বাংলাদেশের জাতীয় কবিতা উৎসব-এর আমন্ত্রণে ভারতের কবি উৎপলকুমার বসু ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় আসেন। এখানকার কবি, শিল্পী-লেখকদের সঙ্গে তার মতবিনিময়, সাক্ষাত, উপদেশ, তর্ক, আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো, আরো অনেক নতুন-পুরনো জমে থাকা লেনদেন ঘটে।
জহির হাসান : আপনাকে যদি বলা হয় আপনি ‘জাতে জীবনানন্দ, ধর্মে উৎপল’ তাহলে এটাকে কিভাবে নিবেন?
উৎপলকুমার বসু : হা হা (হাসি)। আচ্ছা বেশ। নিব কেন? ঠিক আছে যা বলেছো, ভালোই বলেছো। ধর্মে একটাই জিনিস হয় সেটা হচ্ছে জিরাফ। শক্তির লাইন আছে না? ধর্মে আছি জিরাফেও আছি।
জহির : অনেক কবিদের কবিতায় দেখা যায় যে তারা চিন্তা, দর্শন দ্বারা ডিকটেইটেড হয়ে কবিতা লিখেন। তো চিন্তার নিজস্ব ধর্ম হচ্ছে সে নিজেকে সম্পূর্ণ করতে চায়। সেক্ষেত্রে কবিতা মার খেয়ে যায়। মানে চিন্তা ডিকটেটেড কবিতা—কবিতা কিনা?
উৎপল : অন্য কবি, কবিতা সম্পর্কে আমার পক্ষে মন্তব্য করা খুব কঠিন। তবে আমার লেখায় খুব চিন্তা-টিন্তা কিছু নেই। উচ্চচিন্তা কিচ্চু নেই। আমার হচ্ছে সাধারণ—যাকে বলে স্ট্রিট রিয়ালিটি। সেসব চিন্তাই আমার লেখায় আছে। উচ্চমার্গীয় কোনো চিন্তা আমার লেখায় নেই।
জাহিদ হাসান মাহমুদ : আপনি বললেন স্ট্রিট রিয়ালিটি। এই স্ট্রিট রিয়ালিটি আপনি কিভাবে অবজার্ভ করেন?
উৎপল : ও! সেটা আমার ঘুরে বেড়াতে হয়। রাস্তায় রাস্তায়। স্ট্রিট রিয়ালিটি যেভাবে লোকে দেখে। বাজারে-হাটে রাস্তায়, বাসস্ট্যান্ডে, রেলস্টেশনে যথেষ্ট...। সেখান থেকে রিয়ালিটির মাল-মশলা পাওয়া যায়। কিন্তু এইসব কিছু তো আর টেপ-রেকর্ডারের মতো ব্যবহার করা হয় না। নির্বাচন করে, এটা ওটার ঘাড়ে চাপিয়ে। কোনো কোনো জিনিস দশ বছর আগেকার, এ বছর ব্যবহার করে।
জহির : তাহলে কি আপনাকে একজন সমগ্রতাবাদী বা সর্বগ্রাসী কবি বলতে পারি?
উৎপল : না, তা বলো না । সেটা হলে খুব বড় বলা হবে।
জহির : আপনার কবিতায় রাজনীতি, অর্থনীতি, আদর্শ-অনাদর্শ সব কিছুই আছে। সেটা মানে হয়ত আপনি উচ্চকিতভাবে বলেন না।
উৎপল : তা বলতে পারো। সবই আছে।
জহির : আচ্ছা, স্ট্রিট রিয়ালিটিতে যারা আছে আপনি কি তাদের কাছাকাছি আসতে চান? মানে আপনার কবিতা ও তাদের জীবনযাপন ফারাক ঘুঁচাতে চান? আমি নিশ্চিত যে তারা আপনার লেখা পড়ে।
উৎপল : পড়ে, না? সুতরাং তাদের কাছাকাছি আসার কোনোরকম চেষ্টা করার দরকার নেই।
জাহিদ : কিন্তু ব্যাপারটা যদি আমরা এইভাবে চিন্তা করি যে, তারা যে জীবনযাত্রার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন, সেই জীবনযাত্রা স্ট্রিট রিয়ালিটিকে পোট্রে করার জন্য আপনি অতটা উচ্চকিত না?
উৎপল : এটা আমার স্বভাব বলা যেতে পারে বা আমি আকর্ষিত হই ওই ওই দিকটায়।
জহির : আপনার কবিতায় দেখা যায় যে, কবিতার কোথাও জ্ঞানগত সিদ্ধান্ত দেন না। ফলে পাঠক-কবির সম্পর্ক তৈরির সুযোগ থাকে। আপনি কি সচেতনভাবে এটা করেন?
উৎপল : নিশ্চয়ই সচেতনভাবে। করতে করতে অভ্যেস হয়ে যায়। তখন কি আর সচেতনভাবে করে? মানে সচেতন তো নিশ্চয়ই।
জহির : সচেতনভাবে যেসব কবিতা লেখা হয়। সেইটা আসলেই কি ভালো কবিতা?
উৎপল : হতে পারে। আমি জানি না। কে কোথায় লেখে কিভাবে। হয়...।
জাহিদ : আচ্ছা, আমি যদি ব্যাখাটা এভাবে করি যে, কোনো ফেনোমেনাতে একটা ঘটনা ঘটে, একটা হচ্ছে স্পনটেনাস, অরেকটা স্টিমুলেটেড। আপনি কি স্পনটেনাস ধারাতে আকর্ষিত বেশি?
উৎপল : আমি দুটোতেই আকর্ষিত। দুটোই কাজ করে। তবে অনেকটাই মুডের ওপর। ঠিক জায়গায় দুই-ই হয়। সময়ের ব্যাপার। বলা কঠিন। কখন কোনটা ধরো এই সময়টা আমি স্পনটেনাস হলাম, পরে... । মনে বলা কঠিন।
জহির : আপনার অনেক কবিতায় এক ধরনের মনোলগ লেখেন। এই যে আপনি ১, ২, ৩, ... ইত্যাদি কবিতায় নাম্বার দেন এগুলো আমার কাছে মনে হয়েছে পাঠকের চোখ ভোলানোর জন্যে। আর মনে হয় যেন সব মিলিয়ে পুরা একটা কবিতাই লিখছেন।
উৎপল : পাঠকের চোখ আমি কী করে ভোলাব? পাঠক আমার চেয়ে অনেক বেশি ধূর্ত। সেই আমাকে ভোলায়। আমি পাঠককে ভোলানোর কোনো চেষ্টা করি না। তবে ১, ২, ৩, ... দিই যে, এগুলো সংখ্যা। প্রথমত, কবিতার নাম দিতে আমি ইতস্তত করি। অনেকে খুব অ্যাম্বিশাস নাম দেয় এবং লোকে নামটা পড়েই চমকে যায়। তারপর কবিতাটা পড়ে না। ১, ২, ৩ দিলে হয় কী, লোকে তো আর ১, ২, ৩,... দিলে হয় কী, লোকে তো আর ১, ২, ৩... নিয়ে মাথা ঘামাবে না। লেখাটা পড়বে আর কি। আমি চাই লেখাটা পড়ুক। সেই জন্য আমার কবিতার বইয়ের নামগুলো খুব সরল হয়।
জাহিদ : ‘সুখ-দুঃখের সাথী’। খুব সুন্দর নাম।
উৎপল : ‘সুখ-দুঃখের সাথী’। এই রকম নাম হয়। কিন্তু তাছাড়া আমি একটা পিরিয়ডে সাত দিন ধরে লিখলাম। প্রথম দিনের কবিতাটা ১, বিকালবেলার কবিতাটা ২,... এ রকম একটা রবীন্দ্রনাথও করে গেছেন। নাম্বার দিয়ে লেখা কবিতা। যখন আর নাম খুঁজে পেতেন না সঙ্গে সঙ্গে নাম্বার দিয়ে দিতেন। এটা অনেকে করেছেন।
জহির : ‘বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে’র ৪ নং কবিতায় আপনি লিখেছেন ‘শুনেছি মানুষজনপাখি দেখে মাঠের আড়ালে। ওড়াউড়ি করে থাকে। শূন্য থেকে লাফ দেয়। আবার গাছেও চড়ে ফল-মূল ঠোকরায়। ’ এখানে মানুষকে পাখির ভূমিকায় চড়িয়ে বা রিপ্লেসমেন্ট করে বৈপরীত্য থেকে হাস্যরস বা অভিব্যক্তি আদায় করেছেন। আপনার অনেক আগের কবিতায়ও আছে। আবিষ্কৃত টুল বারবার ব্যবহার করা আপনার কাছে মেকানিক্যাল লাগে না? মনে হয় না আমি নতুন করে ব্যবহার করতে পারছি না এবং পুরনো টুল দিয়ে কাজ করছি।
উৎপল : না... পুরনো যন্ত্রপাতির প্রতি একটা মমত্ব পড়ে যায় তো! একজন কাঠের মিস্ত্রি তার পুরনো হাতুড়িটা ছাড়তে চায় না কারণ হচ্ছে সেটাই সে ব্যবহার করে। এ রকম হয় পুরনো জিনিস, পুরনো কৌশলের প্রতি টান থেকে। তবে এই যে মানুষের সঙ্গে জগতের অন্যান্য পশু-প্রাণি, গাছপালা—অন্যান্য মানুষের সম্পর্ক—এই জিনিসটা আমাকে খুউব আকর্ষণ করে এবং এটা আমার প্রধান চিন্তার বিষয়। মানুষ-লোকজন-আত্মীয়স্বজন-কুকুর-বেড়াল সব মিলিয়ে চারপাশ।
জহির : অগ্রজ কবিদের সঙ্গে অনেক রকমের আধার ও আধেয়ের দিক থেকে শেয়ারিং আছে আপনার কবিতায়। যেমন মাইকেল, জীবনানন্দ। অনুজদের সঙ্গে কি এরকম শেয়ারিং সচেতনে-অচেতনে হয়? এ রকম শক্তিশালী, অশক্তিশালী কবিও হতে পারে।
উৎপল : হুঁ, করি হয়ত কখনো কখনো। যেমন মহাকবি মাইকেল বা ইয়ে সেরকম কোনো কবি পরবর্তীকালে এসেছেন বলে আমার মনে হয় না। মানে, অন্তত আমার জানা নেই। তবে শেয়ার করি। করব না কেন? আমি অনেকের লেখা থেকে লিখি।
জহির : তা আপনি মাইকেলকে এত বড় করে দেখছেন কেন? রবীন্দ্রনাথ থেকেও বড় করে দেখছেন?
উৎপল : বা বা! সে এখন এত বড় প্রশ্নের কী করে জবাব দেব, মাইকেল কেন বড় কবি? নানা কারণে। সেসব তোমাদের বই পড়ে জেনে নিতে হবে। মাইকেলের আগে বড় কবি কে ছিলেন? বলো। একজন কবির সঙ্গে একজন কবির দূরত্ব দেখলেই তো বোঝা যায় যে কোথায় স্বতন্ত্র বা কেন ইনি আলাদা। মাইকেল কত আলাদা এটা যেদিন তুমি বুঝতে পারবে সেদিন বুঝতে পারবে যে মাইকেল কেন বড় কবি। এ দু’জনকে পাশাপাশি পড়ো, তাহলে বুঝতে পারবে।
জহির : আপনি রবীন্দ্রনাথের থেকে মাইকেলকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেললেন যে...
উৎপল : আমি মাইকেলকে বেশি গুরুত্ব দিই। আরো দেব। নিশ্চয়ই দেব। রবীন্দ্রনাথকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু মাইকেলকে আমি ভালোবাসি। মানে, দুটোর মধ্যে মনের একটু তফাৎ আছে। মাইকেল ১০ বছর মাত্র লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ৪০ বছর লিখেছেন। মাইকেল ১০ বছরে উলটপালট করে দিয়ে গেছেন। আর রবীন্দ্রনাথ ধীরেসুস্থে করেছেন। রবীন্দ্রনাথের বহু কীর্তি আছে। মাইকেলের আবার সেসব ছিল না। রবীন্দ্রনাথের স্কুল করা, গান লেখা, ছবি আঁকা, এসব মাইকেলের ছিল না।
(ঢাকার বিক্রমপুরে উৎপলকুমার বসুর সঙ্গে জহির হাসান, ২০০৬)
জহির : কিন্তু মাইকেলকে নিয়ে অভিমত আছে যে মাইকেল একটা জিনিস করেছেন—তিনি ইউরোপিয়ান কালচার এখানে আসুক ওটা চাননি। কিন্তু নলেজটা আসুক চাইছেন, সাপোর্ট করছেন। মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারটা।
উৎপল : তা হয়েছে। তখন কলোনিয়াল পিরিয়ড ছিল। ইংরেজরা এসেছে এ দেশে। কিন্তু আমাদের ভারতবর্ষে মেয়েরা তো খুব শিক্ষিত ছিল একসময়। ট্রাডিশনাল ভারতবর্ষের মেয়েরা শিক্ষিত ছিল না? বিরাট-শিক্ষিত ছিল। হ্যাঁ, তারপর আমরা ভুলে গেছি। যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়েছে। দেশ পরিবর্তন হয়েছে। ... অনেক কিছু। কিন্তু তুমি যেটা বলছো সেটা মেয়েদের শিক্ষিত করা নয়। সেটা হচ্ছে সর্বশিক্ষা। সব মেয়ে শিক্ষিত হবে। সব ছেলে শিক্ষিত হবে। এটা হয়ত আগে ভারতবর্ষে ছিল না। আগে হয়ত কিছু মেয়ে শিক্ষিত হতো। কিছু মেয়ে উচ্চমার্গের চিন্তা-টিন্তা করত। সবাই করত না। এখানে তফাৎ।
জহির : (আপনার কবিতায় ফিরে আসি)। আপনার কবিতায় অধিকাংশ জুড়ে থাকে হার্ড রিয়ালিটির থেকে এসে পড়া বস্তু ও প্রাণ আর কত কিছু। কিন্তু সেই সব যেন নীরব-শীতল হয়ে পাঠকের কাছে ফিরে আছে। এতে এ বিষয়ে পাঠকের রুচির পরিধি নির্দিষ্টাপ্রাপ্ত হয়। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
উৎপল : আমি চাই যে পাঠক তার প্রাণপণ চেষ্টা করুক। পাঠকের সঙ্গে সবসময় আমার একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক থাকে। আমি একটা জিনিস তৈরি করে পাঠককে দিলাম, আর সে খেয়ে নিল। সেটা আমি চাই না। আমি চাই যে সে নিজেও কিছু কন্ট্রিবিউট করুক। সে নিজেও তৈরি করুক। আসলে এটা আমাদের যৌথ, দ্বৈত উদ্যোগে তৈরি একটা কবিতা।
জহির : যৌথ রচনা।
উৎপল : হ্যাঁ, যৌথ রচনা।
জাহিদ : কিন্তু ব্যাপারটা এভাবে বুঝতে চেষ্টা করি—মানে পাঠককে ইনভলব করে নেওয়া?
উৎপল : নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই! আসলে সেখানে আর পাঠকের আলাদা সত্তা আমি ধরতে পারি না। তখন সে পাঠক হয়ত আমি নিজেই।
জহির : ‘সুখ-দুঃখের সাথী’র একটা কবিতায় আপনি বলছেন ‘চিন্তার জাল আমি গুটিয়ে নিয়েছি। ’ আপনার শেষের দিকের কবিতায় এ ধরনের রূপক অলঙ্কারের ব্যবহার কমে আসছে।
উৎপল : সে আবার কী? বহু অলঙ্কৃত কবিতাও আছে। এক সময় আমি প্রচুর অলঙ্কারে লিখেছি। তারপর আস্তে আস্তে বুড়ো হয়ে যাচ্ছি না! সাজগোছ ভালো লাগে না।
জহির : না, মানে আপনি হার্ড রিয়ালিটি নিয়ে ডিল করেন। সেখানে তো অলঙ্কার হার্ড রিয়ালিটিকে ঢেকে ফেলতে পারে। তার বস্তুচালিত আসল জরুরি চেহারাটা আনএক্সপ্রেসড রাখতে পারে। প্রকাশিত নাও করতে পারে।
উৎপল : এই কাজ সেখান থেকেই তৈরি হয়। জাত হয়। হার্ড রিয়ালিটি থেকে। আমি অলঙ্কার বলতে এই রকমের জিনিস বুঝছি না কিন্তু, যেটা আগের মধ্যযুগে লোকেরা বুঝত। কাব্যের অলঙ্কার। সে রকম নয়।
জহির : মানে নতুন নতুন অলঙ্কার সৃষ্টি করা সম্ভব।
উৎপল : নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই! কবির তো তাই কাজ। নতুন নতুন অলঙ্কার সে তৈরি করবে। বানাবে।
জাহিদ : এ অলঙ্কারগুলো কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি হতে পারে?
উৎপল : হ্যাঁ। কারো কারো ক্ষেত্রে দর্শনপ্রসূত কিন্তু আমার দৃশ্য জগৎ থেকে আসা। মানে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যজগৎ থেকে অ্যাবস্ট্রাক্ট চিন্তা বা উচ্চমাপের চিন্তা থেকে আসেনি।
জাহিদ : এই অলঙ্কার দিয়ে কি আপনি কবিতার শরীর তৈরি করেন? নাকি কবিতায় যে মেসেজটা আসছে তাকে সিগনিফাই করেন?
উৎপল : আমার কবিতা, মেসেজহীন কবিতা। যার জন্য আমার কবিতায় কোনো দর্শন মানে কোনো ওজন নেই। ভার নেই।
জহির : এই যে বলছেন ভারহীন কবিতা। তো এটা দিয়ে কোনো সোশাল রেসপনসিবিলিটিকে কিভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছান?
উৎপল : আমি সোশাল রেসপনসিবিলিটিতে বিশ্বাস করি না। একজন কবি তার পাঠকের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করুক। পাঠক কবিতা পড়ুক। একটা প্রতিক্রিয়া হোক।
জহির : মানে পাঠকের কোনো আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করবেন এ রকম কিছু লেখার মুহূর্তে আপনার মাথায় লাইঅ্যাবিলিটি ফিল করেন না।
উৎপল : পাঠকের আকাঙ্ক্ষা কী, তাই তো আমি জানি না। আমার কবিতা কে পড়ছে, কে না পড়ছে, আমি কী করে জানব? আমি যেটা চাই যে আমি একটা জিনিস তৈরি করলাম। মধ্যে কিছু কিছু ফাঁক রাখলাম। আমি চাই যেই পড়ুক না কেন নিম্নশ্রেণি, উচ্চশ্রেণির, পুরুষ-মহিলা... তারা যে যার মতো করে ফাঁকগুলো ভর্তি করে নিক। শূন্যস্থানগুলো পূরণ করে নিক।
জহির : কিন্তু আপনি যে ভাষায়, যে অবস্থান থেকে লেখেন—এটা তো দরিদ্র, নিম্নশ্রেণির সাধারণ মানুষ তো পড়ে বুঝতে পারবে না আপনার কবিতা।
উৎপল : তারা নিজেরা না পড়তে পারে। ধরো কেউ পড়ল। তা শুনে অর্থ করতে পারে।
জহির : জীবনানন্দের লাইন আছে ‘যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা’ এটাকে অরগানাইজ করে লিখলেন কি আপনি? ‘এ জীবন ক্ষতদের, এ জীবন রক্তগ্রন্থির। ’ নাকি জীবনানন্দের ওই লাইনটা কালে চর্বিত চর্বণ হয়ে ফিক্সড মিনিং দেয়া শুরু করেছে, ফলে আপনি ভ্যারিয়্যাবল মিনিং তৈরির চেষ্টা করলেন?
উৎপল : আসলে এই লাইনটা লেখার সময় আমার খুব জীবনানন্দের ওই লেখার কথা মনে পড়েনি, মাথায় আসেনি। আমি ওই লাইনটা আমার ধারণা, আমি সতর্কভাবেই লিখেছি। তবে তুমি যদি ওর পেছনে জীবনানন্দ দেখো, মাইকেল দেখো, ভারতচন্দ্র দেখো—দেখতে পারো। তবে এটা আমি সতর্কভাবে লিখেছি।
জহির : সচেতনভাবে লিখেছেন, কী জানি অবচেতনে তাহলে জীবনানন্দ আছে।
উৎপল : হতে পারে। হতে পারে। জীবনানন্দ কেন? গোটা বিশ্বসাহিত্য রয়েছে আমার অবচেতনে।
জহির : আপনার কবিতায় পরম্পরা নিয়ে প্রথাগত ধারণাকে পাত্তা দেননি। ফলে বাক্য থেকে বাক্যান্তরে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়, যে অ্যাবসার্ডিটি ক্রিয়েট করে তা কবিতার শক্তি বৃদ্ধি করে।
উৎপল : বোধ হয়। আমি ঠিক সেভাবে ভাবিনি। এবার থেকে ভাবব। আমার খুব যে এই কবিতা কেন, কী, কে পড়ে, কে না পড়ে—এগুলো নিয়ে আমার খুব মাথাব্যথা নেই। আমি আমার জীবন-যাপন, আড্ডা দেওয়া, বন্ধুত্ব, ঘুরে বেড়ানো এগুলোতেই ব্যস্ত থাকি। তার ফাঁকে ফাঁকে কবিতা হয়, নাও হতে পারে। এমন দায়বদ্ধ নই যে আমাকে লিখতেই হবে। আমি দীর্ঘদিন লিখিনি। সুতরাং আমাকে সে রকম করে ভেবো না যে সকালে উঠে মাথা গোঁজ করে লিখতে বসে গেলাম।
জহির : সে রকম আছে অনেকে হয়ত।
উৎপল : না, সেটা মনে হয় কবিতা লেখার জন্য দরকারও নেই। অবশ্য যারা করে তারা বলবে দরকার আছে।
জহির : তারা ডিসিপ্লিন খোঁজে জীবনের ভেতর।
উৎপল : তারা ডিসিপ্লিন খোঁজে এবং এগুলো সব বেশিরভাগ ঔপন্যাসিকরা করে। করে আর কি...
জহির : পৃষ্ঠা সংখ্যার ব্যাপার থাকে।
উৎপল : পৃষ্ঠা সংখ্যার ব্যাপার থাকে।
জহির : ইচ্ছা করলে তো আপনি কবিতা শেষ করে দিতে পারেন। আপনার তো সমস্যা নাই।
উৎপল : ভালো বলেছো। হ্যাঁ, আমার কোনো সমস্যা নেই। একটা সমস্যা আছে, সেটা লেখা ছাপানোর সময় বা এডিট করার সময় বা প্রুফ দেখার সময়। তখন সব সমস্যা তৈরি হয়। ছাপার অক্ষরে দেখলে।
শেষ কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৬
শিল্প-সাহিত্য
ঢাকায় উৎপলকুমার বসুর সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকার ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।