ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সনির ব্লুজ (শেষ কিস্তি) | জেমস আর্থার বাল্ডউইন | অনুবাদ: সোহরাব সুমন

অনুবাদ গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৫
সনির ব্লুজ (শেষ কিস্তি) | জেমস আর্থার বাল্ডউইন | অনুবাদ: সোহরাব সুমন

জেমস আর্থার বাল্ডউইন (২ আগস্ট, ১৯২৪-পহেলা ডিসেম্বর, ১৯৮৭) একাধারে একজন আমেরিকান ছোট গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, নাট্যকার, কবি এবং সমাজ সমালোচক। তার প্রবন্ধ সংগ্রহ ‘নোট অব আ নেটিভ সন’ (১৯৫৫)-এ তিনি বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কার আমেরিকার পশ্চিমা সমাজে বিদ্যমান এবং তখনও আলোচিত হয়নি এমন সাম্প্রদায়িক, যৌন এবং নানা ধরনের শ্রেণী বিভেদ এবং এই সংক্রান্ত অনেক অপরিহার্য সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন।

দ্য ফায়ার নেক্সট টাইম (১৯৬৩), নো নেইম ইন দ্য স্ট্রিট (১৯৭২), এবং দ্য ডেভিল ফাইন্ড ওয়ার্ক (১৯৭৬) তার আরো তিনটি বিখ্যাত প্রবন্ধ সংগ্রহ।

বাল্ডউইনের উপন্যাস এবং নাটক সমূহে কৃষ্ণাঙ্গসহ সমকামী এবং উভকামী পুরুষদের মৌলিক ব্যক্তিগত অনেক প্রশ্ন এবং জটিল সব সামাজিক ও মানসিক পীড়ন এবং ন্যায়সঙ্গত চাওয়া পাওয়া কাহিনী হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। একই সঙ্গে এধরনের ব্যক্তিত্বের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে বেশ কিছু আভ্যন্তরীণ বাঁধা বিঘ্নও বর্ণিত হয়েছে। সমকামীদের অধিকারের বিষয়টি আমেরিকা জুড়ে ব্যাপকভাবে সমর্থন পাবার আগেই এসম্পর্কে বল্ডউইন তার বিখ্যাত উপন্যাস, গিওভানি’স রুম (১৯৫৬) লেখেন, এটি তার দ্বিতীয় উপন্যাস। তার প্রথম উপন্যাস, গো টেল ইট ওন দ্য মাউন্টেইন, তার সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম।

সনি’স ব্লুজ গল্পটি বল্ডউইনের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং নির্বাচিত গল্পগুলির একটি। এটি ১৯৫৭ সালে প্রথম ছাপা হয়, পরে গোয়িং টু মিট দ্য ম্যান (১৯৬৫) গল্প সংগ্রহে ঠাঁই পায়। - অনুবাদক



ষষ্ঠ কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন



মরা ডাওন টাওনের অন্ধকার পথ পেরিয়ে কাছের একমাত্র নাইটক্লাবে যাই। সরু, কোলাহলময়, লোকজনে ঠাসা বারের বড় কামরার প্রবেশ পথ ঠেলে ভেতরে ঢুকি, যেখানে গানের মঞ্চ। ঘরটার আলো খুব কম হওয়ায়, কিছু দেখতে না পেয়ে, কয়েক মুহূর্তের জন্য আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর, “হ্যালো, বয়”—কেউ একজন বলে ওঠে আর প্রকাণ্ড একটা কালো লোক, সনি বা আমার থেকে অনেক বড়, আলোর ঝলকানির মাঝে হঠাৎ করেই কোথা থেকে যেন এসে হাজির হয় এবং সনির কাঁধ ঘিরে একটা হাত রাখে। “আমি এখানেই বসে ছিলাম”—সে বলে, “তোমার অপেক্ষায়। ”

লোকটার গলার স্বরও খুব ভারী, এবং অন্ধকারে মাথাগুলো আমাদের দিকে ফিরে।

সনি দাঁত বের করে হাসে এবং টেনে খানিকটা দূরে সরে যায়, আর বলে, “ক্রেওলে এইটা হচ্ছে আমার ভাই। আমি তোমাকে ওর কথা বলেছি। ”
ক্রেওলে আমার সঙ্গে হাত মেলান। “তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে আমি খুবই খুশি, বাবা”—সে বলে, আর এটা খুবই স্পষ্ট যে সনির কারণে সেখানে আমার সঙ্গে দেখা করতে পেরে তিনি খুবই সন্তুষ্ট। এবং সে হেসে বলে, “আপনারা আপনাদের পরিবারে সত্যিকারের একজন মিউজিসিয়ান পেয়েছেন”—এবং তিনি সনির কাঁধ থেকে হাতটা সরান এবং মমতার সঙ্গে, হাতের উল্টো পাশটা দিয়ে, হালকা করে, ওকে চাপড় মারেন।



সে যা বাজাতে চায় তাকে সেটাই বাজাতে জানতে হয়। এবং একটা পিয়ানো কেবলই একটা পিয়ানো। এটা অনেকগুলো কাঠ আর তার আর ছোট বড় কয়েক গোছা হাতুড়ি আর হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি। যদি একে নিয়ে খুব বেশি কিছু করার ইচ্ছে থাকে তাহলে সেটা আপনাকে নিজের চেষ্টার মাধ্যমেই খুঁজে নিতে হবে, চেষ্টার মাধ্যমে এবং কেবল এর মাধ্যমেই একে দিয়ে সব কিছু করিয়ে নেয়া সম্ভব



“ভালো, এবার আমি সবটা শুনলাম”—পেছন থেকে কেউ একজন বলে ওঠে। এটা ছিল অন্য একজন মিউজিসিয়ান এবং সনির বন্ধু, দেখতে একেবারে কয়লার মতো কালো, চাহনি উচ্ছ্বল, গড়নে একেবারে খাটো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে আমাকে একেবারে বুকের ভেতর থেকে ফিসফিস করে, সনি সম্পর্কে সবচেয়ে ভয়ানক গোপন একটা কথা বলতে শুরু করে, তার দাঁতগুলো লাইট হাউজের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল আর তার হাসিটা ভূমিকম্প শুরুর মতো মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল। আর তাতে করে এটা বোঝা যায় যে বারের প্রত্যেকে বা কমবেশি সবাই সনির সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত, এদের কেউ কেউ মিউজিসিয়ান, এখানে কাজ করে, বা কাছাকাছি কোথাও থাকে, বা এখানে কাজ করে না, কেউ কেউ কেবল লাভের আশায় ওর সঙ্গে গায়ে পড়ে ভাব জমাতে এসেছে এবং কেউ কেউ শুধু সনির বাজানো শুনতেই এখানে এসেছে। তাদের সবার সঙ্গেই আমি পরিচিত হই এবং তাদের সবাই আমার সঙ্গে মার্জিত ব্যবহার করে। যদিও তাদের সবার কাছে এটা স্পষ্ট ছিল, আমি কেবল সনির ভাই। এখানে, আমি সনির জগতের ভেতর। অথবা, বরং বলা যায়: সনির রাজত্বে। এখানে, এমন প্রশ্নও আসতে পারে না, আদৌ তার শিরায় রাজ রক্ত বইছে কিনা।

খুব শীঘ্রই ওরা বাজাতে শুরু করে এবং ক্রেওলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে অন্ধকার কোণের দিকে একটা টেবিল ঘিরে বসে। এরপর আমি ওদের দেখতে থাকি, ক্রেওলে এবং কালো বেটে লোকটা এবং সনি আর অন্যদের, যখন ওরা মঞ্চের একেবারে নিচে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো সব কিছু খুঁটিয়ে দেখছিল। মঞ্চের আলো ছাপিয়ে এসে খানিকটা ওদের ওপরও পড়ছিল এবং, তাতে করে ওদের হাসি, অঙ্গভঙ্গি আর নড়াচড়া চোখে পড়ছিল, তারপরও আমার মনে হচ্ছিল খুব শীঘ্র আলোর বৃত্তের মাঝে পা না রাখতে ওরা সব থেকে বেশি সতর্ক ছিল: তাই ওরা আলোক বৃত্তের মাঝ দিয়ে না বুঝেই এমনভাবে চলাচল করছিল, যেন ওরা একে একে শিখার মাঝে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এরপর, আমি ওদের একজনকে দেখতে পাই, সেই ছোট্ট, কালো লোকটা, আলোর ভেতর দিয়ে, মঞ্চ অতিক্রম করে এবং তার ড্রামস নিয়ে ভাঁড়ামি শুরু করে। এরপর—কৌতুক করে এবং একই সঙ্গে খুব আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে—ক্রেওলে সনির হাত ধরে এবং তাকে পিয়ানোর দিকে নিয়ে যায়। একজন মহিলা সনির নাম ধরে ডেকে ওঠে এবং কয়েক জোড়া হাত হাততালি দিতে শুরু করে। এবং সনিও, কৌতুক করে এবং আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে এবং খুব আবেগী ভঙ্গিতে, আমার মনে হচ্ছিল ও কেঁদে ফেলবে, তবে তা লুকাতে বা দেখাবার চেষ্টা না করে, একজন পুরুষের মতো, দাঁত বের করে হাসে এবং তার দুহাত বুকে রাখে এবং কোমর পর্যন্ত ঝুঁকে সবাইকে অভিবাদন জানায়।

এরপর ক্রেওলে বেজ বেহালার কাছে যায় এবং একটা রোগা, আর খুব ফর্সা চামড়ার বাদামি লোক লাফিয়ে মঞ্চে উঠে তার বিষাণটা হাতে তুলে নেয়। এভাবে যে যার জায়গায় অবস্থান নেয় এবং মঞ্চ আর ঘরের পরিবেশ বদলে টানটান হয়ে ওঠে। কেউ একজন মাইক্রোফোনের দিকে এগিয়ে যায় এবং একে একে সবার নাম ঘোষণা করে। তারপর চারদিক থেকে নানা ধরনের ফিসফিস শুনতে পাওয়া যায়। বারের কেউ একজন সবাইকে চুপ করতে বলে। পরিচারিকা এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকে, উদ্বেগের সঙ্গে, শেষবারের মতো ফরমায়েশ নিতে থাকে, ছেলে আর মেয়েরা একে অপরের আরো কাছাকাছি হয়, আর মঞ্চের আলোগুলো, আর ওর ওপরকার সেই চারজন বাজিয়ে, কেমন যেন একটা ধূম্রনীলে পরিণত হয়। তাই ওদের সবাইকে ওখানে দেখতে অন্যরকম লাগছিল। ক্রেওলে শেষবারের মতো পরখ করে নেয়, যেন দেখছিল তার সবগুলো ছানা খাঁচায় ঢুকেছে কিনা, এবং এর পরপরই সে—লাফিয়ে ওঠে এবং বেহালায় ঝংকার তোলে। এবং অন্যরাও বাজাতে শুরু করে।

সঙ্গীত সম্পর্কে আমার যতদূর জ্ঞান অনেক লোক সেসব কানেও শোনেনি। আর তারপরও, কোনো কোনো দুর্লভ সময়ে যখন কোনো কিছু খোলা হয়, আর তার সঙ্গে গান বাজানো হয়, মূলত আমরা তখন যা শুনে থাকি, অথবা মনোযোগ দিয়ে শুনি, তাতে ব্যক্তিগত, নিজস্ব কিছু বিস্মৃত স্মৃতিচারণ থাকে। কিন্তু যারা গান বানায় তাদের এর থেকেও বেশি কিছু শুনতে হয়, তার রিক্ততা থেকে ফুসে ওঠা আর বাতাসে আঘাত হানা আর্তচিৎকারের সঙ্গে লেনদেন করতে হয়। যা তার স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলে, এরপর, অন্যকিছু মনে করিয়ে দেয়, সেটা আরো বেশি ভয়ানক কেননা তাতে কোনো শব্দ থাকে না, এবং একই কারণে তাতে বিজয়োন্মত্ততাও থাকে। আর ওর এই বিজয়, যখন ও কোনো কিছুতে জিতে যায়, সেটা একপ্রকারে আমাদেরও জেতা। আমি শুধু সনির মুখের দিকে চেয়ে দেখি। ওর মুখে ঝঞ্ঝার ছাপ, ও খুব পরিশ্রম করেছে, কিন্তু ও তখন বাজাচ্ছিল না। আর ঘটনাক্রমে আমার মনে হতে থাকে, মঞ্চের সবাই ওর জন্য অপেক্ষা করছে, উভয়পক্ষ ওর জন্য অপেক্ষা করছে এবং একসঙ্গে ওকে ঠেলছে। কিন্তু যখনই আমি ক্রেওলেকে দেখতে শুরু করি, আমি বুঝতে পারি যে ক্রেওলেই ওদের সবাইকে পেছন থেকে আঁকড়ে রয়েছে। সে ওদের ওপর অল্পবিস্তর বর্ষণ করছিল। বেহারার বিলাপের সঙ্গে, তালে তালে সমস্ত শরীর দোলাচ্ছিল, আধো চোখ বুজে, সে সব কিছুই শুনলেও, সনির বাজানো শুনছিল। সে সনির সঙ্গে কথা বলে। সে চাইছিল সনি বেলাভূমি ছেড়ে গভীর জলে ডুব দিক। সে ছিল সেই গভীর জলে সনির দ্রষ্টা আর টেনে নিয়ে যাওয়াটা সেই একই জিনিস ছিল না—সে সেখানেই ছিল, আর সে সেটা জানত। আর সে চাইছিল সনিও সেটা জানুক। সে অপেক্ষা করছিল সনি এমন করে বাজাক যাতে ক্রেওলে বুঝতে পারে সনি জলের ভেতরে রয়েছে।

এবং, ক্রেওলে যখন শুনছিল, সনি নড়ে ওঠে, গভীরভাবে, প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে যেমনটা হয়। আমার আগে কখনোই জানার সুযোগ হয়নি গাইয়ে আর তার বাদ্যের মাঝে কী চমৎকার সম্পর্ক হতে পারে। তাকে সেটা অনুভব করতে হয়, যন্ত্রটাকে, নিজের জীবনের দমের ভেতর থেকে। সে যা বাজাতে চায় তাকে সেটাই বাজাতে জানতে হয়। এবং একটা পিয়ানো কেবলই একটা পিয়ানো। এটা অনেকগুলো কাঠ আর তার আর ছোট বড় কয়েক গোছা হাতুড়ি আর হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি। যদি একে নিয়ে খুব বেশি কিছু করার ইচ্ছে থাকে তাহলে সেটা আপনাকে নিজের চেষ্টার মাধ্যমেই খুঁজে নিতে হবে, চেষ্টার মাধ্যমে এবং কেবল এর মাধ্যমেই একে দিয়ে সব কিছু করিয়ে নেয়া সম্ভব।

আর সনি বছর খানেক ধরে পিয়ানোর কাছে ছিল না। আর তার নিজের জীবনের সঙ্গে খুব একটা ভালো সম্পর্ক ছিল না, এখন যে জীবন তার সামনে প্রসারিত সেটা এরকমও ছিল না, সে এবং পিয়ানোটা তোতলাতে থাকে, কোনো রকমে বেজে ওঠে, ভীত হয়ে, থেমে যায়; অন্যভাবে বেজে, আঁতকে ওঠে, সময়টাকে চিহ্নিত করে, আবারও বাজতে শুরু করে; এরপর মনে হয় দিক খুঁজে পায়, আবারও ভয়ে, থেমে যায়। এবং সনির যে মুখটা আমি দেখি তা আগে কখনোই দেখিনি। সব কিছুই তাতে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবার অবস্থা, সেখানে তার ভেতরে ক্রোধ আর আবেগের মাঝে যে যুদ্ধটা চলছিল তাতে সাধারণত যেসব জিনিস গোপন থাকে তা পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়।

তবু, ক্রেওলের মুখটা এমন দেখাচ্ছিল যেন তারা এইমাত্র প্রথম অংশটা শেষ করতে যাচ্ছে, আমার মনে হতে থাকে কিছু একটা ঘটে গেছে, এমন কিছু যা আমি শুনিনি। এরপর ওরা শেষ করে, ছড়ানো ছিটানোভাবে এদিক সেদিক থেকে করতালি পড়তে শুরু করে, এবং এরপর, তৎক্ষণাৎ কিছু জানান না দিয়েই, ক্রেওলে অন্য কিছু বাজাতে শুরু করে, এটা ছিল একেবারেই বিদ্রূপাত্মক, এটা ছিল—এম আই ব্লু। এবং সে নির্দেশ দেবার পরপরই সনি বাজাতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু একটা ঘটতে শুরু করে। আর ক্রেওলেও বর্ষণ হতে দেয়। সেই শুকনো, খাটো, কালো লোকটা তার ড্রামসে ভয়াবহ কিছু একটা বলতে শুরু করে, ক্রেওলে জবাব দেয়, এবং তার জবাবে ড্রামসটাও বলে ওঠে। এরপর আকুল সুরে বিষাণটা বেজে ওঠে, মিষ্টি আর উঁচু স্বরে, সম্ভবত খানিকটা বিচ্ছেদের সুরে, এবং ক্রেওলে শুনে, মাঝে মধ্যে সুন্দর, শান্ত, পুরনো, আর শুকনো মন্তব্য ছুঁড়ে দিতে থাকে। তারপর আবারও সবাই একসঙ্গে বাজাতে শুরু করে, আর সনি আবারও সেই পরিবারের একজন সদস্যে পরিণত হয়। ওর মুখ দেখেই আমি সেটা বলে দিতে পারি। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল নিজের আঙ্গুলের নিচে যেন সে একেবারে নতুন একটা পিয়ানো খুঁজে পেয়েছে। মনে হচ্ছিল ও আগেকার সেই জড়তাটা কাটিয়ে উঠেছে। তারপর কিছুক্ষণের জন্য, সনিকে ভার মুক্ত পেয়ে, মনে হচ্ছিল ওরা সবাই ওর সঙ্গে সায় দেয় যে একেবারে নতুন সেই পিয়ানোটা বুঝি গ্যাস।

ক্রেওলে সামনে এগিয়ে এসে সবাইকে মনে করিয়ে দেয় যে তারা যা বাজাচ্ছে তা আসলে ব্লুজ। সে ওদের সবার ভেতরে কোথাও আঘাত করে, সে আমার ভেতরে কোথাও আঘাত হানে, আমাকে, এবং বাজনাটা আরো আঁটসাঁট আর গভীর হয়, সেই বোধ বাতাসে ঝংকার তোলে। ক্রেওলে আমাদের বলতে শুরু করে ব্লুজ বলতে আসলে কী বোঝায়। সেটা আসলে নতুন কোনো কিছু নয়। সে এবং তার ছেলেরা মঞ্চে সেটাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করছে, ধ্বংস, বিনাশ, পাগলামী, এবং মৃত্যু ঝুঁকির পরও, যাতে নতুনভাবে নতুন কিছু আমাদের শোনাতে পারে। যেন, আমরা যেভাবে কষ্ট পাই, ভুগি, এবং আমরা যেভাবে আনন্দিত হই, এবং আমরা যেভাবে জিতে যাই সেইসব গল্পের কোনোটাই আসলে নতুন নয়, যেন, সেটা আমরা সব সময়ই শুনে আসছি। যেন, বলার জন্য আর কোনো গল্প বাকি নেই, এটা কেবল এই আস্ত অন্ধকারের মাঝে দেখতে পাওয়া একমাত্র আলো।

এবং সেই মুখ, সেই শরীর, তারের ওপরকার সেই মজবুত হাতগুলোর অনুসারে, সব দেশেই এই গল্পের অন্য একটা অবয়ব রয়েছে, এবং সব প্রজন্মের কাছে এর নতুন একটা গভীরতা রয়েছে। শোনার চেষ্টা করুন, ক্রেওলে যেন বলছে, একটু শোনার চেষ্টা করুন। এখন এর সবই সনির ব্লুজ। সে সেই খাটো কৃষ্ণাঙ্গ লোকটার ড্রামসকে তা শিখিয়ে ছেড়েছে, বাদামি লোকটার বিষাণটাকে। ক্রেওলে আর সনিকে জলে নামাবার চেষ্টা করছে না। সে কেবল তার এই বাজাবার সফলতা কামনা করছে। এরপর সে পিছিয়ে যায়, খুব ধীরে, এই অপরিমেয় আভাসে বাতাসকে পূর্ণ করে যে সনি এখন নিজের কথা বলছে।

তারপর তারা সবাই সনিকে ঘিরে জড়ো হয় এবং সনি বাজাতে থাকে। মাঝে মধ্যে তাদের কেউ কেউ এর ফাঁকে ফাঁকে বাজিয়ে ওঠে এবং মনে হয় কেউ একজন যেন বলে উঠল, আমেন। সনির আঙ্গুলগুলো চারপাশের বাতাসকে পুরোপুরি জীবন্ত আর ভরপুর করে তোলে, তার জীবনের সাহায্যে। কিন্তু সেই জীবন অন্য আরো অনেককে ধারণ করে। এবং সনি আবার প্রথমে ফিরে যায়, সে আসলে অতিরিক্ত একটা দিয়ে শুরু করে, গানের খোলামেলা কথার সরল উক্তিতে। গানটা ছিল খুবই সুন্দর কেননা তাতে কোনো তাড়া ছিল না এবং কোনো প্রকার বিলাপও না। মনে হচ্ছিল আমি যে যন্ত্রণাময় গানটা শুনছি সেটাকে সে নিজের করে নিয়েছে, আমাদেরও যা পোড়াচ্ছিল তা আমরা নিজের করে নিয়েছিলাম, কেমন করে আমরা সেই শোক এড়াতে পারি। আমাদের ভেতর মুক্তি ওত পেতে ছিল এবং আমি সেটা টের পাই, অবশেষে, তাই সে আমাদের মুক্তিতে সাহায্য করে যদি আমরা তা শুনি, তাই আমাদের ছাড়া সে কখনোই মুক্ত হতে পারে না। তবু ওর মুখে এখন যুদ্ধের কোনো ছাপ নেই। ও কিসের মাঝে দিয়ে গিয়েছে আমি তা শুনি, এবং পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পৌঁছাবার আগপর্যন্ত ওর এই যাত্রা অব্যাহত থাকে। সে একে নিজের করে নিয়েছে: সেই দীর্ঘ পঙ্‌তি, যেখানে আমরা কেবল মা বাবাকে চিনতাম। এবং সে তাতে আবারও ফিরে আসে, যেমন করে সব কিছু ফিরে ফিরে আসে, যাতে মৃত্যুর মাঝ দিয়ে, তা চিরজীবী হতে পারে। আমি আবারও আমার মায়ের মুখটা দেখি, আর এই প্রথমবারের মতো, মনে হয়, কিভাবে রাস্তার পাথরগুলোর ওপর হাঁটার সময় সেগুলো তার পায়ের ওপর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। আমি সেই চাঁদের আলো ছাওয়া সড়কটা দেখতে পাই যেখানে আমার বাবার ভাই মারা গিয়েছে। এবং তা আমার স্মৃতিতে কিছু একটা ফিরিয়ে দেয় এবং আমাকে অতীতের মাঝে নিয়ে যায়। আমি আবার আমার ছোট্ট মেয়েটাকে দেখতে পাই এবং আবারও ইসাবেলের চোখের জল অনুভব করি, এবং বুঝতে পারি আমার নিজের চোখ জুড়েও জল ঝরতে শুরু করেছে। এবং তবু আমি বুঝতে পারছিলাম যে এটা কেবল একটা মুহূর্ত, কারণ বাইরে তখনও বাকি বিশ্বটা অপেক্ষা করছে, বাঘের মতো ক্ষুধার্ত, এবং আমাদের ঘিরে যে সমস্যাগুলো প্রসারিত তা আকাশের চেয়েও বিশাল।

তারপর এক সময় তা শেষ হয়। ক্রেওলে এবং সনি হাফ ছেড়ে বাঁচে, দুজনেই ভিজে একাকার, ওরা তবু দাঁত বের করে হাসছে। চারিদিকে প্রচণ্ড করতালি এবং তার অনেকটাই ছিল বাস্তব। অন্ধকারে সেই মেয়েটা এগিয়ে আসে এবং আমি তাকে মঞ্চে পানীয় নিয়ে যেতে বলি। তারপর দীর্ঘ নীরবতা, ওরা তখন ওপরের সেই ধূম্রনীল আলোতে নিজেদের মধ্যে কথা চালাচালি করছিল এবং কিছুক্ষণ বাদে আমি দেখতে পাই সেই মেয়েটা সনির জন্য তার পিয়ানোর ওপর একটা স্কচ আর দুধ রেখে আসে। মনে হচ্ছিল ও সেটা দেখতে পায়নি, কিন্তু আবারও বাজাবার আগে দিয়ে, সে তাতে একটা চুমুক দেয় এবং আমার দিকে তাকায়, এবং মাথা নোয়ায়। এরপর সে সেটা আবারও পিয়ানোর ওপরে রাখে। আমার জন্য, এরপর, ওরা আবার বাজাতে শুরু করলে, কাঁপতে থাকা কাপটা আমার ভাইয়ের মাথার ওপর উজ্জ্বলভাবে নড়তে থাকে।



বাংলাদেশ সময়: ১৬২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।