ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

শুভ জন্মদিন তিশা | এমদাদুল হক

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৫
শুভ জন্মদিন তিশা | এমদাদুল হক

মাঝে মাঝে মনে হয় আজকেই জীবনের শেষ দিন, আর তখনই ডাক্তারের দেয়া সময়ের হুঁশিয়ারি মনে পড়ে, বড়জোর আর তিরিশ দিন! তবে এইটা বলা মুশকিল, সবার শরীর একরকমের না, সবাই একরকমের রেসপন্স করে না! এরপরও ডাক্তার বলল, হয়ত পাঁচ্চল্লিশ দিন।

আমি বাসায় কাউকে কিছু বলি নাই, বরং অহেতুক ঝগড়া কইরা চইলা আসছি! সেই ঝগড়ায় মা অসুস্থ শরীর নিয়া অনেক কান্নাকাটি করছে আর বাবা ছিল নিঃশ্চুপ পরবর্তী কয়েক দিন।

বান্ধবীরে হঠাৎ কইরা কল করা বন্ধ করাতে সে ধইরা নিছে আমি নতুন প্রেমিকা পাইছি, এবং এই ফেসবুক জমানায় সে আজকাল প্রেম বিষয়ক স্টেটাস দিয়া নতুন প্রেমিক জুটানের ধান্ধায় আছে। কাছের বন্ধুদের কাছ থাইকা টাকা লোন করা শুরু করছি ফলে ওরা এখন আমারে এড়াইয়া চলে! আমি রাস্তায় হাঁটা শুরু করি। মিরপুর থেকে সাভার তারপর শ্রীপুর।

আজ রাতে গল্পটার বাকিটুকু লিখব বলে ভেবে রেখেছি তবে ব্যাপক উত্তেজনায় উপরের লাইন কয়টা প্রকাশ কইরা দিলেই আমার পরিচিত লোকজন, বন্ধু-বান্ধবী, প্রাক্তন প্রেমিকা, স্কুলের সহপাঠী আর আমাদের পারার চা ব্যবসায়ী বাচ্চু সিরিয়াস হইয়া যায়। ওরা সিরিয়াস হইয়া আমাকে বারেবার ফোন দিতে শুরু করে, লোকজনের জ্বালায় ফোনের সুইচ অফ করে দিলাম, তাতে নতুন বিপদ হলো, যেহেতু আমি গত সপ্তায় বাসা পাল্টাইছি ফলে সবাই এখনো আমার ঠিকানা জানে না, শুধু জানে আমি নতুন বাসায় উঠছি এবং আমার এই ঠিকানা না জানা যেন আমাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার সামিল, কারণ তখন তাদের আর আমার সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় থাকে না।



পুলিশ মামাই এই মুহূর্তের বিপদে তাদের সাহায্য করতে পারবে ভেবে আমার বান্ধবী তার মামার সাথে যোগাযোগ কইরা, ফোন ট্র্যাক কইরা, আমার বাসার ঠিকানা বাইর কইরা, বাসার নিচে দারোয়ানরে আমার চেহারার বর্ণনা দিয়া আমার ফ্ল্যাটে আইসা আমার দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুইলা গেলে সোজা আমার রুমে আইসা পড়ে, আর পরে দেখে আমি এই গল্পের বাকি অংশ লিখতেছি, যেহেতু এইটাই আমার আসন্ন মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে যাবার পর আমার বান্ধবীর সাথে আমার প্রথম দেখা, ফলে সে দূর থেকে দৌড়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিতে চায় এবং আমাকে বুকে জড়িয়ে নেবার আগেই আমার টেবিলে আমার পুরাতন প্রেমিকার ফটো দেখে থমকে দাঁড়ায়



বিষয়টা আরো সিরিয়াস হয়ে গেলে আমার বান্ধবী, বন্ধু, এবং প্রেমিকা একটা সভা করে আমাকে খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার বান্ধবীর যে মামা পুলিশে চাকরি করে তার দ্বারস্থ হয় এবং পুলিশ মামাই এই মুহূর্তের বিপদে তাদের সাহায্য করতে পারবে ভেবে আমার বান্ধবী তার মামার সাথে যোগাযোগ কইরা, ফোন ট্র্যাক কইরা, আমার বাসার ঠিকানা বাইর কইরা, বাসার নিচে দারোয়ানরে আমার চেহারার বর্ণনা দিয়া আমার ফ্ল্যাটে আইসা আমার দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুইলা গেলে সোজা আমার রুমে আইসা পড়ে, আর পরে দেখে আমি এই গল্পের বাকি অংশ লিখতেছি, যেহেতু এইটাই আমার আসন্ন মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে যাবার পর আমার বান্ধবীর সাথে আমার প্রথম দেখা, ফলে সে দূর থেকে দৌড়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিতে চায় এবং আমাকে বুকে জড়িয়ে নেবার আগেই আমার টেবিলে আমার পুরাতন প্রেমিকার ফটো দেখে থমকে দাঁড়ায় আর আমাকে ছোটলোক বলে গালি দিয়ে চলে যেতে চায়, আর তখনই আমি গল্পের পরের অংশ পালটাইয়া ফেলি; এতদূর থাইকা পেরেশান হইয়া যে মানুষটা আমারে দেখতে আসছে তারে আমি লেমন-এইড অফার করি।

গল্পের বাকি অংশটুকু লিখতে পারতেছি না কারণ এই মুহূর্তে আমার বান্ধবী আমারে ফোন দিয়া জ্বালাইতাছে, কাল বাদে পরশু নাকি ওর জন্মদিন, এই কথা বারবার স্মরণ করাইয়া দিতাছে আর ঢাকা শহরে তার প্রিয় রেস্টুরেন্টের তালিকা শুনাইতেছে, বলতেছে এই সকল রেস্টুরেন্টে সে কোনোদিন যায় নাই, আমি বললাম; জন্মদিন উপলক্ষে আমি তোমারে নিয়া একটা গল্প লিখতাছি, দেখবা এই গল্পটাও দারুণ হিট হইব বাংলানিউজের সাহিত্য পাতায়! বান্ধবী এইসব বুঝল না, তবে শুধু বলল, এমদাদুল গেট রিড অফ ইউর ফ্যান্টাসি, ইউ আর রুইং ইউর লাইফ, ফ্যান্টাসি আর রিয়েল লাইফ এক না! হঠাৎ ক্ষেপে চিৎকার শুরু করল আর বলল তুমি আমাকে নিয়া কিছু লিখবা না প্লিজ, আই ওয়ানা গেট রিড অফ ইউ;  অনেক সহ্য করছি এতদিন। এইসব গল্প ফেসবুকে ছড়াইয়া গেলে কী হবে বুঝতাছো?

শত হোক ওর একটা ইমেজ আছে ফেসবুকে! অথচ আমার বুক খালি কইরা সে জন্মদিনের দিন তার পছন্দের পোলার সাথে ঘুইরা বেড়াইছে, সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখছে আর গেজেট অ্যান্ড গিয়ার থাইকা একটা স্মার্টফোন কিনছে এবং এইটা আমি যখন জানতে পারলাম তখন আমি আবার আমার গল্প পালটাইতে চাইলাম।

বান্ধবী আমার ঠিকানা সবাইরে জানাইয়া দেয় ফলে ওরা প্রতিনিয়ত আমার বাসায় হানা দেয় এবং শরীরের খোঁজ খবর করতে থাকে, কোথায় ব্যথা? কেমন ব্যথা? কবে থেকে ব্যথা? এখন ব্যথা আছে কিনা এই সব প্রশ্ন শুনতে শুনতে যখন আমার মাথা ব্যথা শুরু হয় তখন আমি আর বাসায় থাকি না। আমি নয় নাম্বার রোডে হাঁটা শুরু করলাম, হাঁটতে হাঁটতে পার্ক ক্রস করে যেতে থাকলাম কালশী ব্রিজের দিকে। তখন দেখলাম সাগুফতা রোডে প্রচুর প্রেমিক প্রেমিকা প্রেম করছে, একসাথে বসে আছে, গল্প করছে আর শুধু ঝাল মুড়ি নয়ত বাদাম খাচ্ছে, এইসব দেখতে দেখতে আমি এক ঝালমুড়িওলার সামনে আইসা মুড়ি খাব বলায় সে আমারে কইলো মামা কাউয়া বিরানির গন্ধ আইতাছে না? আপনে টের পান? আমি কইলাম কাউয়া বিরানি? মানে? কাউয়ার আবার বিরানি হয় নাকি? মুড়িওয়ালা কইলো কন কী?! পোল্ট্রি বিরানি পঁয়ত্রিশ টাকা আর কাউয়া বিরানি পঞ্চাশ টাকা মামা, এই আমার সামনের জায়গাটাতেই তো বেচত কিন্তু এখন অনেকদিন হইছে বেচা বন্ধ, নতুন কোনো জায়গায় ব্যবসা খুলছে মনে হয়, এইসব সাত-পাঁচ কইতে কইতে দেখি আমার মুড়ি বানাইয়া হাতে ধরাইয়া দিল; আমি কইলাম ছোলা দিছো মুড়িতে? কয়, না দেই নাই, আপনেরে দেইখাই মনে হইছে আপনে মুড়িতে ছোলা খান না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

আবার হাঁটা শুরু করলাম। বিদায় হবার সময় মুড়িওয়ালা কইলো কাউয়া বিরানি কিন্তু শরীরের বল বৃদ্ধি করে, সে মুচকি হইসা কইলো আরো অনেক উপকারও আছে।

বাসায় আইসা প্রচণ্ড মাথা ব্যথা নিয়া লিখতে বসলাম। আর একদিন পর তিশার জন্মদিন! তিশাকে আমি পছন্দ করি, ভালোবাসি কিনা জানি না; তবে এইটুকু বুঝি ভালোবাসা জন্ম নিতে টাইম লাগে। তিশার কথা মনে হতেই সব উল্টাপাল্টা হইয়া গেল। কিন্তু তখন আমি মনোনিবেশ করলাম আবার গল্পে। তিশা আসলে আমার মাথায় বাস করে, আমি যে তিশাকে চিনি সেই তিশার সাথে লালমাটিয়ার তিশার কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে লালমাটিয়ার তিশা যখন আমার সামনে আসে আমি এলোমেলো হয়ে যাই। যেহেতু এই মুহূর্তে তিশার ভাবনায় পড়ে গেলাম ফলে আমি মুড়িওয়ালার কাউয়া বিরানির গল্প শুনে আর বাসায় আসলাম না, পার্কে চলে গেলাম।

আজ তিশার জন্মদিন। পার্কে যেয়ে দেখা হয় মুনিমের সাথে, মুনিম আমার ছোট বেলার বন্ধু। হারিয়ে গেছে অনেক আগে, যাবার সময় বলে গেছে আমি যেন কখনোই ওর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা না করি। পার্কে যখন একটা খালি বেঞ্চ খুঁজছিলাম বসার জন্য, তখন দেখলাম মুনিম একটা বেঞ্চের এক কোণায় বইসা আছে, আমি আরো কাছে এসে যখন নিশ্চিত হলাম এটাই মুনিম তখন পাশে বইসা পড়লাম আর কথা বলতে চাইলাম ওর সাথে। কিন্তু মুনিম কোনো কথা বলল না, আমি মুনিমের পাশে বসেই রইলাম, আমি অনেক কথা বলার চেষ্টা করেও যখন দেখলাম মুনিমের কথা বলার কোনো আগ্রহ নেই, তখন আমরা চুপচাপ বসে রইলাম আর পার্কে যে পুকুরটা আছে সেইটার দিকে তাকাইয়া রইলাম।

গল্পটা হচ্ছে না, গল্পের কাঠামো হারিয়ে ফেলেছি, বোরিং লাগতেছে তাই একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি কী লিখব! তিশাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ফোন করলাম,  বললাম হ্যাপি বার্থ ডে তিশা। তিশা বলল, আই অ্যাম ইন এ রিলেশন এমদাদুল।

আমি চুপ হয়ে গেলাম। তিশার সাথে আমার এগার মাস পরিচয়ের পর এটাই তিশার প্রথম জন্মদিন! আমি কখনো বলিনি আমি তিশাকে পছন্দ করি বরং বলতাম তোমাকে আমি পছন্দ করি না, ভাবতাম কাউকে পছন্দ করি বলাটা এক রকমের মিথ্যে বলা হয়, মানুষ আসলে কেউ কাউকে পছন্দ করে না, করে নাই কোনো সময়ে, সবাই সবার, কেউ কারো না অথচ তিশা বুঝল না প্রতিদিন ফোন করে তোমাকে পছন্দ করি না বলার পিছনে অনেক এফোর্ট থাকে, ভালোবাসা থাকে। তিশা আমার কথাটাই শুনল কিন্তু আমার আচরণটা বুঝল না; হয়ত বুঝল, শুধু আমাকে বুঝল না কিংবা এমনও হতে পারে আমাকে বুঝল কিন্তু আমাকে চাইল না। আমাকে বুঝল বলেই হয়ত চাইল না!

আমার ঘর প্রায় রাতে কেঁপে কেঁপে ওঠে, মাঝে মাঝে ভূমিকম্প বলে মনে হয়, টেলিভিশন চালু করি, খবর দেখি, কিন্তু ভূমিকম্পের কোনো খবর নাই। আর তখন মনে হয় এই বুঝি শেষ, আজকেই হয়ত শেষ দিন, আজকেই জীবনের শেষ দিন! কিন্তু না, আসলে না, পরক্ষণেই আশা জাগে এই ভেবে, ডাক্তারের কথা মতো আরো আঠার দিন আছে আমার হাতে! যখন সব এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে সকল এলোমেলো চিন্তায় তখন মনে পরে—“নাথিং লাস্ট ফর এভার”—সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনায় প্রতীক আমাকে একদিন বলছিল।



বাংলাদেশ সময়: ১৩০৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।