ওগো দুখজাগানিয়া, তোমায় গান শোনাব...
“গাম্ভীর্য নির্বোধের মুখোশ, আমি তা-ই খসাতে এসেছি”—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ নাটকের একটি উল্লেখযোগ্য সংলাপ এটি। মোড়লের জবানীতে এই দার্শনিক উক্তি আসলে রঞ্জনেরই মুখনিঃসৃত বাণী।
সিনেমাটির আলোচনার শুরুতেই এই ধরনের নির্দিষ্ট উপসংহার টানবার পেছনে নিজের যুক্তিটুকু উপস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই রয়েছে। তার আগে কাহিনীর সংক্ষিপ্ত সারটুকু বলে নিতে চাই।
পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত তিনজন নারীর জীবনের ছোট ছোট ঘটনার উপাদানে ভর করে সিনেমাটি এগিয়ে গেছে সম্ভাবনার দিকে। সমাপ্তি না বলে সম্ভাবনা বলছি এই কারণে; যাঁরা সিনেমাটি দেখবেন তারাই উপলব্ধি করবেন চলচ্চিত্রটি আদতে বহমান। পরিচালক নিজে যেচে এর কোনো সমাপ্তিরেখা টেনে দেননি। সমাপ্তি ঘোষণা করেও শেষ হতে না দেওয়ার মধ্যে যে শিল্পবোধ তা-ই ছবিটির নির্যাস।
সিনেমাটির আরেকটি অনবদ্য অংশ হচ্ছে এর সম্পাদনা। বাহুল্যহীন কিন্তু প্রয়োজনীয়ভাবেই ছবিটিকে সুসংহত করেছে এর এডিটিং। মিউজিকও এককথায় অসাধারণ। কোথাও সিনেমা থেকে মিউজিক আলাদা মনে হয়নি। ছবিটির সাউন্ড ডিজাইনও নিয়ন্ত্রিতভাবে ধারালো। তবে দৃশ্যের সাথে সংযোগপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কখনো কখনো সাউন্ড ডিজাইন অনেকটা প্রথাগত মনে হয়েছে। যেমন ময়নার প্রেগন্যান্ট হওয়ার সংলাপের ওপর বাজ পড়ার শব্দ। সিনেমাটির আরেকটা উল্লেখযোগ্য অংশ এর মেক-আপ। এত ভালো মেক-আপ সচরাচর দেখা যায় না বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে। কাহিনীর কথা তো সবখানেই উল্লেখ করেছি; আলাদাভাবে উল্লেখ করতে চাই সংলাপের অনবদ্য ব্যবহারটুকুর কথা। কোনো সংলাপই জবরদস্তি করে ঢোকানো মনে হয়নি সিনেমাটিতে। অপ্রাসঙ্গিক দার্শনিক উক্তি থেকে ছবিটি সম্পূর্ণভাবেই মুক্ত ছিল যা আমাদের চলচ্চিত্রে বিরল দৃষ্টান্ত
নারী চরিত্রগুলোর প্রথম জন ‘রয়া’ নামের এক ত্রিশোর্ধ রমণী; যে তার সংসার ও সামাজিক পরিচয়ের সাথে সাথে মঞ্চকর্মী হিসেবে নিজের ব্যক্তি-পরিচয়টুকু আঁকড়ে ধরে মানিয়ে থাকতে চায় বাস্তবতার সাথে। কখনো কখনো সে সংসার এবং সমাজের চাইতেও তার অভিনীত ‘নন্দিনী’ চরিত্রটির ভেতরেই তলিয়ে থাকে বেশি; যার প্রমাণ চলচ্চিত্রটির বিভিন্ন দৃশ্যের মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। অন্যজন নারী রয়ার মা; যিনি ধর্মের ওপর নিজের ভার ছেড়ে দিয়ে আপাতভাবে নিশ্চিন্ত। প্রথাগত ধর্মাচারের সাথে সাংঘর্ষিক বলে নিজের মেয়ের অভিনয় নিয়েও বিচলিত তিনি; কিঞ্চিৎ বিরক্তও বটে। যদিও আমরা সিনেমার একটি সংলাপ থেকে জানতে পারি, তাঁর স্বামী কোনো এক অভিনেত্রীর টানে তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। এটাও রয়ার মায়ের চিন্তাজগতে পাকাপোক্ত প্রভাব ফেলে থাকতে পারে। তৃতীয়জন রয়ার গৃহকর্মী ‘ময়না’; যে তার বয়স ও শ্রেণীর ধর্ম মেনেই লিফটম্যান ‘সবুজ মিয়া’র প্রেমে আত্মহারা। শুধু এটুকু সামান্য তথ্যে ময়নার চরিত্রটির সরলীকরণ হয়ে পড়ে কারণ সিনেমার মধ্যভাগে আমরা দেখি একটা স্বাভাবিক সংসারের লোভ তারও রয়েছে যেখানে তার পরিচয় হবে পরিবারের অংশ হিসেবে; গৃহকর্মী হিসেবে নয়।
এই তিনজন মূল-চরিত্র ছাড়াও সিনেমায় পার্শ্বচরিত্র হিসেবে কয়েকজন পুরুষ আছেন; যাদের মধ্যে একজন রয়ার স্বামী সফল ব্যবসায়ী(আর্কিটেক্ট?) সামির। আরেকজন—খ্যাতনামা নাট্য গবেষক ইমতিয়াজ; যে রয়াকে ‘নন্দিনী’ চরিত্রের বিনির্মাণ ঘটাতে প্রেরণা দেয়। অন্যজন রয়ার অভিনীত ‘রক্তকরবী’ নাটকের নির্দেশক রাসেল ভাই। রবীন্দ্রপূজারী রাসেল ভাই রক্তকরবীর বিনির্মাণের কথা শুনে আঁতকে ওঠেন প্রায়। তাঁর মতে ‘ঠাকুর’ যা বলেছেন, যেভাবে বলেছেন তাই ধ্রুব। এর বিনির্মাণ উন্মাদনার শামিল। এছাড়াও ময়নার প্রেমিক লিফটম্যান ‘সবুজ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্র; যে সম্তানসম্ভবা ময়নার দায়িত্ব নিয়ে রয়ার কাছ থেকে ময়নাকে কেড়ে নিয়ে যায়।
‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ সিনেমাটির মূল কাহিনী দর্শক নিশ্চয়ই ছবিটি দেখেই জানবেন। আলোচনার খাতিরে আমি তার চোরাস্রোতগুলো নিয়ে আলাপ করতে চাই। ছবিটির প্রধানতম সাফল্য, রবিঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ নাটকের কাঠামোর ওপর ভর করে লতা-গাছের মতো তড়তড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস। লতা-গাছটি তার খুঁটিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে এতটাই সাবলীলভাবে বেড়ে উঠেছে যে রক্তকরবীর সহজাত কাব্যিক গাম্ভীর্য যেন এই ছবিটিতে যক্ষপুরীর ভেতরে মুক্তির আস্বাদ নিয়ে আসা নন্দিনীর মতোই প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’তে আমরা দেখি যক্ষপুরীর গহীন পাতালে ‘নন্দিনী’ মুক্তির বার্তা নিয়ে হাজির হয়। তার উপস্থিতি সবার বন্দিদশাকে প্রকট করে তুলতে থাকে ক্রমাগত। যারা এতদিন জানতেও চাইত না বন্দিত্বের স্বরূপ কী; কিভাবে পেতে হয় মুক্তির আস্বাদ, তারাও পাগলপারা হয়ে ওঠে শৃঙ্খল ভাঙবার অভিপ্রায়ে। এমনকি যে রাজা সবাইকে লোভ ও ভয়ের খাঁচায় বন্দি করে রেখে বাধ্য করছে মাটি শুষে প্রাণ বের করে নিতে, সেও তার নিজের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায় নন্দিনীর স্পর্শে। নন্দিনী কে তবে! সে কি প্রেম? হৃদয়ের অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষা? রুবাইয়াত নিজেও এর উত্তর খোঁজেন নি। বরং এই মেটাফোরকে ইট পাথরের পাঁজরে ঢাকা ‘ঢাকা’ শহরের ওপর আছড়ে ফেলতে চেয়েছেন। তাই রয়ার নির্মিত রক্তকরবী আসলে সন্তানসম্ভবা ‘ময়না’র আখ্যান হয়ে ওঠে। ময়নার গর্ভে লালিত হওয়া শিশুটিই হয়ে ওঠে নন্দিনী। আর সহস্রাধিক প্রাণ নিয়ে ধ্বসে পড়া রানাপ্লাজা’র শহর ‘ঢাকা’ এই নাটকের দিগন্ত-বিস্তৃত মঞ্চ। হয়ত এই কারণেই ‘রক্তকরবী’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ সমাপ্তি রেখা টানলেও রুবাইয়াত তার নির্মিত ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ শেষ করতে চান নি। কেননা, বহমান এই শহরের ‘রক্তকরবী’ আসলেই সমাপ্তিহীন। এভাবে পরিচালক ‘রক্তকরবী’র যক্ষপূরী থেকে নিজেকেও মুক্ত করে নিয়েছেন প্রজ্ঞার সাথে। তাই রবিঠাকুরের মূল নাটকটিকে ফলের আঁটির মতো সম্মান দিয়েও এই চলচ্চিত্রটি ফলের শ্বাঁসের মতো ভালোবাসায় সিক্ত হতে পারে অনায়াসে।
সিনেমার মূল চরিত্র রয়া তার অভিনীত ‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনী চরিত্রটির প্রথাগত কাঠামোর সাথে অনেকটা আপোস করেই ১২ বছর ধরে চরিত্রটি অভিনয় করে যাচ্ছে। এক যুগ অবসানের পর সিদ্ধান্ত হয় নতুন কেউ এই চরিত্রটিতে প্রাণ সঞ্চার করবে। আমরা সিনেমায় তার দৃশ্যগত প্রমাণও দেখতে পাই যখন গ্রিনরুমের চেয়ার থেকে রয়া উঠে যাওয়ার পর সেই চেয়ারে নতুন মেয়েটি বসে তখন রয়ার খুলে রাখা লাল টিপটা ক্যামেরার কারসাজিতে তার দুই ভ্রু’র মাঝখানে স্থান পায়। এই মন্তাজ আপাতদৃষ্টিতে আহামরি না হলেও চলচ্চিত্রটির প্রবহমানতার সাথে সাযুজ্য তৈরি করে।
ইমতিয়াজ নামের একজন মঞ্চ গবেষকের আগ্রহের কারণে রয়াকে শেষবারের মতো ‘নন্দিনী’ চরিত্রটিতে অভিনয় করার আমন্ত্রণ জানান নির্দেশক রাসেল ভাই। ইমতিয়াজ রয়ার অভিনয় পারদর্শিতায় মুগ্ধ হয়ে রয়ার সাথে যোগাযোগ করলে রয়া নির্দেশক রাসেল ভাইয়ের উপস্থিতিতে নন্দিনী চরিত্রটিতে অভিনয়ে তার অনাগ্রহের কথা স্পষ্ট করে জানায়। বরং সে নন্দিনী চরিত্রটিকে সমকালের প্রেক্ষাপটে এনে অন্য মাত্রায় সাজাতে চায়। রয়ার এই নিরীক্ষার আগ্রহকে ইমতিয়াজ স্বাগত জানালে রয়া নিজেই রক্তকরবী নাটকটি নির্দেশনার ভার গ্রহণ করে। অন্যদিকে যাপিত জীবনে ঘটে যাওয়া ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা তার মধ্যে নানারকম প্রভাব বিস্তার করতে থাকে ক্রমশ। তার নিজস্ব সব বিষয়ে স্বামীর নির্লিপ্তি, মায়ের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার, সবোর্পরি সন্তান গ্রহণ করবার জন্য এই দুজনের চাপাচাপি এবং অন্যদিকে হুট করে ময়নার কনসিভ করা ও সংসার সাজাবার অভিপ্রায়ে তার ঘর ছেড়ে চলে গিয়ে গামের্ন্টসে চাকরি নেওয়া; এসব বিষয় তার মধ্যে একধরনের ডিলেমা তৈরি করে যা তার মনোজগতকে অস্থিতিশীল করে তোলে। এর ওপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে রানাপ্লাজার ধ্বংসযজ্ঞ তার চিন্তার আগুনে ঘি ঢালে। রয়া তার অন্তর্দৃষ্টিতে দেখতে পায় সমকালের এই গামের্ন্টস কর্মীরা রক্তকরবী নাটকের যক্ষপুরীরই শোষিত মানুষের প্রতিচ্ছায়া। যক্ষপুরীতে যেমন প্রত্যেক শ্রমিকের পরিচয় তার সংখ্যায়; তেমনি গামের্ন্টস কর্মীদের জীবনও সংখ্যার অদৃশ্য বেড়াজালে আবদ্ধ। এই প্রতিতুলনাটুকু সিনেমায় আমরা যদিও রয়ার দৃষ্টিতে দেখতে পাই; কিন্তু বাস্তবিকভাবে এটি নির্মাতারই অর্ন্তসৃষ্টি। রয়া রক্তকরবীর নির্যাসটুকু রেখে নতুন ছাঁচে ঢেলে সাজায় নাটকটিকে। নাটকটির ব্যর্থতা বা সাফল্যের আগেই পরিচালক সফলভাবে শেষ করেন তাঁর ছবিটি। যা শেষ হয়েও শেষ না হওয়ার আঁচটুকু দিয়ে আহ্লাদিত করে দর্শকদের।
‘রক্তকরবী’ নাটকের অভিনব বিনির্মাণ ছাড়াও চলচ্চিত্রটির প্রধানতম সাফল্য এর গল্প বলার ঢঙে এবং অভিনয় পরিকল্পনায়। প্রত্যেকটি চরিত্রের অভিনয় এতই সাবলীল যে, দর্শক নিজেই নিজের অজান্তে সিনেমাটির অংশ হয়ে ওঠে। ‘ময়না’ চরিত্রে অভিনয় করা মেয়েটি তো মুগ্ধ করার মতোই সাবলীল। অন্যান্যদের অভিনয়ও এককথায় অসাধারণ। অভিনয় এবং নির্মাণের পরিমিতিবোধ সিনেমাটিকে শিল্প করে তুলেছে। গল্পের প্লট এতটাই ছক কেটে সাজানো যে ডিজাইনটুকু চোখে পড়ে না, আবেশটুকু থাকে শুধু।
সিনেমাটির কাহিনী তিনজন নারীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। তবে পুরুষ চরিত্রগুলো আরেকটু নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারত বলে মনে হয়। বিশেষ করে রয়ার স্বামী সামিরের চরিত্রটির আরেকটু ডিটেইল থাকলে ভালো হতো। ইমতিয়াজ চরিত্রটি খুবই স্বাভাবিক ছিল। তবে রয়া ও ইমতিয়াজের প্রেমের দৃশ্যটি না থাকলে বিশেষ ক্ষতি হতো বলে মনে হয় না। যেমন না থাকলে ভালো হতো নাস্তিকদের বিরুদ্ধে মিছিলের দৃশ্যটি। বিছানায় সাপের দৃশ্যটি অন্যভাবে চিত্রায়িত হতে পারত কি?
‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’-এর সিনেমাটোগ্রাফি ছবিটির সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবেই মিশে ছিল শেষ পর্যন্ত। আলাদা করে নিজের কণ্ঠ জানান দেয়নি কোথাও। অথচ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে ছবিটির সীমারেখা নির্ধারণে এর নিবিড় ভূমিকাটুকু স্পষ্ট দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে ট্রানজিশন শটগুলোর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আপাতভাবে নিরপেক্ষ হয়েও সবসময় গল্পের সাথে সমানে তাল ঠুকে গেছে এরা। এই প্রশংসা কিঞ্চিৎ সম্পাদনা ও এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রোডাকশান ডিজাইন ইউনিটেরও প্রাপ্য। প্রোডাকশন ডিজাইন একটি ছবিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তারই প্রমাণ যেন ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ সিনেমাটি। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে ঢাকা শহরের ডকুমেন্টেশন, বিভিন্ন শ্রেণী বা সম্পর্কের মানুষের সাথে সংযোগের ক্ষেত্রে বাচনভঙ্গির স্বাভাবিক বিভিন্নতা, দৃশ্যগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংযুক্তি এবং আরো অনেক কিছু নিখুঁত প্রোডাকশন ডিজাইনের বৈশিষ্ট্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। একটা মোটা দাগের উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা হয়ত কিছুটা বোঝানো যেতে পারে। রয়া কিছু পেপার কাটিংয়ের ওপর নিজের হাতের ছাপ আঁকছিল। ময়না যখন জিজ্ঞেস করল তখন রয়া জানায় এই ফটোগ্রাফের মেয়েটাকে তার স্বামী হাত কেটে দিয়েছে পরীক্ষা না দেয়ার জন্য। তবু মেয়েটা পরীক্ষা দিয়েছে নিজের মনের জোর দেখিয়ে। রয়াও মেয়েটির মতো হতে চায়। যারা সিনেমাটি দেখবেন, তারা অনায়াসে ফটোগ্রাফটির ওপর হাত আঁকা এবং মেয়েটির মতো হয়ে উঠতে চাওয়ার সাযুজ্য খুঁজে পাবেন ছবিতে। ওজনদার কিছু নয়, কিন্তু রত্নের মতো আলো ঠিকরাচ্ছে ঠিকই।
রয়ার মতো ময়নাও তার নিজস্ব সামাজিক সংস্কারের খাঁচায় বন্দি। বাচ্চা বাচ্চা করে কেউ তার প্রাণ ওষ্ঠাগত করে না তুললেও তার প্রেমিক সবুজ মিয়া কিন্তু তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় ঠিকই আলগোছে জানিয়ে দেয় তার সাথে থাকতে হলে তার মতোই থাকতে হবে। রয়া তাকে সোনার গয়না উপহার দিলেও সে সেগুলো রয়ার কাছেই গচ্ছিত রাখে এই ভেবে যে; তার প্রাণপ্রিয় প্রেমিক ও স্বামী সবুজ ঠিকই গয়নাগুলো ছিনিয়ে নিয়ে যাবে তার কাছ থেকে।
সিনেমার প্রথম দিকে ময়নার মুখে শোনা ‘সাপের স্বামী হওয়ার গল্প’ পুরো ছবিতেই মেটাফোর হিসেবে কাজ করেছে। ময়না তো মেনেই নিয়েছে তাকে। আর রয়ার স্বপ্নে ধীরে ধীরে হানা দিতে শুরু করেছে স্বামী রূপী অজগর।
নারীত্বের যে স্বাভাবিক অসহায়তা তা শ্রেণী-পেশা-বয়স নির্বিশেষে সবার জন্য সমানভাবেই প্রযোজ্য আমাদের সমাজে। তাই নিজেকে ধর্মের শক্তিশালী খাঁচায় আটকে নিতে হয় রয়ার মাকে। সেকেলে সামাজিক মূল্যবোধগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে নিতে সেগুলোকেও নিজের অংশ করে নেন তিনি। কারণ, তিনি বুঝতে পারেন, আপাতভাবে মুখ বন্ধ রাখলেও সমাজ তার ধারালো দাঁতগুলো শাণ দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই তিনি সতর্ক থাকেন; নিজের জন্যেও, নিজের মেয়ের জন্যেও।
সিনেমার একটি বড় সুবিধা হচ্ছে সিনেমায় আপাতভাবে সাধারণ একটি দৃশ্যও সিনেমার অন্তর্নিহিত সত্যটির ধারণা দিয়ে যেতে পারে। ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ ছবিটির অনেকগুলো দৃশ্যেই তার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। এরকমই একটি দৃশ্য নিজের রুমে রয়ার অ্যাকটিং প্র্যাকটিশ করার দৃশ্য। নন্দিনী চরিত্রে ডুবে থাকা রয়া ভুলে যায় তার স্বামীর বাইরে যাওয়ার কথা। হঠাৎ মনে পড়লে সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্বামীকে বিদায় দেওয়ার মুহূর্তে সামির তাকে মনে করিয়ে দেয় বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে রয়ার দেয়া প্রতিশ্রুতির বিষয়ে। সামির বেরিয়ে গেলে রয়া আলগোছে নন্দিনীর কসটিউম হিসেবে পরা শাড়ি খুলে ফেলে হেঁটে যায় করিডোর দিয়ে। নন্দিনী আর রয়ার মধ্যের পরস্পরবিরোধিতাটুকু এই সামান্য একটা দৃশ্যের ভেতর দিয়েই স্পষ্ট হয়ে উঠতে পেরেছে।
‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ সিনেমাটির আরেকটি বিশেষ সফলতা এর কস্টিউম। কোথাও বাহুল্য নেই এর, অথচ আভাটুকু চোখে পড়ে। কস্টিউম যে ছবির একটি অন্যতম প্রধান অংশ তার প্রমাণ পাওয়া গেছে এই সিনেমায়। সেদিক থেকে সেট এবং প্রপস বরং কিঞ্চিৎ হতাশ করে। সবখানে না, শুধু রয়ার ফ্ল্যাটের সেট ডিজাইনে। সবকিছু এত পরিপাটি করে সাজানো যে বিজ্ঞাপনের আর্ট ডিরেকশন বলে মনে হতে পারে কখনো কখনো। এক সাক্ষাৎকারে পরিচালক বলেছেন, এখানে তিনটি পেইন্টিং ব্যবহার করেছেন কাহিনীর অন্তঃসারটুকুকে মাত্রা দিতে। পেইন্টিংয়ের ব্যবহারটুকু চোখে পড়েনি আমার। তাতে অবশ্য সিনেমার রস নিতে আমাকে বাড়তি ভোগান্তি পোহাতে হয়নি।
সিনেমাটির আরেকটি অনবদ্য অংশ হচ্ছে এর সম্পাদনা। বাহুল্যহীন কিন্তু প্রয়োজনীয়ভাবেই ছবিটিকে সুসংহত করেছে এর এডিটিং। মিউজিকও এককথায় অসাধারণ। কোথাও সিনেমা থেকে মিউজিক আলাদা মনে হয়নি। ছবিটির সাউন্ড ডিজাইনও নিয়ন্ত্রিতভাবে ধারালো। তবে দৃশ্যের সাথে সংযোগপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কখনো কখনো সাউন্ড ডিজাইন অনেকটা প্রথাগত মনে হয়েছে। যেমন ময়নার প্রেগন্যান্ট হওয়ার সংলাপের ওপর বাজ পড়ার শব্দ। সিনেমাটির আরেকটা উল্লেখযোগ্য অংশ এর মেক-আপ। এত ভালো মেক-আপ সচরাচর দেখা যায় না বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে। কাহিনীর কথা তো সবখানেই উল্লেখ করেছি; আলাদাভাবে উল্লেখ করতে চাই সংলাপের অনবদ্য ব্যবহারটুকুর কথা। কোনো সংলাপই জবরদস্তি করে ঢোকানো মনে হয়নি সিনেমাটিতে। অপ্রাসঙ্গিক দার্শনিক উক্তি থেকে ছবিটি সম্পূর্ণভাবেই মুক্ত ছিল যা আমাদের চলচ্চিত্রে বিরল দৃষ্টান্ত।
সিনেমাটির একটা বিষয়ের মীমাংসা করতে পারছি না এখনো। রয়া ও ইমতিয়াজের একটি প্রেমের দৃশ্য আমরা দেখতে পাই ছবির শেষদিকে। তারই প্রস্তুতি হিসেবে ইমতিয়াজের সাথে যে দু’বার রয়ার পরিকল্পিতভাবে দেখা হয় সেই দুইবারই আমরা রয়াকে সাজতে দেখি। তবে কি ইমতিয়াজের প্রতি, তার খ্যাতির প্রতি রয়ার আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল! ইমতিয়াজের মাধ্যমে রয়া কি নিজের একাকিত্বকে পূরণ করে নিতে চাইছিল? নাকি রয়া ইমতিয়াজকে মুক্তির দরজা হিসেবে দেখতে ভালোবাসছিল? কিন্তু, ইমতিয়াজ কেন সাড়া দেবে এতে! মুহূর্তের একাকিত্ব দূর করার জন্য! নাকি শুধুই জৈবিক তাড়না! ইমতিয়াজ যেভাবে মায়ের বাঙালি ঘরানার রান্নার প্রসঙ্গে আপ্লুত হয়ে পড়েছিল তাতে রয়ার প্রতি কি ছদ্ম-প্রেমের ভান ছিল না তার মধ্যে? কিংবা কোনো অজুহাতের লেজ ধরে দু’জনের মধ্যেই প্রথাগত সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসার তাড়া ছিল? অথবা, একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে পৌঁছাবার পরে সব সংস্কারই ম্লান হয়ে পড়ে—তাই ভাবতে চেয়েছেন পরিচালক। ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, তবে প্রেমের এই কৌশল আমার অবচেতনে একটি ক্লিশে অনুভূতি তৈরি করেছে।
যাইহোক, যে প্রশংসাসূচক বাক্যটি দিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম তাই দিয়ে শেষ করতে চাই। আমার সবসময় মনে হয় সিনেমায় পরিমিতিই প্রধানতম শিল্পরূপ, সাবলীলতাই তার একমাত্র ভাষা। এই ছবিটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। তথাকথিত শৈল্পিক গাম্ভীর্যকে সন্তর্পণে এড়িয়ে অন্তরের সত্যটুকুই সরলভাবে প্রকাশিত হয়েছে ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ ছবিটিতে। কোথাও মুখস্ত সমাজবাস্তবতার বয়ান কপচানোর চেষ্টা না করে পরিচালক দর্শকের সামনে মুক্তভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন ছবিটিকে। দর্শক চাইলে নিজেই নিজের মতো করে মিলিয়ে নিতে পারেন এর প্রান্তভাগগুলো, যার যেভাবে খুশি। সবশেষে রক্তকরবী থেকে দুটো সংলাপ কোট করার লোভ সংবরণ করতে না পারার জন্য দুঃখিত—
নন্দিনী: পাগল, যখন তুমি গান করো, তখন কেবল আমার মনে হয় অনেক তোমার পাওনা ছিল, কিন্তু কিছু তোমাকে দিতে পারি নি।
বিশু: তোর সে কিছু-না দেওয়া আমি ললাটে প’রে চলে যাব। অল্প কিছু-দেওয়ার দামে আমার গান বিক্রি করব না।
** জালালের গল্পের হওয়া না হওয়া | অঞ্জন সরকার জিমি
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৬