ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ভাগিরথী | গাজী তানজিয়া

মুক্তিযুদ্ধের গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
ভাগিরথী | গাজী তানজিয়া

জও তার ঘুম ভাঙল সেই অদ্ভুত গা শিরশিরানো স্বপ্নটা দেখে, একটা বড় শ্মশানে স্তূপ করা মৃতদেহে আগুন জ্বলিয়ে দিচ্ছে এক কাপালিক। কাপালিকের শিষ্য সামন্তরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।

তাদের চোখে মুখে বিকৃত উল্লাসের চিহ্ন। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন, সেই আগুনে পুড়ছে নানা ধর্ম বর্ণের অসহায় নারী পুরুষ। আগুন জ্বলছে, জ্বলছে আগুন, কিন্তু সেই আগুনে গণগনে উত্তাপ নেই বরং যেন মেরু অঞ্চলের হাড় হীম হয়ে যাওয়া তীক্ষ্ণ ছুরির মতো ঠাণ্ডা এসে বিঁধছে তার শরীরে। সেই হীম ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে যেতে যেতে ঘুম ভাঙে সমরের। সারা শরীর জুড়ে তখন তীব্র কাঁপুনি। মনে হয় যেন জ্বর এসে গেছে। ঘুম ভাঙার পর কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে ভাবতে থাকে সে। কাপালিক কেন মৃত দেহে আগুন দেবে! তার কাজ তো মৃতদেহের সাথেই; ওর ওপর বসে ধ্যন-যজ্ঞ করা! বহ্নুৎসবের সাথে তো তার কোনো যোগ নেই। কী অর্থ এই স্বপ্নের!

সমর বুঝতে পারে তার সময় শেষ হয়ে এসেছে। জ্বরটা থেকে থেকেই আসছে, প্রায় প্রতি রাতেই। অথচ এখনো সে কাজটা করে উঠতে পারল না। প্রায় প্রতিদিনই চেষ্টা করে সে। থানায় যায়, সেকেন্ড অফিসারের সাথে কথা বলে। সেকেন্ড অফিসার খুব আগ্রহ নিয়ে পেন্সিল দিয়ে খাতায় কী সব লিখে রাখে। প্রথম প্রথম দু’এক দিন তাকে চাও খাইয়েছে। এখন আর খাওয়ায় না। তবে ধমক ধামকও দেয় না। বলে, “এখন যান, কাজ হবে। লিখে রাখছি তো থানার খাতায় একই অভিযোগ কয়বার লিখব বলেন তো! যান বাড়ি যান। ”

সমর ফুসফুসে আটকে যাওয় কাশিটাকে ঘড়ঘড়ে আওয়াজে বাইরে ঠেলে দিতে দিতে থানার বাইরে পা বাড়ায়।



বিরাণ ভূমিতে ভাগিরথী ছাড়া আর কোনো মাইয়া লোক নাই। সুশীল কর্মকারের বড় ঘর খানায় ওরা আস্তানা গাড়ল। বাড়ি-ঘর ছাইড়্যা ওরা তহন ওইখানেই পারমানেন্ট। রান্দন-বাড়নের জন্য একজন বাবুর্র্চিও জোগাড় করছে। কিন্তু বাটনা বাটন, কুটনা কোটন, ঝাড়ন পোছনের জন্য তো একজন মাইয়া লোক লাগে। নোমো পাড়ায় তো কারো দিশা নাই। হেই লাইগ্যা ভাগিরথীর ডাক পড়ল ওইখানে কাম করনের। আমি হেই দিনও কইলাম, চল মাগি রাইতের আন্দারে পালাই। অয় কয়, ‘না



সমর এখন বুঝতে পারে কাজটা হবে না। সে আগে এটা বুঝত না, তার বোঝার কথাও না, কারণ সর্বোচ্চ মহলের সব কথা সে সত্য মনে করে, বিশ্বাস করে। কিন্তু তাকে এই কথাটা বলেছে তার বন্ধুপরিমল, “কাজটা আসলে ওরা করবে না বন্ধু। ” সরকারের মতো পরিমলের কথাও সে বিশ্বাস করে, না করার কোনো কারণ নাই।

পরিমল তার দীর্ঘদিনের বন্ধু, এর মধ্যে একদিনও সে অবিশ্বাসের কোনো কাজ করে নাই। তাছাড়া পরিমল আর তার মধ্যে অন্য একটা জায়গায় অদ্ভুত মিল আছে। তারা দুজনেই একটা শব্দ শুনতে পায়; যা আর কেউ শুনতে পায় না। তারপরও পরিমলের বাস্তব বুদ্ধি তার তুলনায় অনেক বেশি। পরিমল মাঝে মাঝে বলে, “সব অন্যায়ের কি বিচার হয়! দেখছো কখনো? আর এর পেছনে রাজনীতি থাকলে তো তার কত রকম নখরা। ”

“তয় আমি যে শব্দ শুনি হেইডা কি মিথ্যা হইয়া যাইবে? ওই যে গোরের মইধ্যে গুমরাইয়া গুমরাইয়া ওডে। জায়গাডা এহন সমতল ভূমি, গোরের কোনো চিহ্ন নাই। চাইরজন মানুষ ওর মইধ্যে চাপা দেওয়া, কারো মুখে কোনো শব্দ নাই শুধু ভাগিরথীই ওর মইধ্যে গুমরায় ক্যান?”

“ওর ত্যাজ, জানতা না বন্ধু ওর ত্যাজ আছিল ক্যামন! কোনো অন্যায় দেখলে ত্যাজে জ্বইল্যা উঠত। ”

“অরে বাইর করো, বন্ধু অরে ওই গোরের ভিতর দিয়া বাইর করো, নইলে এই অন্যায়ের বিচার অইব না। এ্যাহন সময় আইছে এ্যাহন যদি বাইর না করো তয় আর এ্যাগো সাজা অইব কবে?”

“তুমি বন্ধু বোকার বোকাই আছো, তুমি জানো না, ওরা ক্ষমতাবান!”

“কিন্তু এই খ্যামতায় অরা ঢুকল ক্যামনে?”

“যুগে যুগে অরা সব ক্ষমতায়ই ঢুকতে পারে। ”

“হেই জইন্যেই আমি ভাগিরথীর ন্যায় বিচার পামু না? অরে যে..! হেই কতা এই দ্যাশ-গেরামে কেডা না জানে। আমাগো জামানার সবাই জানে, সবাই দ্যাখছে, অরা সাক্ষ্য দেবে। ”

“কোথায় দেবে সাক্ষী?”

“ক্যান, থানায়, ট্রাইবুনালে!”

“আগে অপরাধী সনাক্ত হইতে হইব না?”

“সনাক্ত তো হইয়াই আছে, আমি করমু, তুমি করবা সনাক্ত। ”

“আমাগো কথায় কাম হইব না, দেখো না বদর আলী কেমন ক্ষমতার দলের লেবাস পইরা ঘোরে! আর এখন যে খাতায় নাম আছে, সেই খাতায় নাম থাকলে কোনো ট্রাইবুনালে নাম উঠানো আমাগো পক্ষে সম্ভব না। ”

সমর আগ্রহের সাথে বলে, “পুলিশ যে খাতায় নাম-ধাম লিখল?”

“অ্যাকশানে যাইতে দ্যাখলা এখনো?”

“না। বুঝলা বন্ধু হেই জইন্যেই ভাগিরথী গুমরায় ও উইঠ্যা আইতে চায়। অহন গুমরাইলে কাম অইব! অরে যহন আমি নিষেধ করছিলাম তহন শুনে নাই। ও কখনো শুনে না। যহন পাকিস্তানি আর্মির সাথে দালালেরা সবাইরে ধইরা ধইরা বিনাশ করতে ছিল, কইছিলাম চল ওপারে যাই। হগ্যলে যাইতাছে, ল আমরাও যাই। অয় রাজী হয় নাই। কয়, ‘এ্যার একটা বিহিত দেখমু। কী অপরাধ আমাগো যে এইভাবে ধইরা ধইরা পোকা মাকড়ের নাহান বিনাশ করব!’ আমি ধমকাইয়া কইলাম, তুই মাতারি মানুষ তুই কী করবি? বেশি খাউজ হইছে? বটি নিয়া দাবড়াইয়া আইল আমার দিকে, আমি আর ভয়ে কিছুই কই নাই। একে একে সবাই তহন বাড়ি ঘর ছাড়তাছে। সবাই আমারে কয়, ‘কিরে সমইর‌্যা যাবি না? এইহানে থাইক্যা মরতে চাও? ওপার ল যাই। ’ আমি ভাগিরথীরে বুঝাইতে পারি না। আবার অরে একলা ছাইড়্যা যাইতেও পারি না। হারাদিন এদিক ওদিক বনে বাদাড়ে ঘুরি। অরে সাবধান হইতে কই। হুনে না। আমার কতা কিছুই হুনে না। নোমো পাড়া তহন বিরান ভূমি। হেইখানে আইস্যা দখল নিল চ্যাংড়া বদর আলী। আরো কয়ডা অর মতো চ্যংড়া পোলাপাইন।

বদর আলী তহনো লেবাস ধরছিল। মাথায় সারাক্ষণ কিস্তি টুপি, পরনে কাবলি স্যালোয়ার-কামিজ।

বিরান ভূমিতে ভাগিরথী ছাড়া আর কোনো মাইয়া লোক নাই। সুশীল কর্মকারের বড় ঘর খানায় ওরা আস্তানা গাড়ল। বাড়ি-ঘর ছাইড়্যা ওরা তহন ওইখানেই পারমানেন্ট। রান্দন-বাড়নের জন্য একজন বাবুর্র্চিও জোগাড় করছে। কিন্তু বাটনা বাটন, কুটনা কোটন, ঝাড়ন পোছনের জন্য তো একজন মাইয়া লোক লাগে। নোমো পাড়ায় তো কারো দিশা নাই। হেই লাইগ্যা ভাগিরথীর ডাক পড়ল ওইখানে কাম করনের।

আমি হেই দিনও কইলাম, চল মাগি রাইতের আন্দারে পালাই। অয় কয়, ‘না। ’

আমি সহজে রাগ হই না। তারপরও মাথায় রক্ত চইড়া গেল। কইলাম, মাগি এ্যাতো দ্যাশ দ্যাশ করো; বাইচ্যা থাকলে হ্যার পর তো দ্যাশ! এ্যাহন তো তুইও মরবি, আমারেও মারবি। অয় কোনো প্রতিক্রিয়া দেহায় না দেইখা মুহূর্তের মইধ্যে আমি অর পা দুইডা জড়াইয়া ধরি, ধইর‌্যা কই, চল সোনা, বাইচ্যা থাকলে ফের দ্যাশে ফিরমু। হে শুধু কইল, ‘তুমি যাও, তোমারে তো আমি নিষেধ করি নাই’। এমন মাইয়া লোকের সাথে মাইনষে পারে ক্যামনে? সে তোমার দুর্বলতা বুইঝ্যা ফালাইছিল বন্ধু! হেইডাই তো কাল অইছিল। এহন ওই গোরের মইধ্যে বইস্যা ফুঁসলে কী কাম হইবে!”

“হ্যার পর কী হইল?”

“তোমরা তো সবাই চইল্যা গেলা, আর ভগি ওইহানে কামে গেল। বাবুর্চির জোগাড় দ্যায়, ঝাড়-পোছ করে। ওইহানে ওরা অস্থায়ী ক্যাম্প বানাইল। সেইখানে আবার মাঝে মাঝে পাকিস্তানি আর্মিরাও আসত। খানা-খাদ্য খায়, ফুর্তি-ফার্তা করে। মাইয়্যা মানুষও ধইর‌্যা নিয়া আসত। ভদ্র ঘরের সুন্দরী জোয়ান মাইয়া। আমাগো ভগির তো ছিল মর্দমান চেহারা। লম্বা, হাড্ডি চওড়া, গায়ের রঙটাও তাম্রবর্ণ। ”

“তার মানে কইতে চাও ভগিরে ওরা ভোগের উপযোগী ভাবে নাই?”

“হবে হয়ত। ”

“তুমি বন্ধু ভুল বুঝছো। ভগি ছিল ঘরের মুরগি। অরে ওরা তহনই ভোগ করতে চাইছিল যহন বাইরে টান পড়ব। ”

“কিন্তু ভগি যে এমন কাণ্ড করব কে বুঝছিল। অর সাথে যে বলেশ্বর নদীর ওপারে মুক্তিযোদ্ধাগো ক্যাম্পের লগে যোগাযোগ আছিল হেই কথাডা ও আমারে পর্যন্ত কয় নাই। বদর আলীর আস্তানায় যা কথা বার্তা হইত তার ব্যাবাকই ও ওপার গিয়া ফাঁস করত। ফলে হইল কী, পাক-আর্মিগো কোনো অপারেশনই সফল হয় না। সব জায়গাতেই মুক্তিযোদ্ধাগো লগে গোলাগুলি হয়।

এর মইধ্যে একদিন ট্রেজারি লুট হইয়া গেল। মহাকুমা শহরের ব্যাবাক অস্ত্র তখন মুক্তিযোদ্ধাগো হাতে। সেই অপরাধে এসডিপিও সাহেবরে পাক-আর্মিরা বলেশ্বরের তীরে নিয়া গুলি কইরা মাইরা ফেলাইল। বলেশ্বরের ওই তীরে প্রতি রাইতেই ওরা গুলি কইরা মানুষ মারত। কত কত নিরীহ মানুষ! হ তারপর হইল কী, বদর আলীর চ্যাঙড়ারা তখন ভাগিরথীর ওপর সন্দেহ করতে লাগল। ওরা ভগিরে জিগায়, ‘ভগি তুমি বিকাল হইলে নদী পার হইয়া কোথায় যাও?’

ভগি জবাব দেয়, ‘ওপারে আমার মাসির বাড়ি, মাসি বেজায় অসুস্থ। দ্যাখোনের কেউ নাই, বাড়িসুদ্ধা লোকজন সব কোথায় কোথায় গেছে, মাসিরে দ্যাখতে যাই। ’ চ্যাঙড়ারা কয়, ‘মাসিরে দেখতে না যাইয়া তোমার কাছে নিয়া আসলেই তো পারো। ’ ভগি এই কথার কোনো জবাব দেয় না। সে উঠান ঝাড় দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভগি কর্মকারের উঠান, বাড়ি, ঠাকুরঘর সব ঝেড়ে পুছে রাখে। যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে যেন তারা সব ঠিক-ঠাক পায়। হেই দিন সন্ধায় অগো ক্যাম্পের বাবুর্চি চান্দু ভাই আইল আমাগো ঘরে। ছোটখাট মানুষ আছিল চান্দু ভাই। দাওয়ায় বসতে বসতে ভগিরে কইল, ‘ভগি একখান পান দে তো বইন; গলাডা শুকাইয়া গেছে। ’

ভগি পান বানাইয়া দিলে, হেই পান খান মুখে পুইর‌্যা  আমারে সাক্ষী মাইন্যা ভগিরে কইল, ‘তুই মরার জইন্যে এইখানে পইড়্যা আছস কেন ভগি? তামাম লোক ওপার গেল, তুই এহানে কী চাস? যুদ্ধ করস? এই তোর মরদের সামনে রাইখ্যা কইতাছি বাঁচতে চাইলে ভাগ। ’ হা-হা করে ওঠে ভগি। ‘হায় হায় চান্দু ভাই, এইসব কী কও? আমি মাইয়া মানুষ যুদ্ধের কী বুঝি?’
‘যুদ্ধ বোঝো না, তয় এইখানে কী চাও?’ প্রায় খিচিয়ে ওঠে চান্দু ভাই।
‘যুদ্ধ বুঝি না বইলাই তো এইখানে পইড়া আছি; বুঝলে তো সবার মতো ওপার চইল্যা যাইতাম। ’
‘বোঝো আর না বোঝো, এখন তুই যা ভগি। তর ভালোর জইন্যেই কইতাছি। অগো কথা বার্তার ভাব ভালো ঠেকতাছি না। আর তোমারেও কই সমরদা তুমি কি কিছুই বোঝো না?’
আমি নিরুপায় এ কথা চান্দু ভাইরে কী কইরা বুঝাই! আমি বুঝলেও ভগি যে বুঝতে চায় না। চান্দু চইল্যা গেলে আমি সেই রাইতেও ভগিরে কইলাম, ‘এই যুদ্ধ কি আর শেষ হইব ভগি? চল আমরা পালাই। ’
ভগি নিশ্চুপ, এই কথার কোনো জবাব দেয় না। আমি ওর হাত দুইখানা চাইপা ধরি। ‘চল সোনা!’
ও চোখে আগুন নিয়া আমার দিকে তাকায়। আমি ওর মাথায় হাত বুলাই, নিজের চোখের পানি ফেলি। কোনো কাজ হয় না। ভগি তখন ফুঁসতে থাকে, এহন যেমন ফোঁসে গোরের মইধ্যে তেমন।

পরদিন ভোরবেলা কামে যাওয়া মাত্র ভগিরো ঘিইরা ধরে বদরের চ্যাংড়া পোলাপাইন।

‘ভগি বল, ওপার তুই কার কাছে যাস?’
ভগির একই জবাব, ‘মাসির কাছে! লাগলে তোমরা কেউ আমার সঙ্গে গিয়া দেইখা আসো কই যাই?’
‘হ তোর লগে যাইয়া জীবনডা খুয়াই আরকি! তুই বুঝিস কি আমরা কিছু জানি না, কোনো খোঁজ খবর রাখি না!  ওইপার তোর লাঙ্গেরা থাকে হারামজাদি! হ্যাগো গিয়া তুই সব খবর পাচার করস। ’
ভগি কোনো জবাব দেয় না। সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।
‘কী, কথার জবাব দ্যাস না ক্যান? ত্যাজ দ্যাখাও? তোর সব ত্যাজ ভাঙব এখন। মাইয়া মানুষের আবার ত্যাজ! কাপড় খুইল্যা দিলে সব শেষ। ’
এমন সময় পাকিস্তানি অফিসার বলে ওঠে, ‘লটকাও শালিকো। ’
আদেশ শুনে ছুটে আসে এক চ্যাংড়া, ‘কাহা লটকাউ স্যার?’
অফিসারের চেখে তখন লকলকে লোভ। বলল, ‘আভি নেহি, প্যাহেলে ফিস্ট, দেন হ্যাং আপ টু হার। ’
ভাগিরথীকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় ঘরের ভেতরে।
কাপড় খোলা হলো। একে এক সব কাপড়। সেই নগ্ন মেয়ে মানুষের ওপর সওয়ার হয়েছিল একের পর এক হিংস্র পশু তাদের যাবতীয় পাশবিকতা নিয়ে।

ভাগিরথীর যাবতীয় রমণীয় অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ক্ষত বিক্ষত। সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। সেই অবস্থায় তার দুই হাতে দড়ি বাঁধা হলো। সেই অবস্থায় তাকে নিয়ে যাওয়া হলো আর্মি জিপের কাছে। জিপের পেছনের বাম্পারে দড়ির অপর প্রান্ত বাঁধতে বাঁধতে তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘বোল শালি, মুক্তিকো ক্যাম্প কাহা? বোলো তো ছোড় দেঙ্গে। ’
ভাগিরথী নিশ্চুপ। তার দুচোখে আগুনের হলকা।
ভগিকে তখন প্রশ্ন করে বদর আলী। বল ভগি, ‘মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় আছে? ওপারে ওদের ক্যাম্প কোথায়? কোথায় থাকে তারা? আজ রাইতে ওদের অপারেশনের কথা বইলা নিয়া আয় এপারে, দিই সব কয়টারে শেষ কইরা। ’

বদরের কথা শেষ হওয়া মাত্র ভগি একদলা থুতু ছুড়ে দেয় তার মুখে। আর সাথে সাথেই তীব্র গর্জন করে স্টার্ট নেয় মিলিটারি জিপ।

গোটা পিরোজপুর মহকুমা জুড়ে দানবীয় গর্জনে মারণাস্ত্র হয়ে ছুটতে থাকে হায়নাদের জলপাই বাহন। তার পেছনে হাতে দড়ি বাঁধা রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত ভাগিরথীর নিথর শরীর। ধুলোয় লুটোচ্ছে তার ক্ষয়ে যাওয়া সবুজশাড়ি, ছোপ ছোপ রক্ত সারা পথ জুড়ে।

সেদিন রাতে ওই বলেশ্বরের তীরে ভগিরে গোর দেয়া হয়। গণ কবরে। সাথে আরো তিনজন ছিল ওই কবরে। ওই দিন রাত্রে ওদের শিকার ওই তিনজন নিরীহ মানুষ। প্রতি রাতে বলেশ্বরের তীরে বলি হওয়া নিরীহ বাঙালি। ওই শোনো বন্ধু ভগি ফুসতাছে। শুনতে পাইতেছো?”

“হ্যাঁ, পাইতেছি। ”
“চল ওরে উঠাই, গোর খুইড়া উঠাই ওরে। ”
“উঠাইলে কী হবে?”
“উঠাইলে কাজ হবে। ”
“কী কাজ হবে?”
“অরে উঠাইলে ওই লোকগুলা বিশ্বাস করব ভাগিরথী আছিল। বদর আলীও আছিল সেই সময়ে। তয় এখন যে লেবাসে, সেই লেবাসে না। ”



বাংলাদেশ সময়: ১৮১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।