ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

অপরাজিতা | আহমাদ মোস্তফা কামাল

মুক্তিযুদ্ধের গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
অপরাজিতা | আহমাদ মোস্তফা কামাল

ই যে খালটা দেখছো, এটাও অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। যুদ্ধের সময় কত যে বেওয়ারিশ লাশ এই খাল দিয়ে ভেসে গেছে!’—তিনি বলছিলেন আর অনীক ভাবছিল, এটা তাহলে একসময় খাল ছিল! এ-গ্রামে নতুন আসা কারো পক্ষে ব্যাপারটা বোঝা কঠিন।

গভীর নয় ততটা, প্রায় ভরাটই বলা যায়, তবে বিস্তার অনেকখানি, ছোট নদীগুলোর মতোই, যদিও এখন আর পানি নেই। হয়ত অনেক বছর ধরেই নেই এবং সেজন্যই মানুষের পায়ে চলার পথ হয়ে উঠেছে এটি। কথাটা বললও সে—

আপনি না বললে বুঝতে পারতাম না যে এখানে একসময় খাল ছিল। লোকজন তো এটাকে হাঁটার পথ বানিয়ে ফেলেছে!

হ্যাঁ, বোঝার কথাও নয়। পলি পড়ে ভরে গেছে। কিন্তু একসময় গভীর ছিল, পানিও থাকত সারা বছর। আর বর্ষায় খাল উপচে পানি চলে আসত মাঠে। মাঠজুড়ে পানি, থৈ থৈ বর্ষা।



সেই মেয়েটিকেও বাড়িতে পৌঁছে দিল এক মুক্তিযোদ্ধা। গ্রাম ভেঙে লোক এলো তাকে দেখতে। কেউ ভাবেনি যে সে বেঁচে আছে, এমনকি বাপ-মাও ধরে নিয়েছিলেন—তাদের মেয়ে মরে গেছে। এতদিন পর যে ফিরে এলো, সে যেন তাদের মেয়ে নয়! বেঁচেই আছে শুধু কিন্তু একে বেঁচে থাকা বলে না। ক্ষতবিক্ষত শরীর আর মরে যাওয়া মন নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায়? তা, মনের খবর আর কজনই রাখে বলো! প্রাথমিক বিহ্ববলতা কেটে গেল দ্রুত, কঠোর বাস্তবতা হা করে এসে দাঁড়াল সামনে। গ্রামের লোক একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করল। ধর্ষিতা মেয়ে, সম্ভ্রম হারানো মেয়ে, সম্মান হারানো মেয়ে, জীবনের ওপর বীতশ্রদ্ধ এক মেয়ে, এই মেয়েকে নিয়ে কী করা যায় বলো? কোথায় রাখবে তাকে, কিভাবে পার করবে? এরকম এক মেয়েকে লোকেরা নিজেদের গ্রামে আর রাখতে চাইল না। বাপ-মায়ের ওপর চাপ এলো—হয় বিয়ে দিয়ে দাও নইলে যেভাবে পারো বিদায় করো



অনীক তাঁর ভাষার ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হচ্ছিল। নিশ্চয়ই অনেক বইটই পড়েন, হয়ত কবিতাও পড়েন, নইলে এমন চমৎকার সব শব্দ ব্যবহার করতে পারতেন না। সে অবশ্য এই গ্রামের সবকিছু নিয়েই মুগ্ধ হয়ে আছে। দুদিনের জন্য বেড়াতে এসে চারদিন পার করেও তার যেতে ইচ্ছে করছে না। এত সুন্দর গ্রাম সে জীবনে আর কখনো দেখেনি। আর এই মহিলা, সম্পর্কে তার দাদিশাশুড়ি, একটু দূর সম্পর্কের যদিও, এত সুন্দর করে গল্প বলেন যে কান পেতে শুনতে ইচ্ছে করে।

নদীই শুকিয়ে গেছে—তিনি বলতে লাগলেন—আর এ তো খাল! তাছাড়া, খাল টিকিয়ে রাখতে হলে দু-চার বছর পরপর খনন করতে হয়, নইলে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায়। নদী তীরবর্তী গ্রাম, বোঝোই তো। দু-দুটো নদী। একটু দূরে পদ্মা, সেখান থেকে ইছামতি এসে ঢুকে পড়েছে গ্রামগুলোর ভেতরে। খালের পানির উৎস তো ছিল ওই নদী। বর্ষার সময় পদ্মা থেকে ইছামতিতে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ত, ইছামতি থেকে এই খালগুলোতে, তারপর খাল উপচে ফসলের মাঠে। বর্ষার পরও খালে রয়ে যেত সেই পানি, গভীর ছিল যে! কতকাল যে খালগুলো খনন করা হয়নি! এখন আর মানুষের উদ্যম নেই, উদ্যোগ নেই, প্রয়োজনও নেই।

প্রয়োজন নেই কেন? পানির প্রয়োজন কখনো ফুরায় নাকি?

তা ফুরায় না, তবে বিকল্প উপায় থাকলে কে অত কষ্ট করে? আগে পানি ধরে রাখার জন্য প্রতিবছর চৈত্র মাসে গ্রামের মানুষই স্বেচ্ছায় খনন করত, যতটা সম্ভব গভীর করে। বর্ষায় পানি এলে ভরে যেত, আবার পানি নেমে যাওয়ার সময় যেন খালের পানিও চলে না যায় সেজন্য এর মুখে বাধ দেয়া হতো। ওই পানি দিয়েই সারাবছরের প্রয়োজন মিটত। তখন কত যে যত্ন ছিল মানুষের! এই গ্রাম, আশেপাশের আরো দু-চারটা গ্রাম ঘুরলে দেখবে আধমাইল পরপর একটা খাল...

তা সে ইতোমধ্যেই দেখে ফেলেছে। সে তো এখানে এসেছে গ্রাম দেখতেই। শহুরে পরিবেশে বড় হয়েছে অনীক, ছোটবেলায় মাঝে-মধ্যে দাদার বাড়ি বা নানার বাড়িতে যাওয়া হতো বটে, কিন্তু ওটাও বেড়ানোই হতো, সম্পর্ক তৈরি হয়নি। মাঝখানে দীর্ঘ প্রবাসজীবনের ফলে ওই যাওয়াটুকুও বন্ধ হয়ে গেল, আর অনেক বছর পর ফিরে এসে জানল—গ্রামের জমিজমা সব বিক্রি করে দিয়েছে বাপ-চাচারা। ওখানে কেউ থাকে না, ওসব দেখাশোনার ঝক্কি পোহাবে কে? ভিটেবাড়িটুকু আছে বটে, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কেউ আর যায় না সেখানে, বসবাসের উপযুক্তও নেই বোধ হয়। এসব কারণে নিজের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিতে আর যাওয়া হলো না অনীকের। অথচ ঢাকার বিষাক্ত পরিবেশে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। দেশে এসে বিয়ে করেছে সে, বিয়ে-পরবর্তী আতিথেয়তা, আনুষ্ঠানিকতা আর নিমন্ত্রণের বহরও তাকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। শ্বশুরবাড়িরও একই অবস্থা। গ্রামে একটা ঠিকানা আছে বটে, কিন্তু সেখানে কেউ থাকে না অনেক বছর ধরে। নতুন জামাই নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার মতো পরিবেশ নেই। বেশ কিছুদিন ধরেই সে বউকে বলছিল—‘কোনো একটা গ্রামে যেতে ইচ্ছে করছে। গ্রাম মানে গ্রামই, ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম বা সিলেট বা কক্সবাজার নয়। ’ তো, কয়েকদিন ভেবে মুনা জানাল—‘উদাসপুর যাওয়া যায়!’

উদাসপুর! নামটাই তো ভারি সুন্দর। কেউ আছে ওখানে?

হ্যাঁ, আমার এক দাদা-দাদি আছেন। বাবার মামা-মামি। দারুণ মানুষ। শহরে আসতে চান না, মাঝে-মধ্যে আমরাই গিয়ে দেখা করে আসি।

অনীক রাজি হয়ে গেল। দাদিকে চিঠি লেখা হলো। নতুন জামাই যাবে, না জানিয়ে কি আর যাওয়া যায়? চিঠির উত্তরও এলো দ্রুত। তারপর এই আসা। খুব ভালো লাগছে এসে। অপূর্ব সুন্দর গ্রাম। এখনো শহুরে সভ্যতা গ্রাস করে নিতে পারেনি এর সরল সৌন্দর্য। পাকা রাস্তা নেই গ্রামে, পায়ে চলা পথ; বিদ্যুৎ আসেনি বলে সন্ধ্যা হতে না হতেই বাড়িগুলোতে কুপি বা হারিকেন জ্বলে ওঠে; ঝিঁঝিঁর অবিশ্রান্ত কোলাহল, জোনাকজ্বলা বন, প্রহরজাগা পাখির করুণ-বিলম্বিত সুরের ডাক, টিনের চালে শিশির পড়ার শব্দ—ঠিক যেন উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে সব। পুরো ব্যাপারটাই অনীকের জন্য দারুণ রোমাঞ্চকর। এসেছিল দুদিনের জন্য, এত ভালো লাগছে বলে দাদিকে গিয়ে বলেছে—

আমি আরো কয়েকটা দিন থাকি দাদি?

দাদি অবাক—জিজ্ঞেস করার কী আছে দাদাভাই? যতদিন ইচ্ছে থাকো।

আমার তো সারাজীবন থেকে যেতে ইচ্ছে করছে।

তাও থাকতে পারো। আমার তাহলে একজন সঙ্গী জোটে।

দাদা তো হিংসে করবে!

করুক না! বুড়ো বয়সে একটু হিংসে হওয়া ভালো।

দাদি যতটা আলাপচারি, দাদা ততটা নন। খুব বেশি কথা বলেন না। বয়সের ভারে খানিকটা ক্লান্তও। দাদিরও বয়স হয়েছে। হয়ত সত্তরের কাছাকাছি। কিন্তু চলাফেরা দেখে বা কথাবার্তা শুনে অতটা মনে হয় না। এককালে যে দারুণ সুন্দরী ছিলেন তা অবশ্য বোঝা যায়। দাদির সঙ্গে খুনসুটি-ঠাট্টা-দুষ্টুমি, তাঁর হাতের অপূর্ব রান্না, বসে বসে গল্প শোনা, আর বউকে নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়ানো—এসব নিয়ে বেশ আনন্দেই আছে অনীক। বহুকাল পর সে এমন নির্ভার, দুশ্চিন্তাহীন, আনন্দময় জীবন কাটাচ্ছে। মুনাও সারাক্ষণ দাদার সঙ্গে পুটুরপুটুর গল্প করে, দুজনের খুব ভাব—বোঝা যায়।

এখানে-সেখানে ঘুরতে ঘুরতে মনে মনে গ্রামের পুরনো দিনের একটা ছবিও এঁকে ফেলেছে অনীক। বেশ বড় গ্রাম, কয়েক মাইল দক্ষিণে প্রমত্ত পদ্মা নদী, সেখান থেকে একটা শাখা ঢুকে এঁকেবেঁকে উত্তরের দিকে চলে গেছে, লোকে সেটিকে ইছামতি নদী বলে দাবি করে। শীর্ণ একটা নদী, দেখে অনীকের একটু সন্দেহ হয়েছিল, ভেবেছিল এটাও একটা খালই, কিন্তু দাদা-দাদি আর এখানকার বয়স্ক মানুষের কাছে জেনেছে, এটা প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হওয়া, বহুকাল আগে থেকেই ছিল, আর একসময় এত শীর্ণও ছিল না, এখনকার চেহারা দেখে পুরনো দিনের নদীটিকে বোঝা যাবে না। খাল মানুষই কাটে, আর নদী প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়—এই তথ্যও সে নতুন জেনেছে, আগে ব্যাপারটা জানা ছিল না তার। তো ইছামতির দু-পাড়ে দুটো আলাদা গ্রাম। নদীটি যেহেতু উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহমান, দু-পাড়ের গ্রাম দুটো পূর্ব ও পশ্চিম উদাসপুর নামে পরিচিত। সে এখন আছে পূর্ব উদাসপুরে। ব্যাপারটা দাঁড়ালো এইরকম—এই গ্রামের পশ্চিমে ইছামতি, ইছামতির ওপারে আরেক গ্রাম, এপারে অনেকগুলো বাড়ি, তারপর ফসলি জমির মাঠ, ছোটখাটো নয়—বিশাল মাঠ, সেই মাঠ পেরিয়ে দূরে মূল সড়ক, যেটা ধরে গঞ্জে যাওয়া যায়। সড়কের ওপাশে আবার অনেকগুলো বাড়ি। গ্রামকে ভাগ করেছে এই মাঠ। সেখানে কোনো বাড়িঘর নেই, শুধু চোখজুড়ানো ফসল আর ফসল। তো, খালগুলো কাটা হয়েছিল ইছামতির মুখ থেকে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে লম্বালম্বি করে, থেমেছে একদম মূল সড়কের গা ঘেঁষে। এখন পানি না থাকলেও একসময় এগুলোই ছিল গ্রামবাসীর প্রধান পানির উৎস। দাদির কাছে সেসব দিনের গল্প শুনছিল অনীক বাড়ির কাছের খালটির পাড়ে একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে। তিনি বলছিলেন—

এখন শ্যালো ইঞ্জিন এসেছে, টিউবওয়েল এসেছে, মানুষ মাটির নিচ থেকে পানি তোলে, খালের ওপর আর নির্ভর করে না। তাছাড়া ইছামতিও আর আগের মতো নেই। মুখে বাধ, নদীও নানা জায়গায় ভরাট।

সর্বনাশ! এখানেও নদী দখল হয় নাকি? হাউজিং সোসাইটি এসে গেছে?

না, তা নয়। পদ্মার ভাঙন ফেরানোর জন্য বাধটা দিতে হয়েছিল। এখন না আছে নদী, না আছে খাল। আরো সবকিছুর মতো এই চিহ্নও মুছে গেছে। কিন্তু মনের ভেতর যে চিহ্ন গেঁথে আছে তা কি আর মোছা যায়?

যায় না?

নাহ, যায় না।

আমার তো মনে হয় অনেকের মন থেকেই ওসব স্মৃতি মুছে গেছে।

না যায়নি। যারা যুদ্ধ করেছে বা দেখেছে তাদের মন থেকে মোছেনি। তবে এটুকু বলতে পারি খনন না করলে যেমন খাল শুকিয়ে যায়, নদী শুকিয়ে যায়, তেমনই মন বাঁচিয়ে রাখার জন্যও মাঝে মাঝে খুঁড়তে হয়। খুঁড়ে দেখতে হয়, ওখানে কী লুকিয়ে আছে।

হুম। আচ্ছা, ওই যে বলছিলেন, অনেক বেওয়ারিশ লাশ ভেসে গেছে এই খাল দিয়ে...

তা গেছে। যদিও আমি দেখিনি। আমি তো এ গাঁয়ের মেয়ে না, বউ হয়ে এলাম যুদ্ধের বছর দুয়েক পর। তোমার দাদার কাছে শুনেছি এসব কথা। একাত্তর সালে দীর্ঘস্থায়ী বর্ষা হয়েছিল বাংলাদেশে। আর এ অঞ্চলের বর্ষা মানে একেবারে থৈ থৈ বর্ষা, মাঠ-ঘাট সব পানিতে ডুবে থাকত। পায়ে হেঁটে চলার উপায় থাকত না, গাড়িটাড়ি চলার তো প্রশ্নই নেই। পাকিস্তানিরা নদীপথে চলাফেরা করত লঞ্চে, গ্রামের ভেতর ঢুকত নৌকা দিয়ে, রাজাকাররা পথ দেখিয়ে নিয়ে আসত। নির্বিচারে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিত, নিরীহ মানুষ মেরে গ্রাম উজাড় করে ফেলত। সোমত্ত মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত, মুক্তিযোদ্ধারাও ধরা পড়ত। ক্যাম্পে তাদের ওপর চলত অকথ্য নির্যাতন। যারা মারা যেত তাদের লাশও ফেলে দেয়া হতো পানিতে। যেভাবেই মরুক, লাশ পানিতে ফেলা ছাড়া উপায় ছিল না। বর্ষায় গোরস্তান ডুবে গিয়েছিল। এত লাশ কবর দেবে কোথায়, দেবেই বা কে?

শুনতে শুনতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল অনীক। কল্পনা করার চেষ্টা করেও ব্যাপারটা আয়ত্তে আনতে পারছিল না। মানুষের কল্পনারও একটা সীমা আছে—সে অনুভব করতে পারছিল।

দাদি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। বাতাসটা ভারী হয়ে আছে, অনীক আর কথাই বলতে পারছে না, বিস্তারিত বর্ণনা শোনার সাহসও হচ্ছে না! দাদিই আবার শুরু করলেন—

শুধু যে লাশ ভেসে যাওয়ার স্মৃতি তা নয়, আরো অনেক কিছুর সাক্ষী হয়ে ছিল এই খাল।

কী রকম?

ধরো, এই গাঁয়ের এক বউ সুযোগ পেলেই এই খালের পাড়ে এসে দাঁড়াত, আর মনভরে কাঁদত একা একা। সেই কান্নার সাক্ষী হয়ে ছিল সে। হয়ত বউটির চোখের অনেক নোনা পানিও মিশে গিয়েছিল এই খালের মিষ্টি পানির সঙ্গে!

কাঁদত কেন? বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য মন কেমন করত বলে?

না। বাপের বাড়িতে আর কোনোদিন যেতে পারবে না বলে।

কেন কেন?  প্রেমট্রেম করে বাপ-মায়ের অমতে পালিয়ে বিয়ে করেছিল বুঝি মেয়েটি?

নাহ! বাপ-মা রাখতেই চায়নি তাকে। রাখার উপায়ই ছিল না। মেয়েটিও পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, বাপ-মাও চেয়েছিল পালিয়ে যাক মেয়েটা, তবু বেঁচে থাকুক।

এ আবার কেমন কথা? কোনো বাপ-মা এমন চাইতে পারে?

স্বাভাবিক অবস্থায় পারে না, কিন্তু তখন সময়টি যে ছিল অস্বাভাবিক!

একটু খুলে বলুন না! এভাবে বললে কি কিছু বোঝা যায়?

মেয়েটিকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানের আর্মিরা, বন্দি করে রেখেছিল ওদের ক্যাম্পে। একাত্তরের জুন মাসে। তারপর ছ মাস ধরে...

ও!

অনীক আবার স্তব্ধ হয়ে গেল। এসব ‘গল্প’ আসলে শোনা কঠিন। ভীষণ কষ্ট হয়। যদিও শ্রোতার কাছে এগুলো ‘গল্প’ আর বক্তার কাছে তাঁর জীবন, তবু শ্রোতার কষ্ট হয়! ব্যাপারটা যে এদিকে মোড় নেবে, সে ভাবতেও পারেনি। প্রথমে ভেবেছিল, পরিবেশ হালকা করার জন্য দাদি নিজের যৌবনকালের গল্প শুরু করেছেন, সেও তাই ঠাট্টার ছলে প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করার কথা জিজ্ঞেস করেছিল, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এ এক অন্য গল্প। আবারও অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে অনীক জানতে চাইল—

তারপর?

সতেরই ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করল মেয়েটিকে। না, শুধু তাকেই নয়, আরো অনেক মেয়েকে। যাদের স্মৃতিশক্তি তখনও অক্ষুণ্ণ ছিল, মানে পুরোপুরি পাগল হয়ে যায়নি, বাড়ির ঠিকানা বলতে পেরেছিল, মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করল, বাকিদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো আশ্রয়কেন্দ্রে। সেই মেয়েটিকেও বাড়িতে পৌঁছে দিল এক মুক্তিযোদ্ধা। গ্রাম ভেঙে লোক এলো তাকে দেখতে। কেউ ভাবেনি যে সে বেঁচে আছে, এমনকি বাপ-মাও ধরে নিয়েছিলেন—তাদের মেয়ে মরে গেছে। এতদিন পর যে ফিরে এলো, সে যেন তাদের মেয়ে নয়! বেঁচেই আছে শুধু কিন্তু একে বেঁচে থাকা বলে না। ক্ষতবিক্ষত শরীর আর মরে যাওয়া মন নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায়? তা, মনের খবর আর কজনই রাখে বলো! প্রাথমিক বিহ্ববলতা কেটে গেল দ্রুত, কঠোর বাস্তবতা হা করে এসে দাঁড়াল সামনে। গ্রামের লোক একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করল। ধর্ষিতা মেয়ে, সম্ভ্রম হারানো মেয়ে, সম্মান হারানো মেয়ে, জীবনের ওপর বীতশ্রদ্ধ এক মেয়ে, এই মেয়েকে নিয়ে কী করা যায় বলো? কোথায় রাখবে তাকে, কিভাবে পার করবে? এরকম এক মেয়েকে লোকেরা নিজেদের গ্রামে আর রাখতে চাইল না। বাপ-মায়ের ওপর চাপ এলো—হয় বিয়ে দিয়ে দাও নইলে যেভাবে পারো বিদায় করো। মা-বাপ-আত্মীয়স্বজন পড়ল মহাবিপদে। চাইলেই কি বিয়ে দেয়া যায়? তার মতো স্বর্বস্ব হারানো মেয়েকে বিয়ে করবে কে? কিন্তু এসব কথা ওসব লোকদের বোঝানোর সাধ্য নেই, তাদের একটাই কথা—বিয়ে  দিতে না পারলে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলো!

ছিহ!—অনীক চিৎকার করে উঠল—ছি ছি! এরা মানুষ নাকি? গ্রাম ভরতি সব লোক কি রাজাকার ছিল?

না তা ছিল না। কিন্তু এই অবস্থাই চলছিল দেশজুড়ে। এই মেয়েরা সমাজের কাছে অপাঙক্তেয় হয়ে উঠেছিল।

কেন এমন হলো? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। ওই মেয়েরা তো কোনো দোষ করেনি!

আমার কি মনে হয় জানো? মানুষের আসলে দুটো মন। একটা ব্যক্তিগত, আরেকটা সামাজিক। সামাজিক মনটি কখনো কখনো ব্যক্তিমনকে ছাড়িয়ে যায়। তখন ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয় এমন অনেক বিষয়ও সমাজের চাপে গ্রহণ করে নেয় মানুষ। ওই সম্ভ্রম হারানো মেয়েদের ব্যাপারে সেটাই ঘটেছিল। নিশ্চয়ই এমন অনেক মানুষ ছিলেন, যাদের ভেতরে এদের জন্য সহানুভূতি ছিল, কিন্তু সামাজিক মনের কাছে হার মেনেছে তাদের ব্যক্তিগত মন।

তা তো বুঝলাম। কিন্তু কেউ এরকম আচরণের প্রতিবাদ করেনি? মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় ছিলেন? তাঁরাও প্রতিবাদ করেননি?

তখন তো খুব অস্থির সময়। মুক্তিযোদ্ধারা দিশেহারা। অনেকে চলে যাচ্ছেন আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্সে, নিজেদের ভেতর তৈরি হচ্ছে দ্বন্দ্ব, নিজেদের ভবিষ্যত নিয়েও সবাই কমবেশি শঙ্কিত। এদিকটায় নজর দেয়ার সুযোগ তাঁরা পাননি।

তারপর কী হলো?

এরকম চাপের মুখে মা-বাপ আর কীই বা করতে পারে? সাধারণ মানুষ তারা, রুখে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। তারা তো চাইতেই পারেন—মেয়েটা কোথাও পালিয়ে বাঁচুক!

তা পারেন। মেয়েটি সত্যিই পালিয়েছিল?

এই সময়ে ত্রাতা হয়ে এলেন মেয়েটির মামা-মামি। এসে সব দেখে-শুনে বললেন—মেয়েটাকে তাঁরাই নিয়ে যাবেন, মেয়ে হিসেবেই কাছে রাখবেন, কিন্তু শর্ত হলো তার মা-বাবা কোনোদিন পরিচয় দিয়ে তাকে আনতে যেতে পারবেন না। বাপ-মা বিনাবাক্যব্যয়ে রাজি হয়ে গেলেন, মেয়েটিও। মামা-মামি তাকে নিয়ে প্রথমে শহরে গেলেন, একটু ভদ্রস্থ করে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তাঁদের কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না তো, আদর-স্নেহের অভাব হয়নি মেয়েটির। তার নামও পাল্টে দিলেন তাঁরা।

নাম পাল্টালেন কেন?

পুরনো কোনো পরিচয় রাখতে চাইলেন না। তাঁদের গ্রামের মানুষ যেন কোনোভাবেই ব্যাপারটা জানতে না পারে, যেন তার প্রকৃত পরিচয় উদঘাটন করতে না পারে, সেই জন্য এই ব্যবস্থা।

ও! সেই নতুন নামেই মেয়েটির নতুন জীবন হলো?

হ্যাঁ, শুধু নিজের নাম নয়। বাবার নামও পাল্টে গেল!

বাবার নামও? আশ্চর্য! বাবার নামের জায়গায় মামার নাম লেখা হলো বুঝি?

নাহ! লেখা হলো পিতার নাম।

মানে?

পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি ফিরলেন দেশে। ফিরে দেখলেন তাঁর এত ভালোবাসার দেশ ছিন্নভিন্ন করে রেখে গেছে পাকিস্তানিরা। সর্বত্র সর্বনাশের ছাপ। তিনি তো শুধু নেতা ছিলেন না, ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন পিতা। এই মেয়েদের দুর্দশার বিষয়টি তিনি অনুভব করলেন বাবার মন নিয়ে। বললেন—‘মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিতা সকল মেয়ের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও, আর ঠিকানা লিখে দাও ধানমন্ডি ৩২ নম্বর। ’ কম কষ্টে এই কথা বলেছিলেন তিনি? সারাদেশেই তখন চলছে এই দুর্যোগ, সম্ভ্রম হারানো মেয়েদের ঘরে রাখতে চাইছে না তাদের বাপ-মায়েরা। আর রাখবেই বা কিভাবে? কেউ গর্ভবতী, কেউ বাচ্চার জন্ম দিয়েছে, কেউ পাগল হয়ে গেছে, আর বাকিরা নানা রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসা নেই, ওষুধ নেই, পথ্য নেই, আছে শুধু অপমান আর অসম্মান আর সামাজিক চাপ। বিপর্যয় নেমে এসেছে তাদের জীবনে। তিনি, সেই পিতাই কেবল বুঝলেন এই অপার বেদনার রূপ, এই রকম সব মেয়েকে স্বীকৃতি দিলেন নিজের কন্যা হিসেবে। সেই থেকে মেয়েটি বাকি জীবন পিতার নাম লিখেছে শেখ মুজিবুর রহমান আর ঠিকানা লিখেছে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর।

কী অদ্ভুত! অনীক ভাবছিল। একটা মেয়ে তার নাম পাল্টাল—এটা না হয় অনেকেই করে, শখ করেও করে, কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই করে; কিন্তু বাবার নামের জায়গায় সারাজীবন ধরে লিখে গেল জাতির পিতার নাম—এটা নিশ্চয়ই সচরাচর ঘটে না! এও তাহলে সম্ভব!

তারপর কী হলো দাদি?

তারও অনেকদিন পর সেই মুক্তিযোদ্ধাটি এলো তাদের বাড়িতে। মেয়েটিকে খুঁজল, কিন্তু সে তো পালিয়েছে। গ্রামের কেউ কিছু জানাতে পারল না, আর বাপ-মা কিছু জানাতে চাইল না।

কেন?

মেয়ে এক নতুন জীবন শুরু করেছে, সেখানে পুরনো কোনো মানুষের উপস্থিতি থাকুক তা নিশ্চয়ই চায়নি।

তারপর?

সে তখন মেয়ের বাপকে গিয়ে ধরল। বলল—ওকে আমি বিয়ে করতে চাই, বলুন মেয়েকে কোথায় রেখেছেন!

বিয়ে করতে চায় শুনে বাপ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সব খুলে বলল, নতুন ঠিকানাও দিল। আর তার পরদিনই সে এসে হাজির হলো মামার বাড়িতে। মামা প্রথমে স্বীকারই করতে চাননি যে, এই নামে এ-বাড়িতে কোনো মেয়ে আছে। কারণ সে খোঁজ করছিল পুরনো নামে, যে নাম এ বাড়িতে আসার পর বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। মামাকে সরাসরি বলল—আমি সব জেনেই এসেছি। মেয়েটি যদি রাজি থাকে তাহলে তাকে আমি বিয়ে করতে চাই।

এবার মামাও নরম হলেন। বিয়ের আয়োজন হলো। মেয়েটির বাপ-মা এলেন সেই বাড়িতে, তবু বিয়ের কাবিননামায় মেয়েটির নতুন নাম লেখা হলো—অপরাজিতা রহমান, পিতা : শেখ মুজিবুর রহমান, ঠিকানা : সড়ক নং ৩২, ধানমন্ডি, ঢাকা।

অনীক ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে সব। ফিসফিসিয়ে বলল—দাদি, আপনার নামটা খুব সুন্দর হয়েছে। অপরাজিতা। বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া ওই আশ্চর্য সুন্দর ছোট্ট ফুলটির মতোই আকর্ষণীয় আপনি।

দাদি একটুও অবাক হলেন না। বললেন—আমি জানতাম তুমি বুঝে ফেলবে। বুদ্ধিমান ছেলে। জানো, এই ঘটনা আমি কাউকে কোনোদিন বলিনি। এমনকি মুনাও জানে না, তার বাবাও জানে না।

কেন কাউকে বলেননি কোনোদিন? দেশের জন্য এত বড় সেক্রিফাইস করেছেন, আপনি তো আমাদের গর্ব।

বইয়ের ভাষায় কথা বলো না ভাই। আমরা যে কী অবস্থার ভেতর দিয়ে গিয়েছি, তা শুধু আমরাই জানি। লক্ষ লক্ষ মেয়ে সম্ভ্রম হারিয়েছে, তাদের কজনের নাম জানো তোমরা? গর্ব? গর্ব হলে নাম লিখে রাখতে না?

দাদির কণ্ঠে ক্ষোভ নেই, রাগ নেই, অভিমান নেই, আছে গভীর বেদনার দীর্ঘশ্বাস। অনীক আর কোনো কথা না বলে তাঁর পাশ থেকে নেমে মাটিতে বসে পড়ে, তারপর দু-হাতে তাঁর একটা পা তুলে নেয়।

এই করছো কী দাদাভাই? ছাড়ো। ছাড়ো বলছি।

অনীক ছাড়ে না। বরং মুখ নামিয়ে পায়ের পাতায় চুমু খায়, তারপর আরেক পা দু-হাতে তুলে নিয়ে সেটিতেও। তার চোখভরতি তখন জল ছিল, ছিল অপরাজিতা রহমানের চোখেও।



বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।