ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বান্ধবী | উম্মে ফারহানা

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৫
বান্ধবী | উম্মে ফারহানা

বৃহস্পতিবার রাত আটটার বাসে যথারীতি ভিড় কম, টেকনিক্যাল থেকে উঠে সামনের দিকে সিট পেয়ে গেলাম। এমনিতে আমি শাহবাগ বা সায়েন্সল্যাব থেকে বাসে উঠি, আজকে মিরপুর এক নম্বর গেছিলাম মেজখালার বাসায়।

আমি আত্মীয়স্বজনের বাসায় যেতে চাই না, আজকে যেতে হলো মা’র জোরাজুরিতে, কী জানি এক উপহার এনেছে মায়ের বোনপো বিদেশ থেকে। মায়ের অনেক আত্মীয়ই দেশের বাইরে থাকে, তাদের আনা উপহার দেখলে হাসি পেয়ে যায়। একজনের জন্য একটা সোয়েটার, কিংবা একটা শ্যাম্পুর শিশি, একটা নেইলপলিশ বা এক কৌটা ক্রিম। আমি আরো অনেক বিদেশ থেকে আসা লোকজনের উপহার সামগ্রী দেখেছি, দাম বা মান যাই হোক, পরিমাণ এত কম দেখিনি, তাও আবার দশ বারো বছর পর পর এসে! কেন দিতেই হবে উপহার, যদি মন খুলে দিতে না পারে কেউ? কান্তার মামা প্রায় প্রতি বছর দেশে আসেন, একেকজনের জন্যে ব্যাগ ভরে ভরে উপহার নিয়ে, এত চকলেট আনেন যে কান্তা বন্ধুদের সবাইকে দিয়ে দিয়ে শেষ করতে পারে না, হলের খালাদেরও দেয়, গতবার আমাকেও একগাদা জিনিস দিয়েছেন মামা, (সব ভালো ব্র্যান্ডের লিপস্টিক, মেইক আপ আর টয়লেট্রিজ, আমার কাজিনরা ওই পরিমাণ জিনিস পুরো ফ্যামিলির মধ্যে বিতরণ করেন) কারণ তার আগেরবার দেশে বেড়াতে এসে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর। আমি কান্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম উনি কানাডাতে কী করেন, কান্তা বলল উনি নাকি একটা গাড়ির দোকানের সেলস পারসন। মায়ের বোনপো বোনঝিরা সবাই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার। গতকাল কান্তার সঙ্গে আমার ঝগড়াটা লাগবার পেছনে সম্ভবত এটাও একটা কারণ, কিংবা বলা ভালো সুপ্ত কারণ ছিল। আমি বারবার বলছিলাম যে মিরপুর যেতে হবে, ও বারবার জিজ্ঞেস করছিল কেন, আমি বলতে চাইছিলাম না আর ইনসিস্ট করছিল ধানমন্ডি যাবার জন্যে, ওর কোন এক ‘বন্ধু’র সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে আমাকে। আমি যেতে চাইছিলাম না কারণ ওর এই তথাকথিত ‘বন্ধু’টি বয়সে অনেক বড়, যেটি আদৌ বন্ধুত্বের পক্ষে কোনো অন্তরায় নয়, বিবাহিত, যা আপাতদৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নয়, এক সন্তানের পিতা, তাতেও কিছুই এসে যেত না, যদি এবং কেবল যদি এটি বন্ধুত্বই হতো, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে কান্তা এই বিবাহিত ব্যক্তিটির ওপর ক্রাশ খেয়ে বসে আছে, হালকা পাতলা ক্রাশ না, বড়সড় ক্রাশ। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছিল না। এখন কথা হলো, আমি তো আর ওর গার্জিয়ান নই, আমাকে কেন খবরদারি করতে হবে, বন্ধু হোক বা শুধুই রুমমেট, সবাই এডাল্ট, সবাই নিজেরটা ভালো বোঝে। কিন্তু ওর এই বন্ধুদের আচরণ যেন ক্যামন। ঈদের ছুটিতে বাসায় ছিলাম আমি, কান্তা ফোন করল, কথা বলতে বলল সেই ‘বন্ধু’দের একজনের সঙ্গে, কান্তা যার ওপর ক্রাশ খেয়ে আছে সেই পলাশ সাহেবের বন্ধু, উনার নাম মামুন। ফোন ধরেই আমাকে বলল, “আপনি মাইমেনসিং থেকে আসছেন? আসবার সময় একটা জিনিস নিয়ে আসবেন” আমি বললাম, “কী জিনিস?” সে হেসে বলল, “মিষ্টি, কৃষ্ণা কেবিনের মিষ্টি, আপনাদের ওখানে নাকি ওটা খুব বিখ্যাত?” আমি বললাম, “কৃষ্ণা কেবিন ছাড়াও আরো অনেক ভালো মিষ্টি এখানে পাওয়া যায়”, “কিন্তু আমার যে কৃষ্ণা কেবিনের মিষ্টিই লাগবে” বলেই মামুন খুব হাসতে লাগল। কৃষ্ণা কেবিনের ব্যাপারটা হলো, ওই মিষ্টির দোকানের উল্টো দিকেই নাজমা বোর্ডিং, শহরের ব্রথেলে ঢোকার পথ। আমি যখন কান্তাকে বিষয়টা বললাম, ও কনফিউজড হয়ে গেল, বলল, “কিন্তু সে হয়ত শুধু মিষ্টির কথাই বলতে চাইছে, তুইই অযথা অন্য মানে দাঁড় করাইতে চাইতেছিস”। কালকে ধানমন্ডির একটা পিৎজার দোকান থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে আসবার সময় কান্তাকে ধমকাচ্ছিলাম আমি। একদল লুচ্চার সামনে খেলো হবার কোনো মানে নেই, নিজেকে হাস্যকর করে তোলা, নিজের অনুভূতিকে সস্তা হতে দেওয়াটা আত্মসম্মানের পক্ষে হানিকর। আমার ধমকে কান্তা রীতিমতো কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল, বলল, “কিন্তু পলাশ তো আমার ব্যাপারে অনেক কেয়ারিং, বিডিআর বিদ্রোহের দিন আমি ওই এলাকায় ছিলাম, ও ফোন করে আমার খোঁজ নিছে”। আমি খেঁকিয়ে উঠে বললাম, “তাতেই তুমি ধন্য হয়া গেছো, লুক কান্তা, হি ইজ প্লেয়িং গেমস উইথ ইউ, তুই এটা বুঝতে না চাইলে, নিজেকে একটা কুত্তার মুখের সামনে মাংসের টুকরা হইতে দিলে আমার কিছু বলার নাই, ইটস ইয়োর লাইফ”।



আমি তখন লকড জ। কান্তা প্রলাপের মতন বলছিল, “মানে আমার চেহারাটেহারা আরেকটু ভালো হইলে, বুবস আরেকটু বড় হইলে, হ্যাঁ... দাঁতগুলা এত উঁচু না হইলে, স্কিন আরো ফ্রেশ হইলে... হ্যাঁ... মানে ওনলি ইফ আই ওয়্যার আ বিট মোর অ্যাট্রাকটিভ... থিংস উড হ্যাভ বিন ডিফ্রেন্ট, না?... মানে মনে কর, এই যে আমার ২৫ হয়া গেছে, আমি এখনো ভার্জিন, ধর এইটা একটু আনইউজুয়াল না? ধর তোর যে ক্যাম্পাসেই কয়টা রিলেশনশিপ হইল, মানে, আমার তো আর হবে না...”



“হেলো”... আমি তাকিয়ে দেখলাম সিটের ওপর একহাতে ভর দিয়ে ঝুঁকে আছে সাকিব। সাকিব বিবিএতে পড়ে, আমাদের ব্যাচেরই। ক্যাম্পাসে পাঁচজন সবচেয়ে সুদর্শন যুবকের তালিকা তৈরি হলে, যে-ই করুক সেই তালিকা, সাকিবকে প্রথম তিনজনের মধ্যে রাখবে, কিংবা রাখতে বাধ্য হবে। “হেই হ্যান্ডসাম”, আমি ফ্লার্ট করার মুডে নেই, কিন্তু অত সুদর্শন যুবককে টিপিক্যাল হাই-হ্যালো করার মতন বেরসিক এখনো হইনি। “তর বান্ধবী কই?” তিনজনের সিট, আমি জানলার পাশে ছিলাম, সাকিব অন্যপাশে বসবার পরেও অনেকখানি জায়গা দুজনের মাঝখানে থেকে গেল। অন্যসময় হলে হয়ত এ নিয়ে একটু আফসোস করতাম মনে মনে। কিন্তু এই মুহূর্তে কান্তা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না। “কে, কান্তা?” আমি সাকিবের দিকে একটু সরে এসে বললাম। “হ, তর বান্ধবী তো ক্যাম্পাসে একজনই” সাকিব ফিচেল একটা হাসি দিল। “ক্যান, একজনই হবে ক্যান, আমার আরো অনেক বান্ধবী আছে”। আমি ছেলেদের সঙ্গে সহজে মিশি বলেই বোধহয় খোঁচা দিল। “ওরা হইল মেয়ে বন্ধু, আর এ হইল বান্ধবী, পার্থক্য আছে না?” আমি আর কথা বাড়ালাম না। মামা ভাড়া নিতে আসল আমিনবাজার পার হবার পর। সাকিব পাঁচজনের ভাড়া দিল। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম মোহিত, শিহাব আর ফয়সাল, দরজায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। এদের মধ্যে ফয়সাল আমার নিজের বিভাগের বাকি দুইজন বিবিএ কিংবা এনথ্রো, আমি ঠিক জানি না। ফয়সালের বিষয়ে আমার একটা অপরাধবোধ আছে, কোনো একদিন কান্তার কাছে কনফেস করব ভেবেছিলাম, করা হয়ে ওঠেনি। কালকের ঝগড়ার পর সম্ভাবনা আরো কমে গেল। কালকে আটটার বাসেই উঠেছিলাম আমরা। ভিড় ছিল ভালোই, তার মধ্যেই আমি যথেষ্ট জোরে চিৎকার করতে করতে ওকে বকা দিচ্ছিলাম। তুই একটা মোরন, বেহায়া, ফালতু, দে জাস্ট ওয়ান্ট টু ফাক ইউ, নাথিং এলস... এইসব কথা বলছিলাম, আশেপাশের সবাই শুনছিল আর চোখ বড় বড় করে দেখছিল কান্তা অঝোরে কাঁদছে। আমরা ফোর্থ ইয়ারে ওঠার পর সিনিয়র তেমন কেউ নেই, যারা ছিল তাদের সঙ্গে আমার এমন কোনো হৃদ্যতা নেই যে আমাকে ধমক দেবে। একদম পেছনের সিটে আমার বিভাগের বড় ভাই সোহেল ভাই ছিল, আমি দেখিনি। সোহেল ভাই-ই গলা উঁচিয়ে বলেছিল, “অই মিতু, চুপ কর, রুমে গিয়া ঝগড়া করিস”। আমি তখন চুপ করেছিলাম। ক্যাম্পাসে গসিপ হয় খুব সহজেই। আমাকে নিয়ে হরেক রকম গসিপ এমনিতেই চালু আছে। কালকে সম্ভবত নতুন কোনো গসিপ হয়েছে, সাকিব সেইজন্যেই ‘বান্ধবী’ বলে খোঁচাটা মারল।

“বিড়ি খাবি?” সাকিবের প্রশ্নটা শুনে চমক ভাঙে আমার। “নারে, জুনিয়র পোলাপাইন আছে” আমি আসলে উঠে গিয়ে দরজায় দাঁড়াতে আগ্রহী না। ফয়সালকে এড়াতে চাইছি। ফয়সালের সঙ্গে আমার একটা ঝামেলা আছে। ওর সঙ্গে দুইবার শুয়েছি আমি, কিন্তু তারপর থেকে দেখি ও কেমন যেন টেইকেন ফর গ্রান্টেড ধরে নিয়েছে আমাকে। সারাক্ষণ মাতবরি করছে আমার ওপর। নাকি ভেবেছে আমি ওর প্রেমে পড়ে আছি, কে জানে! আমার বয়েই গেছে ওর ট্যানট্রামস সহ্য করতে। নেহাত একই গ্রুপে প্রজেক্ট জমা দিতে হচ্ছে বলে, নয়ত ও এমন কোনো আহামরি বন্ধু নয় যার সঙ্গে যোগাযোগ আমাকে রাখতেই হবে।

গত মাসে একদিন শেষ রাতে গাঁজা খেয়ে আমি আর কান্তা গান শুনছিলাম। কান্তার মামার দেওয়া ল্যাপটপে কলিম শরাফীর কণ্ঠে “আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার” বাজছিল, রিপিট দেওয়া ছিল। ঘোরের মধ্যে মনে হচ্ছিল আসলেই ঝড় উঠেছে। আসলে তখনও ফাল্গুন মাস, ঝড় বৃষ্টির নামগন্ধ নেই।   হঠাৎ কান্তা বলল, “সেদিন তোর বন্ধু ফয়সালের সঙ্গে বসে আসলাম”। আমি গানে ডুবে ছিলাম, বললাম, “তাই নাকি?” “হ” বলেই কান্তা হেঁড়ে গলায় গাইতে শুরু করল, “সুবহানআল্লা, সুবহানআল্লা”। ফানা ছবির একটা গান, অন্তরার অংশটাতে একটা লাইন আছে, “হোনা হ্যাঁয় তুঝমে ফানা”, খুব হিট এখন গানটা। তারচেয়ে বড় কথা ফয়সালকে দেখলেই অন্য বিভাগের মেয়েদের মধ্যে দুইএকজন এই গান করে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করে, মেয়েগুলো সবাই আমার হলের, এর মধ্যে জিওগ্রাফির সাকী একটু অ্যাডভান্সড। ওকে লক্ষ্য করে ফয়সাল কিছুদিন আগে “ও সাকী সাকী, আ পাস আ র‍্যাহ না যায়ে কোয়ী খোয়াহিশ বাকী” গাইত, তাতেই উৎসাহিত হয়ে ফানার এই গান গেয়ে সাকী উত্তর দিতে শুরু করে, সাকীর প্ররোচনায় অন্যরাও। আমিও দুইএকবার গেয়েছি ওদের সঙ্গে। এখন রান্নাঘরে বা বাথরুমে আমাদের ব্যাচের কেউ এই গান করলেই অন্যরা বলে “ফয়সাল আছে নাকি আশে পাশে?”
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “গান গাইতে গাইতে আসলি?”
“উ”
“উ মানে কী?”
“না”
“তাইলে?”
“ফ্লার্ট করতে করতে”
“ও ও ও, গুড গুড”
“নো, নট গুড ইনাফ”
“মানে”
“আয়্যাম নট গুড এট ফ্লার্টিং, ইউ নো”
“বাট ইউ নেভার ট্রায়েড ইট”
“দ্যাট ডে আই ডিড”
“তারপরে?”
“তোর বন্ধু আমাকে বুঝিয়ে দিল, হি ইজ... হি ইজ...”
“হি ইজ?”
“হি ইজ মোর স্মার্ট, মোর সেক্সি... অ্যান্ড টু প্রুভ দ্যাট...”
“টু প্রুভ দ্যাট?”
“হি টাচড মি”
আমার তখন নেশা ছুটে যাচ্ছে, খাটের ওপর উঠে বসে বললাম, “মানে কী? গায়ে হাত দিছে?”
“উ”
“উ মানে? দিছে নাকি? তুই কইশা চটকনা মারতে পারলি না?”
“না”
“না ক্যান?”
“কারণ, কারণ...”
“কী কারণ?”
“মজা করতেছিলাম, আমি হাঁটু দিয়া একটু বাড়ি দিছি অর হাঁটুতে, তারপরে ও কনুই দিয়া গুঁতা দিল...”
“ও, এই মাত্র? তাই বল”—সিরিয়াস কোন মলাস্টেশন নয়, আমি হাঁপ ছাড়লাম।
“না, তারপরে আমি অর উরুতে হাত রাখছিলাম, আর ও আমার কোমর জড়ায়া ধরছিল এক হাত দিয়া”
“আচ্ছা, আর কিছুই না?”
“না”
দেখলাম ‘না’টা বলতে গিয়ে কান্তার কণ্ঠ ভারী হয়ে যাচ্ছে।
“তুই কী নিয়া আপসেট আসলে?”
“দ্যাখ মিতু, আমি তো আর সুন্দর না, সেক্সিও না। ”
“মানে কী? তোর আবার এইসব নিয়া কমপ্লেক্স কবে থাইকা শুরু হইল?”
“কমপ্লেক্স না, আসলে আমার জাগায় অন্য যেকোন মেয়ে থাকলে, ধর তুই থাকলে, বাস ক্যাম্পাসে পৌঁছানোর পর আরো অনেক কিছু হইতে পারত... পারত না?”

আমি তখন লকড জ। কান্তা প্রলাপের মতন বলছিল, “মানে আমার চেহারাটেহারা আরেকটু ভালো হইলে, বুবস আরেকটু বড় হইলে, হ্যাঁ... দাঁতগুলা এত উঁচু না হইলে, স্কিন আরো ফ্রেশ হইলে... হ্যাঁ... মানে ওনলি ইফ আই ওয়্যার আ বিট মোর অ্যাট্রাকটিভ... থিংস উড হ্যাভ বিন ডিফ্রেন্ট, না?... মানে মনে কর, এই যে আমার ২৫ হয়া গেছে, আমি এখনো ভার্জিন, ধর এইটা একটু আনইউজুয়াল না? ধর তোর যে ক্যাম্পাসেই কয়টা রিলেশনশিপ হইল, মানে, আমার তো আর হবে না...”

আমার মনে হলো কেউ আমাকে একটা কষে চড় মেরেছে। আমার যথেচ্ছা চলাফেরা আর অনিয়ন্ত্রিত সম্পর্কগুলো নিয়ে আমি লজ্জিত বা কুণ্ঠিত না হলেও বুঝতে পারি এই বিষয়গুলো আমাকে একা করে দিচ্ছে। অনেক মেয়েই সামনে আমার সঙ্গে মেশে, ভালোভাবে কথা বলে, আড়ালে যা তা গসিপ করে। তারা কেউ সতীসাবিত্রী নয়, একটা সম্পর্ক ভাঙলে নিয়ম করে ঝগড়া আর চোখের পানি নাকের পানির পর তারাও আরেক সম্পর্কে জড়ায়, না বনলে বাপমায়ের ঠিক করা পাত্রের গলায় মালাও দেয়, কিন্তু আমার মতন কোনো কমিটমেন্টের তোয়াক্কা না করে যখন যার সঙ্গে ইচ্ছা ঘুরেফিরে বেড়ানো, ভালো না লাগলে ডিসমিস করে দেওয়ার মতন গাটস এদের নেই। তাই আমাকে স্লাট বলে এরা বেশ আত্মতৃপ্তি অনুভব করে। কারো আবার আমার মুখের ওপর কিছু বলার সাহসও নেই, আমি একদিন বাথরুম থেকে শুনেছিলাম, দাঁত মাজতে মাজতে দুজন আমাকে নিয়েই কথা বলছিল, স্লাট শব্দটা খুব ঘৃণাভরে উচ্চারণ করেছিল একজন। আমার নন কনভেনশনাল পোশাক, আমার ধূমপান, এগুলোও তাঁদের জন্যে সমস্যা, তাঁদের হয়ত অস্বস্তি হয়। কিন্তু এই প্রায় একঘরে প্রায় মার্জিনালাইজড হয়ে থাকার ব্যাপারটা যে আমাকে পীড়া দেয় না, তাও না। আমি চেষ্টা করলেও কে কার সঙ্গে কোন চিপায় গেল, কোন মার্কেটে কোন জামার কাপড় সস্তায় পাওয়া যায়, কোন সিরিয়ালের কোন চরিত্রের কয়টা বিয়ে এসব নিয়ে লনে বসে গল্প করতে পারি না। তাই বুঝতে পারি আমি অ্যালিয়েনেটেড হয়ে গেছি, কান্তা ছাড়া আর হাতে গোনা দুই তিনজন মেয়েকে আমি বন্ধু ভাবতে পারি, ছেলেদের মধ্যে কাউকেই নয়। দুইএকটা স্মলটাইম রোমান্স হয়ত করেছি ক্যাম্পাসে, শুয়েওছি, কিন্তু সেগুলো নিশ্চয়ই আমার কোনো যোগ্যতা নয় যে এটা নিয়ে কেউ আমার থেকে নিজেকে ইনফিরিওর ভাবতে পারে। আর কান্তার মতন ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া একটা মেয়ে তো নয়ই। আমি ওকে বলতে পারলাম না যে ওর ব্রনের দাগওয়ালা মুখ, উঁচু দাঁত, ছোট স্তনের বুকই আমার অনেক ভালো লাগে, আমি ওকে বলতে পারলাম না যে ফয়সালের সঙ্গে বাসের এক সিটে বসে ক্যাম্পাসে ফিরে গাঁজা খাবার অজুহাতে বিজ্ঞান কারখানার পেছনে গিয়ে আমি আসলেই ‘অনেক কিছু’ করেছিলাম, আমি ওকে বলতে পারলাম না যে তাতে আসলে তেমন কিছুই এসে যায় না কারণ আমি বা ফয়সাল কেউ কাউকে ভালো টালো বাসি না আর ফয়সাল ওকে বিজ্ঞান কারখানার পেছনে নিয়ে যায়নি বরং এম এইচের গেইটে নেমে গেছে বলে বাসে করা ফ্লার্ট বা ফ্লার্টের প্রতিযোগিতায় ও হেরে গেছে বলে ধরে নিতে হবে এমনও না।

কালকে যখন রুমে ফিরে আমি জিনিসপত্র গোছাচ্ছিলাম অন্য রুমে গিয়ে থাকব বলে, তখন কান্তাই আমাকে আটকাল। বলল, “তুই আমার সঙ্গে থাকবি না?” তখনও ওর চোখে পানি। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম, “এরপর আর কেন থাকব তোর রুমে?” কান্তা সরি বলল, বলল ভুল হয়ে গেছে, আর কোনোদিন পলাশ মামুনদের আড্ডায় আমাকে যেতে বলবে না, ও নিজেও যাবে না। আমি বললাম, “তুই যাবি না ক্যান, তোর ভাল্লাগলে তুই যাবি”। খুব যে বেশি অপমান করেছিল পলাশ আর মামুন তাও না, ওরা শুধু একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, আমার রংচটা জিন্স, সূতির ফতুয়া আর বাটার চপ্পলওয়ালা ধূলিধূসরিত পা যেন খুব দ্রষ্টব্য বিষয়, এমনভাবে পরখ করছিল আগাপাশতলা। ওদের ভাবে মনে হচ্ছিল ওরা বড় চাকরি করে আর ঢাকা শহরে গাড়ি চালিয়ে চলে বলে অফিসের পর বাসায় ফেরার আগে পুরনো বউয়ের বদলে হাঁটুর বয়সী নিত্য নতুন মেয়েদের সঙ্গ উপভোগ করতে পারে খুব সহজেই, দামি পিৎজার দোকানে তাদের ক্রেডিট কার্ডে দেওয়া একবেলার বিলের সমপরিমাণের টাকায় আমাদের হলের ক্যান্টিন ডাইনিং এমনকি বটতলায় খেলেও অনেকবেলা খাওয়া যাবে এই তথ্যটি যেন বা ওরা জানে। মামুন আর পলাশ নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল কোন এক হট মেয়েকে নিয়ে, যে কিনা কোন পার্টিতে মদ খেয়ে বমি করছিল, “বমিটাও কি রোমান্টিক ছিল বল?” বলে দুই বন্ধুতে হুল্লোড় করে হেসে উঠছিল, আমাদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, যেন আমরা কাঙ্গালি ভোজে আসা ভিখিরি, আপাতত খাদ্য পরিবেশিত হবার জন্য অপেক্ষা করছি। পিৎজা আসার পর এক কামড় খেয়েই কান্তা বলল, “আমি খাব না, ভালো লাগতেছে না” ততক্ষণে ওর সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়ে গিয়েছিল চোখে চোখে, ও বুঝতে পারছিল আমি ভেতরে ভেতরে ফুঁসছি, ভিসুভিয়াস জাগছে, যেকোন সময়ে বিস্ফোরণ হবে, যদিও আমি চুপচাপ খাচ্ছিলাম। তখন মামুন বলল, “আমার অবশ্য খাবার মাত্রই ভালো লাগে খেতে”। পলাশ খাচ্ছিলই না, বলল, “খাবারের ব্যাপারে মামুনের কোনো না নেই, খাবার আর মেয়ে, হলেই হলো”। মামুন একটা মুখভঙ্গি করল, যাতে বোঝা গেল সে শুধু এটি মেনেই নিচ্ছে না, বরং তাঁকে এত ভালো বোঝার জন্য বন্ধুকে ধন্যবাদও দিচ্ছে। এইসবগুলো আচরণ এমন যে নালিশ করা যায় না, যে কাউকে বললে সে বলবে আমি ওভাররিঅ্যাক্ট করছি। হয়ত বলবে আমরা নিজেরা বন্ধুদের মধ্যে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে অনেক বেফাঁস কথাবার্তা বলি কিনা, যদি বলেই থাকি তাহলে ওরা আর কী এমন দোষ করেছে, কান্তা তো ওদের বন্ধুই। যে কেউ আমার মুখ থেকে শুনলে হয়ত বলবে আমি যদি প্রেমের তোয়াক্কা না করে নিজের বয়সী একটি ছেলের সঙ্গে শুতে পারি তাহলে বয়স্ক কারো সামনে কেন মিসেস গ্র্যান্ডি সাজতে চাইছি কিংবা ওরা বয়সে বড় বলেই বড় ভাইয়ার মতন আচরণ করবে সেটাই বা কেন আশা করছি। আমি কান্তার আশাভঙ্গের ব্যাপারটাই ভাবছিলাম। পলাশ নামক এই সুদর্শন বিদেশি পারফিউমের গন্ধ ছড়ানো ব্যক্তিটির সঙ্গে শুয়ে কি ও ফয়সালের সঙ্গে বেশি দূর যেতে না পারার শোক ভুলতে চায়? যেনতেনপ্রকারে ভার্জিনিটি লুজ করাই কি ওর উদ্দেশ্য? বোধ হয় না। ও এক ধরনের মুগ্ধতা নিয়ে পলাশের দিকে তাকিয়ে ছিল, একটা মোহ, একটা রং। এটা প্রেমের পূর্বাভাস। কিন্তু পলাশ কান্তাকে লেজে খেলাচ্ছে, যেকোন অন্ধ মানুষ শুধুমাত্র গন্ধ শুঁকেই তা বলে দিতে পারবে।

আমি বললাম, “দ্যাখ, তুই ওই লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবি কি রাখবি না সেটা তোর নিজের ডিসিশন, আমি তোরে শাসন করার কেউ না। আমারে আলাপ করায়া দেয়ার দরকার ছিল না” কথা শেষ, এমন একটা ভঙ্গি করে আমি একটা সিগারেট ধরিয়েছিলাম। তখন মাত্র দশটা বাজে। রুমে সিগারেট খেলেও সাধারণত এগারটার পর খাই, যখন বারান্দায় কারো আসার সম্ভাবনা কম, কিন্তু কালকে বেশি রেগে গেছিলাম।

“অই, নামবি না?”

দেখলাম হল চলে এসেছে। সাকিবও নামল, ফয়সালরা কখন নেমেছে খেয়াল করিনি, ডেইরির স্টপেজ কখন পেরোলাম তাও দেখিনি, ফোনে রিচার্জ করা দরকার ছিল, কিন্তু প্রান্তিক যেতে ইচ্ছা করছে না। আমি নেমে গেলাম। রুমের সামনে গিয়ে দেখি তালা ঝুলছে। কান্তা ফেরেনি। আমি রুমে ঢুকে বাতি জ্বালালাম। আমার খাটের ওপর কান্তার ল্যাপটপ। আমার কিছু জামাকাপড় বারান্দায় নাড়া ছিল, সেগুলো এনে রেখে গেছে। আমি না ধোয়া কাপড় পরতে পারি না, অন্যের জামাকাপড়ও পরি না। হলে অনেকেই অনেকের জামাব্লাউজ এমনকি পেটিকোট পর্যন্ত ধার করে। আমার এই স্বভাব সবাই জানে, অনেকে মুখও বাঁকায়, নখরামি ভাবে। কান্তাও অনেকের ড্রেস পরে, ওর অন্য বন্ধুরাও ওরগুলো পরে, শুধু আমার একটা ফতুয়া ও একবার চেয়ে নিয়েছিল, আমিও দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, “ধোয়া না, ধুয়ে পরিস”। ও বলেছিল, “ধোয়া না দেখেই তো চাইলাম”। আমি তখন কিছু বলিনি, পরে দেখলাম আসলেই ও ফতুয়াটা না ধুয়েই পরে নিয়েছে। মনে পড়ল, আজ সকালেও ওটাই ওকে পরতে দেখেছি। এমনিতে ও জিন্স ফতুয়া পরে ক্লাসে যায় না, ওদের বিভাগের শিক্ষকরা নাকি মাইন্ড করে। ও কি তাহলে আজ ক্লাসে যায়নি? দুপুরে হলে ফিরেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে, নয়ত আমার কাপড় কখন আনল? একটা এসএমএস পাঠাবার পয়সাও নেই ফোনে। বলেছিল ঢাকা যাবে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে টাকা তুলতে, উঁচু দাঁতের ট্রিটমেন্ট বেশ খরচসাপেক্ষ, ওই চিকিৎসার জন্যেই টাকাটা পাঠাবার কথা ওর মামার। কিন্তু সে জন্যে হলে ফিরবে না কেন? কাল শুক্রবার, সব ব্যাংক বন্ধ। তাহলে কি আবার পলাশ? কে জানে! হয়ত পলাশের সঙ্গে ডেটিং, হয়ত মামুনের বউ বাসায় নেই, পলাশ ওকে মামুনের খালি বাসায় নিয়ে যাবে। হয়ত ঢাকার বাইরে কোথাও যাচ্ছে ওরা। কালরাতের পর তো আর এ বিষয়ে কথা হয়নি কোনো।

গতমাসে যখন ফয়সালের সঙ্গে ক্যম্পাসে ফেরার কথা বলছিল ও, তখনও পলাশ নামের ব্যক্তিটির প্রাদুর্ভাব হয়নি। সেরাতে আমি ওর প্রলাপের কোনো জবাব দিতে না পেরে চুপচাপ ওর পাশে গিয়ে শুয়েছিলাম, ওর কোমর জড়িয়ে ধরে। টি শার্টের ভেতর দিয়ে পেটের ওপর হাত নিয়েও থেমে গিয়েছিলাম, গালে ঠোঁট ছুঁয়ে নোনতা স্বাদ পেয়ে বুঝেছিলাম ও কাঁদছে। হাত বের করে এনে টি শার্টের ওপর দিয়ে আলতো করে রেখেছি পরে। ও ভার্জিন। ও আমার আদর চায় না।

হয়ত এখন ও কোনো প্রার্থিত পুরুষকে পাশে পেয়েছে, হয়ত ওর ছোট ছোট স্তনেই হাত বুলাচ্ছে মাগিবাজ পলাশ, ভালোবেসে না হোক, মাংশ ভেবেই হোক, হয়ত নিয়েছে ওকে। ফয়সাল জগতের শেষ পুরুষ নয়, ফয়সালের প্রত্যাখ্যান ওর নারীত্বকে ঘা দিয়ে যেতে পারে, নষ্ট তো আর করতে পারবে না।

আমি কান্তার বিছানায় শুয়ে পড়লাম, গোসল না করে, কাপড় না পালটে। দরজাটা ভেতর থেকে না আটকে, বাতি না নিভিয়ে। যদি ও হলে ফিরে থাকে, অন্য কার রুমে থেকে থাকে, যদি ওর ফিরতে মন চায়...

একটু পরে উঠে দরজা আটকালাম, খুব ঘুম পাচ্ছে, ল্যাপটপ চুরির সম্ভাবনা কম, তবু। বাতি নিভিয়ে ল্যাপটপে চার্জ লাগিয়ে গান ছেড়ে দিলাম, “মিতু’স প্লে লিস্ট” নামে একটা প্লে লিস্ট আছে এতে, জগাখিচুড়ি লিস্ট, জগজিৎ সিং, জন ডেনভার, শচীন কর্তা সবাই আছেন। রিপিট দিয়ে দিলাম আমি। কলিম শরাফী গাইতে থাকলেন
“আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরাণ সখা বন্ধু হে আমার”...



বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।