ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বাজিমাৎ (শেষ পর্ব)| ডি. এইচ্ লরেন্স | অনুবাদ: নূর-ই-ফাতিমা মোশাররফ জাহান

ধারাবাহিক অনুবাদ গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১৬
বাজিমাৎ (শেষ পর্ব)| ডি. এইচ্ লরেন্স | অনুবাদ: নূর-ই-ফাতিমা মোশাররফ জাহান

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

খুব সহজেই সবকিছু সামলে নেয় তারা। মামার বুদ্ধিমতো পল তার হাতে পাঁচ হাজার পাউন্ড তুলে দেয়।

মামা উকিলের মাধ্যমে বন্দোবস্ত করে দেয় যে পলের মা পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে প্রতি জন্মদিনে হাজার পাউন্ড পাবে উপহার হিসাবে।

মামা বলে, “যাক এখন থেকে তোর মা পরপর পাঁচ জন্মদিনে হাজার পাউন্ড করে উপহার পাবে। এভাবে পেতে পেতে আবার বদঅভ্যাস না হয়ে যায়। ”

পলের মায়ের জন্মদিন নভেম্বর মাসে। ইদানীং বাড়ির সেই আওয়াজটা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কিন্তু এত ভাগ্য থেকেও পল আর কুলিয়ে উঠতে পারছে না। হাজার পাউন্ডের কথা লেখা সেই জন্মদিনের চিঠিটি মায়ের হাতে পৌঁছালে কী ফল হয় তা দেখার জন্য তার আর তর সইছে না।

বাইরের লোক কেউ না থাকলে পল আজকাল বাবা মার সাথেই খাবার টেবিলে খেতে বসে। এখন সে বড় হচ্ছে কিনা। মা প্রায় রোজই শহরে যায়। মা আজকাল নিজের এক সুপ্ত প্রতিভার খোঁজ পেয়েছে—পোশাকের নকশা আঁকার গুণ। তাই এক বান্ধবীর চিত্রশালায় সে গোপনে আঁকাআঁকির কাজ শুরু করে। সেই বান্ধবী আবার নাম করা পোশাক বিপণির প্রধান নকশাশিল্পী। পত্রিকার বিজ্ঞাপনের জন্য রেশমী, পশমী, চুমকিওয়ালা নানা রকম পোশাকের নকশা এঁকে বান্ধবী বছরে কয়েক হাজার পাউন্ড রোজগার করে। আর এদিকে বছরে মাত্র কয়েক শ’ পাউন্ড রোজগারে পলের মায়ের মন ভরে না। সে মনে প্রাণে চায় কোনো একটা বিষয়ে সেরা হতে, অথচ সামান্য একটা পোশাক নকশার কাজে পর্যন্ত সেরা হতে পারছে না।



উকিল সাহেব পুরো পাঁচ হাজার পাউন্ডই মায়ের হাতে তুলে দেয়। এরপর ঘটে ভারি অদ্ভুত ঘটনা। বাড়ির সেই আওয়াজ এবার একদম লাগাম ছাড়া, উন্মত্ত। যেন কোনো মনোরম ফাল্গুনী সন্ধ্যায় অজস্র ব্যাঙের বেসুরো ঘ্যাঙর ঘ্যাং। বাড়িতে নতুন কিছু আসবাব এলো। পলের জন্যও নতুন শিক্ষক রাখা হলো। আসছে বছর পল বিখ্যাত ‘ইটন’ স্কুলে ভর্তি হবে। তার বাবাও একসময় এই নামী স্কুলের ছাত্র ছিল। ঘরদোরের সাজসজ্জা এখন আরো নজরকাড়া। পলের মা একসময় যেমন বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত ছিল, তারই ছোঁয়া এবার একটু একটু করে লাগতে শুরু করেছে পুরো বাড়ি জুড়ে। তবুও বাগানে থোকায় থোকায় ফুটে থাকা কাঠবাদাম ফুলের গুচ্ছ, লজ্জাবতী লতা আর সোফায় সাজানো রঙ-বেরঙের কুশনের তলা থেকে বেরিয়ে আসা তীব্র এক নিঃশব্দ চিৎকারে গোটা বাড়ি যেন গমগম করতে থাকে—“টাকা চাই, আরো টাকা! আরো চাই, অনেক টাকা! চাই-ই চাই, অনেক টাকা!”



জন্মদিনের সকালে পলের মা নাস্তা খেতে একতলায় নেমে এলো। মা চিঠিপত্র খুলে পড়ার সময় পল অধীর আগ্রহে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। উকিল সাহেবের চিঠির খাম পলের চেনা। চিঠিটা পড়তে পড়তে মায়ের চোখমুখ পাথরের মতো কঠিন, ভাবলেশহীন হতে থাকে। তার মুখে মমতার লেশমাত্র নেই, আছে শুধু দৃঢ় সংকল্পের ছায়া। মা এই চিঠি অন্যসব চিঠির তলায় লুকিয়ে রাখে। এ বিষয়ে আর একটাও কথা বলে না।

“জন্মদিনে আজ ভালো কিছু পাওনি, মা?”
“আছে আর কি, মোটামুটি,” মায়ের কণ্ঠ নিরুত্তাপ। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মা শহরের দিকে চলে যায়। কিন্তু বিকেল হতেই অস্কার মামা এসে হাজির। মামা জানায় পলের মা নাকি উকিল সাহেবের সাথে অনেকক্ষণ যাবৎ আলোচনা করেছে। মা ওই পাঁচ হাজার পাউন্ড একবারেই হাতে পেতে চাইছে, অনেক দেনা আছে কিনা।
“তোমার কি মত, মামা?” ছেলেটি জানতে চায়।
“তুই-ই বল কী করবি। ”
“তাহলে দিয়ে দাও না! অন্য রেসে ঠিকই আবার টাকা হতে আসবে। ”
“হাতের পাঁচ ছাড়তে নেই রে ভাগ্নে!’ অস্কার মামা বলে।
“সামনে গ্রান্ড ন্যাশনাল, লিংকনশায়ার আর ডার্বি-র রেস আছে। এর মধ্যে অন্তত একটা রেসের ব্যাপারে মন থেকে ঠিকই সায় পাব,” পল বলে।

অস্কার মামার অনুমতিতে উকিল সাহেব পুরো পাঁচ হাজার পাউন্ডই মায়ের হাতে তুলে দেয়। এরপর ঘটে ভারি অদ্ভুত ঘটনা। বাড়ির সেই আওয়াজ এবার একদম লাগাম ছাড়া, উন্মত্ত। যেন কোনো মনোরম ফাল্গুনী সন্ধ্যায় অজস্র ব্যাঙের বেসুরো ঘ্যাঙর ঘ্যাং। বাড়িতে নতুন কিছু আসবাব এলো। পলের জন্যও নতুন শিক্ষক রাখা হলো। আসছে বছর পল বিখ্যাত ‘ইটন’ স্কুলে ভর্তি হবে। তার বাবাও একসময় এই নামী স্কুলের ছাত্র ছিল। ঘরদোরের সাজসজ্জা এখন আরো নজরকাড়া। পলের মা একসময় যেমন বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত ছিল, তারই ছোঁয়া এবার একটু একটু করে লাগতে শুরু করেছে পুরো বাড়ি জুড়ে। তবুও বাগানে থোকায় থোকায় ফুটে থাকা কাঠবাদাম ফুলের গুচ্ছ, লজ্জাবতী লতা আর সোফায় সাজানো রঙ-বেরঙের কুশনের তলা থেকে বেরিয়ে আসা তীব্র এক নিঃশব্দ চিৎকারে গোটা বাড়ি যেন গমগম করতে থাকে—“টাকা চাই, আরো টাকা! আরো চাই, অনেক টাকা! চাই-ই চাই, অনেক টাকা!”

পলের বড় ভয় করে। সে গৃহশিক্ষকদের কাছে গ্রিক আর ল্যাটিন পড়ায় মনোযোগ দেয়। প্রবল উত্তেজনায় ব্যাসেটের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটে তার। গ্র্যান্ড ন্যাশনাল রেস গেল অথচ সে আগেভাগে কিছুই ‘জানতে’ পারেনি। এই কারণে একশ’ পাউন্ড হেরে যায় সে। গ্রীষ্মকাল এসে যাচ্ছে। লিংকনের রেস নিয়ে ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় তার দিন কাটে। কিন্তু লিংকনের বেলাতেও সে আগেভাগে মন থেকে কিছুই জানতে পারে না। এখানেও পাঁচশ’ পাউন্ড হেরে যায়। তার অদ্ভুত আচরণ আর উদভ্রান্ত চাহনি দেখলে মনে হয় যেন তার ভেতরে একটা ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটতে চলেছে।

“বাদ দে না, ভাগ্নে! এসব নিয়ে আর মাথা ঘামাস না তো!” অস্কার মামা পীড়াপীড়ি করতে থাকে। কিন্তু মামার কোনো কথাই যেন ছেলেটির কানে ঠিকমতো পৌঁছায় না।
“ডার্বির রেসের ফল আমাকে জানতেই হবে! জানতেই হবে!” ঘুরেফিরে সেই এক কথাই বারবার বলে যায় সে। তার বড় বড় নীল চোখ যেন জ্বলছে—এ যেন এক উন্মাদের দৃষ্টি।

তার এই অস্বাভাবিক উত্তেজনা একসময় মায়ের নজরে পড়ে।

“তুই বরং ক’টা দিন সাগরপাড় থেকে একটু বেড়িয়ে আয়। এখন এভাবে ঘরে বসে না থেকে বেড়াতে গেলেই বরং তোর বেশি ভালো লাগবে, তাই না? আমার তো মনে হয় গেলেই ভালো করবি তুই,” বলতে বলতে মা চিন্তিতভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মায়ের মন তার জন্য ভারী হয়ে আসে।

ছেলেটি তার রহস্যময় নীল চোখদু’টি মেলে তাকায়।

সে বলে, “ডার্বির রেসের আগে আমি কিছুতেই যেতে পারব না, মা! কিছুতেই না!”    ছেলের মুখে ‘না’ শুনে মায়ের গলা ধরে এলো। মা বলে, “কেন রে? কেন যাবি না? চাইলে সাগর দেখা শেষেও তোর অস্কার মামার সাথে রেস দেখতে যেতে পারবি। শুধু শুধু এখানে বসে থেকে তোর কাজ নেই। তাছাড়া আমি খেয়াল করেছি তুই এসব রেস নিয়ে অতিরিক্ত মাথা ঘামাচ্ছিস। এ তো মোটেও ভালো লক্ষণ না। আমার বাপের বাড়িতে সবার জুয়ার নেশা। আর এই নেশা যে কতটা ক্ষতি করেছে তা বড় না হয়ে বুঝতে পারবি না। অনেক ক্ষতি করেছে। ওই ব্যাসেটকে এবার বিদায় করতে হবে। তোর অস্কার মামাকেও বলে দেব, তোর মাথা থেকে রেসের ভূত নামার আগে যেন তোকে আর এসব ছাইপাঁশ গল্প না বলে। এবার যা, সাগরপাড় থেকে ঘুরে আয়। আর মাথা থেকেও এসব ঝেড়ে ফেল। তোর মাথা একেবারে খারাপ হয়ে যাচ্ছে!”
“তুমি যা বলবে তাই করব, মা। শুধু ‘ডার্বি’র রেসের আগে আমাকে এখান থেকে কোথাও যেতে বলো না,” ছেলে বলে।
“এখান থেকে মানে? এই বাড়ি থেকে?”
“হ্যাঁ,” ছেলেটি একদৃষ্টে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে জবাব দেয়।
“অদ্ভুত ছেলে তো তুই। আচ্ছা, এই বাড়ি নিয়ে তোর হঠাৎ এত মাথাব্যথা কিসের? এ বাড়ি যে তোর এত প্রিয় জানতাম না তো। ”

ছেলেটি নীরবে অপলক চেয়ে থাকে মায়ের মুখের দিকে। তার গোপন কথাটির মাঝেও আরেকটি গোপন কথা লুকিয়ে আছে যার কথা সে কারো কাছেই প্রকাশ করেনি, এমনকি ব্যাসেট বা অস্কার মামার কাছেও না।

মা কয়েক মুহূর্ত দ্বিধাগ্রস্তভাবে অন্ধকার মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বলে, “আচ্ছা, ঠিক আছে! তোর মন না চাইলে ডার্বির রেসের আগে সাগরপাড়ে যেতে হবে না। কিন্তু আমাকে কথা দে, এসব ভেবে ভেবে আর তুই মাথা খারাপ করবি না। কথা দে, ওসব রেস-টেস নিয়ে আর এত বেশি মাথা ঘামাবি না। ”
“আরে না, আমি আর ওসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামাব না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো, মা। তোমার জায়গায় হলে আমিও নিশ্চিন্তে থাকতাম,” ছেলেটি সহজ গলায় বলে ওঠে।
“তুই আমার জায়গায় আর আমি তোর জায়গায় হলে যে কী হতো তাই ভাবি,” মা বলে।
“কিন্তু মা, তোমার আসলেই চিন্তার কোনো কারণ নেই,” ছেলে আবারও বলে।
“শুনে বড়ই খুশি হলাম,” মা ক্লান্ত স্বরে জবাব দেয়।
“তুমি খুশি হতেই পারো, মা। মানে তোমার জেনে রাখা ভালো যে তুমি সত্যিই নিশ্চিন্তে থাকতে পারো,” ছেলে খুব জোর দিয়ে বলে।
“তাই বুঝি? তাহলে ভেবে দেখব সত্যিই নিশ্চিন্ত হতে পারি কি না,” মা বলে।

পলের গোপনতম কথাটি আসলে তার সেই কাঠের ঘোড়া, যে ঘোড়ার নির্দিষ্ট কোনো নাম নেই। একটু বড় হয়ে যাওয়ায় সে এখন আয়ার নজরদারি থেকে মুক্ত। তাই কাঠের এই খেলনা ঘোড়াটিকে সে খেলাঘর থেকে সরিয়ে এনে চিলেকোঠায় তার শোবার ঘরে রেখেছে।
“তোর কি এখনো এই কাঠের ঘোড়ায় চড়ার বয়স আছে?” মা আপত্তি করেছিল।
“দেখো মা, সত্যিকারের ঘোড়া যতদিন না পাচ্ছি ততদিন না হয় এই ঘোড়াতেই চড়লাম,” ছেলের খামখেয়ালী জবাব এলো।
“এই ঘোড়ার সাথে খেলতে সত্যিই তোর ভালো লাগে?”
“হ্যাঁ মা, এই ঘোড়া খুব ভালো। এর সাথে খেলতে আমার খুব ভালো লাগে। ”
আর এভাবেই জীর্ণশীর্ণ ঘোড়াটি স্থির, উদ্ধতভঙ্গিতে ছেলেটির ঘরেই নিজের জায়গা করে নিল।

‘ডার্বি’র রেসের দিন ঘনিয়ে আসতে থাকে আর ছেলেটির অস্থিরতা বেড়েই চলে। কেউ কিছু বললে যেন শুনতেই পায় না। শরীর একেবারেই ভেঙে পড়েছে, চোখের দৃষ্টিও উদভ্রান্ত। ছেলের চিন্তায় মাঝে মাঝে অদ্ভুত এক অস্বস্তিতে মায়ের হাত পা আচমকা জমে আসে। একরাশ দুশ্চিন্তা হঠাৎ এসে তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। প্রতিবারই প্রায় আধ ঘণ্টা যাবৎ এমন লাগে তার। তখন খুব ইচ্ছা করে ছুটে গিয়ে দেখে আসতে যে তার ছেলেটি নিরাপদে আছে কিনা।

ডার্বির রেসের দু’দিন আগের কথা। মা সেই রাতে শহরে গেল জমকালো এক অনুষ্ঠানের নেমন্তন্ন রক্ষা করতে। সেখানে হঠাৎ তার নাড়ি ছেড়া ধন—তার প্রথম সন্তানের জন্য সেই দুশ্চিন্তার অনুভূতিটি এমনভাবে তার সমস্ত সত্তাকে গ্রাস করে ফেলে যে ঠিকমতো কথা বলতেও তার কষ্ট হয়। সে প্রাণপণে এমন দুর্ভাবনা তার মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চায় কারণ তার সাধারণ বিবেচনা অনুযায়ী এমন আশঙ্কা নিতান্তই ভিত্তিহীন। কিন্তু এ যাতনা এতটাই ভয়াবহ যে নাচের আসর ছেড়ে সে দ্রুত ছুটে যায় টেলিফোনে বাড়ির খবর নিতে। ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করার আয়া এত রাতে ফোন পেয়ে ভীষণ অবাক হয়, একেবারে চমকে ওঠে।

“ছেলেমেয়েরা সব ঠিক আছে তো, মিস উইল্মট?”
“জ্বী ম্যাডাম, তারা সব ঠিকই আছে। ”
“আর তোমাদের ছোট সাহেব? সে ঠিক আছে তো?”
“সে তো লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘুমুতে চলে গেল। ছুটে গিয়ে একবার দেখে আসব?”
“না, না, ঠিক আছে। যেতে হবে না। আজ আমরা আগে আগেই ফিরব। তোমাকে আর আমাদের জন্য জেগে বসে থাকতে হবে না। ” পলের মা অনিচ্ছাসত্ত্বেও আয়াকে নিষেধ করে দেয়। সে তার ছেলের ব্যক্তিসাতন্ত্র্যে হস্তক্ষেপ করতে চায় না।
“জ্বী আচ্ছা, ম্যাডাম” আয়া বলে।

পলের বাবা মা যখন গাড়ি করে বাড়ি ঢোকে তখন ঘড়িতে রাত একটা বাজে। চারিদিকে সুনশান নীরবতা। পলের মা ঘরে গিয়ে তার সাদা পশমি ওভারকোটটি আলগোছে খুলে ফেলে একটু হালকা হয়। কাজের মেয়েকে আগেই বলে রেখেছিল যেন তার জন্য জেগে না থাকে। একতলা থেকে পলের বাবার আওয়াজ পাওয়া যায়, সেই সাথে হুইস্কির গ্লাসের টুংটাং শব্দ।

ঠিক সেই সময় অদ্ভুত সেই দুশ্চিন্তা আবারও তার মনকে ঘিরে ধরে। তাই সে চুপি চুপি সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যায় ছেলের চিলেকোঠার ঘরের দিকে। তিনতলার বারান্দা দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলে সে। একটা অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসছে না? কিসের আওয়াজ এটা?

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কান পাতে সে। শুনতে শুনতে তার শরীর যেন অবশ হয়ে এলো। ভেতরে কেমন একটা অদ্ভুত শব্দ—ভারি অথচ চাপা। তার হৃৎপিণ্ডের গতি যেন থেমে গেল। আওয়াজটা চাপা হলেও প্রবল আর দ্রুতগামী। বিরাট কোনো বস্তু যেন নিঃশব্দে অথচ প্রবলবেগে নড়ে চলেছে। সেটা কী? ও ঈশ্বর, কী সেটা? তাকে জানতেই হবে। তার মন বলছে এই শব্দ তার চেনা, সে জানে কী নড়ছে।

তবু সে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না। কিছুতেই যেন বলে বোঝাতে পারে না সে। আর সেই জিনিসটা পাগলের মতো নড়ে চলে, নড়তেই থাকে।

ভয়ে আতঙ্কে প্রায় জমে গিয়ে সে আস্তে আস্তে দরজার হাতল ঘোরায়।

ঘর অন্ধকার। তবু আবছা ছায়ায় আর অস্ফুট শব্দে বোঝা যায় যে জানালার পাশে কিছু একটা প্রবল বেগে অনবরত সামনে পেছনে দুলে চলেছে। বিস্ময়ে আর ভয়ে তার চোখ দু’টো ছানাবড়া।

আচমকা সে বাতি জ্বেলে দেখতে পায় তার ছেলে একটি সবুজ পায়জামা পরে পাগলের মতো কাঠের ঘোড়ায় বসে দুলে চলেছে। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে দেখা গেল ছেলে দুর্দান্ত প্রতাপে কাঠের ঘোড়া হাঁকিয়ে চলেছে আর তার স্বর্ণকেশী মা হালকা সবুজ পোশাক আর স্ফটিকের গয়না পরে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
“পল! তুই এটা কী করছিস?” মা চিৎকার করে ডাকে।
“‘মালাবার’ জিতবে! ‘মালাবার’ জিতবে!” ছেলে অদ্ভুত তেজে চিৎকার করতে থাকে।

ছেলেটির জ্বলন্ত চোখ দু’টি কেবল ক্ষণিকের জন্য মায়ের দিকে অর্থহীন দৃষ্টি হেনে থেমে যায়। তারপর সে দড়াম করে আছড়ে পড়ে মেঝেতে। মায়ের হৃদয়ে যেন তার বেদনাপীড়িত মাতৃত্বের এক প্লাবন বয়ে যায়। সে ছুটে যায় তার ছেলেকে ধরে তুলতে।

কিন্তু ছেলেটি তখন অজ্ঞান হয়ে গেছে। আর অজ্ঞান হয়েই সে অনেকটা বিকারগ্রস্তের মতো পড়ে থাকে। ছেলেটি বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে করতে কথা বলে। মা তখন ছেলের পাশে পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।

“‘মালাবার’! ‘মালাবার’ জিতবে! ব্যাসেট, ব্যাসেট, আমি জেনে গেছি! ‘মালাবার’ জিতবে!” এভাবে চিৎকার করতে করতে ছেলেটি বারবার বিছানা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করতে থাকে। উঠে গিয়ে সেই কাঠের ঘোড়া হাঁকাতে চায় সে, যার পিঠে চেপে সে ভবিষ্যতের সন্ধান পায়।
“‘মালাবার’ মানে কী?” ছেলেটির কঠিন-হৃদয় মা জানতে চায়।
“জানি না,” তার বাবা পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে জবাব দেয়।
“‘মালাবার’ মনে কী?” মা এবার তার ভাই অস্কারকে জিজ্ঞেস করে।
“ ‘মালাবার’ ডার্বির রেসের একটা ঘোড়ার নাম,” ভাইয়ের জবাব এলো।
কিছুটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও অস্কার ক্রেসওয়েল ব্যাসেটের সাথে আলোচনা করে। তারপর ‘মালাবার’-এর নামে হাজার পাউন্ড বাজি ধরে আসে—জিতলে বাজির টাকার চৌদ্দ গুণ উঠে আসবে।

অসুখের তৃতীয় দিনে রোগীর অবস্থা আরো গুরুতর হয়। সবাই অপেক্ষা করতে থাকে কখন অবস্থার একটু পরিবর্তন হয়। ছেলেটির এক মাথা কোঁকড়া চুল। বালিশে মাথা রেখে অনবরত এপাশ ওপাশ করে চলেছে। তার না হয় ঘুম, না ফেরে জ্ঞান। তার নীল চোখ দুটি যেন একজোড়া নীল পাথর। মা তার ঠায় বসে থাকে। মা ভেবেছিল নিজের হৃদয় বলে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই,  কিন্তু সেই হৃদয় আসলে পাথরে পরিণত হয়েছে।

সেদিন সন্ধ্যায় আর অস্কার ক্রেসওয়েল আসে না। কিন্তু ব্যাসেট রোগীর ঘরে অনুমতি চেয়ে পাঠায়। সে কিছুক্ষণ, শুধুমাত্র অল্প কিছুক্ষণের জন্য রোগীর ঘরে একটু আসতে চায়। ব্যাসেটের অনধিকারচর্চায় পলের মা খুব রেগে গেলেও পরে কী ভেবে যেন রাজি হয়ে যায়। ছেলের অবস্থা সেই আগের মতোই। কে জানে, যদি ব্যাসেট এসে তার জ্ঞান ফেরাতে পারে।

ব্যাসেট মালি ছোটখাটো মানুষ। নাকের নিচে ছোট্ট এক টুকরো বাদামী গোঁফ। তার ছোট ছোট বাদামী চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। লোকটি পা টিপে টিপে ঘরের ভেতরে ঢোকে। তারপর পলের মাকে একটা সেলাম ঠুকে চুপিসারে রোগীর বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ছোট ছোট চকচকে চোখ মেলে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ছটফট করতে থাকা মুমূর্ষু ছেলেটির দিকে।

ব্যাসেট ফিসফিস করে বলে, “ছোট সাহেব!, ছোট সাহেব! ‘মালাবার’ জিতে গেছে, একেবারে বাজিমাৎ। তোমার কথামতোই কাজ করেছি। তুমি সত্তর হাজার পাউন্ডেরও বেশি জিতেছো; এখন তুমি আশি হাজার পাউন্ডের মালিক। ‘মালাবার’ বাজিমাৎ করেছে, ছোট সাহেব!”
“‘মালাবার’! ‘মালাবার’! আমি কি ‘মালাবার’-এর কথাই বলেছিলাম, মা? ‘মালাবার’? মা, তোমার কি মনে হয় আমার ভাগ্য আছে? আগেই জানতাম ‘মালাবার’ জিতবে, তাই না? আশি হাজার পাউন্ডেরও বেশি! এটা তো ভাগ্যের কথা, তাই না মা? আশি হাজার পাউন্ডেরও বেশি! আমি জানতাম, সব জানতাম! ‘মালাবার’-এর বাজিমাৎ! মন থেকে সায় পাওয়ার আগ পর্যন্ত যদি ঘোড়ার পিঠে দুলতেই থাকি, তবে তোমায় বলে দিচ্ছি ব্যাসেট, যতদূর খুশি তত দূর যাওয়া যায়। তোমার সাধ্যমত বাজি ধরেছিলে তো, ব্যাসেট?”
“হাজার পাউন্ড ধরেছিলাম, ছোট সাহেব!”
“কখনো তোমাকে বলা হয়নি মা, একবার যদি ঘোড়ায় চড়ে দুলতে দুলতে সায় পেয়ে যাই, তবে নিশ্চিন্ত... একেবারে নিশ্চিন্ত। মাগো, তোমায় কি কখনো বলেছি, মা? আমার ভাগ্য আছে!”
“ না রে, কখনো বলিসনি”, মা বলে।

সে রাতেই ছেলেটি মারা গেল।

ছেলের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে মা শুনতে পেল তার ভাই তাকে উদ্দেশ্য করে বলছে—“সত্যি বলছি রে হেস্টার, একদিকে তোর লাভের খাতায় উঠল আশি হাজার পাউন্ড, আর অন্য দিকে লোকসানের খাতায় তোর এই হতভাগা ছেলেটা। হায়রে অভাগা, যে দুনিয়ায় জিততে গেলে এভাবে খেলনা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ছুটতে হয়, সেই দুনিয়া ছেড়ে পালিয়ে বড় বাঁচা বেঁচে গেছে বেচারা। ”



বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১৬

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।