ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

শান্ত হেমন্ত | অমিতাভ পাল

হেমন্তের গদ্য ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১৫
শান্ত হেমন্ত | অমিতাভ পাল

তু হিসাবে হেমন্তের যে জিনিসটা আছে, সেটা অন্য ঋতুদের মধ্যে খুব একটা নেই। এই জিনিসটার নাম সূক্ষ্ণতা।

এটা আমাদের চামড়ায় হয়ত খানিক আভাস রেখে যায়, কিন্তু আত্মায় এর কোনো দাগই থাকে না। এত নরম, এত কোমল এই ঋতু—যে এর প্রতীকগুলিও সইতে পারে না একটু বেশি তাপ বা রুক্ষতা।

আপামরকে টের পাওয়াতে না পারলেও হেমন্ত কিন্তু একজনকে বেশ প্রভাবিত করেছিল। এই লোকটাই হেমন্তের রিপ্রেজেন্টেটিভ, সেলসম্যান বা বিজ্ঞাপন—যাই বলি না কেন। লোকটার নাম জীবনানন্দ দাশ। হেমন্তের নীরব উপস্থিতি এবং সূক্ষ্ণতার মতোই এই লোকটারও সবকিছু। প্রকৃতিতে যেমন বড় বড় ও দাপটওয়ালা ঋতুর ফাঁকফোকরে পাতলা একটা কাঁথার মতো শুয়ে থাকে হেমন্ত—জীবনানন্দও তেমনি দাপুটে কবিদের ভিড়ে ওই পাতলা কাঁথাটার মতো। হেমন্তের শেষরাতে ওটা গায়ে না দিলে কাশি হয়, গা ম্যাজম্যাজ করে।



হেমন্ত ঋতুর মজা ভোররাতে। সারারাতের ঘুম যখন ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে পুবের আকাশের মতো—হেমন্ত তখন হাজির হয় আমাদের বিছানায়। ঠাণ্ডা হাতের ছোঁয়া লাগিয়ে বিরক্ত করে, এতদিন গরমে সহায় ছিল যে সিলিং ফ্যানটা—তাকে বানিয়ে তোলে শত্রু আর লেপের ভার বইবার আগে করিয়ে নেয় কাঁথা গায়ে দেবার নেট প্র্যাকটিস



তবে ঋতুটার নাম নিয়ে এক ভদ্রলোক কিন্তু বেশ সরব হয়ে উঠেছিলেন বাংলার জনমানসে। তাঁর রেশ এখনো দূষিত পৃথিবীর মোটা দাগের ঋতুগুলির ফাঁকফোকরে বয়ে যায় একটা শ্রান্তিহর ঠাণ্ডা বাতাসের মতো। এই লোকটার অস্ত্র ছিল গান। জীবনানন্দের মতো কবিতা লিখতে চায় যেমন অনেক তরুণ কবি—তেমনি হেমন্ত মুখার্জির মতো গান গাইতে চাওয়া গায়কের সংখ্যাও কম না।

হেমন্ত ঋতুর মজা ভোররাতে। সারারাতের ঘুম যখন ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে পুবের আকাশের মতো—হেমন্ত তখন হাজির হয় আমাদের বিছানায়। ঠাণ্ডা হাতের ছোঁয়া লাগিয়ে বিরক্ত করে, এতদিন গরমে সহায় ছিল যে সিলিং ফ্যানটা—তাকে বানিয়ে তোলে শত্রু আর লেপের ভার বইবার আগে করিয়ে নেয় কাঁথা গায়ে দেবার নেট প্র্যাকটিস।

হেমন্ত আমাদের জীবনে বেশ ঝামেলাও আনে। চোরাকারবারিরা যেমন সীমান্ত পার হতে গিয়ে নানান সমস্যার মুখোমুখি হয়, কেউ নিহত হয় গুলিতে, কেউ পঙ্গু হয়ে যায় সারাজীবনের জন্য বা রক্ষীদের সঙ্গে দর কষাকষিতে কেউ সফল হয়ে হাসে—তেমনি দুই বড় ঋতুর মাঝখানের এই সীমান্তঋতুটাও বিভিন্ন অসুখ বাঁধিয়ে দেয় আমাদের শরীরে। সেইসব অসুখের কোনোটায় আহত হয় আমাদের শ্বাসযন্ত্র, কোনোটায় ভারসাম্য হারায় তাপমাত্রা। তবে আমরাও দক্ষ চোরাকারবারি—সীমান্ত পার হতে গিয়ে প্রহরীদের ধোঁকায় ফেলে দিতে আমাদের জুরি নেই।

হেমন্ত আমার কাছে সবসময় শীতের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতির ঋতু। শীতের দুই মাস যেন টেস্ট ম্যাচের দীর্ঘ পাঁচ দিন। এই পাঁচটা দিন খোলা আকাশের নিচে কাটানোর অভ্যাসটা করিয়ে দেয় হেমন্ত। কোচের মতো নেট প্র্যাকটিসে শিখিয়ে দেয় শীতের বিভিন্ন হাওয়ার ঝাপটাকে সামলাতে হয় কিভাবে।

আমার হেমন্ত ছিল ক্রিকেটের হেমন্ত। অক্টোবরের মাঝামাঝি ময়মনসিংহের সার্কিট হাউজ মাঠটাতে গজিয়ে উঠত বিভিন্ন ক্লাবের প্র্যাকটিস নেট। আর আমরা ভোরে ফিটনেস ট্রেনিং আর বিকালে ব্যাট-বলের ধুন্ধুমারে কাটাতাম সেই উচ্ছল প্রাণবন্ত দিনগুলি। ভোরের ফিটনেস ট্রেনিংয়ের পর শিশিরভেজা কাদায় কেডসের তলা ভরে যাওয়া বা শেষ বিকালে ঘামে ভেজা শরীরটাতে শীতের ঝাপটা মনে করিয়ে দিত চারপাশে এখন হেমন্ত। আর শশীকান্ত মহারাজের আলেকজান্ডার ক্যাসেলের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো গম্ভীর গাছগুলি বিকালের অর্ধেকটা যেতে না যেতেই যেরকম অন্ধকার ঘনিয়ে তুলতো চারপাশে—তাতে হেমন্ত না এসে পারতই না। তারপর সেই হেমন্ত কখন যে ডুবে যেত শীতের নিমগ্নতার মধ্যে—আমরা তা টেরই পেতাম না।

শিশির, শিউলি ফুল, কাঁথা আর অলিভ অয়েলের হেমন্ত—আমি তোমাকে ভালোবাসি।



বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।