ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

উর্দু কথাসাহিত্যে নারীবাদ এবং রশিদ জাহান | সার্জিন শরীফ

বিবিধ ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৫
উর্দু কথাসাহিত্যে নারীবাদ এবং রশিদ জাহান | সার্জিন শরীফ

ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষে শিক্ষার অভাব, অশিক্ষা-কুসংস্কারের কুপ্রভাব আর পুরুষ শাসিত সমাজে সুযোগের অভাবে ভারতীয় নারীরা বিশেষ করে মুসলিম নারীরা ছিলেন অধিকার বঞ্চিত এবং ঘরের কোণে পর্দার আড়ালে বন্দি। তাদের এ বন্দিদশা থেকে মুক্তি, স্বাধিকার বিষয়ে সচেতন করে তোলা এবং একই সাথে নারী অধিকার নিয়ে সামনে থেকে যে ক’জন নারী নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে উর্দুভাষী সাম্যবাদী কথাসাহিত্যিক রশিদ জাহান ছিলেন অন্যতম।

শুধু তাই নয় একইসাথে তিনি তাঁর প্রখর মেধা, সাহসী পদক্ষেপ এবং অসাধারণ লেখনী শক্তি দিয়ে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের ধর্মান্ধ, গোঁড়া পুরুষ শাসিত সমাজের গোঁড়ামির ভিঁতে শক্ত আঘাত হেনেছিলেন।

জন্ম: ২৫ আগস্ট ১৯০৫, মৃত্যু: ১৯৫২। রশিদ জাহান ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই)-এর একজন সক্রিয় সদস্য। সে সময়ের সাহসী, অকুতোভয় এবং নির্ভীক স্পষ্টবাদী এ ভারতীয় নারী সাহিত্যিক উর্দু সাহিত্যে নারীবাদী ধারার বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৩১ সালে অন্য তিনজন তরুণ উর্দু সাহিত্যিক ‘মাহমুদ উজ জাফর’, ‘সাজ্জাদ জহির’ এবং ‘আহমেদ আলী’র সাথে যৌথভাবে রচিত রশিদ জাহানের সাড়া সৃষ্টিকারী বই ‘আঙ্গারে’ প্রকাশিত হয়। যা ছিল মূলত কিছু প্রথাবিরোধী ছোটগল্পের সংকলন।



যে উর্দু প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশ করা হয় সেটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ত‌ৎকালীন ধর্মীয় নেতারা এর ওপর বিভিন্ন ফতোয়া জারি করেন। বইটির প্রকাশনার বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ শুরু হয় এবং প্রকাশককে ত‌ৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে লিখিতভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করে বইটির অবিক্রিত কপিগুলো জমা দিতে হয়



রশিদ জাহান ১৯০৫ সালের ২৫ আগস্ট ভারতের আলীগড়ে জন্মগ্রহণ করেন। প্রখ্যাত ভারতীয় শিক্ষাবিদ শেখ আব্দুল্লাহ এবং বেগম ওয়াহিদ জাহান দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে রশিদ ছিলেন সবার বড়। তাঁর শিক্ষা জীবনের শুরু হয় আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীনে নিজের বাবার প্রতিষ্ঠা করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘মহিলা কলেজে’। ১৯২১ সালে তিনি লক্ষ্ণৌতে অবস্থিত ‘ইসাবেলা থোবার্ন কলেজে’ পড়াশোনা করার জন্য আলীগড় ত্যাগ করেন। এর তিন বছর পরে ১৯২৪ সালে তিনি দিল্লির ‘লেডি হার্ডিঞ্জ মেডিকেল কলেজ’ থেকে গাইনোকলজির ওপরে প্রশিক্ষণ নেন এবং উত্তর ভারতের ছোট শহর বাহরাইচ থেকে বুলান্দসর এবং মেরুত-এ গাইনোকলজিস্ট হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৩৪ সালে তিনি বন্ধু এবং সহকর্মী মাহমুদ উজ জাফরকে বিয়ে করেন।

১৯৩১ সালে তাঁর ব্যাপক সাড়া সৃষ্টিকারী প্রথাবিরোধী ছোটগল্পের সংকলন ‘আঙ্গারে’ প্রকাশিত হয়, যা সর্ব ভারতীয় শিয়া কনফারেন্স, লক্ষ্ণৌতে ‘কুরুচিপূর্ণ’ এবং ‘মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতির ওপরে আঘাত’ বলে ঘোষিত হয়। যে উর্দু প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশ করা হয় সেটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ত‌ৎকালীন ধর্মীয় নেতারা এর ওপর বিভিন্ন ফতোয়া জারি করেন। বইটির প্রকাশনার বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ শুরু হয় এবং প্রকাশককে ত‌ৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে লিখিতভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করে বইটির অবিক্রিত কপিগুলো জমা দিতে হয়।

প্রকাশের মাত্র তিন মাসের মধ্যেই ব্রিটিশ সরকার এই ‘অনৈতিক’ বইটির ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বইটির মাত্র পাঁচটি আসল কপি বর্তমানে সংরক্ষিত রয়েছে। তিনি তাঁর চম‌ৎকার লেখনী শক্তি এবং একজন গাইনোকলজিস্টের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মেয়েদের যৌনশিক্ষা এবং জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি বিষয়ে জ্ঞানদানের চেষ্টা করেছেন। কিছুদিন আগে ইংরেজি ভাষায় বইটির একটি অনলাইন সংস্করণ বের করা হয়েছে।

‘আঙ্গারে’ বইটিতে জাহানের লেখা দুটো ছোটগল্পের একটি ‘দিল্লি কি সাইর’, গল্পটি মাত্র তিন পৃষ্ঠার কিন্তু এতে পর্দার আড়ালে নারীর জীবন এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের সামাজিক অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় গল্প ‘পর্দা কি পিছে’-তে ধনী এবং সম্ভ্রান্ত দুই মুসলিম পরিবারের দু’জন মহিলার মধ্যে কথোপকথন তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর কিছু লেখা বিভিন্ন সংকলন যেমন—‘আওরাত আউর দুসরে আফসানা ওয়া ড্রামে (১৯৩৭)’ এবং ‘বো আউর দুসরে আফসানা ওয়া ড্রামে’-তে সংকলিত হয়েছে।

১৯৫২ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে রশিদ জাহান ইউটেরাস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে রাশিয়ার মস্কোতে চিকি‌ৎসা নিতে যান এবং সেখানেই একটি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সেখানকার এক সিমেট্রিতে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। রশিদ জাহান সত্যিকার অর্থেই মানুষের কথার বলার চেষ্টা করেছেন বারবার। উর্দুভাষায় সাম্যবাদী ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন প্রতিনিয়ত। তিনি কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেননি, সমগ্র বিশ্বের শোষিত মানুষের পক্ষে লড়েছিলেন।



বাংলাদেশ সময়: ১৫১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।