ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কফিন | চন্দন চৌধুরী

মুক্তিযুদ্ধের গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
কফিন | চন্দন চৌধুরী

কাল থেকে হাসির রেখাটা ঝুলে আছে দয়ারামের মুখে। অনেকদিন পর দেখা গেল এই ঝিলিক।

তার হতকিচ্ছিরি মেজাজে এতদিন কেউ কথাটি পর্যন্ত বলতে চাইত না। দেহটা লিকলিকে, বর্ণটাও শ্যাম, এর ওপর মুখটা থাকত কুমড়োর মতো। কিন্তু ওস্তাদ লোক বলে কেউ ঘাটাত না। আজ এমন উচ্ছ্বল স্বভাব দেখে তার দিকে চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে বাকিরা। মানে সুবল, গণি আর বাসুদেব। বলা যায় সাহসও পাচ্ছে। সুবলই বাসুদেবের কানে ফিসফিস করে, ‘মনে হয় ঝামেলাডা মিডছে। ’

বাসুদেবের এক সমস্যা, একটু পর পরই লুঙ্গির গিঁট আলগা হয়ে যায়। সামলাতে গিয়ে বারবার উঠে দাঁড়াতে হয়। বিষয়টা খুবই বিরক্তিকর ঠেকে দয়ারামের। অন্যদিন হলে দু-একটা ধমক লাগিয়ে দিত, ‘লুঙ্গিটা কোমরে দড়ি দিয়া বাইন্ধা রাখতে পারছ না। ’ আজ কিছু বলল না। সুবল ঠিকই বোঝে। এর মধ্যে লুঙ্গিটাকে শক্ত করে গিঁট দিয়েছে বাসুদেব। আবার হাত লাগায় কাজে। গণিটা বোকার হাড়। কে কী বলল, এসবে কিছু যায় আসে না। কোনো ভুল কাজের জন্য ওস্তাদ যখন তাকে ধমক দেয়, তখনও বোকার মতো হাসে। এতে আরো বেড়ে যায় দয়ারামের রাগ। মনে হতে থাকে তার চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেছে জ্বলন্ত চুল্লির আগুনের মতো। মাঝে মাঝে গাল বরাবর একটা কষে চড় দিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সে জানে, নির্বোধটাকে ধমক দিয়েও লাভ নেই।



রসিয়ে রসিয়ে বকের মাংস দিয়ে ভাত খাচ্ছে বাসুদেব। সামান্য দূরেই কাঠে নিরন্তর রামদা চালিয়ে পালিশ করে যাচ্ছে সুবল ও গণি। বাসুদেবের দিকে তাকিয়ে গণি বলল, ‘এই, সব খাইস না, আমগো লাইগ্যা দুই টুকরা রাহিছ। বাড়িত থাইক্যা ভাত আইলে খামুনে। ’ ‘আইচ্ছা’ বইল্যা খেতে থাকে বাসুদেব। এদিকে সম্পূর্ণ তৈরি হওয়া একটা কফিনে হাত বোলায় দয়ারাম। ভাবছে, কফিন বানানোর নির্দেশ দিনকে দিন বাড়ছে। তার মানে ইদানীং বেশি বেশি পাকহানাদার মরছে



আজ তাদের চারজনকে বানাতে হবে সতেরটা কফিন। খবরটা এসেছে সকালে। যদিও কফিন বানিয়ে কোনো টাকা পায় না তারা। কিন্তু কফিন তো বানাতেই হবে। না বানালে বেঁচে থাকা যাবে না। প্রথম দিকে সপ্তাহে দুই একটা কফিন বানানোর নির্দেশ আসত। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সংখ্যাটা। সপ্তাহে একটা থেকে দুইটা, দুইটা থেকে তিন চারটা। আর আজ একদিনে কিনা বানাতে হবে সতেরটা। খুবই কঠিন কাজ। হাত চালাতে হবে দ্রুত।

সুবলই কথা শুরু করে, ‘ওস্তাদের মনডা দেহি আজগা ভালাই। ’ হাসে দয়ারাম। এতেই উত্তর মিলে। বাসুদেব বলে, ‘ওস্তাদ, কফিন বানাতে আর ভাল্লাগে না। ’ প্রথম দিকে ভালো লাগত না দয়ারামেরও। এখন ভালো লাগে। তার মনে হয়, যত কফিন তত সুখ। কফিন বানাতেই তার যত আনন্দ। কফিনে পেরেক ঠুকতে ঠুকতে বলে, ‘বুঝলি, আমার স্বপ্ন ভাইঙা দুই খণ্ড হইয়া গেছে। কফিনে যখন পেরেক ঠুকি, মনে অয় স্বপ্নডা জোড়া লাগাইতাছি। ’ এমন উত্তরে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় সুবল। মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝে না। ভাবে, কিছুদিন যাবত মানুষডা কেমন পাগল পাগল কথা বলে! দয়ারাম আবার বলে, ‘যত পেরেক মারি মনে অয় স্বপ্নডা আরো পোক্তা হইতাছে। ’

ঝামেলা মেটেনি, ভেবে নেয় সুবল। মনে মনে বলে, ‘ঝামেলা দো মিডেই নাই, গিট্টু দেহি আরো লাগছে। ওস্তাদের মাতাডা যে কবে ঠিক হইব!’ এসব ভেবে আবার প্রশ্নও করে, তাহলে হাসির রহস্য কী! বাসুদেবও ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে বিমর্ষ হয়। গণিকে তামাক সাজাতে বলে দয়ারাম। গাছের ছায়ায় গুড়গুড় করে হুক্কা টানে। বাসুদেব সুবলের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘ওস্তাদের মনে অয় মাতাডা পুরাডাই গেছে সুবল ভাই। ’ ‘হ। আমারও মনে অয়। বাদ দে। কাম কর। ’ রামদা চালাতে শুরু করে দুজনে।

সামনে নদী। পাড়ে বসে কাজ করে তারা। ইদানীং মানুষজন খুবই কম দেখা যায় এদিকটায়। আগে নিয়মিত লঞ্চ চলত নদীতে। তবে এখন লঞ্চ এলে মানুষের আত্মা শুকিয়ে যায়। ভয়ে। মনে হয় লঞ্চ নয়, দানব আসে, আসে মৃত্যু। তখন গাছের আড়ালে ডুব দেয় দয়ারামরাও। বুকগুলো ধরফর করে। ভয়ে শরীর থেকে আত্মা উড়ে যায়। আর প্রচণ্ড ঘামতে থাকে তারা। এরকম পরিস্থিতিতে সবসময় চোখকান খোলা রেখে কাজ করতে হয় তাদের। আজ ঘর থেকে বের হওয়ার সময় দয়ারামের স্ত্রী মায়াদাসী বলেছিল ভয়ে নাকি তার শরীর কাঁপে। কাঁপে তো দয়ারামেরও। সে কিছুই বোঝায় না। বোঝালে যে সবই গণ্ডগোল বাঁধবে। এসবের শুরু সেদিন থেকে, রশিদ হুজুর যেদিন দুইজন খাকি ড্রেস পরা লোক নিয়ে তার কাছে আসে। তাদের একটা কফিন দরকার। বুঝতে বাকি ছিল না দয়ারামের। লোকগুলোকে দেখে ভয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল তিন সাগরেদ। রশিদ হুজুরই দয়ারামকে অভয় দেয়। তবে অবাধ্য হলে কী হবে, সেটাও জানায়।

প্রথম কফিন বানাতে গিয়ে গণি নিজের হাতে পেরেক ঢুকিয়ে ফেলেছিল। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল তার হাত। কিন্তু হাসছিল গণি। যেন কিছুই হয়নি। মুখে দূর্বাঘাস নিয়ে চিবিয়ে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয় দয়ারাম। তাতেও রক্ত বন্ধ হয় না। নদীর পাড়ে জমির আইলেই ছিল ঢোলকলমির ঝাড়। সেদিকে তাকিয়ে দয়ারাম বলে, ‘এই সুবল, এক কাম কর তো, ঐখান থাইক্যা কয়েকটা মিলিটারি পাতা ছিঁড়া লইয়ায়। পাতার ডুগার কষ লাগাইলে রক্ত বন্ধ হইয়া যাইব। ’ রক্ত বন্ধ হতে আরও কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু এতে যে মনের ভেতর একটা অসুখ জন্ম হবে, কে জানত!

সেদিন নৌকায় আলকাতরা লাগাতে গিয়েই দেখতে পায় দয়ারাম, আলকাতরা নয়, রক্ত লাগাচ্ছে। ভয়ে হাত থেকে মাটিতে ছিটকে পড়ে আলকাতরার ঘড়া। কাঁপছিল দয়ারাম। কোনো কথাও বলতে পারছিল না। কোনোমতে সুবলকে বলেছিল, ‘কি রে, তোরা কী আনলি! এ দেহি রক্ত!’ দৌড়ে এসেছিল সুবল। বলল, ‘কও কি ওস্তাদ! আলকাতরারে রক্ত কইতাছো কেরে?’ দুই হাত মুখের সামনে এনে কাঁদতে থাকে দয়ারাম, ‘তোরা আমারে আলকাতরা না আইন্যা রক্ত আইন্যা দিলি?’ এমন কথা শুনে চিৎকার করে গণিকে পানি নিয়ে আসতে বলে সুবল। দয়ারামকে বসিয়ে মাথায় পানি ঢালতে থাকে। দয়ারাম এবার চিৎকার করে ওঠে, ‘একি! আমার মাতায় রক্ত ঢালতাছস কেরে? পানি দে। ’ গণি বলে, ‘আমরা দো তোমার মাতায় পানিই ঢালতাছি। ’ ‘ফাইজলামি করছ। একটা চড় দিয়া দাঁত ফালাইয়া দিমু। রক্ত দিয়া মাতা ধোঁয়াছ, আবার কছ পানি!’

সুবল বলে, ‘আইচ্ছা, চল তোমারে নদীত নিয়া যাই। ’ নদীর পানিতে পা রাখতেই শিউরে ওঠে দয়ারাম, পুরো নদীটাকেই তার রক্ত মনে হতে থাকে। এবার সে ধীরস্থির হয়। বোঝার চেষ্টা করে। ভয়ে আর আশঙ্কায় নিশ্চয়ই উল্টাপাল্টা দেখছে। ভেবে সে আর চিৎকার করে না। তবে সুবলদের দিকে তাকিয়েও সবাইকে লাল রঙের দেখতে পায়। সুবল, গণি, আর বাসুদেব—সবার শরীর লাল। দয়ারাম ভাবে, লাল রঙের সর্বনাশ ধরেছে তারে। এরপর বাসুদেবকে বলে গাছের ছায়ায় একটা মাদুর পাতার জন্য। সেখানে শুয়ে সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ঘুম আসে না। শরীরের ভেতরে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা। সেটা যে কী ধরনের, তা বুঝতে পারছিল না। সেদিন অনেকক্ষণ নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ করছিল দয়ারাম।

এখন অবশ্য মনের সুখে ধোঁয়া তুলছে হুক্কায়। যদিও ধোঁয়াটাকে লাল মনে হচ্ছে তার, তবু ডাকচিৎকার করছে না। এখনো তার চোখের সামনে পুরো নদী লাল হয়ে যায়, নীল আকাশটা মুহূর্তের মধ্যে লাল হয়ে যায়, গাছগুলো সবুজ হারিয়ে হয়ে ওঠে রক্তলাল।

আজ অনেক কাজ। সতেরটা কফিন বানানোর জন্য এর মধ্যে কাঠগুলোকে সাইজ করা হয়ে গেছে। তিনজনই করাত চালাচ্ছে। কিভাবে কী করতে হবে সবই জানে তার সাগরেদরা। ওস্তাদের ভাবনা ভাঙে সুবল, ‘ওস্তাদ, এত কফিন বানাইয়া আমগোর কী লাভ! কুনু টেয়াপইসা দো পাই না। ঘরে খাবার দাবার নাই। ’ দয়ারাম হাসে, ‘যা দেয়, তা যে খাবারদাবার থাইক্যাও অনেক বেশিরে...অনেক বেশি। ’ ‘কী যে কওনা তুমি মাঝে মাঝে, মাতামুণ্ডু কিছুই বুঝি না। ’ ‘বুঝবিরে বুঝবি, সব বুঝবি। আয়, একজন আমার লগে রামদা ধর, কাঠগুলারে তাড়াতাড়ি পালিশ কইরা লইতে হইব। ’ সুবলই রামদা টানে। রামদা টানতে টানতে দয়ারামের মনে হয়, সে একটা মৃত শরীরে ইস্ত্রি করছে। মনে মনে বলছে, ‘আগে মরলি না কেন, আরো সুন্দর কফিন বানাইতাম তোর লাইগ্যা। ’ হো হো করে হেসে ওঠে দয়ারাম। এবার তাকে ভূত ভূত লাগে সুবলের। মনে হয় এটা তার ওস্তাদ নয়, ওস্তাদের প্রেতাত্মা। এই কফিন বানাতে বানাতে তার ওস্তাদই যেন কফিন হয়ে গেছে! আগে যখন নৌকা তৈরি করত, কাজ করতে করতে গান করত দয়ারাম, কখনো বা খুঁনসুটি করত। সুবলের বিয়ের দুদিন পর দয়ারাম তো দুষ্টুমি করতেও ছাড়েনি, ‘হুন, এহন থাইক্যা তুই একটা নাও হইয়া গেছত। মাঝিও তুই-ই। আর তোর বৌ? সে হইল যাত্রী। এখন কেমনে পারাপার করবি, তুই-ই জানোছ। আবার তুই যদি নাও না হইয়া হাতি হছ, তোর বৌ হাতির পিডে চড়ব, তুই যদি বাঘ হছ, তর বৌ তখন কী হইব বল তো?’ বলে সামান্য বিরতি দেয়। এরপর হাসতে হাসতে বলে, ‘হরিণরে হরিণ। হরিণের মাংস খুব টেইস্ট। খাইছোস কুনুদিন?’ রাগ আর লজ্জা দুটোই একসঙ্গে ধরেছিল সুবলকে। সে মুখটাকে ঈষৎ কালো করে বলেছিল, ‘কি যে কওনা ওস্তাদ!’

আজ সেই হাসি, সেই উচ্ছ্বলতা ধরেছে দয়ারামকে। সুবল বলল, ‘ওস্তাদ, চলো এখান থাইক্যা পলাইয়া যাই। কত মানুঐদো পলাইয়া গেছে। ওইপাড় চইল্যা গেছে। আমরা পইড়া আছি কেরে!’
‘তর ইচ্ছা হইলে তুই যা। আমি যামু না। এইখানেই থাকমু। ’
‘একদিন দো হেরা আমগোরেও মাইরা লাইবো। ’
‘অইতে পারে। ’
‘তইলে?’
‘তইলে আবার কী! মারলে মারব, এর আগে দেখমু কয়ডা কফিন বানাইতে পারি। ’
‘কফিন কফিন!’ সুবলের মুখ দিয়ে খিস্তির মতো বের হলো শব্দটা। শুনে হেসে ওঠে দয়ারাম। বলে, ‘কফিন বানাইতে যে এত সুখ আমি জানতাম না। ’
‘তুমি কি জানো, আমগো বানানো এই কফিন দিয়া কাগো মরা নেওয়া অয়?’
‘জানিরে জানি। এইজন্যই দো বড় আনন্দ। ’

এবার সাহস আরো বেড়ে যায় সুবলের, ‘তোমার মাতাডা যে এক্কেবারেই গেছে, বুঝতে পারতাছো? এই কফিন দিয়া দো কোনো বাঙালিগো লাশ নেওয়া হয় না!’ দয়ারাম হাসতে হাসতে বলে, ‘তাও জানি, তো হইছে কী?’ আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করে না সুবলের। হাসছে দয়ারাম। সুবলের মনে হচ্ছে এই হাসি আগুন হয়ে ছিটকে পড়ছে তার শরীরে। রাগে জ্বলছে সে। ওস্তাদের হাভভাব মোটেও ভালো ঠেকছে না তার। ভাবছে, ওস্তাদ আবার রশিদ হুজুরের নতুন খপ্পড়ে পড়েনি তো! শেষে জাত ধর্ম বিসর্জন দেবে নাকি লোকটা! হলেও হতে পারে, ভয়ে আর বাঁচার জন্য মানুষ কত কী করে! এখন যেমন ওরা শত্রুর জন্য কফিন বানাচ্ছে। মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় সুবল, মরবে তবু জাত খোয়াবে না।

এর মধ্যে দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছে মায়াদাসী। গত রাতের ঝড়ে একটা বক এসে পড়েছিল বাড়ির উঠোনে। বকটা ধরেছিল দয়ারাম। সকালে বৌকে দিয়ে এসেছিল মাংস রান্না করতে। গরম ভাতের সঙ্গে বকের মাংস, রসিয়ে খাবার ইচ্ছে। কিন্তু খাবারে হাত দিতেই বমি বমি লাগল দয়ারামের। সানকিতে বকের মাংসের পরিবর্তে দেখতে পেল মানুষের হাড়গোড়। কী করে এই খাবার খাবে, বুঝতে পারল না দয়ারাম। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল অন্যদিকে। মায়াদাসী বলল, ‘কী, খাও না কেরে? সহালে না এত কইরা কইলা বগাডা কাডো, বহুদিন মাংস খাই না!’ আবার সানকির দিকে তাকায় দয়ারাম। বকের মাংস তো নয়ই, মানুষের রক্ত আর মাংস মনে হচ্ছে তার কাছে। খেতে ইচ্ছে হলো না তার। বাসুদেবকে ডেকে বলল, ‘এই, খাবিরে তোরা?’ ‘না খাইলে দেও খাই। ’ বলেই সানকি হাতে তুলে নিল বাসুদেব। মায়াদাসী তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেহো না, হের কী যেন হইছে! কহন কী করে আমি দো কিছুই বুঝি না। সহালে কইলো বগাডা কাডো, মাংস খামু। আর এহন ঝোল দিয়া ভাত মাইখ্যাও মুহে নেয় না। ’

রসিয়ে রসিয়ে বকের মাংস দিয়ে ভাত খাচ্ছে বাসুদেব। সামান্য দূরেই কাঠে নিরন্তর রামদা চালিয়ে পালিশ করে যাচ্ছে সুবল ও গণি। বাসুদেবের দিকে তাকিয়ে গণি বলল, ‘এই, সব খাইস না, আমগো লাইগ্যা দুই টুকরা রাহিছ। বাড়িত থাইক্যা ভাত আইলে খামুনে। ’ ‘আইচ্ছা’ বইল্যা খেতে থাকে বাসুদেব। এদিকে সম্পূর্ণ তৈরি হওয়া একটা কফিনে হাত বোলায় দয়ারাম। ভাবছে, কফিন বানানোর নির্দেশ দিনকে দিন বাড়ছে। তার মানে ইদানীং বেশি বেশি পাকহানাদার মরছে। আর ততই সুখ বাড়ছে তার মনে। কফিনটায় ধরে দয়ারামের মনে হতে থাকে এর ভেতরে শুয়ে আছে একজন ছিন্নবিচ্ছিন্ন হানাদারের লাশ। আনন্দে ভরে ওঠে দয়ারামের বুকটা। আর এটা দেখার পর সে অনুভব করে তার ক্ষুধা বেড়ে যাচ্ছে রাক্ষসের মতো। তার নাকে এসে লাগছে রক্তমাংসের গন্ধ। নিজেকে একটা হাঙর মনে হতে থাকে তার। যেন বহুদিন খায়নি সে। দেখতে পায় তার খাবারটা খেয়ে ফেলছে বাসুদেব।

এক ঝটকায় বাসুদেবের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় সানকিটা। হতভম্ব হয়ে যায় বাসুদেব। সানকির দিকে তাকিয়ে দয়ারাম দেখে মানুষের মাংস ঠিকই, তবে সেগুলো পাকহানাদারদের। শরীরের সব শক্তি দিয়ে মাংসে কামড় বসাতে থাকে দয়ারাম। এই মাংস যে এত সুস্বাদু হবে ভাবতেই পারেনি সে। দয়ারামের এমন খাওয়া দেখে হা হয়ে যায় মায়াদাসীর মুখ। হতবিহ্বল বাসুদেবের সঙ্গে অবাক হয়ে তাকায় সুবল আর গণিও। কিন্তু এসবে ভ্রুক্ষেপ নেই দয়ারামের। গ্রোগ্রাসে খেয়ে যাচ্ছে সে। ক্রমশ দাঁত চালিয়ে যাচ্ছে এক হানাদারের হাড়মাংসে। আর খেতে খেতে তার মুখ বেয়ে পড়ছে যেন পাষণ্ড হানাদারের রক্ত।



বাংলাদেশ সময়: ১৮১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।