প্রথম পর্বের লিংক
৩.
আজ থেকে দুশো বছর আগে ‘পণ্ডিত’ ও ‘মুন্সি’ দুটি পদ তৈরি করেছিল ইংরেজরা। সংস্কৃত-জানা ও ফারসি-জানা লোক যথাক্রমে এই দুই পদের অধিকারী।
পরবর্তীকালে দেখা গেল, পণ্ডিতদের অনুচর একদিকে ফারসিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে উদ্যত, অন্যদিকে মুন্সিদের গুপ্তচর সংস্কৃতকে হটিয়ে দিতে মশগুল। প্রথম পক্ষের উৎপাত পুরো উনিশ শতক জুড়েই। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ১৮৩৮ সালে ‘পারসীক অভিধান’ নামে যে সংকলনটি করেন জয়গোপাল তর্ক্কালঙ্কার, তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষায় যে সব বিদেশি (ফারসি) শব্দ ব্যবহৃত হয় তা চিহ্নিত করা। যাতে এসব শব্দ পরিহার করে শুদ্ধ বাংলা চর্চায় লেখকরা সচেতন হয়ে ওঠেন। [উৎস : মোহম্মদ আজম, বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও রবীন্দ্রনাথ]। দ্বিতীয়পক্ষের আবির্ভাব ঘটে বিশেষত বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বর্তমান বাংলাদেশের পাকিস্তান পর্বে। সে আলোচনায় যাব পরে। লক্ষণীয়, এরা কেউই চাষাভুশার বয়ান থেকে শব্দ কুড়াতে তেমন আগ্রহী নয়। এটা কি দুই সংস্কৃতির লড়াই শুধু, ইংরেজের ইন্ধন ও আস্কারায়? তা মনে হয় না। এ সংকট বা সংঘাত আগেও ছিল, তবে একটু ভিন্নভাবে। তার কিছু আভাস পাই আবদুল হাকিমের কবিতায় :
যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। / সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। ।
এরও একশো বছর পর ভারতচন্দ্র লিখছেন :
প্রাচীন পণ্ডিতগণ গিয়াছেন কয়ে। / যে হৌক সে হৌক ভাষা কাব্য রস লয়ে। ।
.................
না রবে প্রসাদগুণ না হবে রসাল। / অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল। ।
এটাকে একটা খাঁটি বাংলা কবিতাই মনে হচ্ছে। শুধু বাধ সাধছে নিচে-দাগ-দেওয়া শব্দগুলি। কবিতাংশটি নিয়েছি ‘হুচ্’ নামে একটি ছোটকাগজ থেকে। যার সম্পাদক কবি আলোড়ন খীসা। ‘হুচ্’ চাকমা শব্দ, এর মানে চিহ্ন। এই কবির নাম হেগা চাকমা। পত্রিকা থেকেই জানতে পারি, রিপরিপ কথাটার মানে নিভু নিভু। আর আদাম হলো গ্রাম। বর্তমানে এই বাংলাদেশে আদিবাসীদের উদ্যোগে বেশ কিছু দ্বিভাষিক সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা লিপিতে। রাঙামাটি কিংবা খাগড়াছড়ি থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে রেঙ (ধ্বনি), রানজুনি (রংধনু), কাজলী (অনুরোধ), রেগা (সেতুবন্ধন) ইত্যাদি। এসব পত্রিকার মধ্যে বাস্তবিক অর্থে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে একটা সেতুবন্ধনের প্রয়াস দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের তরফে সে প্রয়াস কোথায়?
সেদিনের ভাষা-সংকটকে তারা মোকাবেলা করেছেন নিজেদের সৃজনশীলতার নিরিখে। বলা যায়, আত্মবিশ্বাসের জায়গা থেকে স্বগোত্রীয় পাঠকশ্রোতাকে কেবল ধমক মেরেই দেয়াল টপকে গেছেন তারা। কিন্তু ব্রিটিশ-আমলে সমস্যাটা যখন টনটনে রাজনৈতিক হয়ে উঠল, বিশেষত বঙ্গভঙ্গ রদের পর কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের টানাপড়েনে বাঙালি ইন্টেলিজেন্সিয়া যখন দ্বিধাবিভক্ত, তখন লেখকের কণ্ঠস্বর আপ্সে নিচু হয়ে এলো, তাকে এগুতে হলো যুক্তিতর্কের পথ ধরে, অনেক হিশাব কষে।
এই সময়ের আঁচ সবচেয়ে বেশি টের পাওয়া যায় কাজী নজরুল ইসলামে। হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় অনুষঙ্গ তাকে দুই হাতে একই সাথে আগলাতে হয়েছে : ‘তাজী বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার হিম্মতহ্রেষা হেঁকে চলে’। কবিতা বা গান লিখেই ক্ষান্ত হননি, কৈফিয়ত দিতেও বাধ্য হয়েছেন যেন :
“বাংলাসাহিত্য হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই সাহিত্য। এতে হিন্দু দেবদেবীর নাম দেখলে রাগ করা যেমন অন্যায়, হিন্দুরও তেমনি মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে নিত্য-প্রচলিত মুসলমানি শব্দ তাদের লিখিত সাহিত্যে দেখে ভুরু কোঁচকানো অন্যায়। আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের এ-সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানি শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু-দেবদেবীর নাম নিই। অবশ্য এর জন্যে অনেক জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্যহানি হয়েছে। তবু আমি জেনেশুনেই তা করেছি। ”
এর কিছুকাল আগে বঙ্গীয় সারস্বত সমাজ মুখরিত হয়ে উঠেছিল বাবু বাংলা ও প্রাকৃত বাংলার কলহে। মনে রাখা দরকার, সংস্কৃত ভাষা ও ব্যাকরণের আধিপত্যকে উৎপীড়ন হিশেবে চিহ্নিত করার কাজটি শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে শুরু হলেও, প্রতিরোধ গড়ে উঠল এই প্রথম। এবং সেটাও বেশ দলবদ্ধভাবে। প্রমথ চৌধুরী তামাশার সুরেই আলাপটা শুরু করলেন :
“...শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের বিশ্বাস যে, আদিশূরের আদিপুরুষ যখন গৌড়ভাষা সৃষ্টি করতে উদ্যত হলেন, তখন তাঁর সংকল্প ছিল যে, ভাষাটাকে বিলকুল সংস্কৃত ভাষা করে তোলেন, শুধু গৌড়বাসীদের প্রতি পরম অনুকম্পাবশত তাদের ভাষার গুটিকতক কথা বাংলা ভাষায় ব্যবহার করতে অনুমতি দিয়েছিলেন। এখন যাঁরা সংস্কৃতবহুল ভাষা ব্যবহার করবার পক্ষপাতী, তাঁরা ঐ যে গোড়ায় গলদ হয়েছিল তাই শুধরে নেবার জন্য উৎকণ্ঠিত হয়েছেন। আমাদের ভাষায় অনেক অবিকৃত সংস্কৃত শব্দ আছে, সেইগুলিকেই ভাষার গোড়াপত্তন ধরে নিয়ে, তার উপর যত পারো আরো সংস্কৃত শব্দ চাপাও—কালক্রমে বাংলায় ও সংস্কৃতে দ্বৈতভাব থাকবে না। ”
(কথার কথা)
তিনি আমাদের মনোযোগ ফেরালেন ইতিহাসের দিকে : “ফোর্ট উইলিয়মের পণ্ডিত মহাশয়েরা যে গদ্য রচনা করে গিয়েছেন তাতে ফারসি-আরবির স্পর্শমাত্র নেই। তাঁদের ঐ তিরস্করণী বুদ্ধির প্রতাপে বাংলা ভাষা থেকে শুধু যে আরবি-ফারসি বেরিয়ে গেল তাই নয়, সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য তদ্ভব কথাও সাহিত্য হতে বহিষ্কৃত হলো। ...শুধু অসংখ্য কথা যে বেরিয়ে গেল তাই নয়, ভাষার কলকব্জাও বদলে গেল। ...ফলে বাঙালির মুখে যা ছিল active, বাঙালির লেখায় তা passive হয়ে পড়ল। ” (আমাদের ভাষা-সংকট)
লক্ষ্যণীয়, প্রমথ চৌধুরী জোর দিচ্ছেন বাঙালির জবানের ওপর, মানে মুখের বুলিকে আশ্রয় করতে বলছেন। সে কারণে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ও ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শাকে’ বলেছেন ‘বিদ্রোহের দুটি লাল পতাকা’।
এবারে শোনা যাক তাঁর পরমাত্মীয় ঠাকুর মহাশয় কী বলছেন :
“বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সূত্রপাত হইল বিদেশীর ফরমাশে, এবং তার সূত্রধার হইলেন সংস্কৃত পণ্ডিত, বাংলা ভাষার সঙ্গে যাঁদের ভাসুর-ভাদ্রবউয়ের সম্বন্ধ। তাঁরা এ ভাষার কখনো মুখদর্শন করেন নাই। এই সজীব ভাষা তাঁদের কাছে ঘোমটার ভিতরে আড়ষ্ট হইয়া ছিল, সেইজন্য ইহাকে তাঁরা আমল দিলেন না। তাঁরা সংস্কৃত ব্যাকরণের হাতুড়ি পিটিয়া নিজের হাতে এমন একটা পদার্থ খাড়া করিলেন যাহার কেবল বিধিই আছে কিন্তু গতি নাই। সীতাকে নির্বাসন দিয়া যজ্ঞকর্তার ফরমাশে তাঁরা সোনার সীতা গড়িলেন। ...
যদি স্বভাবের তাগিদে বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সৃষ্টি হইত, তবে এমন গড়াপেটা ভাষা দিয়া তার আরম্ভ হইত না। তবে গোড়ায় তাহা কাঁচা থাকিত এবং ক্রমে ক্রমে পাকা নিয়মে তার বাঁধন আঁট হইয়া উঠিত। প্রাকৃত বাংলা বাড়িয়া উঠিতে উঠিতে প্রয়োজনমত সংস্কৃত ভাষার ভাণ্ডার হইতে আপন অভাব দূর করিয়া লইত।
কিন্তু বাংলা গদ্য-সাহিত্য ঠিক তার উল্টা পথে চলিল। গোড়ায় দেখি তাহা সংস্কৃত ভাষা, কেবল তাহাকে বাংলার নামে চালাইবার জন্য কিছু সামান্য পরিমাণে তাহাতে বাংলার খাদ মিশাল করা হইয়াছে। এ একরকম ঠকানো। ”
(ভাষার কথা)
কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এইসব আলোচনা যখন চলছে, ঠিক তখনই শান্তিনিকেতনে বসে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তৈরি করে চলেছেন তার মহাগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি। নাম ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’। এ অভিধান খুললে পাঠকের বিভ্রান্ত হবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এটি সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি কিনা। অত্যন্ত নিষ্ঠা বা পরহেজগারির সঙ্গে তজ্জ ও তৎসম শব্দের ধনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক চেহারা এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। চকিতে মনে হতে পারে, এটি সম্ভবত বাঙালি ব্রাহ্মণের সংস্কৃতে অভিপ্রয়াণ। যেমন, অভিধানের প্রথম অক্ষর (শব্দাংশ বা উপসর্গ) হচ্ছে ‘অ’। এটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হরিচরণ শরণ নিয়েছেন পাণিনির। বিসমিল্লাতেই খোলাশা হয়ে গেছে এই অভিধান কিসের বা কার পায়রবি করবে।
‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। এর দুবছর আগে বেরোয় ‘চলন্তিকা’। সংকলক রাজশেখর বসু। তিনি হরিবাবুকে সাধুবাদ জানিয়ে লেখেন :
“কেহই শ্রীযুক্ত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের ন্যায় বিরাট কোষগ্রন্থ সংকলনের প্রয়াস করেন নাই। বঙ্গীয় শব্দকোষে প্রাচীন ও আধুনিক সংস্কৃতেতর শব্দ (তদ্ভব দেশজ বৈদেশিক প্রভৃতি) প্রচুর আছে। কিন্তু সংকলয়িতার পক্ষপাত নাই, তিনি বাঙলা ভাষায় প্রচলিত ও প্রয়োগযোগ্য বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দের সংগ্রহে ও বিবৃতিতে কিছুমাত্র কার্পণ্য করেন নাই। যেমন সংস্কৃত শব্দের ব্যুৎপত্তি দিয়াছেন, তেমনি অসংস্কৃত শব্দের উৎপত্তি যথাসম্ভব দেখাইয়াছেন। এই সমদর্শিতার ফলে তাঁহার গ্রন্থ যেমন মুখ্যত বাঙলা সাহিত্যের প্রয়োজনসাধক হইয়াছে, তেমনি গৌণত সংস্কৃত সাহিত্য চর্চারও সহায়ক হইয়াছে। সংস্কৃত মৃত ভাষা কিন্তু গ্রিক লাটিনের তুল্য মৃত নয়। ভাগ্যবতী বঙ্গভাষা সংস্কৃত শব্দের অক্ষয় ভাণ্ডারের উত্তরাধিকারিণী, এবং এই বিপুল সম্পৎ ভোগ করিবার সামর্থ্যও বঙ্গভাষার প্রকৃতিগত। আমাদের ভাষা যতই স্বাধীন স্বচ্ছন্দ হউক, খাঁটী বাঙলাশব্দের যতই বৈচিত্র্য ও ব্যঞ্জনা-শক্তি থাকুক, বাঙলা ভাষার লেখককে পদে পদে সংস্কৃত ভাষার শরণ লইতে হয়। কেবল নূতন শব্দের প্রয়োজনে নয়, সুপ্রচলিত শব্দের অর্থপ্রসার করিবার নিমিত্তও। অতএব বাঙলাঅভিধানে যত বেশী সংস্কৃত শব্দের বিবৃতি পাওয়া যায় ততই বাঙলা সাহিত্যের উপকার। বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় এই মহোপকার করিয়াছেন। তিনি সংস্কৃত শব্দের বাঙলা প্রয়োগ দেখিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, সংস্কৃত সাহিত্য হইতে রাশি রাশি প্রয়োগের দৃষ্টান্ত আহরণ করিয়াছেন। এই বিশাল কোষগ্রন্থে যে শব্দসম্ভার ও অর্থবৈচিত্র্য রহিয়াছে তাহাতে কেবল বর্তমান বাঙলা সাহিত্যের চর্চা সুগম হইবে এমন নয়, ভবিষ্যৎ সাহিত্যও সমৃদ্ধিলাভ করিবে। ” (৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪)
সংকলয়িতার পক্ষপাত আছে কি নেই, সে নিয়ে বৃথা বাক্যব্যয় করব না আর, শুধু অশনি-সংকেত হিশেবে এই কথাটায় নোক্তা দিয়ে রাখা যাক : ‘বাঙলাঅভিধানে যত বেশী সংস্কৃত শব্দের বিবৃতি পাওয়া যায় ততই বাঙলা সাহিত্যের উপকার। ’ আমাদের মত ঠিক তার উল্টো না হলেও সম্পূর্ণ ভিন্ন। সংস্কৃতের প্রতি বাঙালির এই রাধাভাব আজ অব্দি বাংলা ব্যাকরণকে তার নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেয় নি।
বঙ্গীয় শব্দকোষে তৎসম শব্দগুলির বাক্যপদীয় দৃষ্টান্ত হিশেবে বেদ, উপনিষদসহ সংস্কৃতকাব্য-নাট্য মন্থন করে তুলে আনা হয়েছে শ্লোকসমুচ্চয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে, আরবি-ফারসি শব্দ কিছুবা যা-ও আছে, তাদের বাক্যনজির হাজির করতে কেন কোরান-হাদিস-গজল টেনে আনা হলো না?
ভাগ্য ভালো, মুসলিম লীগপন্থিরা সে উদ্যোগ নেয় নি। নেয় নি, তাইবা বলি কেমন করে? আরো একটা বীভৎস ব্যাপার তারা ঘটাতে চেয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। চেয়েছিল বাংলা বর্ণমালার ক্ষেত্রে আরবি হরফের প্রতিস্থাপন। যে চেষ্টা হালে পানি পায় নি। কিন্তু তাদের মেহনত অনেকটাই ফলদায়ী হয়েছিল ভিন্ন একটি দিকে। আরবি-ফারসি শব্দের আকছার ব্যবহার বাংলা ভাষার বদন খানিকটা বদলে দিয়েছিল।
এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা রাখে ‘পূর্ব পাকিন্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’। এর প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে কোলকাতায়, মুসলিম ছাত্রলীগের ঘাঁটি ইসলামিয়া কলেজ মিলনায়তনে। এ অধিবেশনে আবুল মনসুর আহমদের পেশ করা ইশতেহারের কয়েকটি বক্তব্যে নজর বুলানো যাক :
পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দারা ভারতের অন্যান্য জাত থেকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ধর্মীয় ভ্রাতাদের থেকে একটা স্বতন্ত্র আলাহিদা জাত। ...
পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলা ও আসামের সাহিত্য বলতে আমরা যা বুঝি তা বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্য। এটা খুব উন্নত সাহিত্য। তবুও এ সাহিত্য পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয়। কারণ এটা বাংলার মুসলমানের সাহিত্য নয়। এ সাহিত্যে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য কোনো দান নেই, শুধু তা নয়, মুসলমানদের প্রতিও এ সাহিত্যের কোনো দান নেই। অর্থাৎ এ সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ কোনো প্রেরণা পায় নি এবং পাচ্ছে না। এর কারণ আছে। সে কারণ এই যে, এই সাহিত্যের স্রষ্টাও মুসলমান নয়। এর বিষয়বস্তু মুসলমানী নয়, এর স্পিরিটও মুসলমানী নয়, এর ভাষাও মুসলমানের ভাষা নয়। ...সাহিত্যের নায়ক-নায়িকা যদি আমরা না হলাম, সাহিত্যের পটভূমি যদি আমার কর্মভূমি না হলো, সাহিত্যের বাণী যদি আমার মর্মবাণী না হলো তবে সে সাহিত্য আমার সাহিত্য হয় কিরূপে? আমার ঐতিহ্য আমার ইতিহাস আমার ইতিকথা এবং আমার উপকথা যে সাহিত্যের উৎস নয়, সে সাহিত্য আমার জীবন-উৎস হবে কেমন করে?...
বস্তুত, বাংলার মুসলমানের যেমন একটা নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, তেমনি তাদের একটা নিজস্ব সাহিত্যও আছে। সে সাহিত্যের নাম মুসলমানী বাংলা সাহিত্য বা পুঁথি সাহিত্য। পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য রচিত হবে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মুখের ভাষায়। সে ভাষা সংস্কৃত বা তথাকথিত বাংলা ব্যাকরণের কোনো তোয়াক্কা করে না। বাংলা ভাষার কথা বলতে গেলেই হরফের কথাও এসে পড়ে। আমি শুধু এইটুকু বলে রাখছি যে বাংলার বর্তমান বর্ণমালার আবর্জনা আমরা রাখব না।
রেনেসাঁ সোসাইটির এই সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে আবুল কালাম শামসুদ্দীন বলেন : “...অনাবশ্যক অক্ষর বাংলা বর্ণমালায় ভিড় করে আছে। ...সংস্কৃত ভাষার প্রতি অতিরিক্ত মোহবশত স্বভাবত রক্ষণশীল হিন্দু সাহিত্যিকদের এ ব্যাপারে কুণ্ঠা হয়ত স্বাভাবিক। কিন্তু মুসলমান সাহিত্যিক জানেন বাংলা ভাষা একটা মিশ্রভাষা—সংস্কৃতের সাথে এর কোনো যোগ নেই। শুধু তাই নয়, পরোক্ষ যোগও অত্যন্ত ক্ষীণ। কাজেই অনাবশ্যক অক্ষরের মোহ তার থাকতে পারে না। ”
অক্ষর-বিতাড়ন আন্দোলন এতটাই উগ্র হয়ে উঠেছিল যে, গোলাম মোস্তফা প্রমুখ কবিও আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করেন। তাদের যুক্তি ছিল দুটি। এক, আরবি হরফে লিখতে সময় লাগে কম। দুই, আরবি মুসলমানের ধর্মীয় ভাষা।
তবে উল্লেখ্য যে, ফররুখ আহমদ এই দলে ছিলেন না। কিন্তু অপবাদ ও অপপ্রচারের শিকার হয়েছেন। কংকর সিংহ তার ‘বঙ্গভঙ্গ রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ’ বইতে লিখেছেন, ‘কবির পাকিস্তান সৃষ্টির পর পর বাংলাকে তালাক দিয়ে উর্দুকে নিকাহ করার বাসনা ছিল, বাংলা ভাষার হরফ পরিবর্তন করে আরবি হরফ গ্রহণ করার বাসনা। ’ কংকরবাবু প্রমাণ হিশেবে দাখিল করেছেন ফররুখের একটি কবিতাংশ :
দুই শো পঁচিশ মুদ্রা যে অবধি হয়েছে বেতন
বাংলাকে তালাক দিয়া উর্দুকেই করিয়াছি নিকা।
দুঃখজনক যে, কংকর সিংহ ব্যঙ্গাত্মক কবিতাটি হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হয়েছেন শোচনীয়ভাবে। কবিতার ‘আমি’কেই শনাক্ত করেছেন ‘কবি’ বলে। তিনি যদি আরেকটু খোঁজখবর নিতেন তবে জানতে পারতেন, ভাষা-আন্দোলনের অনেক আগেই ফররুখ ‘সওগাত’ পত্রিকায় লিখেছিলেন : “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে যথেষ্ট বাদানুবাদ চলছে। আর সবচাইতে আশার কথা এই যে, আলোচনা হয়েছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, জনগণ ও ছাত্রসমাজ অকুণ্ঠভাবে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং এটা দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে, পাকিস্তানের জনগণের বৃহৎ অংশের মতানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত হবে।
যদি তাই হয়, তা হলে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। ”
আসলে পাকিস্তান ব্যাপারটাই একটা প্রতিক্রিয়া। এ প্রতিক্রিয়ার প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয়। ড. আনিসুজ্জামান তাঁর ‘মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য’ বইয়ের অবতরণিকায় বলছেন, ‘বাঙালী মুসলমানের হাতে আধুনিক সাহিত্যক্ষেত্রে যে ফসলটুকু ফলেছে, দুর্ভাগ্যক্রমে তা বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকের দ্বারা সাধারণভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। পাকিস্তান-সৃষ্টির পর সেকালের মুসলিম সাহিত্যব্রতীদের সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল জেগেছে, অনেক উৎসাহী কর্মী তাঁদের জীবনকাহিনীর পুনর্গঠনে এবং তাঁদের রচনার সন্ধান ও সংগ্রহে, পরিচয়দান ও মূল্যনিরূপণে প্রবৃত্ত হয়েছেন। এর মূল্য আছে। ” এমনকি আনিসুজ্জামানের ঐ গবেষণা-পুস্তকটিও একখানা পাকিস্তানি স্পিরিট।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে, পাকিস্তান-আন্দোলনের সমর্থক প্রায় সকল কবিসাহিত্যিকেরই অন্তরে আরবি-ফারসির প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা। এ ভালোবাসা বাংলাভাষার প্রতি কিছুটা অত্যাচারও বটে। তবে সংস্কৃত-প্রেম ও ফারসি-প্রেম—এই দুই প্রেমের মধ্যে চরিত্রগত একটা ফারাক আছে, সে কথাটাও বলা দরকার। সংস্কৃতপ্রেম এসেছে সংস্কারবশত, এই প্রেম গ্রন্থনির্ভর। অন্যদিকে ফারসিপ্রীতি একটা প্রতিক্রিয়া বটে, কিন্তু তা মানুষের জবান-নির্ভর। যদিও সে জবান আজকের জমানায় এসে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তার বড় একটা অংশ কেবল কিতাব আর পুথিতেই পাওয়া সম্ভব।
৪.
আলোচনাটা এবার গুটিয়ে আনা যাক। আমরা আভাসে দেখাতে চাইলাম, ‘পণ্ডিত’ ও ‘মুন্সি’দের অনুচর ও গুপ্তচরেরা উভয় দিক থেকে বাংলাভাষার ওপর জবরদস্তি করেছেন। এখন আমাদের দাবি এ নয় যে, বাংলা ভাষা থেকে সংস্কৃত বা আরবি-ফারসি শব্দ খেদাও। আমরা অভিধান থেকে প্রয়োজনীয় কোনো শব্দই ফেলে দেয়ার পক্ষপাতী নই। বাঙালির আড়াআড়ি ও রাগবিরাগের প্রত্নচিহ্ন হিশেবে সে সব থাক বরং, যদি অপ্রচলিতও হয়।
একটি পূর্ণাঙ্গ বাংলা অভিধান দরকার এই মুহূর্তে, যাতে ফুটে উঠবে বাঙালির যথার্থ পরিচয়। ঢাকার অভিধানটিতে প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কৃত শব্দের অনুপস্থিতি আছে, যেন তা হীনম্মন্যতামুক্ত। তাই ‘হীনম্মন্য’ শব্দটাই অভিধানে নাই। উদ্ভ্রম আছে, উদ্ভ্রান্ত নাই, যূথ আছে, যূথবদ্ধ নাই, ভূগোল আছে, ভৌগোলিক নাই। ‘পরাগায়ন’ বলে কোনো ব্যাপারই নাই। তবে, এ সমস্ত শূন্যতা পূরণ করা দুঃসাধ্য নয় মোটেও। অন্যদিকে কোলকাতার অভিধানে আরবি-ফারসির অনুপস্থিতি ব্যাপক। এ ব্যাপারে সেখানকার তরুণ কবিরা এতটাই আনপড়, সাধারণ বাক্যালাপে এ বঙ্গের অনেক কথার মানে বুঝতেই বেগ পেতে হয় তাদের। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বললাম কথাটা। প্রসঙ্গক্রমে আরো একটি কথা বলে রাখা দরকার, লোকমুখে ব্যবহৃত অনেক শব্দ সাহিত্যে ঢুকে পড়লেও এখনো অভিধানের গোলায় উঠতে পারে নি। যেমন পারে নি এ ভূখণ্ডের অবাঙালি নৃ-গোষ্ঠীর বহুল পরিচিত, প্রায়শ উচ্চারিত অনেক শব্দ।
এক্ষেত্রে করণীয় একটাই, আকেলমান লোকসমবায়ে একটি বৃহৎ শব্দকোষ তৈরি করা, যার অভিমুখ হবে মরা মানুষের জাবেদাখাতা নয়, জ্যান্ত মানুষের মুখের জবান। কারণ, প্রমথবাবু বলে গিয়েছেন, ‘বাংলা ভাষার অস্তিত্ব প্রকৃতিবাদ অভিধানের ভিতর নয়, বাঙালির মুখে। ’ আমার কবি-বন্ধু ও এস্পানিওল ভাষা-বিশেষজ্ঞ শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রসঙ্গটি শেষ করি। তিনি লিখছেন, “আমাদের বহুখণ্ডিত অস্তিত্বে কি একটি অখণ্ড অভিধানও আশা করা যায় না—যাতে একটি অভিন্ন বানানবিধিও থাকা দরকার। হয়ত বানান নিয়ে অনেকে একমত হবেন না, কিন্তু এক সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে তাকে তৈরি করাই যায়। তাতে সময় লাগবে, কিন্তু দুদেশেই তো ভাষা আকাদেমি রয়েছে। তাঁরা একসঙ্গে কাজ করতে পারেন না? বা বড় কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ?
তবে তাতে শুধু কলকাতা ও ঢাকার পণ্ডিতরা থাকলে হবে না। থাকতে হবে জেলার শব্দভাণ্ডারের সঙ্গে পরিচিত পণ্ডিতদেরও। এবং অবশ্যই থাকতে হবে আসাম ও ত্রিপুরার পণ্ডিতদের। নির্দিষ্ট সময় অন্তর কমিটি বদলে নতুন পণ্ডিতদের জায়গা করে দিলে মনে হয় কাজের গতি ও পরিধি দুটোই বাড়বে। ”
[কালীকৃষ্ণ গুহ সম্পাদিত ‘আরেক রকম’ পত্রিকা থেকে]
৫.
এখন বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ নিয়ে কিছু কথা বলছি। প্রথম প্রশ্ন, এটা কার জন্য ব্যবহারিক? সাধারণের জন্য কি? তা বলা যাচ্ছে না। কারণ এতে এমন অনেক শব্দই পাওয়া যাচ্ছে, যেসবের অস্তিত্ব প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যের বাইরে কোথাও নাই। অর্থাৎ এ অভিধানের অন্যতম উদ্দেশ্য সাহিত্যিক ও সাহিত্যপাঠক। সেক্ষেত্রে অভিধানের ওপর আরো কিছু দাবি তৈরি হয়ে যায়। কী সেই দাবি?
একটি কবিতা শোনানো যাক :
এতটাই মরে গেছি তোমাকে মনে পড়ে না
তুমি নেই, কেউ নেই তোমাকে স্মরণ করার
ভোরের প্রতিটি লাল সূর্যের মতো তোমার আবির্ভাব / পাহাড়চূড়ায় ফোটাতো অজস্র মোন-ফুল।
তুমি নেই—ফোটে না সে ফুল / নিয়তির রাজ্যে উড়ে যায় রমণীর খাপছাড়া চুল
মানুষের বুকে জ্বলে না আশার দীপ / মৃত্যুপুরীর অচেতন জুমে বেঁচে থাকি রিপরিপ।
... ... ...
কত পাহাড় নীরবে দাঁড়িয়ে, বেঁকে গেছে কত নদী চেনা পথ হারিয়ে / তবুও খুঁজেছি একটি আদিবাসী আদাম যৌথ জীবনের স্বপ্নচূড়ায় দাঁড়িয়ে।
এটাকে একটা খাঁটি বাংলা কবিতাই মনে হচ্ছে। শুধু বাধ সাধছে নিচে-দাগ-দেওয়া শব্দগুলি। কবিতাংশটি নিয়েছি ‘হুচ্’ নামে একটি ছোটকাগজ থেকে। যার সম্পাদক কবি আলোড়ন খীসা। ‘হুচ্’ চাকমা শব্দ, এর মানে চিহ্ন। এই কবির নাম হেগা চাকমা। পত্রিকা থেকেই জানতে পারি, রিপরিপ কথাটার মানে নিভু নিভু। আর আদাম হলো গ্রাম।
বর্তমানে এই বাংলাদেশে আদিবাসীদের উদ্যোগে বেশ কিছু দ্বিভাষিক সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা লিপিতে। রাঙামাটি কিংবা খাগড়াছড়ি থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে রেঙ (ধ্বনি), রানজুনি (রংধনু), কাজলী (অনুরোধ), রেগা (সেতুবন্ধন) ইত্যাদি। এসব পত্রিকার মধ্যে বাস্তবিক অর্থে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে একটা সেতুবন্ধনের প্রয়াস দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের তরফে সে প্রয়াস কোথায়?
এইখানে এসে আমাকে স্মরণ করতে হচ্ছে সেলিম আল দীনকে। একটি মারমা রূপকথার ভূমিকায় তিনি লিখছেন :
“১৯৮৬ সালে ঢাকা থিয়েটার আয়োজিত জাতীয় নাট্যমেলায় আমরা এদেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী নৃগোষ্ঠীসমূহের সঙ্গে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ সাধনের সংকল্প উচ্চারণ করি। ...
বাংলাদেশে বাঙালি ব্যতিরেকেও বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর নিবাস। কেউ আদিবাসী—কেউবা পরবর্তীকালে বসতি স্থাপনকারী সম্প্রদায়। দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি এদের উপর চলেছে রাজনৈতিক নিপীড়ন। ...
একটি মারমা রূপকথা নির্বাচনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে এদেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষীদের পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়া এবং অন্যদিকে এর মাধ্যমে—মারমা সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক-নৃতত্ত্ব সম্পর্কে আমাদের ঔৎসুক্য জাগ্রত করা। ... রাষ্ট্রীয় অবজ্ঞা—রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা অর্থনৈতিক নিপীড়নের যে দায় শতবর্ষের—তার খানিকটা অন্তত বহন করুক আমাদের কালের শিল্প। এ কথা কে না জানে শিল্পের সংসারে থাকে দিব্যমানব—শিল্পের হাড়েই গঠিত হয় কালাকালের বজ্র। ”
সেলিম আল দীনের আদিবাসী-নাট্যপ্রয়াসের দুটি ধাপ আমরা লক্ষ করি। প্রথম ধাপে তিনি আদিবাসীদের নাট্য-আঙ্গিক বাংলা নাটকে সাঙ্গীকৃত করার সুযোগ খুঁজেছেন। দ্বিতীয় ধাপে তাদের বিষয়ে ও ভাষায় প্রবেশ করেছেন। প্রথমটি লক্ষ্যণীয় মঞ্চে, দ্বিতীয়টি টেক্সটে। দ্বিতীয়টির উদাহরণ হিসেবে বনপাংশুল, ধাবমান, ঊষাউৎসব ও স্বপ্নরমণীগণ-এর কথা বলা যায়। বিশেষত আমরা বলব, উষাউৎসব ও স্বপ্নরমণীগণ। তার আগে স্মরণ করা যাক মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসটির কথা। এখানে মহাশ্বেতা মুণ্ডা ভাষার কিছু গান জুড়ে দিয়েছেন বিভিন্ন চরিত্রের মুখে। এবং বন্ধনীর মধ্যে রেখেছেন গানটির বাংলা অনুবাদ। ফলে ভাববস্তু অনধাবন করা যায় ঠিকই, কিন্তু শব্দগুলোর যথার্থ মানে বের করা মুশকিল। এই উপন্যাসটি পড়ার সময় ‘উলগুলান’ শব্দটি আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। বিশেষত অরণ্যের ভেতর আগুন জ্বালাবার একটা ইমেজ আমাদের মনে ভেসে ওঠে। যদিও এ শব্দের অর্থ ও ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে কোনো ধারণাই পাই না আমরা।
সেলিম আল দীন কিন্তু উল্টো কাজ করেছেন। তিনি লিখেছেন বাংলা গানই, তাতে গ্রহণ করেছেন মারমা বা মান্দি ভাষার কিছু শব্দ। এর ফলে পাঠক হিশেবে ঐ শব্দগুলির প্রতি আমাদের এক ধরনের ঔৎসুক্য জাগে বৈকি। তিনি পাঠকের এই কৌতূহলও নিবারণ করেছেন গ্রন্থশেষে শব্দার্থ ও টীকা জুড়ে দিয়ে। চমৎকার কিছু শব্দ এখানে তুলে দিচ্ছি :
আস্কি = নক্ষত্র
তাতারারাবুগা = নিরাকার প্রধান ঈশ্বর
আসা, মালজা = দুই অপদেবতা
দাহালা = পাহাড়
ব্রিংনি বিবাল = বুনো ফুল
ছু = পানীয় বিশেষ
মিখখাম = বজ্র
সেলগানি = আকাশ
ছিমছিরি = সোমেশ্বরী
দকমান্দা = মান্দি নারীদের পোশাক
হ্রলয় = ঢেউ
উদাহরণ দিয়ে আপনাদের আর ভারাক্রান্ত করতে চাই না। আমার বক্তব্য এই যে, বাংলা ভাষায় অনেক নতুন শব্দ ঢুকে পড়ছে—বাঙালি ও আদিবাসী উভয়েরই মাধ্যমে। আমরা জানি, জুম্ম সাহিত্য আর বাংলা সাহিত্য একাকার হবার নয়, তবু বাংলা সাহিত্যেরই দোহাই যদি দেই, আমাদের অভিধানগুলি কি এসব শব্দের ব্যাপারে মৌনব্রত পালন করেই যাবে? প্রসঙ্গত বলি, মামুনুর রশীদের ‘রাঢ়াং’ নাটকের কথা আপনারা সবাই জানেন। আমাদের অভিধান জানে কি?
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৬