ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

এককথায়, যুগীদের দুঃখ সমুদ্র সমান | আবু রাশেদ পলাশ

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০১৫
এককথায়, যুগীদের দুঃখ সমুদ্র সমান | আবু রাশেদ পলাশ

- টীর ছাও ডুইব্যা মর, সুরত দেকি পিত্তি জ্বলে।
- ইতা কেমুন কও বুবু, বেটিনি বিয়াইছো হাঁচা?
- দিলের বেদনগো বু, কওননি যায়?
আজকাল প্রায়ই মুখে শ্রাব্য-অশ্রাব্য কথার তুবড়ি ছোটে নঙ্ক’র।

দিনমান যুগীকে উদ্দেশ্য করে অভিসম্পাত করে সে। মা গালিগালাজ করলে পলিথিনে ঘেরা ডেরার ভেতর বসে অশ্রু বিসর্জন দেয় যুগী। লোকচক্ষুর সামনে এসে প্রতিবাদ করে না সহসা। পাশের ডেরার হনুফা যুগীর হয়ে দু’একটি কথার জবাব দেয় মাঝেমাঝে। পরক্ষণে নঙ্ক’র তীক্ষ্ণ বাক্যবানে আক্রান্ত হলে নিজের ঘরে বসে গজগজ করে, “বিয়ানকালে চেতছে বুড়ি বিষ উঠছে মালুম অয়। ”

বাংলাদেশে নদীগুলো আষাঢ় মাসের শেষ নাগাদ যুবতী নারীর রূপ নেয়। জলের ধারা থৈ থৈ করে। বেদে নৌকার বহরগুলো উত্তাল ঢেউয়ে দোল খায়। বেদে ছেলে-মেয়েদের মনে জোয়ার আসে তখন। নৌকা চলে গ্রাম-গ্রামান্তরে, দেশ-দেশান্তরে। সওদাগরী ঘাটে নৌকা থামে কখনো কখনো। মেয়েরা ফেরি করতে বের হয়। ছেলেরা ঘরকন্যার কাজ করে। হাটুরে দলের একজন হয়ে বাজারে গেলে দিনমান চোখে পড়ে বেদেদের। ওরা জলে ভাসা মানুষ। জীবিকার সন্ধান করে হাটে হাটে, ঘাটে ঘাটে।



নঙ্ক’র শরীর খারাপ হলে অন্যদের সাথে পণ্য ফেরি করতে যেতে পারে না সে। নিরুপায় হয়ে যুগী তখন নিজের তৈরি পণ্যগুলো ফেরি করতে বাজারে যায়। সেখানেই নসুর সঙ্গে দেখা হয় তার। ফেরার পথে নসু ওকে এগিয়ে দেয়। তারপর বাজারে কেনা সস্তা দরের কিছু প্রসাধনী হাতে দিয়ে বলে, “হগগল তোমার। পিন্দে দেহায়ও কলাম। ” সহসা কথা বলে না যুগী। নসুর দেওয়া জিনিসগুলো নিয়ে কাপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে ফেলে। তারপর বলে, “আমরার গাঁও যাইস নচেৎ মুনে গোস্যা থুমু



বড়াল নদীতে বেদে নৌকার বহর দেখা যায় অগ্রহায়ণের শেষ অবধি। ঋতু পরিবর্তন হলে নদীতে পানি শুকায়। নদীর গতিপথ ক্রমশ দুর্বোধ্য হতে থাকলে বেদে নৌকাগুলো একসময় চরে গিয়ে ঠেকে। পৌষ মাসের শুরুতেই নদী শুকিয়ে মরা গাঙের রূপ নেয়। শুদ্ধ জলের নিচে সাদা বালু চিকচিক করে তখন। নিরুপায় হয়ে নদীতীরে অস্থায়ী বসতি গড়ে বেদেরা।

দড়িপাড়া গ্রামের উত্তরে বড়াল নদীর তীর ঘেঁষে একদল বেদের বাস। ওরা এ গাঁয়ের স্থায়ী বাসিন্দা নয়। নদী বাস-অনুপযোগী হলে সম্প্রতি এখানে এসে বসতি গড়েছে। এ পাড়ার খড়িমণ্ডল নদীপাড়ের অনাবাদী জমিটা ছেড়ে দিয়েছে ওদের। সুযোগ বুঝে দশ বারোটা ডেরা তুলে নিয়েছে বেদেরা। এগুলোর চারপাশে দৈন্যতার ছাপ। চালাগুলো পলিথিন আর অব্যবহৃত সিমেন্টের বস্তায় মোড়ানো। বিকেলে নদীতে দাপাদাপি করতে এসে গাঁয়ের ছেলেরা ওদের ঘরগুলোর পাশে জটলা করে। সুযোগ বুঝে সভ্য পাড়ার ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব করে কেউ কেউ।

- হামাকনি একখান বিড়ি দিবাম মিয়া ভাই?
- নিয্যস। লও বিড়ি খাই।

নসু আর হর এদেরই দলে। একজন মুসলমান পাড়ার ছেলে অন্যজন জাতবেদে। তবু ওদের বন্ধুত্ব হয়েছে সম্প্রতি। নসু পাখি পোষে, গাঁয়ের দক্ষ হাডুডু খেলোয়াড় সে। নামাকলি বাজারে একটা পান বিড়ির টঙ দোকান আছে তার।

বেদেপাড়ায় পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব মেয়েদের। সে অর্থে ছেলেরা অলস। পড়ন্ত বয়সী অস্তালী এ বেদে পাড়ার সরদার। বেদেরা সবাই সমীহ করে তাকে। বেদে নারীদের কর্মক্ষেত্র ঠিক করে দেয় সে। এক দলে তিন-চার জন। কর্মক্ষেত্র ঠিক হলে মেয়েরা ধলপ্রহরে মাথায় সাপের ঝাঁপি অথবা তন্ত্র-মন্ত্র করার সরঞ্জামাদি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বেদে নারীদের মধ্যে নানকি, হনুফা, নঙ্ক আর হবিরন একই দলে ফেরি করে। শুকনো মৌসুমে দড়িপাড়ার দহলিজে ওদের কণ্ঠ শোনা যায়। “আয়গো মা, বুঝি খেলা দেখবামনি কেউটে, দাঁড়াশ, কালনাগিনী”...

বেদেপাড়ার নঙ্ক’র বারো বছর বয়সী মেয়ে যুগী সংসারের হাল ধরেনি এখনো। এ বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রচলন বেদে পাড়ায়। যুগী অবিবাহিত। ওর বাপ মনুবেদে মারা গেছে বছর ঘুরতে চলল। সংসারে মা মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। নঙ্ক পাড়া ঘুরে সাপ খেলা দেখায়, তাবিজ কবজ বেচে যা উপার্জন করে তাই দিয়ে সংসার চলে ওদের। উপার্জন না হলে ঘরে উপোস সময় কাটায় দুজন। এ দৃশ্য বেদেপাড়ার ঘরে ঘরে। নঙ্ক বাড়ি না থাকলে যুগী নদীতে শামুক কুড়ায়। নদীপাড়ে পুরনো নৌকা মেরামতের অপেক্ষায় থাকে। নৌকার গলুইয়ে বসে নসু আর হর ছিপে বড়শি লাগানোর কাজ করে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে শামুকে মালা গাঁথে যুগী। গাঁথা মালা বাজারে বেচে দেয় হর।

আজকাল প্রায়ই নসুকে বেদেপাড়ায় আসতে দেখা যায়। ও এলে মাটির কলকিতে তামাক সাজিয়ে দেয় হর। হুঁকা টানার ছল করে মনে মনে যুগীকে খোঁজে নসু। দৃষ্টিগোচর হলে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। রাতে বাড়ি ফিরে যুগীকে নিয়ে এলোমেলো ভাবনায় মজে অনেকক্ষণ।

নামাকলি বাজারে অষ্টমীর হাট বসেছে ক’দিন হলো। বিকেলে জোয়ান বুড়ো সবার ঢল নামে সে উপলক্ষে। বেদেরা বাহারি পণ্যের পসরা নিয়ে বসে বাজারে। ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ, আবার সাপ খেলা দেখায় কেউ কেউ। বেদে মেয়েরা মুখে মুখে ছড়া কাটে—“খা খা খা বখ্যিলারে খা, কিপটারে খা, কঞ্জুসরে খা। গাঁইটে টেকা বান্ধে যে না দেয় বাইদেনিরে; মা মনসার ছেরি তাদের খা খা করে খা। ” নঙ্ক’র শরীর খারাপ হলে অন্যদের সাথে পণ্য ফেরি করতে যেতে পারে না সে। নিরুপায় হয়ে যুগী তখন নিজের তৈরি পণ্যগুলো ফেরি করতে বাজারে যায়। সেখানেই নসুর সঙ্গে দেখা হয় তার। ফেরার পথে নসু ওকে এগিয়ে দেয়। তারপর বাজারে কেনা সস্তা দরের কিছু প্রসাধনী হাতে দিয়ে বলে, “হগগল তোমার। পিন্দে দেহায়ও কলাম। ” সহসা কথা বলে না যুগী। নসুর দেওয়া জিনিসগুলো নিয়ে কাপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে ফেলে। তারপর বলে, “আমরার গাঁও যাইস নচেৎ মুনে গোস্যা থুমু। ”

ডাঙায় থাকলে রাতে আগুনের ঢিঁবি জ্বালিয়ে একসঙ্গে জটলা করে বেদে পাড়ার সবাই। ভাতপচা মদ খেয়ে ছেলেরা নেশায় বিভোর হয়। ঘরের বউয়েরা অগোছালো নৃত্য করে মাতলামিতে উৎসাহ দেয়। তারপর পরিবারের কর্ত্রীরা দিনভর উপার্জনের একটা অংশ সরদারকে ভোগ দিলে সেদিনের মতো উৎসবের ইতি টানে সবাই।

অসুস্থতার দরুন কর্মহীন থাকলে সরদারের মজুরী দিতে পারে না নঙ্ক। এজন্য সরদারের সঙ্গে তার কলহ হয়। একপর্যায়ে ওকে উদ্দেশ্য করে অশ্লীল বাক্য বিনিময় করে সরদার, “বেশ্যা মাগীর তেলা গাঁও বানের জলে ভাসান দিমু ডরাইস। ”

বেদে সরদার কলহ করলে বহরের কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করে না। এ পাড়ায় সবাই যমের মতো ভয় করে ওকে। ভালোমন্দ সমস্ত সিদ্ধান্তের মালিক সে। বেদে পাড়ায় তার কথাই আইন। তাই আজকের এ অপরাধে সরদার যে সিদ্ধান্ত দিবে তাই মানতে হবে নঙ্ককে।

রাত বাড়লে নীরবতা নামে বেদেপাড়ার ঘরে ঘরে। একটা একটা করে পিদিম নিভে যায় সর্বত্র। নদীপাড়ে হিম বাতাস এসে গায়ে লাগলে মুহুর্মুহু কম্পন হয় শরীরে। নিজের ঘরে পিদিমের শেষ আলোটা নিভিয়ে নির্ঘুম রজনী কাটায় নঙ্ক। যুগী ঘুমিয়ে গেলে শাড়ির আঁচলটাকে শক্ত করে গুঁজে নেয় কোমরে। তারপর লোকচক্ষুর অন্তরালে বেদে সরদারের ঘরে ঢোকে। আজ রাতে নপুংসকের দেহক্ষুধা মেটানোর দায়িত্ব ওর। আর সবার মতো সরদারকে যথেচ্ছ মজুরী দিতে পারেনি। এ কি আর যেইসেই অন্যায়? দিনের পর দিন যেখানে শুধু বেঁচে থাকার সংগ্রাম সেখানে আত্মসম্ভ্রমের মূল্য কী? নঙ্করা শুধু বেঁচে থাকতে চায়। তারপর সেদিন রাতভর সরদারের ঘরে মেয়ে মানুষের গোঙানোর আওয়াজ শোনা যায়।

পরদিন বেলা করে বিছানা ছাড়ে নঙ্ক। শরীর ব্যথায় উঠতে পারে না সে। বেদেরা সাপের চর্বি দিয়ে বিশেষ প্রকারের তেল তৈরি করে। এটা ব্যথা নাশক। বেদে নারীরা তাদের পুরুষদের ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে সকাল সন্ধ্যা দেহে তেল মালিশ করে। বেলা বাড়লে যুগী তেল গরম করে এনে দেয় নঙ্ককে। তারপর বলে, “অহন উইঠ্যা সিনান দে নিমাই, শইল ভালা পাবি মালুম অয়। ”

ফাল্গুনের শেষদিকে আগুনরূপী গরম পড়ে গাঁয়ের সর্বত্র। অনাবাদী জমিগুলো ফেটে চৌচির হয়। মধ্যাহ্নে ক্ষুধার্ত কাকের কর্কশ কণ্ঠ কানে এলে মনে হয় আসমান ভেঙে গুড়োগুড়ো হলো। গাঁয়ের দরিদ্র মানুষগুলোর ঘরে ঘরে অস্ফুট আর্তনাদ চলে দিনভর। অভুক্ত ছেলে বুড়োর দিকে তাকালে বুকের হাড় গোনা যায় ওদের।

এমনই একদিন দড়িপাড়ায় বিচলিত হয় খড়িমণ্ডল। তার আটবছর বয়সী মেয়ে অজিফার নিথর দেহ পড়ে থাকে দহলিজে। ওকে ঘিরে গাঁয়ের নর-নারী জটলা করে বেলার শেষ অবধি। মণ্ডলের বউ মরিয়ম কন্যাশোকে বড় ঘরের মেঝেতে গড়াগড়ি দেয়। তারপর গগনবিদারী আর্তনাদ করে সে, “আয়গো খোদা জাননি মোর ছদগা দিমু বেটিরে ফিরত দেও। ” অজিফাকে সাপে কেটেছে সকালে। বেদে পল্লীতে খবর গেলে সাপের বিষ ঝাড়তে যেতে হয় নঙ্ককে। ওর সাথে আরো জনপাঁচেক লোক যায় মণ্ডল বাড়ি। ওদের ঘিরে কৌতূহলী দৃষ্টি সরে না গেঁয়োদের। নঙ্ক বলে, “কেউটেগো, অমুন বিষ ছাড়ান দায়। ” ও অপারগতা প্রকাশ করলে ধমক দেয় সরদার, “বিষ টান মাগীর ছাও, আপনা জান ছাড়ান দে। ” তারপর দিনভর অজিফাকে ঝাড়-ফুঁক করে বেদেরা। মাঝেমাঝে সুরেলা কণ্ঠে গীত করে কেউ কেউ:

“নাজানি রমণী কতনা ছলনা জানো
সাপের মুখত খায়ে চুমো ব্যাঙকে কুলে টানো
ও তর সাধন কিয়ে প্রাণ ও তর ভারি দেখি মান
হে যেন মান করা নয় মানুষ মারা বিষ মাখানো বান”

কিন্তু তাতেও কাজ হয় না। অজিফার নিথর দেহ আগের মতোই পড়ে থাকে। অবশেষে সরদার জানায়, “এ বিষ ছাড়ুনের নয়গো আমরারে ক্ষেমা দেন। ”

আজকাল ঘন ঘন বেদে পল্লীতে আসা যাওয়া করে নসু। দিনের শেষবেলা পর্যন্ত হরের সাথে বসে খোশগল্প করে। এখানে এলেই মনে মনে যুগীকে খোঁজে। বেদেপাড়ার যুগীর সাথে মন দেওয়া নেওয়া করছে সে কিছুদিন হলো। বারোবছরী চপলা—নসু এলে মনে মনে উতলা হয়, আশেপাশে আনাগোনা করে। তারপর ঘরের দাওয়ায় বসে সবজি কাটার বাহানা করে নসুর সাথে অব্যক্ত ভালোবাসার আদান প্রদান করে। নামাকলি বাজারে গেলে ফেরার পথে মাঝেমাঝেই পথ এগিয়ে দেয় নসু। দুরন্ত যৌনাকাঙ্ক্ষী নসু সন্ধ্যার অন্ধকারে নরম হাত চেপে ধরলে যুগীর দেহে বিদ্যুৎ খেলে। রাতে পিদিম নেভা ঘরে ঘুমঘুম ভাব করে নসুকে নিয়ে ভাবে যুগী। তারপর বেদেদের জীবন ছেড়ে সভ্য পাড়ায় এসে নিশ্চিত জীবনের স্বপ্ন দেখে।

চৈত্রের গোড়ায় বিয়ের ধুম পড়ে বেদেপল্লীতে। এ পাড়ার নানকি স্বামী হিসেবে পেতে চায় হরকে। হর আপত্তি করে না তাতে। নানকি মেয়ে ভালো, দেখতেও বেশ। সবচেয়ে বড়কথা কর্মঠ সে। ওর সংসারে এলে ভালো থাকবে হর। বন্ধুর বিয়ের খবর পেয়ে নসু এলে হর বলে, “আমরার শাদির নেমন্তন নেও, হগল কাম তোমরার কলাম। ”

হর-নানকির বিয়েকে কেন্দ্র করে উৎসবে মাতে বেদেরা। বেদে ছেলেরা ঢোল বাজালে মেয়েরা সুশৃঙ্খল নৃত্য করে তালেতালে। নসু এলে মাথায় জপজপে তেল দেয় যুগী। তারপর ট্রাঙ্কে রাখা গোলাপি শাড়ি সভ্যপাড়ার মেয়েদের মতো কোমরে কুঁচি দিয়ে পরে সে। নসু পানি চাইলে হুঁকাসমেত এক গেলাস পানি এনে দেয় যুগী। তারপর বলে, “যাইওনা শিগগির। চেপা মাছের বেনুন রান্ধুম খাইয়ে যাইও কলাম। ”

অবিবাহিত ছেলে মেয়েরা বেদে পাড়ার বিয়েতে বরপক্ষ আর কনেপক্ষে বিভক্ত হয়। নানা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে সময় সময় কলহ করে ওরা। সরদার ধমক দিলে কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা নামে। তারপর বরপক্ষের মেয়েরা গীত করে হরকে নিয়ে:

“মাটি করব মাঠা মে, পর ভরউয়া করব ঘাটা মে
চল হে দেউরা, পাটা পূজা বেলা হলে রে হলে...”

বিয়ের শেষে মালা বদল করে বর কনে। তার আগে আরো আনুষ্ঠানিকতা করে বেদে ছেলেরা। পরমুহূর্তে নানকি মালা পরাতে গেলে হঠাৎ কী ভেবে গাছে উঠে বসে হর। হরের এহেন কর্মে চমকে ওঠে নসু। তারপর নিয়ম অনুসারে স্বামীর মান ভাঙাতে গীত করে নানকি:

“ভাত দিমু কাপড় দিমু হগল দিলাম কতা
নাইম্যা আহই সোয়ামী কই জুরাই মুনের ব্যথা
পুলা পালুম বেটি পালুম কামাই করুম মুই
রান্ধুম বাড়ুম হগল করুম নাইম্যা আহই তুই”

নানকির মুখে ভরণপোষণের ভরসা পেয়ে গাছ থেকে নেমে আসে হর। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে বেদেপাড়ার সবাই ভাতপচা মদ খেয়ে নেশায় মাতে। তারপর নিথর হয়ে পড়ে থাকে একেকজন। বেদে পাড়ার নস্কর কখন যেন মদ খাইয়ে দিয়েছে নসুকে, বোঝেনি যুগী। নেশায় বিভোর হলে বেদে ছেলেদের সাথে আমোদে মাতে নসুও। তারপর কী একটা কথা নিয়ে নস্করের সাথে কলহ বাঁধায়। নিরুপায় হয়ে নসুকে নিজেদের ডেরায় রাতযাপনের ব্যবস্থা করে দেয় যুগী। সকালে যখন বেদে পাড়ার ছেলেদের ঘুম ভাঙে, নসু তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। যুগীকে পাশে দেখে কানাঘুষা করে সবাই। রাতে যুগীর চরিত্র হরণ করেছে নসু—এ অভিযোগে পাড়ার ছেলেরা ধরে ওকে মারধর করে। তারপর বেদে বহর থেকে নসুকে বের করে দেয়া হয়। রাতে বেদে পাড়ায় যুগীকে বিষয় করে জটলা করে বেদেরা। চিৎকার করে সরদার, “চরিত্তর আচেনি মাগীর, ভাতাররে ভোগ দিচে কাইল। ”

- হ কতা হাঁচা, এহেন কম্ম ছাড়ুনের নয়।
- জহুর ভিটায় আগুন দে পুড়াই মারুম মাও বেটিক।

নসুকে মারার খবর দড়িপাড়ায় পৌঁছলে প্রতিশোধপরায়ণ হয় গেঁয়োরা। বেদে ছেলেদের এহেন অপকর্ম ছেড়ে দেওয়া যায় না। নসু কি আর যেইসেই লোক। এ পাড়ায় অনেকেই সমীহ করে তাকে। খবর খড়িমণ্ডলের কানে পৌঁছলে হুঙ্কার করে সেও। চালচুলোহীন বেদেরা এমন সাহস পায় কিভাবে? হ্যাঁ, ছাড়বে না গাঁয়ের ছেলেরা, প্রতিশোধ নিবে শীঘ্রই। এরপর সুযোগ বুঝে একদিন বেদে ছেলেদের বাজারে আটকে মারধর করে সবাই।

বেদে পাড়ায় যুগীর এহেন অপকর্মে নাখোশ নঙ্কও। রাত-দিন সবার সাথে সেও অভিসম্পাত করে তাকে। হনুফার নিষেধ মানে না সহসা। তারপর অজানা আশঙ্কায় অশ্রু বিসর্জন দেয় সে। বেদে সরদার মন্দলোক, যুগীকে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র সে নয়। নিশ্চয়ই শাস্তি দেবে।

তারপর একদিন হঠাৎ গভীর রাতে সরদারের ঘরে আবারও মেয়ে মানুষের আর্তনাদ শোনা যায়। যুগী রীতিমত চিৎকার করে সেখানে। শব্দ শুনে শিশুদের ঘুম ভেঙে গেলে কানে তুলা গুঁজে দেয় মায়েরা। তারপর ঘুমানোর বাহানায় যুগীর কুসুমসদৃশ দেহে কারো লৌহচালন অনুভব করে সবাই। প্রতিবাদ করে না কেউ। আজ রাতে বেদে সরদারের ভোগ্যপণ্য হয়েছে যুগী।

বড়াল নদী বর্ষায় আবার যৌবনমতি হয়। ওর দেহের উত্তাল ঢেউয়ে সূর্যের খেলা চলে তখন। শ্রাবণ মাসের কোনো একদিন বেদে সরদার অনুমতি দিলে আবার নাও ভাসে স্রোতজলে। আগামী কয়েকমাস আবার পানিতে ভেসে বেড়াবে বেদেরা। তারপর শুষ্ক মৌসুমে কোনো অচেনা গাঁয়ে বসতি গড়বে আবার।

হর-নানকির বিয়ের পর নসু কোনোদিন আর বেদে পল্লীতে আসেনি। হর নিজেও যেচে কোনোদিন মিশতে যায়নি ওর সাথে। একদিন রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে যুগী নামাকলি বাজারে গেছিল হরের সন্ধানে। হিন্দুপাড়ার মনোহর বলেছিল, অনেকদিন বাজারে আসে না নসু। নদীজলে নৌকা ভাসলে উত্তাল ঢেউয়ে দোল খায়। নঙ্ক’র নৌকায় শুধু পিনপতন নীরবতা। গলুইয়ে বসে যুগী অশ্রু বিসর্জন দিলে দু’ফোঁটা অশ্রু নদীজলে মিশে একাকার হয়। জীবনে আসা যাওয়ার পথে সরদার ও নসু—দুজনকেই নপুংসক মনে হয় যুগীর। দুজনই সুযোগে ব্যবহার করেছে তাকে। একজন দেহে, একজন মনে।

অনেক বছর পর আবার কোনো এক বর্ষায় নদীর ঘাটে দাঁড়ালে জেলে নৌকায় সুর শোনা যায়—“কই যাওরে ভাটিয়াল নাইয়া, ললিত সুরে গাইয়া গান”... নদী নাব্যতা হারালে বেদে জীবনের অবসান হয় কোথাও কোথাও। কোনো কোনো বেদেদের স্থায়ী বসতি হয় ডাঙায়। কিন্তু তাতে যুগীদের জীবনের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। জলের নপুংসক স্থলে এসেও কেউটের বিষ ছড়ায়। পুরনো বড়াল নদী একালে এসে যুগীদের চোখে ঠায় নেয়। কোনো একদিন গড়িয়ে পড়া দু’ফোঁটা অশ্রু নদীর জল গ্রাস করে সমুদ্রকেও গিলে খায়। এককথায়, যুগীদের দুঃখ সমুদ্র সমান।



বাংলাদেশ সময়: ১৮০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।