ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রূপান্তর: ফ্রানৎস কাফকার দুঃস্বপ্ন ও নদী | এনামুল রেজা

পাঠপরবর্তী ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৫
রূপান্তর: ফ্রানৎস কাফকার দুঃস্বপ্ন ও নদী | এনামুল রেজা

বাইরে তুমুল ঝিঁঝি ডাকছে—এরা মাটির ঢিপিতে দিনমান ঘুমায়, বেরিয়ে আসে সন্ধ্যার পরপর। এখন রাতের দ্বিতীয় প্রহর বলেই তাদের ডাক বাতাসে তীব্র বাড়ি খাচ্ছে।

হালকা শীতে চারদিকে বইছে কেমন ঝমঝমে আবেশ, লিখছি ছোটবোনের পড়ার টেবিলে ল্যাপটপ রেখে—ছুটিতে চন্দনীমহল এসেছি। কাল সকালে উঠে যদি নিজেকে আবিষ্কার করি অমন আস্ত, আপাত চোখে কুৎসিত এক ঝিঁঝিপোকা হয়ে বিছানায় পড়ে আছি, কেমন হবে বিষয়টা? আম্মা বিছানার চাদর তুলে আমায় দেখে কি চিৎকার দিয়ে উঠবেন—ও আল্লা, এ কী হলো! রেজা কই গেলি এ সাতসকালে ফের? ছোটবোনেরা ভেবে নেবে ভাইয়া নিশ্চয়ই বাইরে গেছে কোনো এক ফাঁকে, সুতরাং তার চাদরের নিচে ঘাপটি মেরে থাকা কিম্ভুত মাকড়টিকে ঝেঁটা মেরে তাড়ানো উচিত; আব্বা পোকাটা ফেলে আমাকে খুঁজতে বেরুবেন?

একজন সত্যিকার লেখককে প্রতিমুহূর্তে নিজের শিল্পের কাছে সৎ থাকতে হয়, এ নিয়ে আমার বিশ্বাস স্রষ্টায় বিশ্বাসের পরেই অবস্থান করে, অস্বীকার করবার কিছু নেই—ফ্রানৎস কাফকার রূপান্তর শেষ করে অনুভূতিটা হলো—হুট করে আমি এক সকালে অমন বদলে গেলে পোকায়?



এখন এই যে হুট করে একটা মানুষ, যে কি না পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম লোক আর খুব কর্মঠ, জীবন যার কাছে কঠিন হলেও স্বপ্নগুলো মরে যায়নি, মা-বাবা আর সতেরোয় পড়া ছোটবোন গ্রেটিকে নিয়ে মোটামুটি সুখের সংসার—কেনইবা এক সকালে সে পোকা হয়ে যায় আঁৎকা? পুরো বিষয়টাকে সরলাংকে জাদু বাস্তবতা বলে মনে হয়, আসলে কি তাই? বরং, রূপান্তর নিখাদ বাস্তবতার গল্প, নিরেট এবং এক নিম্নমধ্যবিত্ত জার্মান পরিবারের



কাফকা বিষয়ে শেষ দু’বছর এদেশে সম্ভবত সবচে বেশি আলাপ হয়েছে; বইটা (মাসরুর আরেফিন অনূদিত ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র) প্রকাশের আগে থেকে শুরু হয়েছিল আলাপ, শহরের জনবহুল মোড়গুলোতে বইয়ের বিশাল বিশাল সুদৃশ্য পোস্টার, এমনকি যেসব লোক সাহিত্য নিয়ে কোনোকালে আগ্রহী ছিল না, তারাও পথে হাঁটতে কিংবা লোকাল বাসে দুলতে দুলতে গুজগুজ করতে শুরু করেছিল, জিনিসটা কী? কাফকা নিশ্চয়ই এক মহামানব আর তার গল্পসমগ্র হলো সেইরকম বস্তু, নইলে বইয়ের ওধারা বিজ্ঞাপন এ দেশে কে কবে দেখেছে?

বই হাতে নিয়ে দেখলাম, অনুবাদক নিজেই এত বেশি কথা বলেছেন কাফকাকে নিয়ে, গত পঞ্চাশ বছরে এককভাবে কেউ বাংলা ভাষায় ওই জার্মান লেখকটিকে নিয়ে এত কথা বলেননি। আমি একরকম ধাঁধায় পড়ে গেলাম, যেহেতু কাফকা বিষয়ে আমার জানাশোনা তখন অতি সামান্য, কেবল তার ক্ষুধাশিল্পীর অনুবাদ পড়েছি সেবা প্রকাশনীর হাত ধরে, ওতেই তবদা খেয়ে গেছি তার বিষয়ে—এক লোক যে দিনের পর দিন অনশনে কাটিয়ে দেয়, টিকেট কেটে তাকে লোকজন দেখতে আসে, না খেয়ে থাকার বিশ্বরেকর্ড করতে চাওয়া লোকটির পরিণতি আমাকে ভিতরে ভিতরে কাঁদিয়ে ছাড়ে। কাফকা কি আসলে ঊনিশ শতকে দাঁড়ানো সাহিত্যের একজন প্রফেট? নাকি তিনি হয়ে দাঁড়িয়েছেন একটা মানদণ্ড যাতে বিশ্বাস করে অনুবাদক বলে ফেলতে পারেন—আধুনিক বিশ্বের দিকে তাকানো এক অর্থে কাফকার চোখ দিয়ে তাকানো!

কাফকা পড়লে পাঠক হিসেবে আপনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন, পরপর দুটো ইচ্ছে আপনার মনকে কুরে খেতে শুরু করে। এক, আপনি পণ করেন, এ লেখককে আর কখনো পড়বেন না একান্ত কিছু ব্যতিক্রম হাতে রেখে। দুই, আপনি মাত্র শেষ করা গল্পটা নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে যান এবং সুযোগ মতো ওই একই গল্প আবার পড়তে বসেন। সুতরাং কাফকা সাহিত্যের প্রফেট কি না এ আলাপ বাদ দিয়ে আমি ধরে নেই, অনুবাদক নিজে দ্বিতীয় দলের পাঠক, তিনি উত্তেজিত হয়েই এসমস্ত কথা বলেছেন—একান্ত ভক্তের চোখে কাফকা তার কাছে ধরা পড়েছে, তিনি বিশ্লেষণে না গিয়ে কাফকা বিষয়ক মুগ্ধতাই ছড়িয়েছেন একরোখা গতিতে।

এদিকটাই সহজ অর্থে রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল—মাসরুর আরেফিনকৃত অনুবাদ গ্রন্থটা গল্পের এক অফুরন্ত ভাণ্ড হিসেবেই হাতে উঠিয়ে নিয়েছিলাম। যেখানে শুধু গল্পগুলোই উপভোগ করতে পারব, কোনো একটা লেখা ভুল করেও আমার সামনে কাফকার পোস্টমর্টেম তুলে ধরবে না। কিন্তু কোনো গল্পই শুরু করে শেষ করা হয় না, ব্রেসসায় উড়োজাহাজ দু’পাতা পড়ে আমি চলে যাই গির্জায় আসা রমণীর সাথে লেখকের আলাপ আর না হয় ঢুঁ মারি এক গ্রাম্য ডাক্তারের ওপর। এই করতে করতে যখন বছর পেরুতে থাকে, নিজেকে সান্ত্বনা দেই—সময় হয়নি, আমার এখনো সময় হয়নি কাফকার কাছে যাবার।

সুতরাং এদ্দিন বাদে যখন মনে হলো, সময় এসেছে, আমি কাফকা আবার পড়ি—স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে নজর যায় রূপান্তরের দিকে—যাবেই, যা দেখেছি, এ গল্পটা ট্রায়ালের চেয়েও বিখ্যাত, মেটামরফোসিস নামে রোমান কবি ওভিদের যে মহাকাব্য আছে লাতিন ভাষায় (যেহেতু ওভিদ লাতিন ভাষার কবিই ছিলেন, আর আমার পক্ষে হিব্রুতে গল্প লেখা সম্ভব না), ওতে দুর্দান্ত সব রূপান্তরের কাহিনীগুলো আছে—যেখানে নার্সিসাস হয়ে যায় গাছ কিংবা জিউস যৌনকাতর হয়ে ষাঁড়ে রূপান্তরিত হন, ষাঁড়ের বেশেই মিলিত হন কাঙ্ক্ষিত নারীর সাথে! অনুমান করি কাফকা তার গল্পের নামকরণে ওভিদ থেকেই উৎসাহ পেয়ে থাকবেন। আবার এপুলিয়াসের গোল্ডেন এ্যাসও (যার লাতিন অর্থও রূপান্তর) তাকে মুগ্ধ করে থাকবে হয়ত—এই রূপান্তর আরো বিচিত্র—এপুলিয়াসের নায়ক জাদু ব্যবহার করে পাখি হতে চায় কিন্তু ভ্রান্তিজনিত কারণে সে মানুষ থেকে বদলে যায় গাধায়।

আলোচ্য গল্পটির মূল চরিত্র গ্রেগর সামসা (সেই শুনতে শুনতে ক্লিশে হয়ে যাওয়া অথচ বুকে বেদনার ঝড় তোলে যে নামটি) একজন ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যান, যাকে নিত্যদিন ভোর চারটার ট্রেন ধরতে হয় অফিসের জন্য, এক সকালে ঘুম ভেঙে দেখল চার পেরিয়ে পেরিয়ে সাত বেজে যাচ্ছে, রোজকার সময়ে তার ঘুম ভাঙেনি বরং সে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় আকারের এক পোকা হয়ে।

দুই.
আমি জানতাম এখান থেকেই শুরু গল্পটা। গ্রেগরের পোকায় রূপান্তর হবার সকালটি থেকে, কিন্তু পড়তে পড়তে আবিষ্কার করি মূল গল্প শুরু হয় তখন—যখন বেলা বাড়ে, গ্রেগর তার রুমের বন্ধ দরোজার ওপাশ থেকে জান্তব কণ্ঠে কথা বলতে থাকে, তার অফিসের বড় কেরানী চলে আসেন খোঁজ নিতে কী হলো এমন যে, অফিসে যেতে পারেনি সে? গ্রেগর এর কিছুক্ষণ পর মুখ দিয়ে চাবি কামড়ে ধরে কোনো রকমে নিজের দরোজা খুলে উঁকি মারে বাইরে, তার পোকায় রূপান্তরিত অবস্থা দেখে মা অজ্ঞান হয়ে যান, কেরানী দৌড় মারেন এবং বাবা ভয় পান—ক্রোধান্বিত হন, কেরানীর ফেলে যাওয়া ছড়িটা নিয়ে তার দিকে ধেয়ে আসেন, গ্রেগরকে বাধ্য করেন নিজের রুমে ফিরে যেতে।

এখন এই যে হুট করে একটা মানুষ, যে কি না পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম লোক আর খুব কর্মঠ, জীবন যার কাছে কঠিন হলেও স্বপ্নগুলো মরে যায়নি, মা-বাবা আর সতেরোয় পড়া ছোটবোন গ্রেটিকে নিয়ে মোটামুটি সুখের সংসার—কেনইবা এক সকালে সে পোকা হয়ে যায় আঁৎকা? পুরো বিষয়টাকে সরলাংকে জাদু বাস্তবতা বলে মনে হয়, আসলে কি তাই? রূপান্তর নিখাদ বাস্তবতার গল্প, নিরেট এবং এক নিম্নমধ্যবিত্ত জার্মান পরিবারের। সেখানে কারো হুট করেই আকাশে উড়ে যাবার সম্ভাবনা নেই আবার নেই আলাদিনের জাদুর চেরাগে ঘষা দিয়ে দৈত্য বয়ে আনবার অবকাশ। এ দুটি উদাহরণই মেটাফোরিক মহত্ব মণ্ডিত, আমি বলছি না গল্পে অমন হওয়াটা অস্বাভাবিক—গল্প তৈরিই হয় গরু ও ঝড় থেকে আবার গরু-ঝড় গল্পে আসে বাস্তব থেকেই। গার্সিয়া মার্কেসের উড়তে উড়তে হারিয়ে যাওয়া সুন্দরী রেমেদিওস কিংবা মিলান কুন্ডেরার দেবদূতগণ আমাদের মনে বিষণ্ণতা আনে, ভিতরটা কুরে খেতে শুরু করে না। গল্পটায় পরিষ্কার হয়ে ওঠে কাফকার ফ্যান্টাসি নির্মম—যেহেতু তার পৃথিবীটিও নির্মম (গল্পের অবকাশহীন অথচ গল্পময়)।

গ্রেগর সামসা সকাল-সন্ধ্যা হাড়ভাঙা পরিশ্রমেই অর্থ উপার্জন করে, ছুটির দিনগুলোয় পরিবার নিয়ে চলে যায় কোনো অবকাশ যাপন কেন্দ্রে, এ ছাড়া আর কোনো নতুনত্ব তাদের জীবনে ছিল না। কাফকা ঠিক এই স্বাভাবিকতার মাঝে ভয়ঙ্কর গোলযোগ তৈরির জন্য সামসার মেটামরফোসিস কল্পনা করলেন, তাকে বানিয়ে দিলেন পোকা। পোকাটি খোলাচোখে কিম্ভুত, স্বাভাবিক আকৃতির চেয়ে বড় একটা মাকড় কিন্তু আবিষ্কার করতে হয় সে আসলে এক অস্বস্তি—চারপাশ যে নিয়মে চলছে, তার বিরুদ্ধে সে একটা ব্যতিক্রম। যে পুত্রটি ছাড়া পরিবারের কোনো গতি ছিল না, সবার কাছে সে ছিল উন্নতি ও সমৃদ্ধির জীবন্ত প্রত্যাশা, হঠাৎ রূপান্তরে পরিবারের সকলের চোখে তার অবস্থান কেমন বদলে যেতে শুরু করে, আমরা নির্মমভাবে টের পেতে থাকি, এটাই মূলত রূপান্তর।

গ্রেগরের প্রতি নিষ্ঠুরতায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকেন তার বাবা, বৃদ্ধ বয়সে আবার তাকে উপার্জনে নামতে হবে, ক্লান্ত শরীরটিকে আবার নামাতে হবে পথে; এর সমস্ত দায় তিনি চাপিয়ে দেন গ্রেগরের ওপর, তাকে আহত করেন, এমনকি পারিবারিক যেকোন অঘটনে নিশ্চিত ধারণা করে নেন, ওতে হাত (অজস্র পা) আছে পোকায় রূপান্তরিত হওয়া তার পুত্রটির। অপর দিকে অবশ্য দেখা যায় আকস্মিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠবার পর গ্রেগর সামসার মা পুত্রের জন্য ভালোবাসা টের পান, তিনি তাকে দেখতে চান এমনকি তার রুমটিতে মাঝেমধ্যে উঁকি মারেন, যেখানে একটি সোফার নিচে কেটে যাচ্ছিল গ্রেগরের দিবস রজনী। শুধু দেখা যায় গ্রেটি—গ্রেগরের একমাত্র বোন, ভাইয়ের প্রতি স্বাভাবিক খেয়াল ধরে রাখতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তাকে খাওয়াচ্ছে, ঘরদোর পরিষ্কার করে দিয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা গল্পকারের জবানিতে শুনতে পাচ্ছি—এ বোনটির মিউজিক স্কুলে ভর্তি হবার বড় শখ—সে চমৎকার বেহালা বাজায়, আসছে ক্রিসমাসেই গ্রেগর ঠিক করেছিল তাকে মিউজিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে, যত অর্থই লাগুক না কেন। গ্রেগর ভিতরে ভিতরে অনুতপ্ত হয়, পরিবারের এ দুর্দশা আর স্বপ্নভঙ্গের জন্য তার এমন কিম্ভুত পরিবর্তনটাই তো দায়ী অথচ তার কিছু করার নেই, নিয়তি এখানে সবচে বিমূর্ত হয়ে আমাদের কাছে আত্মপ্রকাশ করে।

কাফকা মেটামরফোসিস লেখেন, জীবন আর এর উপাদান কিংবা চরিত্রদের দগ্ধ করেন, বিদ্ধ করেন নির্মমতায়। এর সাথে যোগ হয় সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ, যা তিনি করেছেন আদতে ওই নির্মমতার বিরুদ্ধেই। যেমন, দেয়ালের একটি চিরচেনা পোর্ট্রেট সরিয়ে নিতে চায় গ্রেটা, পোকারূপী গ্রেগর লাফিয়ে ছবিটার ওপর বসে, ছবিটা ওখান থেকে সরাতে দেবে না এই তার পণ—এমনকি ভেবে নেয় বেশি বাড়াবাড়ি করলে সে গিয়ে বসে পড়বে বরং বোনের মুখের ওপর, চলতে থাকে তার কষ্টসৃষ্ট অথচ হাস্যকর নড়াচড়া। যে পৃথিবীর তিনি বাসিন্দা, সেখানে বসে একজন লেখকের ক্ষমতা কদ্দূর বজায় থাকে? গল্পটা পড়তে পড়তে এক মুহূর্তও এ চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না যে, নিশ্চয়ই যা হচ্ছে তা স্রেফ এক দুঃস্বপ্ন, ধুপ করে গ্রেগর ঘুম থেকে জেগে উঠবে অন্য এক ভোরে, আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলব—যাক এসব তো এক দুঃস্বপ্নই ছিল! পুরো গল্পের এমনি মোহ, জীবন্ত এর পরিবেশ; প্রাগের একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত জার্মান পরিবারের সাথে ফারাক মেলে না এমনকি এদেশের অজস্র অমন পরিবারের।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখনও শুরু হয়নি কিন্তু ইউরোপ জুড়ে মাঝে মাঝেই ফুঁসে উঠছে গাঢ় ইহুদিবিদ্বেষ; তা সত্ত্বেও কাফকার লেখায় সরাসরি এসবের কোনো বর্ণনা আমরা পাব না, প্রচণ্ড অন্তর্মুখী এ লোকটি তখন প্রাগের পথেঘাটে হেঁটে বেড়াচ্ছেন, বিয়ারের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছেন, নারীসঙ্গে স্বস্তি খুঁজবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিন্তু কিছুই তাকে শান্তি দিতে পারছে না। প্রতিরাতে দেখা দুঃস্বপ্নগুলো তাড়িয়ে ফিরছে আসলে তাকে দিনমান, কেবল লেখার টেবিলে বসেই তিনি ঢুকতে পারছেন আপন জগতে, যেখানে তিনি নিজেকে ভেবে নিচ্ছেন স্বাধীন। আসলে কি ওখানেও কাফকা স্বাধীনতা পেয়েছেন? মেটামরফোসিসের শব্দগুলো থেকে ভেসে ওঠে—নাহ, স্বাধীনতা তিনি পাননি, পিতার সাথে ব্যক্তি জীবনের দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে গ্রেগর সামসা আর তার বাবার মাঝে দৃশ্যমান নিষ্ঠুর বৈরিতার মাঝে, চেনা জীবনের প্রাত্যহিক জীবিকা নির্বাহের চাপ থেকে মুক্তি পাবার পথ খুঁজতে গিয়ে যে গ্রেগর সামসাকে আঁকতে চাইলেন তিনি, সে অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু অনিবার্য্য দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেল কেবলমাত্র একটা পোকায় রূপান্তরিত হবার পর, যার ফলাফল—মুক্তি নয় আরও নিগুঢ় বন্দিত্ব।

১৯১২ সালের নভেম্বরে ফ্রানৎস কাফকা রূপান্তর লিখেছিলেন, যে বছরটায় বাবা হারমান কাফকার সাথে তার দ্বন্দ্ব পৌঁছে যায় চরমে, পারিবারিক এজবেস্টস কোম্পানির দায়িত্ব নিতে বাবা তাকে বাধ্য করেন, স্বাধীনচেতা কাফকা এ বিষয়টা মেনে নিতে না পেরে যাকে বলে একদম ভেঙে পড়েন, আক্রান্ত হন বিষণ্ণতায়। কাফকা আবশ্যিকভাবে একজন জীবনশিল্পী ছিলেন, স্বপ্ন দেখতেন নিজের মতো এঁকে নেবেন জীবন, তখন পিতার এই চাপিয়ে দেয়া দায়িত্ব তার শিল্পীসত্তায় কঠিন আঘাত হেনেছিল; কাফকা এমনকি এ সময় আত্মহত্যার কথাও চিন্তা করেছেন!

তিন.
গ্রেগর সামসা কাফকার মানস চরিত্র হয়ে দাঁড়ায় স্বাভাবিকভাবেই, অপছন্দনীয় পেশাগত দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় (গ্রেগর চাকরি ছেড়ে দেবার পরিকল্পনা করে মনে মনে, হাতে টাকা জমলে যে অন্য কিছু করবার স্বপ্ন দেখে, তার চাকরির মূল কারণ কোম্পানির বড় কর্তার কাছে বাবার-মায়ের পূর্বোক্ত ঋণগুলো শোধ করা) শিকার হয় নিয়তির—রূপান্তরিত হয় পোকায়। পুঁজিবাদি নিষ্ঠুরতা, কোম্পানির হর্তাকর্তাদের কর্মচারীদের সাথে দুর্ব্যবহার, কথায় কথায় চাকুরি হারিয়ে ফেলবার ঝুঁকি—এসমস্ত বিষয় স্বাভাবিকভাবেই এক স্বাধীনচেতা মানবসত্তায় শেকলের মতো অনুভূত হবে। পোকায় রূপান্তরিত হবার পরেও তার মাঝে আমরা আবিষ্কার করি শিল্পের ক্ষুধাটি অক্ষুণ্ণ থেকে যেতে, বাসার উটকো ভাড়াটেদের যখন তার বোন বেহালা বাজিয়ে শোনায়, নিজের কক্ষটি ছেড়ে সে ওই সঙ্গীতের মোহে বেরিয়ে আসে সকল বিপদের আশঙ্কা তুচ্ছ করে। এই শিল্পভুক সামসাকে তখন আবিষ্কার করতে হয় বাস্তবতার নিষ্পেষণে ক্লান্ত বিধ্বস্ত সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের আত্মা হিসেবে।

একমাত্র বোন গ্রেটি, যে ভাইয়ের জন্য অগাধ স্নেহে পোকায় বদলে যাবার পরেও তাকে ত্যাগ করতে পারে না, এমনকি সেও এক সময় বিরক্ত-হতাশ হয়ে পড়ে, অথচ গ্রেগর নিজে কিন্তু স্বাভাবিক থাকে, মানসিকভাবে সে থেকে যায় আগের সেই উজ্জ্বল যুবকটি। পরিবারের সবাই যে তার এই মাকড়ে বদলে যাওয়া অবয়বটিকে ঘৃণা করছে—বিষয়টা তাকে প্রতিমুহূর্তেই বেদনায় ডুবিয়ে দেয়। কিন্তু তার করবার কিছু থাকে না যেহেতু নিশ্চিতভাবেই একটা পোকা পুনরায় আর মানুষ হয়ে উঠতে পারে না, কেন পারে না? গল্পে আমরা কী দেখতে পাই?

স্বাভাবিকতায় সামান্য পরিবর্তনও মানুষ গ্রহণ করতে পারে না, এমনকি তা নিতান্ত আপনজনের ক্ষেত্রেও, তাহলে হুট করে সমাজের কোনো পরিবর্তন, নতুন কোনো সম্ভাবনা মানুষ কিভাবে মেনে নেবে? আঁৎকা চারপাশের যেকোন পরিবর্তনই মানুষ প্রথম দফায় নেতিবাচকতা ও নিষ্ঠুরতার সাথে গ্রহণ করে, কাফকা তার এই গল্পটিতে সেটাও কি পরিষ্কার করে আঁকেননি? অনেকে ঠিক এ জায়গাটিতেই সাহিত্যে তার নবুয়্যাত আবিষ্কার করেন, বলেন—কাফকা তার সাহিত্য জীবন পার করেছেন আসলে প্রফেসির মাঝে, তার লেখাগুলোয় আমরা আবিষ্কার করেছি নিজ সময়ের পরে ঘটবে এমন অজস্র ঘটনা। তার সময়ে পৃথিবী বদলে যাচ্ছিল, সে বদলের আগমনী সংকেত বাজছিল বাতাসে, পৃথিবীর মানচিত্রে আসছিল বড় কোনো পরিবর্তন, আসছিল যুদ্ধ ও মৃত্যু। পরিবর্তন তো আমাদের জীবনকে এলোমেলো করে দিয়ে যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই—কাফকার গহন জীবনবোধ বইতে থাকা মগজ ঘূর্ণিবায়ুর মতো এ পরিবর্তনের আঁচে হয়ত নিয়ত বিধ্বস্ত হতো, ক্লান্ত কিংবা উদ্দীপ্ত হতো, না হওয়াটাই ছিল অস্বাভাবিকতা।

অন্তর্মুখী স্বভাবের এ জার্মানভাষী ইহুদি লেখকটি ধার্মিক হবার চেষ্টারত ছিলেন, প্রেম ও নারী বিষয়ে আজন্ম তিনি সুস্থির কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি, পিতার সাথে দ্বন্দ্বটা চিরকালই তাকে ভুগিয়েছে অথচ স্পষ্টবাদিতা তো তার মাঝে তেমন ছিল না। সুতরাং নিজস্ব চিন্তাধারা বয়ান করবার জন্য বাধ্য হয়েই তাকে বেছে নিতে হয়েছিল রূপক, প্রতীক, গল্প বলবার জটিল ও জান্তব এক কৌশল—যেখানে প্রতিটি গল্পের পরিণতি তাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে নিয়তির নিষ্ঠুর হাঁতুড়ির নিচে; তিনি নিজে যা কখনো এড়িয়ে যেতে পারেন নি—তার গল্পের চরিত্রদের জন্যও (এখানে উজ্জ্বল গ্রেগর সামসা) সে ব্যবস্থা করা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল।

নিয়তি এড়ানো সম্ভব না হলেও তার বিরুদ্ধে কাফকা দাঁড়ান নতুন এক স্বপ্ন নিয়ে, হতাশায় নিমজ্জিত সামসা পরিবারের গল্পটির শেষ টানতে চান এক আশাবাদ ব্যাক্ত করেই—যেহেতু কঠিন পৃথিবী কখনোই মানুষের জীবন অভিমুখী যাত্রাটিকে থামিয়ে দিতে পারে না, একজন লেখক হিসেবে আশা ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না কাফকাও। তিনি দেখতে পান জীবন তো থেমে থাকে না, যুদ্ধ-মৃত্যু-ঝড় একে বিধ্বস্ত করবার ক্ষমতা রাখে কিন্তু ওতে সমস্ত আশা নিভে যায় না—সেটি টিমটিমে হয়েও জ্বলতে চেষ্টা করে।

আমরা জানি, একটি নদী যখন সৃষ্টি হয়, তাকে ঘিরে বাড়ে লোকালয়, জনপদ, কিংবদন্তী আর শেষ পর্যন্ত গড়ে ওঠে মিথ। ফ্রানৎস কাফকার রূপান্তর এই একশ’ বছর পরেও উত্তাল স্রোতে বইছে, কারণ কাফকাও নদী হয়ে গেছেন, আপনার আমার জীবনের পাশ দিয়ে অতিচেনা এক স্রোতধারা হয়ে বয়ে চলেছে এই নদী।



বাংলাদেশ সময়: ১৫২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৫
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।