বিষয়গুলো সেই সময়ের বিলাতি নারীদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। প্রথমত তারা বেশ ভালো করেই জানত দেশটি তাদের নিজেদের নয়। ভারতের আলো হাওয়া, সংস্কৃতির সাথে তাদের মানিয়ে চলা কঠিন। সব দিক থেকে চিন্তা করে বিলাতি নারীরা ভারতীয় সমাজ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখারই পক্ষপাতী ছিল। আবার উল্টো দিকে পুরনো ধ্যান ধারণায় ডুবে গিয়ে ইংরেজ পুরুষরাও তাদের স্ত্রীদের যথাসম্ভব ভারতীয় পুরুষ সমাজের বাইরে রাখার চেষ্টা করত। বিলাতি নারী এনি উইলসনের—তার বন্ধুর কাছে লেখা একটি চিঠিতে এই আভাস পাওয়া যায়। “তোমাকে বুঝতে হবে যে, কিছু পুরনো ধ্যান ধারণায় বশবর্তী হয়ে ইউরোপিয়ানরাও তাদের নারীদের ভারতীয় পুরুষ সমাজের সামনে উন্মুক্ত করতে চাইত না। তারা তাদের নারীদের ভারতীয় বসবাস অঞ্চলে যেতে দিত না, ভারতীয়দের দর্শনপ্রার্থী হিসেবে গ্রহণ করাও তাদের জন্যে বারণ ছিল। তারা গোটা ভারতীয় সমাজ থেকেই তাদের নারীদের আলাদ করে রাখার পক্ষপাতী ছিল। ”

তবে ইংরেজদের দীর্ঘদিন ভারতে থাকার কারণে এবং বিভিন্ন রকম রাজনৈতিক কৌশলগত কারণেও ইউরোপিয়ানরা ধীরে ধীরে ভারতীয় সমাজের সাথে মিশতে শুরু করে। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের দিকে ব্যবসাপাতি, খেলাধুলা, হাসপাতাল, কোর্ট কাচারি—সর্বত্রই ভারতীয় পুরুষদের সাথে বিলাতি পুরুষদের একটি সামাজিক লেনদেন শুরু হতে থাকে। বিলাতি নারীরাও বিভিন্ন পালা পার্বণে রাজা-মাহারাজাদের অতিথি হয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শুরু করেছিলেন। অবশ্য এ যোগাযোগটি সর্বসাধারণ ভারতীয়দের সাথে ঘটেনি। শুধুমাত্র উচ্চশ্রেণীর ভারতীদের সাথেই ইংরেজরা এ ধরনের একটি যোগাযোগ তৈরি করতে শুরু করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপর ভারতেও জাতীয়তাবাদের হাওয়া যখন তুঙ্গে তখন ইংরেজরা নিজেদের খোলস থেকে বের হয়ে ভারতীয়দের সাথে মেশার চেষ্টা শুরু করে। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সে চেষ্টা অনেকটাই বৃথাচেষ্টায় পর্যবসিত হয়েছিল। কারণ ভারতীয়রাও ততদিনে বুঝে ফেলেছিল, আর যাই হোক ইউরোপিয়ানরা কখনোই ভারতীয়দের বন্ধু হতে পারে না। এবং পরবর্তীতে তাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

পর্ব ১০ পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।