ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সনির ব্লুজ | জেমস আর্থার বাল্ডউইন | অনুবাদ: সোহরাব সুমন

অনুবাদ গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০১৫
সনির ব্লুজ | জেমস আর্থার বাল্ডউইন | অনুবাদ: সোহরাব সুমন

জেমস আর্থার বাল্ডউইন (২ আগস্ট, ১৯২৪-পহেলা ডিসেম্বর, ১৯৮৭) একাধারে একজন আমেরিকান ছোট গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, নাট্যকার, কবি এবং সমাজ সমালোচক। তার প্রবন্ধ সংগ্রহ ‘নোট অব আ নেটিভ সন’ (১৯৫৫)-এ তিনি বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কার আমেরিকার পশ্চিমা সমাজে বিদ্যমান এবং তখনও আলোচিত হয়নি এমন সাম্প্রদায়িক, যৌন এবং নানা ধরনের শ্রেণী বিভেদ এবং এই সংক্রান্ত অনেক অপরিহার্য সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন।

দ্য ফায়ার নেক্সট টাইম (১৯৬৩), নো নেইম ইন দ্য স্ট্রিট (১৯৭২), এবং দ্য ডেভিল ফাইন্ড ওয়ার্ক (১৯৭৬) তার আরো তিনটি বিখ্যাত প্রবন্ধ সংগ্রহ।

বাল্ডউইনের উপন্যাস এবং নাটক সমূহে কৃষ্ণাঙ্গসহ সমকামী এবং উভকামী পুরুষদের মৌলিক ব্যক্তিগত অনেক প্রশ্ন এবং জটিল সব সামাজিক ও মানসিক পীড়ন এবং ন্যায়সঙ্গত চাওয়া পাওয়া কাহিনী হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। একই সঙ্গে এধরনের ব্যক্তিত্বের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে বেশ কিছু আভ্যন্তরীণ বাঁধা বিঘ্নও বর্ণিত হয়েছে। সমকামীদের অধিকারের বিষয়টি আমেরিকা জুড়ে ব্যাপকভাবে সমর্থন পাবার আগেই এসম্পর্কে বল্ডউইন তার বিখ্যাত উপন্যাস, গিওভানি’স রুম (১৯৫৬) লেখেন, এটি তার দ্বিতীয় উপন্যাস। তার প্রথম উপন্যাস, গো টেল ইট ওন দ্য মাউন্টেইন, তার সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম।

সনি’স ব্লুজ গল্পটি বল্ডউইনের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং নির্বাচিত গল্পগুলির একটি। এটি ১৯৫৭ সালে প্রথম ছাপা হয়, পরে গোয়িং টু মিট দ্য ম্যান (১৯৬৫) গল্প সংগ্রহে ঠাঁই পায়। - অনুবাদক



বরটা কাগজে পড়ি, সাবওয়েতে, কাজে যাবার পথে। আমি পড়ি তবে তখন তা আমার মোটেই বিশ্বাস হয়নি, তাই আবারও পড়ে দেখি। তারপর সম্ভবত, আমি লেখাটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, নিউজপ্রিন্ট থেকে বানান করে ওর নামটা উচ্চারণ করি, বানান করে লেখাটা পড়ি। সাবওয়ের গাড়ির দোদুল্যমান আলোতে আমি খবরটার দিকে তাকিয়ে থাকি, এবং আশপাশের লোকেদের মুখ আর শরীরের ভিড়, আর আমার নিজের চেহারাটা অন্ধকারের মাঝে বন্দী হয়ে থাকে, বাইরে থেকে যা প্রায় চিৎকার করে উঠছিল।

কথাটা বিশ্বাস করবার মতো নয় আর আমি নিজেকেও সেটা বলতে থাকি, একই সঙ্গে যেভাবে আমি এতে সন্দেহও করতে পারছিলাম না। আমি আঁতকে উঠি, সনির জন্য ভয় হতে থাকে। সে আবারও আমার কাছে বাস্তব হয়ে ধরা দেয়। আমার পেটের ভেতরে আস্ত একটা জমাট বরফ আটকে থাকে আর দিনভর সেটা একটু একটু করে ধীরে ধীরে গলতে থাকে, যখন আমি আমার বীজগণিত ক্লাস নিচ্ছিলাম। বরফটা ছিল বিশেষ ধরনের। সেটা গলে গলে, টিপ টিপ করে তার বরফ গলা জলের সবটা আমার ধমনীর ওপর নিচে করছিল তবে কখনোই সেটা একেবারে হারিয়ে যায়নি। কখনো সেটা কঠিন হচ্ছিল এবং গলা থেকে বেরিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত মনে হচ্ছিল এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে আসে বা চিৎকার করে উঠি। এমন একটা মুহূর্তে সেটা ঘটছিল যখন প্রতিবারই সনির এমন বিশেষ একটা কথা বা সে করেছিল এমন একটা জিনিস মনে পড়ে যাচ্ছিল।



সিঁড়ি থেকে যখন নেমে আসি তখন উঠান জুড়ে শুনশান নীরবতা। দেখি সেই ছেলেটা একটা দরজার কাছে ছায়ার মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি ওর নাম ধরে ডাকতে যাব। কিন্তু তখনই দেখি ওটা আসলে সনি নয়, তবে পরিচিত বলেই মনে হচ্ছিল, ছেলেটা আমাদের ব্লকের আশপাশেই থাকে। ও সনির বন্ধু। ও কখনোই আমার ছাত্র ছিল না, আমার ছাত্র হবার বয়সও ওর হয়নি, তবে যাই হোক আমি ওকে একেবারেই পছন্দ করি না। আর এখন একটা পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ হবার পরও, ও সেই আগের ব্লকেই রয়ে গেছে, এখনো রাস্তার কোণাকাঞ্চিতে সময় কাটায়, সব সময় উঁচু আর নোংরা দিকটাতে। প্রায়ই আমি বিভিন্ন সময় ওর কাছ দিয়ে যাই আর ও প্রায়ই আমার কাছে এক কোয়াটার বা পঞ্চাশ সেন্ট চায়। সব সময়ই ও উপযুক্ত কোনো না কোনো ছুতাও তৈরি করে আর আমিও সবসময় ওকে তা দেই। ঠিক জানি না কেন



যখন ও আমার ক্লাসের ছেলেদের মতো প্রায় বালক বয়সী হয়ে উঠছিল তখন ওর চেহারাটাই ছিল অনেক উজ্জ্বল আর খোলামেলা, তার অনেকটাই ছিল তামাটে; এবং ওর ছিল চমৎকার দ্বিধাহীন এক জোড়া বাদামি চোখ আর, তাতে ছিল প্রচণ্ড অমায়িকতা আর একান্ততা। আমি অবাক হই ও দেখতে এখন কতটা আলাদা। হিরোইন ফেরিকরা আর ব্যবহারের কারণে, গতকাল সন্ধ্যায় এক ঝটিকা অভিযানে, ওকে গ্রেপ্তার করা হয়, ডাওন-টাওনের এক অ্যাপার্টমেন্ট থেকে।

আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না: কিন্তু এর দ্বারা আমি কী বোঝাতে চাইছি আমি কি আমার ভেতরে কোথাও এর জন্যে কোনো জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না। দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাপারটা আমি নিজের বাইরে রাখি। আমি জানতে চাইনি। আমি সন্দিহান ছিলাম, তবে আমি সেসবের কোনো নাম দেইনি, আমি বিষয়টাকে সরিয়ে রাখি। নিজেকে আমি বলি যে সনি বেপরোয়া ছিল, তবে সে দিশেহারা ছিল না। আর সব সময়ই ও খুব ভালো একটা ছেলে ছিল, কখনোই ও রূঢ় বা দুষ্ট বা অসম্মানজনক কিছু করেনি, যেমনটা আর সব শিশুরা হয়ে থাকে, খুব চটপটে, খুব চটপটে, বিশেষত হারলেমের।

আমি বিশ্বাস করতে চাই না আমার ভাইকে যখন নিচে গিয়ে যেতে দেখেছি তখন সে প্রতিবার নিঃশেষ হয়ে ফিরে এসেছে, সেসময় তার মুখের সব আলো একেবারে নিভে যেত, এরইমধ্যে এমন অবস্থায় আমি আরো অনেককেই দেখেছি। যদিও যা ঘটার তা ঘটে গেছে আর আমি এখানে একপাল ছেলেদের মাঝে বীজগণিত কপচাচ্ছি, যতদূর জানি এদের প্রত্যেকেই, প্রতিবার তাদের মাথার ভেতরে উঁকি দিতে সুই নিয়ে থাকে। হতে পারে বীজগণিত যা পারে তার ক্ষমতা এর চেয়ে অনেক বেশি।

আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এই প্রথমবারের মতো সনি হেরোইন নিয়েছে, সে এখানকার এই ছেলেগুলোর থেকে বয়সে খুব একটা বড় নয়। এই ছেলেগুলো, এখন, তখনকার আমাদের মতোই জীবন যাপন করছে, তবে ওরা খুবই দ্রুততার সঙ্গে বেড়ে উঠছে আর ওদের মাথা ওদের সত্যিকার সম্ভাবনার চেয়ে নিচু ছাদের সঙ্গে বারবার আচমকা ধাক্কা খাচ্ছে। ওরা ক্রোধে ফুঁসে আছে। ওদের সবারই দুটা অন্ধকার সম্বন্ধে জানা, ওদের জীবনের অন্ধকার, যা এখন ওদের খুব কাছাকাছি, আর সিনেমার অন্ধকার, যা তাদের অপর সেই অন্ধকারের প্রতি অন্ধ করে রাখে, এবং যার প্রতি তারা এখন, খুবই প্রতিহিংসাপরায়ণ ভাবে, যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি কল্পনাবিলাসী হয়ে আরো বেশি একা হয়ে পড়ে।

শেষ ঘণ্টাটা বেজে উঠলে, শেষের ক্লাসটা শেষ হলে পর, আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি। মনে হচ্ছিল সারাটাক্ষণ আমি এটাই আঁকড়ে ছিলাম। আমার কাপড় চোপড় ভিজে একেবারে জবজবে হয়ে গিয়েছিল—আমাকে দেখে বোধহয় তখন মনে হচ্ছিল আমি সব পোশাক পরিচ্ছদ পরে সারাটা বিকেল বাষ্পস্নানে বসে রয়েছি। অনেকক্ষণ ধরে আমি ক্লাসরুমে একা বসে থাকি। বাইরে, সিঁড়ির নিচে, ছেলেদের শোরগোল, ভিড় আর হাসাহাসি টের পাচ্ছিলাম। সম্ভবত ওদের হাসি এই প্রথমবার আমাকে অসাড় করে তোলে। এটা সেই আনন্দের হাসি নয়—স্রষ্টাই জানেন কেন—যেমনটা শিশুদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে। সেই হাসি ছিল উপহাস এবং কূপমণ্ডূক গ্রাম্য সংকীর্ণতার, এর উদ্দেশ্যই ছিল কারো ওপর কালিমা লেপন করা। এটা ছিল মোহমুক্তির, এবং এর মাঝে, তাদের অভিশাপের অধিকারও লুকিয়ে ছিল। সম্ভবত আমি ওদের শুনতে পাচ্ছিলাম তার কারণ সেসময় আমি আমার ভাইয়ের কথা ভাবছিলাম। এবং আমার নিজের কথাও।

একটা ছেলে কোন একটা সুরে শিস বাজাচ্ছিল, একই সঙ্গে তা ছিল খুবই জটিল আর সরলও, সেটা তার মুখ থেকে এমনভাবে বেরিয়ে আসছিল যেন সে সত্যিই একটা পাখি, আর শব্দটা ছিল খুবই শান্ত আর সেটা তার সমস্ত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে, উৎফুল্ল বাতাসে, আর সব শোরগোলের মাঝে কেবল তার নিজের অস্তিত্বই জানান দিয়ে যাচ্ছিল।

আমি উঠে দাঁড়াই এবং হেঁটে হেঁটে জানালার কাছে যাই এবং নিচে উঠানের দিকে তাকাই। তখন সবে বসন্তের শুরু এবং ছেলেদের মাঝে প্রাণশক্তি জাগতে শুরু করেছে। মাঝে মধ্যেই ওদের মাঝ দিয়ে একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা হেঁটে চলে যাচ্ছে, অনেকটা দ্রুত ভঙ্গিমায়, যেন তাদের যে কেউ সেই উঠানখানা কোনো রকমে পেরুতে পারলেই হলো, যাতে সেইসব ছেলেদের নিজেদের দৃষ্টি আর মনের সীমানার বাইরে রাখতে পারলেই হয়। আমি আমার জিনিসপত্র গোছগাছ শুরু করি। ভাবতে থাকি ভালো হয় যদি বাড়ি গিয়ে ইসাবেলের সঙ্গে মন খুলে দুটা কথা বলি।

সিঁড়ি থেকে যখন নেমে আসি তখন উঠান জুড়ে শুনশান নীরবতা। দেখি সেই ছেলেটা একটা দরজার কাছে ছায়ার মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি ওর নাম ধরে ডাকতে যাব। কিন্তু তখনই দেখি ওটা আসলে সনি নয়, তবে পরিচিত বলেই মনে হচ্ছিল, ছেলেটা আমাদের ব্লকের আশপাশেই থাকে। ও সনির বন্ধু। ও কখনোই আমার ছাত্র ছিল না, আমার ছাত্র হবার বয়সও ওর হয়নি, তবে যাই হোক আমি ওকে একেবারেই পছন্দ করি না। আর এখন একটা পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ হবার পরও, ও সেই আগের ব্লকেই রয়ে গেছে, এখনো রাস্তার কোণাকাঞ্চিতে সময় কাটায়, সব সময় উঁচু আর নোংরা দিকটাতে। প্রায়ই আমি বিভিন্ন সময় ওর কাছ দিয়ে যাই আর ও প্রায়ই আমার কাছে এক কোয়াটার বা পঞ্চাশ সেন্ট চায়। সব সময়ই ও উপযুক্ত কোনো না কোনো ছুতাও তৈরি করে আর আমিও সবসময় ওকে তা দেই। ঠিক জানি না কেন।

কিন্তু এখন, হঠাৎই ওকে, আমি ঘৃণা করতে শুরু করি। যেভাবে ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে তা সহ্য করতে পারি না, খানিকটা কুকুরের মতো, খানিকটা ধূর্ত ছেলের মতো। ওকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, স্কুলের আঙ্গিনায় ও কী করছে।

আমার দিকে পা টেনে টেনে খানিকটা এগিয়ে আসে এবং বলে, “আমি দেখেছি আপনি কাগজটা পেয়েছেন। তাই এরই মধ্যে ব্যাপারটা জেনে গেছেন। ”
“তুমি কি সনির কথা বোঝাচ্ছো? হ্যাঁ আমি এরই মধ্যে খবরটা জেনেছি। ওরা তোমাকে ধরেনি কেন?”
ও দাঁত বের করে একগাল হাসে। এতে ওকে আরো বীভৎস দেখায় এবং মনে করিয়ে দেয় কোন দিক দিয়ে ও দেখতে শিশুসুলভ। “আমি ওখানে ছিলাম না। আমি ওসব লোক থেকে দূরে থাকি। ”
“তোমার জন্য ভালো। ” আমি ওকে একটা সিগারেট সাধি এবং ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে ওকে দেখতে থাকি। “আপনি নিচে নেমে এদ্দুর হেঁটে আসলেন কেবল আমাকে সনির কথা জিজ্ঞেস করতে?”
“ঠিক ধরেছো। ”

ও মৃদু মাথা দোলায় আর ওর চোখ দুটা তখন অবাক দেখায়, যেন তারা এখন এদিক দিয়েই যাচ্ছে। সূর্যের উজ্জ্বল আভায় ওর ভেজা কালো ত্বকটাকে নিষ্প্রাণ লাগে, চোখ দুটা হলদে এবং পাক খাওয়া চুলগুলোকে ময়লা দেখায়। ওকে খানিকটা আতঙ্কগ্রস্ত বলেই মনে হয়। আমি ওর কাছ থেকে সামান্য পিছিয়ে আসি আর বলি, “ঠিক আছে। কিন্তু আমি এরই মধ্যে এ ব্যাপারে জেনে গেছি আর আমাকে এখন বাড়ি যেতে হচ্ছে। ”
“আমি আপনার সঙ্গে কিছুদূর হাঁটব”—সে বলে। আমরা হাঁটতে থাকি। অঙ্গনে তখনও কয়েক জোড়া বাচ্চা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং ওদের একজন আমাকে শুভরাত্রি বলে আমার পাশের ছেলেটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে।

“আপনি কী করতে চাইছেন?” সে আমাকে জিজ্ঞেস করে। “আমি প্রাক্তন সনির কথা বলছি?”
“দেখো সনির সঙ্গে বছর খানেক ধরে আমার কোনো দেখাসাক্ষাৎ নেই, আমি নিশ্চিত না আমি ওর জন্য কিছু করব। সে যাই হোক, আমি আসলে তেমন কী করতে পারি?”
“তা ঠিক”—ও দ্রুত বলে ওঠে। “আপনি কিছুই করতে পারেন না, সনি কোনো সাহায্য পেতে পারে না, আমার ধারণা। ”

আমি একথাই ভাবছিলাম আর তাই আমার কাছে মনে হতে থাকে একথা বলার কোনো অধিকার ওর নেই।

“সনিকে আমার অদ্ভুত মনে হয়, তবু”—সে বলতে থাকে, আজব একটা ভঙ্গিতে কথা বলে, কথা বলার সময় এমনভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছে—“আমি মনে করি সনি খুবই বুদ্ধিমান একটা ছেলে, আমি মনে করি ও এতই বুদ্ধিমান যে ওকে ঝুলানো সহজ হবে না। ”
“আমার মনে হয় সে নিজেও এমনটাই ভাবে”—আমি স্পষ্ট ভাষায় বলি, “আর তাই ও ঝুলবে। এবং তোমার কী অবস্থা? তুমিও খুব পটু, আমি বাজি ধরতে রাজি। ”
তারপর ও আমার দিকে সরাসরি তাকায়, কয়েক মুহূর্তের জন্য। “আমি মোটেই বুদ্ধিমান নই”—ও বলে, “যদি বুদ্ধিমানই হতাম তবে অনেক আগে থেকেই আমার হাতে একটা পিস্তল থাকত। ”
“দেখো, আমাকে তোমার দুখের গল্প শোনাতে এসো না, যদি আমার কাছে থাকত, তাহলে তোমাকে একটা অবশ্যই দিতাম। ” তারপর নিজেকে আমার অপরাধী মনে হতে থাকে—অপরাধী, সম্ভবত, কখনোই আমি ভাবিনি যে এই অসহায় জারজটারও নিজস্ব কোনো গল্প থাকতে পারে, সেটা অনেক কম দুখেরও হতে পারে, সে জন্য, এবং আমি দ্রুত জিজ্ঞেস করি, ওর এখন কী হবে?”
ও এর কোনো জবাব দেয় না। ও নিজের ভেতরে কোথাও আটকে ছিল। “মজার জিনিস”—ও বলে, আর ওর বলার ভঙ্গি থেকে আমরা দ্রুত ব্রুকলিন পৌঁছার ব্যাপারে আলাপ করতে থাকি, “সকালে যখন খবরের কাগজগুলো দেখি, তখন প্রথম যে প্রশ্নটা আমি নিজেকে করেছিলাম তা হলো আমার কি এ ব্যাপারে কিছু করার আছে। আমি খানিকটা দায়িত্ব অনুভব করি। ”

আমি খুব সতর্ক হয়ে শুনতে থাকি। সাবওয়ে স্টেশনটা ছিল কোণার দিকেই, একেবারে আমাদের পাশেই, এবং আমি থামি। সেও থামে। আমরা তখন একটা বারের সামনে আর ও মাথা নিচু করে আঁড়চোখে সেটার ভেতরে উঁকি মারছিল, কিন্তু ও যাকে খুঁজছিল মনে হয় সে সেখানে ছিল না। জুকবক্সে সজোরে চমৎকার কিছু একটা বাজছে আর আমি বারের পেছনে জুকবক্সের কাছে নাচতে থাকা একটা মেয়েকে দেখি। আর ওর মুখটাও দেখি যেন হাসতে হাসতে কারো কথায় সারা দিচ্ছে, সেই সঙ্গে গানের সঙ্গে তাল রাখছে। ওর হাসির মাঝে যে কেউ একটা ছোট্ট মেয়েকে দেখতে পাবে, যার বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে, যদিও তখনও সেই আধো-বেশ্যার সুন্দর মুখের আড়ালে আস্ত একটা নারী ছটফট করছে।

“আমি সনিকে কখনোই কিছু দেইনি”—সবশেষে ছেলেটা বলে, কিন্তু অনেক আগে আমি স্কুলের ভেতর ঢুকি, তখন সনি আমাকে জিজ্ঞেস করে কেমন লাগছে। ” ও থামে, আমি ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না, বারমেইডের দিকে তাকিয়ে থাকি আর চক্তরটাকে কাঁপাচ্ছিল সেই গানটা মন দিয়ে শুনতে চেষ্টা করি। “আমি ওকে বলি এটা খুব ভালো লাগছে। ” গানটা থামে, বারমেইডও বিরতি দেয়, আর আবারও গান বেজে ওঠার আগপর্যন্ত জুকবক্সের দিকে তাকিয়ে থাকে। “আবারও গান বেজে ওঠে। ”

এর সবই আমাকে এমন একটা জায়গাতে নিয়ে যায় যেখানে আমি যেতে চাই না। নিশ্চিত জানতেও চাই না এতে কেমন লাগে। এটা সব কিছুকেই ভীতির দ্বারা আচ্ছন্ন করে, লোকেদের, এইসব ঘরবাড়ি, গানবাজনা, এই অন্ধকার, পারদরঙা বারমেইড সবাইকে; আর এই ভীতিই ওদের বাস্তবতা।
“এখন ওর কী হবে?” আমি আবারও জিজ্ঞেস করি।
“ওরা ওকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেবে এবং সারিয়ে তুলতে চেষ্টা করবে। ” ও মাথা ঝাঁকায়। “মনে হয় ও নিজেও ওর এই অভ্যাস ঝেঁড়ে ফেলবার কথা ভাববে। তারপর ওরা ওকে ছেড়ে দিবে”—নালার মধ্যে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে ও ইশারা করে। “এই হলো ঘটনা। ”
“এই হলো ঘটনা দিয়ে তুমি কী বোঝাতে চাইছো?”
কিন্তু আমি জানতাম ও কী বুঝিয়েছে।
“আমি বলতে চাইছি এমনই হবে। ” ও মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকায়। মুখের কোণ দুটা টেনে নিচের দিকে নামায়। “আপনি কি বুঝতে পারছেন না আমি কী বলতে চাইছি?” মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে।
“আমি কী করে জানব তুমি কী বোঝাতে চাইছো?” আমি একেবারে ফিসফিস করে কথাটা বলি, জানি না কেন।

“ঠিক”—বাতাসের দিকে মুখকরে ও বলে, “উনি কী করে জানবেন আমি কী বোঝাচ্ছি?” ও আবারও আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়, ধৈর্যসহকারে আর শান্তভাবে, এবং আমি তবু বুঝতে পারি ও কাঁপছে, এমনভাবে কাঁপছে যেন এই বুঝি ভেঙ্গে পড়বে। আমি আবারও গলার ভেতরে সেই বরফটা অনুভব করি, যে ভয়টা আমি সারাটা দুপুর অনুভব করে এসেছি; আর আবারও আমি বারমেইডের দিকে তাকিয়ে থাকি, মেয়েটা বারের ভেতরে চলাচল করছে, গ্লাস ধুচ্ছে, আর থেকে থেকে গান গাইছে। “শুনুন। ওরা ওকে ছেড়ে দেবে এবং তারপর আবারও সবকিছু আগের মতোই শুরু হবে। আমি এটাই বোঝাতে চেয়েছি। ”
“তুমি মনে কর—ওরা ওকে ছেড়ে দেবে। আর তারপর আবারও ও আগের মতোই কাজকারবার শুরু করে দেবে। তুমি কি মনে করো ও কখনোই অভ্যাসটা ঝেঁড়ে ফেলতে পারবে না। তুমি কি এটাই বোঝাতে চেয়েছো?”
“ঠিক তাই”—আনন্দের সঙ্গে ও বলে। “দেখতে পাচ্ছি আপনি আমার কথা ধরতে পেরেছেন। ”
“আমাকে বলো”—শেষে আমি বলি, “ও আসলে কেন মরতে চায়? ও আসলে মরে যেতে চায়, ও নিজেকে মেরে ফেলছে ও কেন মরতে চায়?”
ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠোঁট চাটে। “ও মরতে চায় না। ও বাঁচতে চায়। কেউই মরতে চায় না, কখনোই। ”
তারপর আমি ওকে জিজ্ঞেস করতে চাই—অনেক কিছু। সেসবের জবাব ওর কাছে নেই, বা যদি থেকেও থাকে, তাহলে আমি সেই জবাব সহ্য করতে পারতাম না। আমি হাঁটতে শুরু করি। “ভালো, ভাবি এর কোনোটাই আমাদের কাজ নয়। ”
“এতে করে প্রাক্তন সনি’র প্রতি কঠোর হওয়া হবে”—ও বলে। আমরা সাবওয়ে স্টেশনে পৌঁছাই। “এটা আপনার স্টেশন?” ও জিজ্ঞেস করে। আমি মাথা নাড়াই। একধাপ নিচে নামি। “ধুর!” হঠাৎ ও বলে ওঠে। আমি ওপরে থাকা ওর দিকে তাকাই। আবারও দাঁত বের করে হাসছে। “ধুর যদি বাসায় সব টাকাকড়ি রেখে না আসতাম। আপনার কাছে কি এক ডলার হবে নাকি? এই কেবল দুদিনের জন্য। ”

দ্বিতীয় কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।