ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সনির ব্লুজ (৩) | জেমস আর্থার বাল্ডউইন | অনুবাদ: সোহরাব সুমন

অনুবাদ গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৬, ২০১৫
সনির ব্লুজ (৩) | জেমস আর্থার বাল্ডউইন | অনুবাদ: সোহরাব সুমন

জেমস আর্থার বাল্ডউইন (২ আগস্ট, ১৯২৪-পহেলা ডিসেম্বর, ১৯৮৭) একাধারে একজন আমেরিকান ছোট গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, নাট্যকার, কবি এবং সমাজ সমালোচক। তার প্রবন্ধ সংগ্রহ ‘নোট অব আ নেটিভ সন’ (১৯৫৫)-এ তিনি বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কার আমেরিকার পশ্চিমা সমাজে বিদ্যমান এবং তখনও আলোচিত হয়নি এমন সাম্প্রদায়িক, যৌন এবং নানা ধরনের শ্রেণী বিভেদ এবং এই সংক্রান্ত অনেক অপরিহার্য সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন।

দ্য ফায়ার নেক্সট টাইম (১৯৬৩), নো নেইম ইন দ্য স্ট্রিট (১৯৭২), এবং দ্য ডেভিল ফাইন্ড ওয়ার্ক (১৯৭৬) তার আরো তিনটি বিখ্যাত প্রবন্ধ সংগ্রহ।

বাল্ডউইনের উপন্যাস এবং নাটক সমূহে কৃষ্ণাঙ্গসহ সমকামী এবং উভকামী পুরুষদের মৌলিক ব্যক্তিগত অনেক প্রশ্ন এবং জটিল সব সামাজিক ও মানসিক পীড়ন এবং ন্যায়সঙ্গত চাওয়া পাওয়া কাহিনী হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। একই সঙ্গে এধরনের ব্যক্তিত্বের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে বেশ কিছু আভ্যন্তরীণ বাঁধা বিঘ্নও বর্ণিত হয়েছে। সমকামীদের অধিকারের বিষয়টি আমেরিকা জুড়ে ব্যাপকভাবে সমর্থন পাবার আগেই এসম্পর্কে বল্ডউইন তার বিখ্যাত উপন্যাস, গিওভানি’স রুম (১৯৫৬) লেখেন, এটি তার দ্বিতীয় উপন্যাস। তার প্রথম উপন্যাস, গো টেল ইট ওন দ্য মাউন্টেইন, তার সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম।

সনি’স ব্লুজ গল্পটি বল্ডউইনের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং নির্বাচিত গল্পগুলির একটি। এটি ১৯৫৭ সালে প্রথম ছাপা হয়, পরে গোয়িং টু মিট দ্য ম্যান (১৯৬৫) গল্প সংগ্রহে ঠাঁই পায়। - অনুবাদক



দ্বিতীয় কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন



নি কখনোই বাচাল ছিল না। তাই আমি জানতাম না কেন আমি অতটা নিশ্চিত ছিলাম যে প্রথম রাতে খাবার পর সে আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য আকুল হয়ে ছিল। সব কিছু ভালোই চলছিল, বড় ছেলেটা ওকে মনে রেখেছে, ছোটটা ওকে পছন্দ করে, এবং সনি ওদের প্রত্যেকের জন্য কিছু একটা নিয়ে আসার কথা মনে রাখে; এবং ইসাবেল, যে কিনা সত্যিই আমার চেয়ে কাছের, খোলামেলা আর ওকে কম যন্ত্রণা করত, রাতের খাবারের সময় সে অনেক সমস্যা তৈরি করে এবং সনিকে দেখে সে সত্যিই অনেক খুশি হয়। আর ও সবসময় সনির সঙ্গে এমনভাবে মজা করত যা আমি কখনোই করতাম না। আবারও ওর হাসিখুশি দেখতে পেয়ে আর ওকে হাসতে শুনে এবং ওকে সনিকে হাসাতে দেখে খুবই ভালো লাগছে। মেয়েটা এমন ছিল  না, বা যে করেই হোক দেখতে অন্তত খানিকটা অস্থির বা লাজুক ছিল। এখন সে এমনভাবে কথা বলছে যেন ওর কথা বলার মতো এমন কোনো বিষয়ই নেই যা এড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে এবং সে সনির প্রথম অতীতটা ধরতে পারে, ক্ষীণ অনমনীয়তায়। এবং আমি স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাই মেয়েটা সেখানে ছিল, কেননা আবারও আমাকে সেই বরফ শীতল ভয়টা পেয়ে বসে। আমি যা কিছুই করছি তা আমাকে আরো সজাগ করে তুলছিল বলে মনে হচ্ছিল, এবং যা কিছু বলছি তাতে কোনো প্রচ্ছন্ন মানে রয়েছে বলে মনে হচ্ছিল। মাদকের নেশা ছাড়াবার ব্যাপারে যা কিছু শুনেছি মনে করতে চেষ্টা করি এবং সনির মাঝে তার অস্তিত্ব খুঁজতে আমার বিশেষ কিছু করার থাকে না। বিদ্বেষ থেকে আমি এমনটা করিনি। আমি আমার ভাইয়ের মাঝে কিছু একটা খুঁজে পেতে চেষ্টা করছিলাম। ও নিজে থেকে বলুক সে এখন নিরাপদ সেটা শোনার জন্য আমি মরিয়া হয়ে ছিলাম।



ও, হ্যাঁ। তোমার বাবা আর কখনোই পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। সেদিন থেকে নিশ্চিত না হবার পরও তবু সব সাদা লোককে সে তার ভাইয়ের হত্যাকারী মনে করছে যেহেতু সে এমনই একজন লোককে তার ভাইকে খুন করতে দেখেছে। ”
সে থামে এবং নিজের রুমালটার দিকে তাকিয়ে থাকে আর চোখ মুছে আমার দিকে তাকায়।
“আমি তোমাকে এসব বলিনি”—তিনি বলেন, “যাতে কাউকে অযথা ভয়, কটু কথা বা ঘৃণা না করো। এখন তোমাকে কথাটা বললাম কারণ তোমারও একটা ভাই আছে। আর পৃথিবীটা মোটেই বদলে যায়নি। ”



“নিরাপদ!”—আমার বাবা নিশ্চিত করে বলেছিলেন, অন্যদিকে মা বলেছিলেন কাছাকাছি অন্য কোথাও সরে যেতে যে জায়গাটা শিশুদের জন্য নিরাপদ হবে।
“নিরাপদ, দোযখ! বাচ্চাদের জন্য এমন কোনো নিরাপদ জায়গা কি আছে, না কারো জন্যই না। ”

তিনি সব সময়ই এমন কথা বলতেন, তবে মুখে যতটা বলতেন বাস্তবে আসলে ততটা খারাপ ছিলেন না, এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও, যেদিনটাতে তিনি মাতাল থাকতেন। ঘটনাক্রমে, তিনি সব সময়ই কিছু একটা খুঁজতেন ‘খানিকটা ভালো কিছু’—কিন্তু সেটা খুঁজে পাবার আগেই তিনি মারা যান। তিনি হঠাৎ করেই মারা যান, যুদ্ধের সময় মাতাল এক ছুটির দিনে, সনির বয়স তখন পনের। তার এবং সনির সম্পর্ক কখনোই অতটা ভালো ছিল না। আর এর আংশিক কারণ ছিল সনি ছিল তার বাবার চোখের মণি। এর কারণ ছিল তিনি সনিকে ভীষণ ভালোবাসতেন এবং তিনি ওকে নিয়ে ভয় করতেন, তাই সব সময় ওর পেছনে লেগে থাকতেন। সনির পেছনে লেগে থাকাটা কোনো ভালো ফল বয়ে আনেনি। সনি তাই পিছিয়ে এসে, নিজের ভেতরে সেঁধিয়ে যায়, যেখানে তিনি পৌঁছতে পারেননি। তবে এর মূল কারণ ছিল যেটা তারা কখনোই বুঝে উঠতে পারেনি যে তারা ছিল হুবহু একই রকমের। ড্যাডি ছিল বিশাল আকারের এবং কর্কশ স্বভাবের এবং তিনি খুব জোরে কথা বলতেন, সনি ছিল এর বিপরীত, তবে তাদের দুজনেরই ছিল—একই ধরনের নিরুপদ্রব ব্যক্তিত্ব।

মা এ ব্যাপারে আমাকে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে, ড্যাডির মৃত্যুর পরপর। আমি তখন সেনাবাহিনী থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতেই অবস্থান করছিলাম।

মাকে সেই শেষ বারের মতন জীবিত অবস্থায় দেখি। একইভাবে, এই ছবিটা তাকে যুবতী বেলায় যেমন দেখেছি সেই ছবিগুলোর সঙ্গে আমার মনের ভেতরে মিশে রয়েছে। রোববারের বিকেলগুলোতে সব সময় তাকে যেভাবে দেখেছি তাকে সব সময় আমি তেমনি ভাবতেই অভ্যস্ত, ধরা যাক, যখন বড়রা সবাই মিলে রোববার দুপুরের খাবারের পর আলাপ চারিতায় মেতে উঠত। আমি তাকে সব সময় হালকা নীল রঙের পোশাক পরে থাকতে দেখতাম। তিনি সোফায় বসে থাকতেন। আর আমার বাবা বসতেন ইজি চেয়ারে, সেটা তার থেকে খুব একটা দূরে নয়। আর বসার ঘরটা চার্চের লোক এবং আত্মীয় স্বজনে ঠাঁসা থাকত। তারাও বসার ঘরের চারপাশ ঘিরে থাকা আর সব চেয়ারে বসে থাকত, আর বাইরে ধীরে ধীরে রাত নামত, কিন্তু ভেতরের কেউই সেটা টের পেত না। জানালার শার্সির বাইরে অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে আসত এবং একটু পরপর সড়কের শোরগোল ভেসে আসত, অথবা হতে পারে সেটা কাছের কোনো চার্চের সঙ্গীতের খঞ্জনীর তালের শব্দ। কিন্তু ঘরের ভেতরে সত্যিকার নীরবতা বিরাজ করত। কয়েক মুহূর্তের জন্য কেউই কোনো কথা বলত না, তবে সবগুলো মুখ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসত, ঠিক বাইরের আকাশটার মতো। আর আমার মা খানিকটা কোমর দোলাত, এবং বাবার চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসত। সবাই এমন কিছু একটা খুঁজত যা কোনো শিশুর পক্ষে দেখা সম্ভব ছিল না। কয়েক মিনিটের জন্য তারা বাচ্চাদের কথা ভুলে থাকত। হয়ত কোনো শিশু গালিচার ওপর শুয়ে, আধো ঘুমে ডুবে থাকত। হয়ত কেউ একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে থাকত আর অন্যমনস্কভাবে ওর মাথায় টোকা মারত। হয়ত একটা বাচ্চা চুপচাপ বড় বড় চোখ করে, কোণায় বসে চেয়ার ভাঁজ করত। সেই নীরবতার মাঝে, অন্ধকার নেমে আসত, এবং সেই মুখগুলোর অন্ধকার আড়ালে শিশুদের ভীত করে তুলত। সে আশা করত যে হাতটা তার কপালে আঘাত করছে সেটা কখনোই থামবে না—কখনোই মারা যাবে না। সে আশা করত এমন একটা সময় কখনোই আসবে না যখন এই বয়স্ক লোকেরা বসার ঘর জুড়ে বসে থাকবে না, তারা কে কোথা হতে এসেছে সেসব নিয়ে কথা বলা বন্ধ করবে না, এবং তারা যা দেখেছে, এবং তাদের জীবনে আর তাদের আত্মীয় স্বজনদের জীবনে যা যা ঘটেছে এর কোনো কিছুরই শেষ নেই।

কিন্তু কোনো গভীর চিন্তামগ্ন এবং জেগে থাকা কোনো শিশু ঠিকই জানত যে এর সবই শেষ হতে বাধ্য, যা এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। তখনি কেউ একজন উঠে গিয়ে আলো জ্বালায়। তখন বড়দের বাচ্চাগুলোর কথা মনে পড়ে আর সেদিনের মতো তারা আর কোনো কথা বলে না। আর যখন ঘরটা আলোয় ভরে ওঠে, শিশুরা তখন অন্ধকারে ছেয়ে যায়। সে জানে প্রতিবার বাইরের অন্ধকারের একটু কাছাকাছি যাবার সময় এমনই হয়। বাইরের অন্ধকার হলো সেই জিনিস যা নিয়ে বড়রা কথা বলেছিল। এটা সেই জিনিস তারা যেখান থেকে এসেছে। এটা সেই জিনিস তারা যা ভোগ করে। শিশুটা জানে তারা আর কথা বলবে না কারণ সে যদি খুব বেশি করে জানে তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে, সেও সেটা শীঘ্র খুব বেশি করেই জানবে, তার ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে সেই সম্বন্ধে।

মার সঙ্গে শেষবার যখন কথা বলেছিলাম, আমার মনে পড়ে, তখন আমি খুব অস্থির ছিলাম। আমি বেরিয়ে যেতে চাই আর তখনই ইসাবেলকে দেখি। তখনও আমরা বিয়ে করিনি এবং আমাদের দ্বিধা কাটাতে তখনও আমাকে অনেক খাটতে হয়।

মা ওখানটাতে বসে ছিলেন, অন্ধকারে, জানালার পাশে। তিনি গুনগুন করে পুরনো দিনের চার্চের গান গাইছিলেন, প্রভু, তুমি আমাকে অনেক দূর থেকে এনেছো। সনি আশপাশেই কোথাও ছিল। মা বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল।

“আমি জানি না”—তিনি বলেন, “আবার যদি তোমার সঙ্গে দেখা হয়, তাহলে তোমার সঙ্গে এখান থেকে চলে যাব। তবে আমি আশা করি আমি তোমাকে যা যা শেখাতে চেষ্টা করেছি তা সব সময় মনে রাখবে। ”
“ওভাবে বলো না”—আমি বলি আর হাসি। “তুমি আরো অনেক দিন এখানে থাকবে। ”
সেও হাসে, কিন্তু কিছুই বলে না। দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। আর আমি বলি, “মা অযথা চিন্তা করো না। আমি সব সময় তোমার কাছে লিখব, আর চেকও পেতে থাকবে ...”
“আমি তোমার ভাইয়ের ব্যাপারে কথা বলতে চাইছি”—হঠাৎই, তিনি বলেন। “আমার যদি কিছু একটা হয় ওর দেখাশোনা করবে এমন কারো কাছে যাবার জায়গা থাকবে না। ”
“মা-মা”—আমি বলি, “তোমার বা সনির কিছুই হবে না। সনি ঠিক আছে। ও খুব ভালো ছেলে আর ওর বিচারবুদ্ধিও খুব ভালো। ”
“ও ভালো ছেলে প্রশ্নটা সেখানে নয়”—মা বলেন, “ওর বিচারবুদ্ধি ভালো সেটাও নয়। ও খারাপ ছেলেও নয়, এমনকি বোবা কালাও নয় যে বোকা হবে। ” আমার দিকে তাকিয়ে, তিনি থামেন। “এক সময় তোমার বাবার একজন ভাই ছিল। ” তিনি জানালার বাইরে তাকান। কথাটা বলে এমনভাবে হাসেন যেন ব্যথাটা আমাকে অনুভব করাতে চাইছেন। “এটা তুমি কখনোই জানতে না, জানতে কি?”
“না”—আমি বলি, “কখনোই জানতাম না তো” এবং তার মুখের দিকে তাকাই।
“হুম”—তিনি বলেন, “তোমার বাবার একজন ভাই ছিল। ” তিনি আবারও জানালার বাইরে তাকান। “আমি জানি তুমি তোমার বাবাকে কখনোই কাঁদতে দেখোনি। কিন্তু আমি দেখেছি—বহুবার, যত বছর ধরে তার সঙ্গে রয়েছি। ”
আমি জিজ্ঞেস করি, “তার ভাইয়ের কী হয়েছিল? কেন সবাই তাকে নিয়ে কখনো কোনো কথা পর্যন্ত বলেনি?”

এই প্রথম মাকে দেখতে আমার বুড়ো মনে হচ্ছিল।

“ওর ভাই খুন হয়”—তিনি বলেন, “তখন সে বয়সে তোমার চেয়ে সামান্য ছোট। আমি ওকে চিনতাম। ও খুব চমৎকার একটা ছেলে ছিল। ও খানিকটা দুষ্ট ছিল ঠিকই, তবে কখনো কারো কোনো ক্ষতি করেনি। ”

এরপর তিনি থামেন এবং ঘরটা নীরব হয়ে পড়ে, একেবারে রোববারের সন্ধ্যার মতো। মা বাইরে রাস্তার দিকেই তাকিয়ে থাকে।

“ও মিলে কাজ করত”—তিনি বলেন, “এবং, সব তরুণদের মতোই, ও শনিবারের রাতটাই কেবল নিজের মতো করে কাটাত। শনিবার রাতে ও আর তোমার বাবা বিভিন্ন জায়গাতে ঘুরে বেড়াত, নাচে বা এরকম কিছুতে যেত, অথবা চেনা জানা লোকেদের সঙ্গে বসে থাকত, আর তোমার বাবার সেই ভাই গান গাইত, ওর গলা ছিল খুবই চমৎকার, আর নিজেই নিজের গিটারটা বাজাত। ভালো, সেই শনিবার রাতে, ও আর তোমার বাবা কোন একটা জায়গা থেকে বাড়ি ফিরছিল, আর ওরা দুজনেই তখন সামান্য মাতাল ছিল, আর সেইরাতে আকাশে একটা চাঁদও ছিল, সেটা ছিল দিনের মতোই উজ্জ্বল। তোমার বাবার ভাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিটারটা কাঁধে নিয়ে আপন মনে শিস দিতে থাকে। ওরা একটা টিলা থেকে নেমে আসছিল আর ওদের নিচের রাস্তাটা রাজপথ থেকে ঘুরে ভেতরের দিকে এসেছে। ভালো, তোমার বাবার সেই ভাই সব সময়ই খানিকটা ছটফটে স্বভাবের ছিল, সে সেই টিলা থেকে দৌড়ে নামার সিদ্ধান্ত নেয়, আর কাজটা সে করেও ছাড়ে, তার পেছনের ঝুলন্ত গিটারটা থেকে তখন ঢং ঢং করে শব্দ বেরুচ্ছিল, এবং সে রাস্তার ওপারে চলে যায়, আর তারপর একটা গাছের আড়ালে জল বিয়োগ করে। আর তোমার বাবা তখন ওর সঙ্গে মজা করছিল, আর সে তখনও পাহাড় থেকে নামছিল, খানিকটা ধীরে। এরপর সে একটা মোটর গাড়ির শব্দ শুনতে পায় আর সেই মুহূর্তেই তার ভাই গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসে, চাঁদের আলোয়। এবং সে রাস্তা পার হতে থাকে। আর তোমার বাবা দৌড়ে পাহাড় থেকে নেমে আসে, ও জানায় কেন তা করেছে সেটা তার জানা ছিল না। গাড়িটা ছিল একদল সাদা মানুষে ঠাঁসা। ওরা সবাই ছিল মাতাল, আর যখনই ওরা তোমার বাবার ভাইকে দেখতে পায়, সঙ্গে সঙ্গে সবাই ভয়ানক এক চিৎকার করে সোজা ওর দিকে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। ওরা আসলে মজা করছিল, শুধু ওকে ভয় পাইয়ে দিতে চাইছিল, ওরা ওরকম প্রায়ই করে থাকে, সেটা তোমার জানা। কিন্তু সে সময় ওরা ছিল মাতাল। আর আমার ধারণা সেই ছেলেটাও ছিল মাতাল, আর ভয়ে হিতাহিত জ্ঞান পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে। তখনই সে লাফিয়ে সরে যেতে চায়, কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তোমার বাবা বলেছে সে তার ভাইয়ের চিৎকার শুনেছে, যখন গাড়িটা ওকে চাপা দিয়ে ওর ওপর দিয়ে চলে যায়, আর সে গিটারের কাঠগুলোর ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পায়, আর তার ছেঁড়ার শব্দ, আর সে সাদা লোকেদের চিৎকার শুনতে পায়, আর গাড়িটা চলতেই থাকে, আর সেটা আজও থামেনি। আর যখন তোমার বাবা পাহাড় থেকে নেমে আসে, তখন তার ভাই একতাল মণ্ড আর রক্ত ছাড়া অন্য কিছু নয়। ”

মায়ের চেহারার ওপর চোখের জল চক্ চক্ করছিল। আমার আর কিছুই বলার থাকে না।

“কথাটা সে কখনো বলেনি”—সে বলে, “কারণ আমি তোমাদের মতো বাচ্চা ছেলেদের কাছে ওকে তা কখনোই বলতে দেইনি। সেই রাতে তোমার বাবা একেবারে পাগলের মতো হয়ে যান এবং এরপর আরো অসংখ্য রাত ওর সেভাবেই কাটে। ও বলে গাড়ির আলোটা চলে যাবার পর সেই সড়কটার মতো অন্ধকার কোনো কিছু সে তার সারা জীবনেও দেখেনি। আশপাশে কোনো কিছু, রাস্তার ওপর আর কোনো লোক ছিল না, শুধু তোমার বাবা, ও তার ভাই আর সেই ভাঙ্গা গিটারটা ছাড়া। ও, হ্যাঁ। তোমার বাবা আর কখনোই পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। সেদিন থেকে নিশ্চিত না হবার পরও তবু সব সাদা লোককে সে তার ভাইয়ের হত্যাকারী মনে করছে যেহেতু সে এমনই একজন লোককে তার ভাইকে খুন করতে দেখেছে। ”

সে থামে এবং নিজের রুমালটার দিকে তাকিয়ে থাকে আর চোখ মুছে আমার দিকে তাকায়।

“আমি তোমাকে এসব বলিনি”—তিনি বলেন, “যাতে কাউকে অযথা ভয়, কটু কথা বা ঘৃণা না করো। এখন তোমাকে কথাটা বললাম কারণ তোমারও একটা ভাই আছে। আর পৃথিবীটা মোটেই বদলে যায়নি। ”

আমার ধারণা আমি এটা বিশ্বাস করছি না। আমার ধারণা তিনি সেটা আমার চেহারার মাঝে দেখতে পেয়েছেন। তিনি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে আবারও জানালার দিকে তাকিয়ে, সেই রাস্তার মাঝে কিছু একটা খুঁজতে থাকেন।

“তবে আমি আমার ত্রাণকর্তার প্রশংসা করি”—শেষে তিনি বলেন, “যে তিনি তোমার বাবাকে আমার পাশে একই বাড়িতে রেখেছেন। আমি তাকে বলিনি আমার দিকে কোনো ফুল ছুঁড়ে দিতে, বরং, আমি ঘোষণা করি, তিনি আমাকে খুবই হতাশ করেছেন এটা জানান দিয়ে যে আমি তোমার বাবাকে এই বিশ্ব থেকে নিরাপদ থাকতে সহায়তা করেছি। তোমার বাবা সব সময় বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর, শক্তিমান লোকের মতো আচরণ করেছে। আর সবাই তাকে সেভাবেই দেখেছে। তবে সে যদি ওখানে আমাকে না পেত তবে—তার চোখের জলই দেখতে হতো!”

তিনি আবারও কাঁদতে শুরু করেন। তখনও আমি নড়তে পারছিলাম না। আমি বলি, “স্রষ্টা, স্রষ্টা, বিষয়টা যে এরকম সেটা আমি মোটেই জানতাম না। ”
“ওহ, সোনা”—তিনি বলেন, “এমন আরো অনেক কিছুই আছে যা তোমার জানা নেই। তবে সেসব তোমাকে খুঁজে নিতে হবে। ” তিনি জানালার কাছ থেকে উঠে আমার কাছে আসেন। “তোমার ভাইকে দেখে রাখতে হবে”—তিনি বলেন, “ওকে পড়ে যেতে দিও না, ওর যাই হোক না কেন বা ওর কাছ থেকে যতই খারাপ ব্যবহার পাও না কেন। তুমিও ওর সঙ্গে বহুবার বার দুষ্টামি করবে। তবে ভুলে যেও না আমি তোমাকে কী বলেছি, শুনতে পাচ্ছো?”
“আমি ভুলব না”—আমি বলি। “তুমি চিন্তা করো না, আমি ভুলব না। আমি সনির কিছুই হতে দেব না। ”

আমার মা হেসে ওঠেন যেন তিনি আমার চেহারায় কিছু একটা দেখতে পেয়ে মজা পাচ্ছেন। এরপর, “তুমি হয়ত কোনো কিছু থামাতে পারবে না। তবে জানান দিতে পারবে তুমি ওর পাশে রয়েছো। ”

চতুর্থ কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৬, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।