নাম মিল হবার কারণে ছইল্লা গর্ব করে ডিক্লেয়ার করে, সে ছাদেকুল্লার বংশেরই হবে। তার মায় কইছে।
ছইল্লা: দেখ তার ‘কুল্লা’ আর আমার ‘ছল্লা’ একই টাইটেল।
চাচার চায়ের দোকানে বইসা এই ফাঁকাফাঁকি করতেছিল ছইল্লা।
চায়ের দোকানের এরা বিশ্বাসের গভীরে চইলা যাইতেছিল। ছইল্লা জমায় ফেলছিল সিরিয়াস। ওই সময় মিস্টার (তার নামেরও পাঠোদ্ধার বা শানে নুযুল উদ্ধার করা যায় না) আইসা সব ভণ্ডুল কইরা দেয়।
মাঝে মাঝে কইত্থে আইসা একেকটা ব্রেকিং নিউজ দিয়া জায়গা গরম করে ফেলার কীর্তি আছে মিস্টারের।
মিস্টার: মিইয়া, তাইলে তো আন্ডাপাড়ার জাইল্লা বেজ্ঞুন ইতার বংশের। না? কই ছইল্লা আর কই ছাদেকুল্লা। আমার ফেরেন জইল্লা, ঠেইল্লা বেজ্ঞুন বেজ্ঞুন। মিইইয়া!
এদিকে ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনে উত্তাপ বিরাজমান। শুটিং ফেডারেশানের গর্ব ছাদেকুল্লা এশিয়ান গেমসে শুটিংয়েও সোনা জিতে আসছে। ফেডারেশানে থাকাকালীনই ভাবা গেছিল, সে একটা রত্ন। তাকে নিয়ে এখন পত্রিকা, চ্যানেলগুলা খেলার খবরে হাউকাউ পইড়া গেছেগা। সাংবাদিকদের ভিড়, ইন্টারভিউ, ফটোসেশান কে কার আগে নিবে এই প্রতিযোগিতা চলমান। সামনের অলিম্পিক আসরে ছাদেকুল্লাই যে বাংলাদেশের ট্রাম্প কার্ড। চারদিকে চলছে ছাদেকুল্লা বন্দনা। প্রত্যান্ত অঞ্চলের সহজ সরল ছাদেকুল্লা এত ফোন, মাইক্রোফোন, ক্যামেরা-সেলফিতে পুরা অটো হইয়া গেছে
অকাট যুক্তি। ছইল্লা আর ফ্লোর পায় না। অন্যেরা টার্ন কইরা মিস্টারের দিকে ঘুরে।
- আরে মিয়া আমারেই তো ল্যাদাকালে কামাইল্লা ডাকত। তাইলে?
বইলা একটু চুপ করে যায়। চাচার দিকে তাকায়। চাচা তখন নাক বের করে পুরুপুরি মিস্টারের দিকে নিবিষ্ট।
মিস্টার: কী, চা দিবেন? আমি কি এই গপ করতে আইছি নাকি।
মিস্টার যে এই গপ করতে আইছে লগে এক্সক্লুসিভ কোন নিউজ সেইটা জায়েজ করতে এইটা বলতে হয় যে, সে ফালতু গপ করে না।
ওর নাম যে ছাদেকুল্লা এইটাও আসলে গ্রামের কেউ জানত না। পেপারে দেখেই প্রথম জানতে পারছে। এমনকি তার বাসায়ও আসল নাম ভুলে গিয়ে ছ্যাদা ডাকে।
থার্ড পারসন একজন অনেকক্ষণ ধইরা চোখ বড় বড় কইরা কিছু কইতে চায় কইতে চায় করতেছিল, মিস্টার বুইঝা তারে ফ্লোর দিতাছিল না। এই নীরবতায় ফট করে সে প্রশ্ন করে সবার মনের কথাই বইলা ফেলে।
- আচ্ছা অর নাম ছাদেকুল্লা হয় কেমনে। অরে তো আন্ডা-বুরা বেজ্ঞুনে ছ্যাদা ডাকে।
যেন ‘ছাদেকুল্লা’ অনেক সন্মানের নাম। এই নাম ছ্যাদার কেমন করে হইতে পারে!
এই তথ্য আসলে মিস্টারও জানে না। কিন্তু সে চা নিয়া ‘এসব কী প্রশ্ন করে, সে জাইনাও বলবে না’ এমন ভাব করে অন্যদিকে মুখ ফিরায়ে গম্ভীরভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দেয়।
এই ফাঁকে তার ছাদেকুল্লা ওরফে ছ্যাদাবিষয়ক আরো কথা হইতে থাকে। গ্রামের মানুষ আলাপের একটা বিষয় পাইল আর কি। এবং এইসব কথা ঠাইল পাতা ছড়ায়া গ্রামের কানাকুঞ্চিতে ছড়ায়া যায়।
প্রত্যন্ত সাতকানা গ্রামের মানুষ এইটাই জানে না তার নাম পেপারে কেন আইছে। বড় কিছু গড়ছে এইটা বুঝে শুধু। ‘আরেকদিন বুঝামু’ কইয়া মিস্টার চইলা যায়।
এদিকে ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনে উত্তাপ বিরাজমান। শুটিং ফেডারেশানের গর্ব ছাদেকুল্লা এশিয়ান গেমসে শুটিংয়েও সোনা জিতে আসছে। ফেডারেশানে থাকাকালীনই ভাবা গেছিল, সে একটা রত্ন। তাকে নিয়ে এখন পত্রিকা, চ্যানেলগুলা খেলার খবরে হাউকাউ পইড়া গেছেগা। সাংবাদিকদের ভিড়, ইন্টারভিউ, ফটোসেশান কে কার আগে নিবে এই প্রতিযোগিতা চলমান। সামনের অলিম্পিক আসরে ছাদেকুল্লাই যে বাংলাদেশের ট্রাম্প কার্ড। চারদিকে চলছে ছাদেকুল্লা বন্দনা। প্রত্যান্ত অঞ্চলের সহজ সরল ছাদেকুল্লা এত ফোন, মাইক্রোফোন, ক্যামেরা-সেলফিতে পুরা অটো হইয়া গেছে।
ক্রীড়া সাংবাদিকরা ইন্টারভিউ করছিল।
- ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
ছাদেকুল্লা: ভবিষ্যত পরিকল্পনা আবার কী! টায়ার্ড/হাস্ফাস লাগতেসে। গ্রামে যামু। কিছু জরুরি কাম আছে, ঋণ আছে শোধ দিমু। যারে যা পারি করমু/দিমু। বাপ-মায়েরে ঢাকায় নিয়ামু। অহ তার আগে বাড়িঘরের একটা ব্যবস্থা করমু।
সাং: এখন তো আপনার অনেক মেয়ে ভক্ত। বিয়ে নিয়ে কী পরিকল্পনা?
ছাদেকুল্লা: না বিয়ে নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নাই। মানানসই, টেকসই একজনরে বাইছা লমু।
পরদিন ইন্টারভিউ, নিউজ আইল।
একজন নিউজ করল, “শুটিংয়ে টায়ার্ড/হাস্ফাস মনে করছেন স্বর্ণশিকারী সাদেকুল্লা। গ্রামে ফিরে যেতে চান। সবার জন্য কিছু করার দৃঢ় প্রত্যয়,” আরেকজন করল, “অনেক ভক্তদের মাঝে একজনকে বেছে নেবেন স্বর্ণকুমার। ”
এসব কী? এসব কবে কইল মনে করতে পারল না। মাল খাইছিল। কিন্তু সে তো ইন্টারভিউর পরে, রাতে। হ্যাঙ্গোভার এখনো কাটে নাই। তাই কি কইসে ঠিকঠাক মনেও করতে পারে না। ‘প্রত্যয়’ মানে কী ওইটা নিয়ে ভাবে। নামও ভুল লেখছে। শালায় মাল খাইছিল মনয়!
ফেডারেশানের বড়ভাইকে ফোন করে ভাবে কইবে, ওই সাংবাদিকরে দিকবিদিক একটা মাইর লাগানোর ব্যবস্থা করন যায় কিনা কিন্তু দেখে বড়ভাই উল্টা তারে চার্জ করে।
ছাদেকুল্লা বুঝায়,
- দেখেন ভাই আমি এরকম কিছু কই নাই। কই-ছি, কইছি গ্রামে যামু। বাপ-মায়েরে নিয়া ঢাকা আসমু। কী কইলাম কী লিখল। তারপর দেখেন আমার নামের বানানও ভুল লেখেছে। মারতে ইচ্ছা করে না কন?
ভাই: বুঝছি। শোন এরপর কোনো স্টেটমেন্ট দিতে হইলে আমাদের জিগায়া তারপর। হুট করে কিছু না করে টাইম নিবা। দরকার পড়লে কোয়াশ্চেন পেপার পাঠিয়ে দেবে। এবং লাগলে পেপার বা চ্যানেল নিউজে যাবার আগে নিউজ দেখে নিবা।
ছাদেকুল্লা মুটামুটি বুঝে বা কিছুই বুঝতে পারে না।
ভাই: আর শোন একটা স্পন্সর আসছে, ড্রিঙ্কসের। তারা চায় তুমি তাদেরটা খাও। সাংবাদিক, ভক্ত আইলে, ছবি তুললে সেটা দেখাও।
ছাদেক: সেটা খাইলাম। কিন্তু ভাই মাল হাতে ছবি তুললে কেমন খারাপ দেখা যায় না? সবাই কী ভাব্বো!?
ভাই: আরে মিয়া মাল না। বেভারেজ। ডগি সুপারম্যান এনার্জি ড্রিঙ্কস। তোমার ইচ্ছা।
আর তুমি এখন গ্রামে যাইবা মানে! এখন তো যাইতে পারবা না। এখানে তোমার কাম আছে। এই নিউজের পর তো আরো পারবা না।
ছাদেক: একদিনের জন্যেও না?
ভাই: না। ছাদেক তোমার ওখানে যেতে আসতে লাগবে চারদিন। একদিন থেকে কী (চেইতা ‘বাল’ কইতে গিয়াও কয় না) করবা। আমি বলি শোনো, ঢাকায় বড় দেইখা ফ্ল্যাট নেও। আঙ্কেল-আন্টিরে নিয়া আসো।
ফোন রেখে দেবার পর ছাদেকুল্লা মন থেকে আরো কয়েকবার গালাগালি করে ওদের। নিউজপেপার চোখে পড়লেই মেজাজ খিঁচা যাইতেছে।
তারপরেই তার মাথায় যে চিন্তাটা আসে সেইটা হচ্ছে, এই যে তার বলে অনেক মেয়ে ফ্যান কই তারা। কই গেলে পাওন যাইব। তার পুরান প্রেমের স্মৃতি লারাচারা দিয়া ওঠে। ওইটারে প্রেম কওন যায় কি! সে পছন্দ করত, সাদিয়া জানত। সাদিয়ারে এইটা সেইটা কিনা দিত, কেয়ার করত, বাড়ি পৌঁছায় দিত। অনন্ত হইলে কইলজা বাইর করা দিত। সাদিয়া জানে। তারপর কী করল। ছাদেক জ্বিনে ধরা দুপুরে পাখি মারতে আগাড়ে বাগাড়ে। জঙ্গলের চিপা থেইকা বড়ইর কেটা আর ডঙ্গুল্লা পাতা ছাড়তে ছাড়তে সাদিয়া আর তার বন্ধু আলম বাইর হইল হয়রান আউলা ঝাউলা হয়া। তারপরও ছাদেক বিশ্বাস করত আলমের উদ্দেশ্য খারাপ আছিল। সাদিয়ারে তাবিজ কইরা ভিতরে নিয়া জোরজবস্তি করতে চাইসে কিন্তু সাদিয়া দিতে চায় নাই।
সাদিয়ারে এ ব্যাপারে ডিরেক্ট জিজ্ঞেস করতে পারে নাই। কিন্তু ছাদেক সাদিয়ার লগে ফ্রি হইতে চাইছে। একদিন ঠিকই কৃষ্ণের পুকুরঘাটে সাদিয়া তার কাছে আইসা কান্দাকাটি করে। বেস্ট ডে আছিল তার জীবনে। সেদিন মনে হইছিল ছাদেকও একটু কান্দে, মনে হইছিল সাদিয়ার মাথা তার কোলে বা তার মাথা সাদিয়ার কোলে রাখতে। পজিশন লয়া লইছিল। কইত্থেইকা বিশাল আকার এক পাত্থর আইসা ঝুপ কইরা পড়ে কৃষ্ণের পুকুরে। মনে হইল কেউ এটম বোমা মারল। সাদিয়া উইঠা যে দৌড় মারল ছাদেক টাল সামলাইতে না পাইরা ভয়ে বা সাদিয়ার ঠেলায় পুকুরে পইড়া গেল। এইটারে প্রেম কওন যায় মনয়।
এরপরেও এই মাইয়ার লগে অনেকরে দেখা গেছিল। দুষ্ট আছিল। এটাই ভাল্লগতো হয়ত। এসব নিয়া বিচার সালিশ পর্যন্ত হইছিল। কিন্তু বারবার তো তার কাছেই আসছে। আর যত মাইয়ারেই ভাল্লাগুক মনের সৃতিকোটায় সাদিয়া আইসা পড়ে।
সিনায় লাগছিল যেইদিন বন্ধু/বান্ধবী মহলে তারে ‘ছ্যাদা দেবদা’ কয়া হাসাহাসি করছিল। গ্রামে সবাই তারে ছ্যাদা ডাকে অবশ্য। সেদিন বৃষ্টির মইধ্যে সই করে পাত্থর মাইরা কাউয়ার ডিম বা কোকিলের নাকি কোয়েলের ডিম ফেলছিল না ভাইঙ্গা।
তারপরেও স্টিল ছিল। ঘোর কাটছে রেজাল্টের দিন ফুল নিয়া গেছিল যেইদিন। সবাই পাস করছে সে করছে ফেল। খাতার বা সিস্টেমের কোনো গোণ্ডগোল হয়ত। কিন্তু সাদিয়ারে ফুল দেবার আর সিস্টেম থাকল না।
সাদিয়া এখন কই? কী করে? দেখতে ইচ্ছা করে। না, একবার গ্রামে যাইতেই হইব।
এভাবে ভাবে ছাদেকুল্লা। এখন তো সামনে যাইতেও ভয়, শরম থাকবে না।
চ্যানেলে তখন কজনরে ধুইতেসে সিইও।
- ক্কি ক্কি এঁ এঁ ক্কি! সবাই নিউজ করে ফেলল তারপর আমরা করব... এভাবে চ্যানেল চলবে?
বেতন যে নাও হালাল করে নাও...
রেগে গেলে সিইও’র কাঁপাকাঁপির অভ্যাস আছে।
নানান আইডিয়া গিজগিজ করা জাভেদের মাথা এখন একদম ব্ল্যাঙ্ক।
এই সুযোগে এতদিন ধইরা তক্কে তক্কে থাকা অবহেলিত সানোয়ারের জন্য মোক্ষম সময় আসে। যদ্যপি সে ক্রীড়াসাংবাদিক নহে, কিছু ক্রীড়ানকিতো করাই যায়। সে ডিজাইন দেয়—তারা সবার আগে ছাদেকুল্লার গ্রামে যাবে, প্রতিবেদন তৈরি করবে। ডকু স্টাইল করবে। ফাটায়া দিবে।
জাভেদ ভাই আইসা কয়, আস্তে আস্তে। কুল। বেশি ফাইটা যাবে আবার।
সানোয়ার আরেক কলিগরে বলে,—দেখছেন দেখছেন হিংসা হিংসা।
সানোয়ারের ডিজাইনমতে গ্রীষ্মের এক খরখরা দুপুরে একখান মাইক্রো, চ্যানেলের লোগোঅলা একখান মাইক্রোফোন আর নয়ন নামে একজন এসিস্ট্যান্ট ক্যামেরাম্যান। তার জীবনের পয়লা ক্যামেরা চালনা। সে পায়ে পইড়া ওস্তাদ সানোয়াররে কদম্বুচি করে দুয়া নেয়। সানোয়ার বেজার হয় কর্তৃপক্ষ তার লগে এমন অপ্রফেশনাল আচরণ করছে। টাকা পয়সাও ঠিকমতো দেয় নাই। কিন্তু সানু মন-প্রাণ ঢাইলা ঝাপায়া পড়ার লাইগা যখন রেডি, সাতকানার কাছাকাছি আইসা তখন বেসতের মতো হয়া যায়! এখানে ঝড় হয়ে মাঠ-ঘাট সব প্যাঁক মানে পুট মানে কর্দমাক্ত।
গাড়ি ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়ে সানু। নামার পর বুঝছে যে যা বুঝছিল পরিস্থিতি তার চাইতেও ভয়াবহ। কাদায় পা দেবার লগে লগে পা হাঁটু পর্যন্ত ডাইবা গেল। এমনে মোবাইলসহ প্যান্টের পকেট জাপ্টে ধইরা পা তুইলা তুইলা আগাইতে হইতেছে। কট্টুক গিয়া পা তুইলা দেখে জুতা নাই। এখন আরপিছে যাবারও উপায় নাই। পারলে প্যান্টসহ খুইলা দেবার ইচ্ছা হয়। ক্যামেরাসমেত যার বেশি কষ্ট হয় সেই নয়নের উৎসাহে থৈ থৈ অবস্থা।
দুই যোদ্ধা যখন পানিভাতের যুদ্ধে লিপ্ত তখন বৃষ্টি আসে যায় এমন সুখকর মুহূর্তকে মাতিয়ে সবাই চাচার দোকানে এক হয়।
লিড দিতেসিল ওই থার্ড পারসনটা।
- ছ্যাদা ছুটিং করে ছুটিং
একজন না জিগায়া পারে না,
- নায়ক নাকি গুণ্ডা? এই ছেগা লইতো নায়ক হইবার কথা না। গুণ্ডাই হইব।
থার্ড পারসনও একটু দ্বিধান্বিত। ছুটিং ঠিক, তারে তো নায়কও কইতাছে। কিন্তু নায়কের ডাইসে তো সে যায় না। বন্দুক ফন্দুক লইয়া খাড়াইলে নায়ক হয়নি! নামকরা গুণ্ডাও অইতে পারে।
মিস্টার বসা। প্রিপারেশান লইতাসে। থার্ড পারসন কুতুবের চালাচালি শেষ হইলে মিস্টার নামবে মাঠে।
বৃস্টি নাই কিন্তু চাচার দোকানে কইত্থেইকা বা চাল থেইকা পানি পড়ে। যে বেঞ্চির শেষে বসা সে মুচড়ামুচড়ি কইরা ঠেলতে থাকে পাশেরজনরে।
মিস্টার: তোমরা আমার বদাটা জানো। বন্দুক লয়া সে ছুটিং করে! সে গুলাগুলি করে।
এবার অবধারিতভাবে সবাই যেটা ভাবে প্রশ্নটা চলে আসে।
- পুলিশ?
মিস্টার: পুলিশের মাস্টর। খালি বইয়া থাকে, ঘুমায়, খায়। আর বন্দুক লইয়া টিপ করে খেলাধুলা করে।
মিস্টার ক্লিয়ার করে বুঝাইতে পারে না। কিন্তু সবাই বুইঝা যায়।
এর বেশি মিস্টার কইতেও পারবে না। তার হয়রান লাগে। সে ঘরে চইলা যাবার পথ ধরলে আরো কেউ কেউ আগ্রহ হারায়া উইঠা যায়।
যে কজন বসা চাচাসহ তারা দেখে দুইজন সারাগায়ে মুক্তিযোদ্ধার মতো কাদা মাখামাখি অবস্থায় আগাইতেছে। ওদের হাতের চা মেন্দা মাইরা আসে মাটির মানুষ দুইটাও কাছে আসে।
কাছে আইসা নয়ন পানি চায় না প্রথমে চায় চা। নয়ন সানুকেও দেয় এককাপ। চা দেখে সানু বলে,
- এইটা কী চা? কাদা চা। এই কাদা দিয়া বানানো। তোমার তো ভাই খুব ফুর্তি লাগছে দেখি।
ততক্ষণে তাদের চারপাশে পুলাপানসহ কিছু গ্যাঞ্জামের সৃষ্টি হইছে।
সানু নয়নকে বোঝায়,
- এইসব বিলাসিতা বাদ দাও নয়ন। তুমি যুদ্ধে নামছো ওই মুডে থাকো।
নয়ন চা ফেলে দিয়ে হুঙ্কার দিয়ে ‘ইয়েস স্যার’ বলে স্ট্যান্ডবাই হয়ে যায়।
কুতুব: আপনারা ঢাকা থেকে আইছেন?
সানু কাদা হাতে কুতুবের লগে হ্যান্ডশেক করে।
সানু: হুম। আমি সানোয়ার। ‘চ্যানেল পি’ থেকে। শুটার ছাদেকুল্লার ব্যাপারে কথা বলতে।
প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়াদের ‘হা’ করে তাকায় থাকার পর সানু বলে,
- এটাতো শুটার ছাদেকুল্লার গ্রাম সাতকানা?
একজন কয়ে ওঠে, ‘ছ্যাদা’? মাত্রই তারে লই গবেষণা হইতেছিল। সবাই ‘ছ্যাদা’ ‘ছ্যাদা’
করে ওঠে।
সানু: ছ্যাদা?
কুতুব: হ ছ্যাদা না?
সানু: ছ্যাদা...
নামের কারণে হোক নামকরণের ইতিহাস হোক বা স্মৃতিচারণ থেইকা ছ্যাদার ব্যাপারে জানতে চায় সানু।
নানা মুনির নানা মত পাওয়া যায়।
১। ছেঁড়া মানে পুলা থেইকা ছ্যাদা—এইটা মোটেও শানে নুযুল না। ইতিহাসের বিকৃতিস্বরুপ সম্মিলিত ‘না’ ‘না’ রবে প্রস্তাবনা খারিজ হয়া যায়।
২। তার হাতের নিশান ভালো আছিল। গুল্লি, পাত্থর যেকোন কিছু দিয়া পাতা পর্যন্ত ছ্যাদা করতে পারত। এইটা সানুর মনঃপুত হয়।
৩। তার বাপ-মা ছ্যাদা রাখছে, সবাই ডাকে তাই ছ্যাদা।
তখন প্রায় ৮০ বছরের এক মুরুব্বি আগায় আইসা সবাইরে থামায় দেয়,
- তোমরা কচু জানো।
সানুরে কয়,
‘আমি তিন পিরিয়ডের শাসন দেখছি। ব্রিটিশ, পাকিস্তান আর বাংলাদেশ। ওই ছ্যাদার বাপরে আমি জন্মাইতে দেখছি। ছ্যাদা হইতাসে বান্দরের বান্দর আছিল। গাছে গাছে চড়ত। পাখি ধরত। একবার মান্দার গাছে উইঠা তার প্যান্ট ছ্যাদা হয়া গেছিল। সারাদিন গাছে আছিল। ’
বুইড়ার কথা শুইনা সবার মইধ্যে হাসির ঝড় বয়।
(নিউট্রাল হিসাবে বাইরে থেইকা কই, স্যরি, ছাদেকুল্লা থেইকাও ছ্যাদা হইতে পারে। সেটা কেউ কয় না)
সানু প্রসঙ্গে পালটে ফেলে।
‘কেমন ছিল ছাদেকুল্লা? কেমন ছিল তার শৈশব?’ এই লাইনে চইলা যায়।
ছ্যাদার ব্যাপারে গ্রামের লোকদের ছুটিং করতে টিভির লোক আইছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রত্যেতের মইধ্যে অস্থিরতা সেই সাথে হল্লা শুরু হয়া যায়। তার বিষয়ে সবাই জানে। জানার কথা। কে কার আগে কইবে, মিস্টারের কাছ থেকে শোনা আশপাশের গুজব থেকে শোনা বাড়িয়ে চড়িয়ে কে কত আপন, কত পীরিত সেগুলা ঢালতে থাকে। সবাই একসাথেই বলতে থাকাতে একটা বাজার বসে যায়। নয়ন এলোপাতাড়ি শুট করে আর সবাই ক্যামেরার সামনে মুখ নিয়ে মুখ্য হইতে চেষ্টা করে। সানুকে কেউ কেয়ার করে না। সানু নয়নকে বলে ওদের বোঝাতে যে, ওরা ছাদেকুলের বাসায় যাবে।
সবাই চিনে তাই সবাই তাদের লিড দিয়া লয়া যাইতে উদ্যত হয়।
বিচ্ছিন্ন কিছু শুট
চ্যানেল পি’র সানু আর নয়ন দুইজন পথচারীকে পেয়ে থামায়। তাদের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করে ছাদেকুল্লা ওরফে ছ্যাদার ব্যাপারে। পথচারীর কান্ধে আলু, কদুর বস্তা। হাতেও। তারা কুঁতাইতে কুঁতাইতে বলে,
- বালই। বালই তো।
সানু: আর কিছু জানেন না উনার ব্যাপারে। এক্সক্লুসিভ কিছু?
আলুচাষী: জানতাম না কেন। এই গ্রামের পুলা। জানি তো।
সানু: তো বলেন আর কী জানেন?
আলুচাষী: কইলে কী অবে? টেকা দিবেন?
এদের মধ্যে চাষা চাষা একটু ফিল ছিল। টাকা দিলে দিবে কিন্তু চায়া বসল কেন? সানু নয়নের দিকে চায়।
নয়ন: আপনাদের গ্রামের একটা পুলা গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করছে আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করছে। তার ব্যাপারে বলতে কি কষ্ট লাগে?
আলুচাষী: না লাগে না। বস্তাডি আপনার কান্ধে লন। আমার টাইম খাইতাছেন। আমি না খায়া থাকলে ছ্যাদায় খাওয়াইবো?
বলে চলে যায়। সানু অবাক হয়। বুঝল না ছ্যাদা কতবড় সেলেব্রেটি।
ওরা ছাদেকুল্লার স্কুলের দিকে যাবে ভাবে। স্কুলের মাস্টারদের মূল্যবান বক্তব্য নেয়া ফরজ। স্কুলের কাছাকাছি পেয়ে যায় মুটামুটি শিক্ষিত, বিশিষ্ট দেখতে লাগে আলিবর্দি আকবরকে।
সানু: এক্সকিউজ মি/আসস্লামুলাইকুম। আপনার সাথে একটু কথা বলব।
আকবর মোলায়েমভঙ্গিতে কয়, জ্বি বলুন।
তারপরে নাম জানাজানির পর সানু, ছাদেকুল্লাকে চেনেন তো?...ওরফে ছ্যাদা।
আকবর: ও হ্যাঁ।
সানু: উনার ব্যাপারে কিছু বলেন।
আকবর: বালো। বালো তো। ...সব ঠিক আছে... খালি মাথায় ছিট।
সানু: মাথায় ছিট? কার?
আকবর: ওই ছ্যাদার... আউলায়া যায়। জঙ্গলে গিয়া বয়া থাকত, গাছে ঝুলা থাকত। এমনে পুলা যথেষ্ট বালো। আসেন চা খাই।
চা খাইতে খাইতে।
সানু: তো ট্রিটমেন্ট করায় নাই?
আকবর: কে করাইব? হেই টাকা আছে?
সানু পরে কী হইল জানতে চায়। নয়নকে দেখা যায় গাছের চিপায় অবস্থান লয়া পাতার ফাঁক দিয়া আর্টিস্টিক ফ্রেম ধরে।
আকবর: পরে আর কী। কই গেলগা না গেলগা কেউ কইতেও পারে না। খুঁজেও নাই।
সানু: ইন্টারেস্টিং। নয়ন আমরা তো কমপ্লেক্স, সাস্পেন্স মিলায়া ডকু’র মোচড়ে পায়া ফেলসি তো। টুইস্ট আছে কী বল!
আকবর তার লগে বাসায় যাইতে কয়।
সানু ক্যামেরার দিকে তাকায়া: আকবরের কাছ থেকে এরপরে বিস্তারিত শুনব আমরা। এখন একটা ব্রেক। আশেপাশে আরো কিছু নিয়া নেই।
চায়ের দোকানে দোকানদারসহ লোক ছিল। তারা বড্ড বেশি নিস্প্রভ, চুপচাপ দেখাচ্ছে। এদের কোনো উত্তেজনা নাই!?
সানু দোকানের একজন কাস্টমারের লগে কথা বলে, কী—ছাদেকুল্লা ওরফে ছ্যাদারে চিনেন না?
কাস্টমার: হ চিনি।
দোকানদার: আরে এখানে বইসাই তো কত্ত চা খাইছে। এ ছ্যাদার চাচা লাগে। সবাই চিনে। খুব বালো পুলা। কোনো গরিমা নাই।
তখন সে সাধারণ একজন গরিমার প্রশ্নই আসে না।
সানু ওই লাইনে যায় না, তাইলে ভ্যাব্দা মাইরা বইসা আছেন যে। এখন সে তো অনেক বড় সেলেব্রেটি। আপনার তো বেশি গর্ব হবার কথা।
কাস্টমার: হ।
এই আত্মীয় চাচা ছ্যাদাগো কাছে টাকা পায়। কেমনে কইব বুঝতে পারে না।
কাস্টমার: অরে আমরা টাকা পয়সা দিয়ে কত সাহায্য করছি। কোনো কিছুর আশা কইরা দেই নাই। এই আমি মাইনষের বিপদ আপদে সবসুময়ায় সাহায্য করছি। ছ্যাদাগোরেও দিছি। দিছি দিছি। কোনোদিন খুঁজি নাই।
দোকানদারকে উদ্দেশ করে, কী খুঁজছি—কওনা কেন? এখন দেনেওলা হেগো দিসে... দুয়া করি।
চায়ের টাকা দেওনের সময় দোকানদার হাসে।
সানু: কী হইছে হাসেন কেন?
দোকানদার: আকবরের ভিডিও লইসেন? টিভিত দেখাইবেন?
সানু: হুম। অবশ্যই দেখাব।
দোকানদার: বালো হইব। মজা হইব।
সানু: আরে মিয়া মশকরা পাইছো নাকি। তোমাদের সবাইরেই দেখামু। তা বইলা ফ্রি চা খামু না।
দোকানদার: আমারে দেখাইতে হইব না, চা আরো খান। কিন্তুক অর লগে কোথাও যাইতে কইলে যাইয়েন না।
সানু: কেন? কী হইছে?
দোকানদার: হের মাথায় বালা লেভেলের ছিট আছে। আপনাগো বালোর লাইগা কইলাম। ঢাকা থেইকা আইছেন...
সানু আকবরের দিকে তাকায়। নয়ন তারে নিয়া বিজি। সানু আস্তে আস্তে দূরে সরে নয়নকে উদ্দেশ কইরে বলে, নয়ন পাগল। দৌড় মার। বলতে বলতে নিজে দৌড় মারতে গিয়া আছাড় খায়। আকবর নয়নের হাত পাকড়ে ধরে।
আকবর: কী যাইবেন না। হালার পুত কে পাগল? যাবি না মাইনে শুয়োরের বাইচ্চা... ঢাকা... ঢাকা তোর ..য়া দিয়া ভইরা দিমু...
নয়ন কান্দাকাটি শুরু কইরা দেয়। দোকানের অরা আইসা ছুটাইলে নয়নও দৌড় মারে।
সানু আর নয়ন মিলে একটা ঝোপের চিপায় দ্বিতীয়বারের মতো ড্রেস চেঞ্জ করে।
সানু: এই অঞ্চলের সবার মাথায় ছিট শালা। কই আইসা পড়লাম।
ভয়ে নয়নের বুক এখনো ডিপডিপ করে। কাঁদো কাঁদো হয়া কয়, আপনে ওস্তাদ আমারে ফালায় দৌড় দিলেন।
সানু: আরে বেটা অলটাইম যুদ্ধংদেহী থাকতে কইলাম না। তরে কইলাম দৌড়। দৌড় মাইনে দৌড়।
শেষ কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৬