ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ১৭)

ধারাবাহিক রচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৫
ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ১৭)

পর্ব ১৬ পড়তে ক্লিক করুন

ভারতে এই বৈরী আবহাওয়ায় |
৮৩৩ সালের জুলাই মাস। হায়াদ্রাবাদের রাস্তায় মানুষজন খুব একটা নেই।

কাঠফাটা দুপুরের গা জ্বলে যাওয়া গরমকে হজম করে কার এত সাহস যে তেতে ওঠা রাস্তায় পা ফেলে? দু’একটা পর্দা ঘেরা ঘোড়ার গাড়ি ঠক-ঠক আওয়াজ তুলে চলে গেল। এদিকে ভারতে সদ্য আগত বিলাতি নারী ফ্লোরা এনি স্টিলের চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। রাস্তায় হাওয়ার সাথে ধুলোর কুণ্ডলি আর সেই সাথে যাচ্ছেতাই রকমের গরম। এই গরমে কেউ রাস্তায় হাওয়া খেতে আসে?—নিজের সঙ্গেই কথোপকথন চালায় ফ্লোরা এনি স্টিল। সঙ্গে থাকা ভারতীয় আয়াকেও নিজের ক্ষোভের কথাটা জানায়। ভারতীয় আয়াটি মাটিতে দৃষ্টি রেখে সলজ্জভাবে হাসে। যেন এই পরিস্থিতির জন্য সে-ই দায়ী। একধরনের অপরাধবোধে তার মুখটা বিষণ্ণ হয়ে যায়।

বিলাতি মেম ফ্লোরার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ থেকেই যায়। থাকবে না-ই বা কেন? স্বামী ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সারাদিন নিজের কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত। ঘরবন্দী হয়ে আর কত? একলা ঘরে গৃহস্থালির কাজকর্ম আর বিকেলবেলায় চায়ে চুমুক দিতে দিতে বিলাতি সখিদের সঙ্গে তাস খেলা ছাড়া ফ্লোরার হাতে তেমন কোনো কাজকর্ম নেই। তারচেয়ে বরং রোদ থাকুক, বৃষ্টি হোক—খানিকক্ষণ রাস্তায় হেঁটে যদি সুন্দর একটা সময় কাটানো যায়। তবে হায়াদ্রাবাদ শহরটা মন্দ না। চারপাশ থেকে কেমন একটা সুনশান নীরবতা শহরটার গায়ে লেগেই আছে। বিষয়টা ফ্লোরাকে খুবই মুগ্ধ করে। এদিকে, ভারতীয় আয়াটিও বেশ ভালো। অনেকটা বন্ধুর মতো। “না, না, তাকে বন্ধুর মতো ভাবাটা হয়ত ভালো দেখাবে না। আয়া সে তো আয়াই। বন্ধু কিসের?”—সাথেসাথেই মনে পড়ল সঙ্গে নিয়ে আসা ‘দি ইন্ডিয়ান হাউসকিপার অ্যান্ড কুক’ পুস্তিকার সাবধানী বাণীর কথা। সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, “ঘরের কোনো সাধারণ কাজ করবে না, কারণ তোমার চাকরটি সে কাজটি করতে পারবে। যদি বিশেষ কোনো কাজ তোমার পক্ষে একান্তই করা সম্ভব না হয় তাহলে সবসময়ই অন্যের সাহায্য নেবে। তবে চাকরের কাজ চাকরই করবে। ”এসব ভাবতে ভাবতে হায়াদ্রাবাদের রাস্তার ঘোড়ার গাড়ি আর পাগড়ি পরা বাদামী মানুষদের ঘ্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন ফ্লোরা এনি স্টিল।



বিলাতি নারীরা ভারতীয় আবহাওয়ার এই বৈরী আচরণকে বশে আনার জন্যে তাদের প্রতিদিনের জীবনাভ্যাসে অনেক পরিবর্তন এনেছিল। বিশেষ করে গরমের সময় হালকা খোলামেলা সাদা রঙের পোশাক পরা, কাপড়ের বিশেষ পাখা তৈরি করা এবং ‘পাংখা কুলি’ নিয়োগ দিয়ে হাতটানা এই বিশেষ পাখার বাতাস গ্রহণ করা, বাড়ির আঙিনায় বা বাগানে শয্যা পাতা এবং সেইসাথে গরমের তাপ থেকে রক্ষা পেতে ঘরবাড়ির বিশেষ নকশা তৈরিতে ধীরে ধীরে পারদর্শী হয়ে ওঠা



বিলেতে যে অর্থে ‘সামার’ ভারতে সেই সামারের চেহারা মোটেই একরকম নয়। ভারতের চামড়া ফাটানো গরমে বিলাতি নারীর মোটেও অভ্যস্ত ছিল না। ভারতের তীব্র গরম সাদা চামড়ার বিলাতি নারীদের জন্য রীতিমতো ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা। সেই আঠার শতকে বিলেত থেকে প্রকাশিত ‘রিয়েল লাইফ অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে এলাহাবাদে অবস্থানরত এক বিলাতি নারীর—এই নিয়ে মনোবেদনার চিত্রটি ফুটে উঠেছে। মিসেস কিং নামের বিলাতি এক নারীর উদ্ধৃতি দিয়ে সেই গ্রন্থে বলা হয়েছে, “ মাঝে মাঝে মনে হতো আমার মাথা বুঝি গরম চুল্লিতে ভাজা হচ্ছে। ”

সবদিক বিবেচনা করে বিলাতিরা ভারতের আবহাওয়াকে সেই সময় তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছিল। গরম, শীত এবং বর্ষা। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে আবহাওয়ার চেহারাটা ছিল বিভিন্নরকম। উত্তর ভারতীয় আবহাওয়ার চেহারা তুলনামূলকভাবে বেশ ভালো ছিল। বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম ভারতে কখনোই মৌসুমী ঝড়ের তাণ্ডব দেখা দিত না। দক্ষিণ ভারতে ঠাণ্ডা এবং গরমের উগ্রতা ছিল সহনীয় পর্যায়ে। কিন্তু পূর্ব ভারতে গরমের তোপ ছিল প্রখর। বিশেষ করে বেঙ্গল এবং আসাম প্রদেশে গরমের সময়ে তাপমাত্রা ৯০ থেকে ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে উঠত। আরো পশ্চিমে—করাচিতে এই তাপমাত্রার পরিমাণ ১২০ ডিগ্রি পর্যন্ত ছুঁয়ে যেত।

গরমের সময় বিলাতি নারীদের জীবনাচার, সত্যি বলতে খুবই সীমাবদ্ধ ছিল। এ বিষয়ে বিলাতি নারীদের সতর্ক করে দিয়ে ‘ইন্ডিয়া আউটফিট’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, “গরম যখন প্রকট হতে থাকবে তখন আপনি হয়ত রাতেও যথেষ্ট পরিমাণ বিশ্রাম নিতে পারবেন না। আপনার বিছানা বাড়ির আঙিনায় হাতপাখা ব্যবহার করলেও গরমের হাত থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই। ” ফেনি পার্ক নামের এক বিলাতি নারী ১৮৩০ সালে ভারতের অসহনীয় গরম নিয়ে বলেছেন, “বোকার মতো সারাদিন বাসায় বসে থাকা ছাড়া এই গরমের দিনে কিছুই করার নেই। এই ভারত সত্যি বাসের অযোগ্য কুৎসিত একটা দেশ। ” শুধুই কি গরমের জ্বালা, সেইসাথে রয়েছে বিভিন্ন রকম কীট পতঙ্গ, ব্যাঙ্গের ডাক এবং পাখির কিঁচিরমিচির। বিলাতি নারীদের শান্তিভঙ্গে এরাও কম দায়ী নয়। রসমাউন্ড লরেন্স নামের এক বিলাতি নারী তার রোজনামচায় লিখছেন, “মস্তিষ্কে সারাক্ষণ জ্বালাযন্ত্রণাকারী বিভিন্নরকম এই শব্দগুলোয় প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। ”

কিন্তু গরমের এই উপদ্রূপ থেকে বাঁচার উপায় কী? ভারতেই যেহেতু পাকাপাকিভাবে থাকতে হবে তারজন্য দেশটার ‘যন্ত্রণাদায়ক’ এই গরমকেও জয় করা চাই। বিলাতি নারীরা ভারতীয় আবহাওয়ার এই বৈরী আচরণকে বশে আনার জন্যে তাদের প্রতিদিনের জীবনাভ্যাসে অনেক পরিবর্তন এনেছিল। বিশেষ করে গরমের সময় হালকা খোলামেলা সাদা রঙের পোশাক পরা, কাপড়ের বিশেষ পাখা তৈরি করা এবং ‘পাংখা কুলি’ নিয়োগ দিয়ে হাতটানা এই বিশেষ পাখার বাতাস গ্রহণ করা, বাড়ির আঙিনায় বা বাগানে শয্যা পাতা এবং সেইসাথে গরমের তাপ থেকে রক্ষা পেতে ঘরবাড়ির বিশেষ নকশা তৈরিতে ধীরে ধীরে পারদর্শী হয়ে ওঠা।

বিয়ার বা পানির বোতল ঠাণ্ডা করতে, ঘরের তাপমাত্রা ঠাণ্ডা করতে সেসময় ‘খুস খুস টাট্টিস (khus-khus tatties) ছিল ভারতের একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি। বিশেষ এই পদ্ধতিতে সুগন্ধিযুক্ত ঘাস, পানি এবং বাতাসকে কাজে লাগিয়ে ঘরের ভেতরকার তাপমাত্রা ঠাণ্ডা এবং সহনশীল রাখা হতো। বাড়ির দরজা, জানালায় খুস খুস টাট্টি মূলত এ যুগের ‘এয়ার কন্ডিশন’-এর একটি সনাতনী রূপবিশেষ। সনাতনী এই পদ্ধতিতে পানি জমিয়ে বরফ পর্যন্ত করতে পারত ভারতীয়রা। ১৯৩০ সালে আমেরিকা এককার্গো আপেল পাঠিয়েছিল কলকাতা বন্দরে। আপেলগুলো যেন পচে না যায় সেজন্য বরফ দিয়ে কার্গোটিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছিল। কার্গোর ওই বরফগুলো আমেরিকার ওয়েনহাম লেক থেকে আনা হয়েছিল। দেখাদেখি বিলাতিরাও ভারতে বরফ বানাতে শুরু করল। উল্লেখ্য, ১৮৭৮ সালে কলকাতায় প্রথম বরফ বানানোর কারখানা তৈরি হয়।

ভারতের এমন গরমে বিলাতি নারীদের প্রতিদিনকার জীবনচিত্রটি কেমন ছিল? তারা ঘুম থেকে উঠত ভোর ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে। হালকা চা পানের পর শুরু হতো শরীরচর্চা। কেউ কেউ টেনিস, ঘোড়া দৌড় অথবা গলফ খেলত। ‘ইন্ডিয়া আউটফিট’ পুস্তিকায় একটি সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। “এই সময়টা হলো জানার, ফসলের মাঠের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে নতুন নতুন পথ আবিষ্কার করার, গ্রামের মসজিদ, মন্দিরের ছবি মনের পর্দায় এঁকে গ্রাম্য জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করার এবং সেইসাথে কোনো বন্ধুর সাথে ’ছোট হাজারি’তে (chota hazari)’ সকালের নাস্তা করার। ” ছোট হাজারিতে নাস্তার সময় সকাল ৭টা থেকে ৮টা। নাস্তার পর বিলাতি নারীদের কাজ ছিল ঘর গৃহস্থের কাজে জড়িয়ে পড়া। ঘর গৃহস্থালির কাজের পর কিছুক্ষণ পড়াশোনা, গালগপ্প করা, তারপর গরম পানি দিয়ে গোসল করে দুপুরের খাবার খাওয়া। দুপুরের খাবারের পরপরই বিলাতি মেমসাহেবদের চোখে নিদ্রাদেবী এসে ভর করত। আয়েশী মনে বিছানায় এলিয়ে পড়তেন। বাড়িতে নিয়োজিত পাংখা কুলিরা টানা হাতপাখার বাতাসে তাদের ঘুমকে নিরুপদ্রপ করে তুলত। সূর্য পশ্চিমে হেলার সাথে সাথেই বিলাতি নারীরা তাদের আলসে ভরা চোখের পাপড়িগুলো ধীরে ধীরে মেলতেন এবং ঘুম জেগে আবারো গোসল করে নিতেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে সেজেগুজে কেউ হয়ত স্থানীয় কোনো ক্লাবে আড্ডা দিতে চলে যেতেন, কেউ বা নিজের বাড়িতেই প্রতিবেশি বিলাতি নারীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে আড্ডা দিতেন। কেউ কেউ এসবের কিছুই না করে নিজ বাড়িতে বসে স্বামীর অপেক্ষায় চেয়ে থাকতেন।

‘The Complete Indian House keeper and Cook’ গ্রন্থে গরমের সময়ে বিলাতি নারীদের পোশাক পরিচ্ছেদ নিয়ে কিছু উপদেশ দেওয়া হয়েছে। গ্রন্থে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে টেনিস খেলার সময় লম্বা স্কার্টের নিচে অবশ্যই যেন পেটিকোট পরে নেয়। ঘোড়ায় চড়ার সময় অবশ্যই যেন হালকা জ্যাকেট গায়ে চাপানো থাকে। সকালের দিকে হালকা উলের একটি চাদর গায় দিয়ে রাস্তায় বের হওয়া উচিত। তবে ১৮৯৫ সালে রচিত ‘Women in India’ গ্রন্থের লেখক মেরি ফ্রানসিস বিলিংটন উল্লেখ করেন, “দিন হোক আর রাত হোক, হালকা পোশাকের দিকে বিলাতি নারীদের চোখ রাখা খুব জরুরি। এমন কোনো কাপড় তাদের পরা উচিত নয় যা এমনকি শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করতেও বৈরী হয়ে ওঠে। ”

বলার অপেক্ষা রাখে না বিলাতি নারীরা ভারতের বৈরী আবহাওয়াকে জয় করে সেখানকার জীবন ব্যবস্থায় একাত্ম হয়ে বসবাসের দৃঢ় পরিকল্পনায় মনোনিবেশ করেছিলেন।

পর্ব ১৮ পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৩৩১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।