পেটের ভেতর রক্ত পিপাসু জোঁকের মতো ক্ষুধারা কামড়ায়। ক্ষুধার সাথে আঁতাত করে গা-ও গুলাচ্ছে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। পেটের ভেতর খিদেটা আরো বাড়ে। চোখ জ্বলে। কান্না পায়। নিয়নের আলোর নিচে হঠাৎ কোত্থেকে একটা গাড়ি এসে থামে। জানলার কাচ নামে। উঁকি দেয় একটি মুখ। সব পুরুষের মুখ যেমন থাকে। মন্দিরা চঞ্চল হয়। মনে হয় ইনিই দেবতা। অন্ন জোগান যিনি তিনিই তো দেবতা। পূজা প্রাপ্য তো তারই। ইশারায় ডাকে মানুষটি মন্দিরাকে
গুলশান দুই নাম্বার। পাকিস্তান এ্যাম্বাসির দিকে যেতে হাতের বামে পড়ে গুলশান পার্ক। লাগোয়া রাস্তার এক কোণায় বসে আছে মন্দিরা। হালে এই জায়গাটা রমরমা। হারদিনের মতো আজো মুখে প্রসাধন। সস্তার লিপস্টিক, স্নো পাউডারের কমতি নেই, চোখে কাজল। কাজল নিয়ে মন্দিরার একটু বাড়াবাড়ি মতন আছে। এজন্য মা’র কাছে কত গালি খেয়েছে,
- পেরতের মতো চক্ষে সারাদিন কালি মাখস কেনলো। দেহায় কিরম
- আমি পেরত হইলে তুমি পেরতের মা। দেইখ্য, একদিন এক রাজার বেটা আসব। আমার চক্ষের দিকে চাইয়া বলবে—কইন্যা, তুমার চক্ষে আমার সর্বনাশ দেখিগো।
হাসির দমকে কথা শেষ করতে পারে না। মা অবাক তাকিয়ে থাকে। এই মেয়ের কথার আগামাথা বোঝা তার সাধ্যের বাইরে। যৌবন আসতে এখনো বাকি। শপথ করে বলতে পারি, এই মেয়ে রূপবতী হবে। পিতার জমি নেই জিরেত নেই। দুয়ে একে তিনের সংসার। নদীর পাড়ে ঘর। ঘর ভরা ছোপছোপ দারিদ্র্য। খায় কোনোদিন, কোনোদিন খায় না। দিনশেষে মায়ের কোলে নিদ্রা যায়। আহারে মন্দিরা!! সেই কালান্ত রাতের ভাঙ্গনে ঘর গেল, বাপ মা দুই’ই গেল। আর গেল নিদ্রা, সুখনিদ্রা। একলা কিশোরী সদ্য গোর দেয়া লাশের মতন। শেয়াল কুকুরে টেনে তুলে, ছিঁড়ে খায়। ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। রক্ত মাংস শ্লেষ্মা।
মন্দিরার সবচে প্রিয় প্রসাধন সুগন্ধি। প্রতিদিন সে গায়ে আতর মাখে। রমিজ কাকার দোকান থেকে প্রত্যেক মাসের দ্বিতীয় শুক্রবারে এক শিশি আতর কেনে। কয়েকমাস আগেও পঁচিশ টাকা ছিল, এখন চল্লিশ। দেশে সব জিনিসের দাম বাড়ন্ত, কমে খালি মানুষের। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিন দিনের জন্য এক পার্টির সাথে গিয়েছিল ময়মনসিংহ। ডাঙ্গা নয়, ঘর নয়। দিন রাত পানির উপর বজ্রা ভাসে। সেই সাথে ভাসে মন্দিরা। বাতাসে আওলা শাড়ির আঁচল ভাসে। যার সাথে ছিল, সে কবিয়াল মানুষ। কথায় কথায় ছন্দ মিলায়:
পুবাল হাওয়া দেখা দিয়া দূর চলিয়া যায়
সইগো তুমি আইসো কাছে, বইসো আমার নায়
সুবাসি সাবানে স্নানের পর সেদিন হলুদের ফোঁটা দেয়া লাল একটা শাড়ি পরেছিল মন্দিরা। সাজ পরিপূর্ণ হলে আয়নায় নিজেকে পরখ করা। হাত ব্যাগের ভেতরে একটা গোপন কোণা আছে। তার ভেতরে সে লুকিয়ে রাখে সিঁদুরের ছোট একটা কৌটা। প্রতিবার মৃত্যুর আগে আলগোছে সিঁদুর পরে মন্দিরা। মনে মনে স্বামী মেনেই নতুন পুরুষের সাথে নিশিযাপন। অপাপ যুবতী। যে ছোঁয় পাপ তার। যে শরীরীউল্লাসে মাতে পাপ তার।
চৈত্রের মোটে প্রথম। বাতাসে ফাল্গুনের ঝিম ধরা নেশাটা এখনো কাটেনি। হাওড়ের জলের উপর নগ্ন আকাশ। নীল নীল তারার রাত। জন নাই, মানুষ নাই, ভিটে মাটি কিচ্ছু নাই। নিশুত রাত আর অন্ধকারের ভাঙন। সুশোভিত বজ্রা জল কাটে। দোতলায় সজ্জিত ঘর। সদ্য ভাঁজ ভাঙ্গা বিছানার চাদরে চনমনে গন্ধ। গঞ্জিকা সেবনের পর সেরাতে কবি পুরুষ কৌতূহলে তাকিয়েছিল তার দিকে,
- হিন্দুর মাইয়া তুমি?
- পিতা হিন্দু ছিল। নিজের ধর্ম জানি না। আইজ রাইতে তোমার ধর্ম যা আমারও তাই।
- সংসার নাই, পুত্র নাই সিন্দুর পরো কেন?
- তোমার দীর্ঘ জীবন কামনা করিগো পুরুষ। বলে মন্দিরার হায় রে সে কী হাসি। ঈশানে খোদা সাক্ষী, নৈঋর্তে ভগবান। পরথম যেদিন সে আমার আচানক ঘুম ভাঙ্গাইছিল, কুপির টিমটিম্মা আলোয় আমি তার মুখ দেখছি। আমার শইল্যের ভিতরে তার রক্ত দৌড়ায়। আমার পিতৃব্য সে। আমি চিৎকার কইরা ডাকছি, আয়রে দেবী মনসা, আয় মা কালী-চণ্ডাল রূপ ধইরা অশুরেরে বধ কর। আমারে বাঁচাও মাগো। কেউ আসে নাই। যাইবার কালে জেঠু বিশটা টাকা দিয়া কইছিল, চাইল কিন্না ভাত ফুটাইয়া খাইস। আমার কোনো পাপ নাই। আমার কোনো ধর্ম নাই। আমি জানি শুধু ক্ষুধার অন্ন জুগাতে হবে।
সেই কবি মানুষটা তাকে মায়া করেছিল, যদিও মায়ার ধার ধারে না সে। প্রতি সন্ধায় স্বামী বদল-তার আবার মায়া কী? কিন্তু পেটে যখন আগুন থাকে না, মনের গহনে তার কথা মনে পড়ে। নিরালায় বসে সে তার চুলে হাত বুলিয়েছিল। মমতায় মাখামাখি সে হাত। কত কত কবিতার লাইন আওড়েছিল! মন্দিরা কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না। মুগ্ধ হয়ে শোনে শুধু। “মন্দিরা, তোমারে আমি ঘর দিতে পারব না, কোল ভইরা পুত্র দিতে দিতে পারব না। নামের পাশে নিজের নাম জুইরা তোমার বদনামী ঘুচাইতে পারব না। কিন্তু এই কথা মনে রাইখ্য মেয়ে, তোমার জইন্য আমার মায়া লাগছে। আমি তোমারে ভুলে যাব না কোনোদিন। ” বাহিরে রাত পাখি ডাকে। ব্লাউজের হুকে হাত পরে। আজ নিজেকে চিতার আগুনে পোড়া শব মনে হয় না। আজ জেগে উঠে চরাচর। লখিন্দরের লোহার বাসর ঘরে বেহুলা সুন্দরী। ফিরে আসার সময় কবি তাকে একটা সেন্টের বোতল উপহার দিয়েছিল। মন্দিরা সেটা গায় মাখেনি কোনোদিন। যত্ন করে রেখে দেয় ফুলতোলা টিনের বাক্সে। মাঝে মাঝে বের করে দেখে শুধু। আবার রেখে দেয় যত্ন করে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। পেটের ভেতর খিদেটা আরো বাড়ে। চোখ জ্বলে। কান্না পায়। নিয়নের আলোর নিচে হঠাৎ কোত্থেকে একটা গাড়ি এসে থামে। জানলার কাচ নামে। উঁকি দেয় একটি মুখ। সব পুরুষের মুখ যেমন থাকে। মন্দিরা চঞ্চল হয়। মনে হয় ইনিই দেবতা। অন্ন জোগান যিনি তিনিই তো দেবতা। পূজা প্রাপ্য তো তারই। ইশারায় ডাকে মানুষটি মন্দিরাকে। ত্রস্তে উঠতে গিয়ে বুঝতে পারে, অনেকক্ষণ একভাবে বসে থাকায় পায়ে ঝি ঝি লেগেছে। ভুলে গিয়ে প্রায় দৌড়োয়। এটা সেটা কথা হয়। দামে মিলে। শরীরের দাম, কতইবা আর।
- নাম কী?
- যা মন চায় ডাইক্কো, জবা কুসুম আলো মতি। জল তো জলই। গেলাসে রাখলে যা, ঘটিতে রাখলেও তা। শুচি অশুচি তোমাদের মনে।
- স্ত্রী গেছে বাপের বাড়ি। তোমাকে আজ রাতে ঘরেই নিয়ে যাই। উঠে আসো, বুভুক্ষু পুরুষের আহবান।
দরজা খোলার শব্দ পাওয়া যায়। মন্দিরার চোখে ভাসে সাদা ভাত। ফেনা ওঠা গরম ভাত। ব্যাগের গোপন কোণায় সিঁদুরের কৌটার ওপর হাত রাখে সে। অস্ফুটে তিনবার উচ্চারণ করে, আয়দেহসইত্য, আয় ক্ষুধা সইত্য, আয় ভাত সইত্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৬