প্রথম কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশের জাতীয় কবিতা উৎসব-এর আমন্ত্রণে ভারতের কবি উৎপলকুমার বসু ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় আসেন। এখানকার কবি, শিল্পী-লেখকদের সঙ্গে তার মতবিনিময়, সাক্ষাত, উপদেশ, তর্ক, আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো, আরো অনেক নতুন-পুরনো জমে থাকা লেনদেন ঘটে।
জহির : আচ্ছা, কবি নজরুল ইসলামের কবিতা আপনার কেমন লাগে? প্রান্তিক, অধিকারবঞ্চিত, কুলি-মজুরের জীবন তার কবিতায় বেশি এসছে এজন্য বলছি যে আপনিও এ বিষয়ে সংবেদনশীল। আপনার কবিতায় ব্রাত্যজনের জীবন খুব বেশি আসে। তো সে ক্ষেত্রে আপনি নজরুলের কবিতাকে কিভাবে দেখেন?
উৎপল : নজরুলের কবিতা। একটা কথা বলি, এই যে নজরুলের গান—নজরুলের গান আমাদের স্মৃতির মধ্যে—ছেলেবেলায় শুনেছি। পাড়ার কোনো উৎসব হলে শুনেছি। সুতরাং নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের গানের দিকটা বলছি। এরা আমাদের অবচেতন মনের একটা অঙ্গ। সেদিক থেকে আমি নজরুলের মূল্য দিই। কিন্তু নজরুল কবি হিসাবে কত বড় বা রবীন্দ্রনাথও সেই অর্থে? রবীন্দ্রনাথ তো দীর্ঘ সময় ধরে লিখেছেন। কিছু কিছু অংশে রবীন্দ্রনাথ মোটেই আকর্ষণ করে না। যেমন নজরুলের একটা অংশ আমাকে আকর্ষণ করে না।
জহির : নজরুলের কোন অংশটা আপনাকে আকর্ষণ করে?
উৎপল : কোন অংশটা আকর্ষণ করে সেটা আমি ঠিক কী করে বলব? যেমন আমি নজরুলকে গীতিকার হিসাবে দেখতেই ভালোবাসি। এটা সম্পূর্ণ আমার কথা বলছি কিন্তু এবং যেমন নজরুলের একটা গান আছে—‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’—এটা আমি যখন বিদেশে ছিলাম তখন আমার একজন বাংলাদেশি বন্ধু গানটা চালাতে গেলে বলত, ওই গানটা চালিও না। চালাতে গেলেই বলত, এটা আমার মাথায় এত স্মৃতি টেনে আনে যে আমি ওটা শুনতে চাই না। নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের গানের সাথে আমাদের এই সম্পর্ক আর কি।
জহির : নাকি আপনি নজরুলের কবিতা কম পড়েছেন বলে এরকম হচ্ছে?
উৎপল : নজরুলের কবিতা খুব যে কম পড়েছি, তা না। কিন্তু নজরুলের যে রকম স্লোগানধর্মী কবিতা, বড় বড় উচ্চকিত ঘোষণাকারী কবিতা—এটা করব, সেটা করব, এগুলো আমার কাছে খুব একটা আকর্ষণীয় বলে মনে হয় না।
জহির : ভালো স্লোগান তো ভালো কবিতাও হতে পারে?
উৎপল : হ্যাঁ! যেমন? এবার তোমার বিদ্যের সঙ্গে একটু অ্যাকুইটেন্স হই।
জহির : সঠিক উদাহরণ হয়ত দিতে পারব না এই মুহূর্তে। তবে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার অনেক লাইন তো স্লোগানধর্মী।
উৎপল-জহির : বলো বীর/বলো উন্নত মমশির/ঐ শির নিহারি আমারি, নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রীর.. কিংবা আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেইদিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না...
উৎপল : আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না। এইসব ঘোষণা হিসেবে ভালো। কিন্তু এইগুলো কবিতার, অবশ্য একটানা। এগুলোর মধ্যে একটু কী বলব। একটু বলতে হয় ভেবে দেখতে গেলে, এর মধ্যে তো একটা অসারত্ব আছে। যেমন, তুমি কী করে বলছো যে, আমি সেইদিন হব শান্ত? অমুক-তমুক? এইগুলো...
জাহিদ : এগুলো ডিটারমিনিস্টিক?
উৎপল : ডিটারমিনিস্টিক তো বটেই। আর তাছাড়া তুমি কী হবে, কোন দিন, সে সম্বন্ধে তুমি আজকে কী জানো? আগামীকাল তুমি কী হবে, সে তুমি কী করে জানো?
জহির : না, আমরা তো সবকিছু জেনে কবিতা লিখি না।
উৎপল : এটাই তফাৎ। না জেনে কবিতা লেখা যায় না। তুমি যদি জানো না, সেটাও তুমি জানো। তুমি জানো যে তুমি জানো না। সেটাই তুমি কবিতায় লেখো।
জহির : মানে আমার লিমিটেশনটা...
উৎপল : লিমিটেশন বলতে পারো বা এটা আমার বৃহৎ জগৎবলতে পারো।
জহির : বৃহৎ জগৎ? যারা অজ্ঞান বলে আমরা জানি তারা তো অনেক জ্ঞানী!
উৎপল : হতে পারে। হতে পারে।
জহির : তাহলে তো অজ্ঞান বলে কিছু নেই? কারণ সাবকনসাসে তার সব জ্ঞানই আছে।
উৎপল : তুমি এত সরলীকরণ করো না। কারণ মন এত সরল নয়। যে অজ্ঞান সে কিছু জানে না, যে জ্ঞানী সে সব কিছু জানে। চিরদিন দেখে এসেছি যে যারা মূর্খ, যারা তথাকথিত অজ্ঞান লোক, তারা অনেক বড় বড় কথা বলে গেছে, অনেক গভীর কথা বলে গেছে। এটা সবসময় জ্ঞানী লোকদের আওতায় নয়।
জাহিদ : তাহলে কথাটা আমরা এভাবে বলতে পারি, যে কবিতা কখনো ডিটারমিনেশন দেয় না। কবিতা একটা প্রোসেসকে ইভালুয়েট করে শুধু?
উৎপল : কবিতার লক্ষ্য হচ্ছে সবসময় পাঠকের সঙ্গে কবি কী সম্পর্ক তৈরি করবে।
জাহিদ : পাঠককে ইনভলব করে নেবে। পাঠককে চিন্তা করতে শেখাবে।
উৎপল : তা তো করবেই। পাঠকই কবিতার আপডেটটা তৈরি করবে। আমি অর্ধেকটা করে দিলাম, বাকি অর্ধেক তুমি করো।
জহির: জিনিসটা মর্ডানিস্ট বা সিম্বলিস্টদের পক্ষে যায়। আসল বাস্তবে, আসল জিনিসটা ফেলে, রহস্য অংশটা, রহস্যময়তার অংশটা প্রধান এদের কবিতায়।
উৎপল : আসলে আসল জিনিসটা কী? এ কথাটা কে বলেছে? তুমি বলছো এটা আসল জিনিস। আমি পাঠক হিসেবে মেনে নেব কেন সেটা? রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, নজরুলের কবিতায় তুমি আমাকে বলে দিলে যে এটা হচ্ছে আসল জিনিস—এ কবিতার। আমি মেনে নেব কেন? আমি অন্যভাবে ট্রিট করতে পারি। এই স্বাধীনতা তো সবসময় থাকে। কেবল স্কুলে থাকে না। মাস্টারমশাইরা লাঠি মেরে শিখিয়ে দেয়। এটার একটা মানে হয়। এটাই এটার মানে।
জহির : যারা একাডেমিশিয়ান তারা ফিক্সড মিনিং নিয়ে বেশি ডিল করে। (কিছুক্ষণ চুপ) আপনার কবিতায় ইকোলজিটা চলে আসে—পাখি, মানুষ, গাছ, পানি, বাতাস সবকিছুর সঙ্গে সবাই যেন কোথায় কোনো বিগত বা বর্তমান লেনদেন সেরে নিচ্ছে। বলতে চাচ্ছি, পোস্টমডার্ন সমাজে ইকোলজির গুরুত্বটা কী। না, মানে, মডার্নিজম যেখানে বলছে ধ্বংস করে শুধু গড়ো, গড়ো।
উৎপল : হ্যাঁ, আমি কতগুলো বিষয়ে সচেতন। অপচয় না করা সম্বন্ধে সচেতন। আমি মনে করি এটা খুব অন্যায়, নির্বোধের কাজ। যে আমি প্রচুর জলখরচ করলাম, জলের অপচয় করলাম, খাদ্য এক চামচ খেয়ে বাকিটা ফেলে দিলাম—এই অপচয়গুলোর আমি খুব বিরোধী। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম আলোগুলো বন্ধ করলাম না—এগুলো তো আমাদের স্বভাব। আমি আলোগুলো বন্ধ করব। পাখা বন্ধ করব। ঘর থেকে বেরুব। এই ক্ষমতা, পাওয়ারের অপচয়। আমি ভাবি আমার তো নয়, হয়ত আমি একটা ভাড়া বাড়িতে আছি, সেই পয়সা দিচ্ছে—আমার কী! এ রকম ধরনের। আমি ট্যাপের জল খরচ করলাম, ট্যাপ খুলে রাখলাম, হড় হড় করে জল পড়ে গেল। মনে করলাম, কী হয়েছে, এত কী হয়েছে। করপোরেশনের জল। কিন্তু না, এগুলো সম্পর্কে আমি খুব সচেতন।
আমি নিজে খুব পরিমিতি বোধের মধ্যে থাকি। আমার যা প্রয়োজন নেই, তার বেশি জিনিসে আমি যেতে চাই না। আমার জামা-কাপড়, খাওয়া-দাওয়া, যাই বলো না কেন, খুব পরিমিত। বা মনে করো বড় হোটেলে গেলাম, খুব খেলাম-টেলাম এইগুলো আমার কাছে আকর্ষণের বিষয় নয় এবং এই যে গরমকালে দেখলাম এসি চলছে, শীতকালেও এসি চলছে। হাজার হাজার আলো জ্বলছে। এগুলো আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়।
জহির : ‘মরার পরও কিছু খরচপাতি থাকে। ’ এটা আপনার ব্যক্তিগত হেঁয়ালি। সিরিয়াস জিনিসকে হালকা করে ফেলে বাস্তবতার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা অপনার কবিতার একটা উদ্দেশ্য।
উৎপল : হ্যাঁ, থাকে। তা মরার পর খরচ থাকে না! বাংলায় এক বলে কাঠ-খরচ। আমার এক বন্ধু। একটু পাগলাটে ধরনের ছিল। শংকর বলে। তাকে সবাই বলত যে, তুই একদিন পাখা থেকে ঝুলে পড়। তারপর সব কাঠ-খরচ আমার! এক সময় নাকি একটা লোক—সে ইন্সুরেন্স বিক্রি করত, সেটা পরলোকের ইন্সুরেন্স। যাতে তুমি পরলোকে আরামে থাকতে পারো। তা এরকম এগুলো আছে হেঁয়ালি করে। মৃত্যু-জন্ম নিয়ে প্রচুর বাঙালি নানা রকম...। ওগুলোর বিরুদ্ধে এসব কথা বলা। মৃত্যু অ্যাজ এ ইনস্টিটিউশন, তাকে পরিহাস করি। তোমার কোনো প্রিয়জন মারা গেলে তুমি কি আহত হবে না? তুমি তো কিছুই লিখবে না। কোনো কথাই বলবে না। সেগুলোর সততাকে আমি অবিশ্বাস করছি না। মৃত্যু অ্যাজ এ ইনস্টিটিউশন এবং সেখানে ন্যাকা...কান্না...অমুক-তমুক এগুলোকে আমি অবিশ্বাস করি।
জহির : মানে আপনি প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলোকে ভেঙে দেওয়ার, নাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা থাকে আপনার কবিতায়।
উৎপল : না, আমি সচেতনভাবে করি না। তবে হয়ে যায়। হয়ে যেতে পারে, নাও হতে পারে। এগুলো পড়েছো বলে বলছো। যারা পড়েনি তারা তো মৃত্যুকে অ্যাজ এ প্রতিষ্ঠান হিসেবেই দেখে থাকে। আমাদের অনেক কবিদের ভেতর—সুধীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের ভেতর মৃত্যুচেতনা বিশালভাবে আছে। মৃত্যু সম্পর্কে বহু রকম, বহু কালচারে নানা রকম ইয়ে আছে। এই ট্র্যাডিশনাল ধর্ম যেগুলো তা তো বলে যে কেউ মরে না। মানে খ্রিস্টানরা বলে যে ডাস্ট টু ডাস্ট। আমার শরীর ধুলোতে মিশে যায়। আর স্পিরিট, সোল যে দিয়েছিল তার কাছে ফিরে যায়। হিন্দুরাও বলে এ রকম সূক্ষ্ম শরীর আর স্থূল শরীর। আমরা মরে গেলে আমাদের...
জহির : জীবসত্তা হিসেবে মৃত্যু চেতনা মাঝে মাঝে তাকে পীড়িত করতে পারে।
উৎপল : হ্যাঁ, তা তো করতে পারেই। হয়ত মরে যাওয়া উচিত। অনেকে ফলস উইল টুইল করে দিয়ে চলে যায়।
জহির : কখনো কখনো আপনি কবিতায় সিরিয়াস উইট ব্যবহার করেন। যেমন, আপনি এক জায়গায় বলছেন—‘মাড়ি নিজেই হাসছে। ’ এটা কি অধিকতর লাইট করার জন্য?
উৎপল : না। গোটা লেখাটাই ছিল যে একটা বডি যখন আগুনে পুড়ছে। তখন তার বর্ণনা ছিল যে কে আগে পোড়ে যখন চিতায় চড়ানো হয়। প্রথম লোমগুলো পুড়ে যায়। লোমগুলো সব দাহ্য পদার্থ। তারপর চামড়া। শরীর ফাটে-টাটে। ওই কবিতায় একটা বীভৎস বর্ণনা আছে। তারপর ওর মুখটা পুড়ে যায়। পুড়ে সব খসে যায়। তখন মাড়িটা বেরিয়ে পড়ে। দেখেছো কখনো? দেখলে বুঝতে কী। একবার দ্যাখো একদিন শ্মশানে গিয়ে। আজকাল তো ইলেকট্রিক চুল্লি। ওখানে কাচের ভেতর দিয়ে দেখা যায়। ভেতরে কী হচ্ছে। তুমি ইচ্ছে করলে দেখতে পারো। আমি দেখেছি। তারপর ডোম একটা শিক নিয়ে এসে খোঁচা দেয় শরীরটায়।
জহির : ইলেকট্রিক চুল্লিতে তো আর ডোম রাখার দরকার নেই। তা আমরাই পোড়াতে পারি।
উৎপল : না, ডোম জিনিসটা স্পিড-আপ করে। তাড়াতাড়ি করে। একজনকে থাকতেই হয় সেখানে।
জহির : ইলেকট্রিক চুল্লি যবে এলো, তো ‘ডোম’ শব্দটা তো পাল্টায়নি। মানে আধুনিক শব্দযোগ হয়নি।
উৎপল : সৎকার সহকারী...। ডোম আমাদের বাংলা শব্দ।
জহির : ‘ডোম’ শব্দটার মধ্যে সমাজের নিচুশ্রেণির হায়ারার্কির সংকেত আছে। মেকানাইজেশন হওয়ার পর কিন্তু হায়ারার্কি চেঞ্জ হয়ে যায় অনেক সময়।
উৎপল : ব্যাপার হচ্ছে বহু ইনস্টিটিউশন তো আর ওয়েস্টানাইজড হয়নি। তাহলে তো আমরা খ্রিস্টানদের মতো সৎকার করতাম। সৎকার তো আলাদা। আমাদের সৎকার তো সাংঘাতিক। ছেলে বাবার মুখে গিয়ে আগুন দেয়। তারপর সে তো...। আমার বন্ধু শামসের আনোয়ার মারা গেল। তার দাদি দেখি সেই ডেডবডির কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছে—যদি কোনো অন্যায় করে থাকি তো আমাকে ক্ষমা করে দিও। এ তো মুসলমানের মধ্যে রয়েছে। যে দাদি ওর জুতোর ফিতে বেঁধে দিত সেই নাতির কাছে ক্ষমা চাইছে যে আমাকে ক্ষমা করে দিও। কী গ্রেট! ভাবতে পারো। মানে ওই মুহূর্তে কে উপরে আর কে নিচে... ও বড় ভয়ঙ্কর! ওহ! না... এগুলো কেন বলাচ্ছো আমাকে দিয়ে?
জহির : ধর্মে বিশ্বাস/অবিশ্বাস আলাদা জিনিস। ধর্মীয় কালচারের ভেতরে যে জীবনাচরণ, জীবনের প্রতি আকুতি, যে ঘনিষ্ঠতা সেসব আপনাকে ভাবায় নিশ্চয়ই!
উৎপল : নিশ্চয়ই। খুবই ভাবায়। ভালোবাসায় সময় সময়। বহু জিনিস ভালোও লাগে। যে দাদি যখন ওরকম শামসেরের দাদির ওই মুহূর্তটা ভালো লাগল না? দাদির এইসব কথা দিইনি। আমি বরং বিরক্তই হতাম। কী শামসের তোর দাদি এ রকম তোকে চুল আঁচড়ে দেয়, জুতো পরিয়ে দেয়। একি! ও একটা প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে। ওকে দাদি ওই রকম! দাদি আমাকে ছাড়ে না। ছেড়ে থাকতে পারে না। তো সেদিন যখন দেখলাম, তখন বুঝলাম দাদি কী জিনিস!
জহির : আচ্ছা, বাংলা কবিতায় লাইট কবিতা মেইনস্ট্রিম হতে পারেনি কেন?
উৎপল : মানে হাস্যরস, পরিহাসমূলক কবিতা। এগুলো সব প্রবাদ হয়ে গেছে পরে। যেমন ভারতচন্দ্রের বহু লাইন প্রবাদ হয়ে গেছে। ‘এ মেয়ে তো মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয়। ’ ওই যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে দেবী, তখন নৌকায় ওই যে জল সেঁচে—যেটা ছিল—পা লেগে সেটা সোনার হয়ে গেল। তখন ওই মাছি বলছে, এ মেয়ে তো মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয়। ’ এ রকম বহু আছে।
জহির : তো কবিতার কোনো লাইন যদি প্রবাদ হয়ে যায় সেটা তো খারাপ।
উৎপল : খারাপ-ভালো আমি বিচার করার কে? এ তো বিশাল জগৎ। কে আসছে, কে যাচ্ছে। কী অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
জহির : না, এই অর্থে বলছি যে প্রবাদ হলো সেটার একটা ফিক্সড মিনিং দেয়। সবাই একই অর্থ করে। মোটামুটি একটা বাজারি অর্থ চালু হয়ে যায়।
উৎপল : ভারতচন্দ্রের লাইন আছে। ‘যে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর’—যে বেশি কথা বলে সে বেশি মিথ্যে কথা বলে। এই রকম আর কি...।
জহির : এইসব কবিতা কেন মেইনস্ট্রিম হতে পারেনি।
উৎপল : মেইনস্ট্রিম বলতে তুমি কী বোঝো, তার ওপর নির্ভর করছে। মেইনস্ট্রিম কী?
জহির : মানুষ যার কবিতা বেশি পড়ে। যেমন রবীন্দ্রনাথকে বলা যায় মেইনস্ট্রিম।
উৎপল : তাকে তো এইভাবে আর পড়িও না। পাঠও করি না। দু’শ’ বছর পরে কেন পড়তে যাব? তবে কী কারণে লোকে রবীন্দ্রনাথ পড়ে তা দেখতে হবে। সে হয়ত নানা কারণ আছে। প্রথমত, সহজলভ্য রবীন্দ্রনাথ।
জহির : নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে আছে?
উৎপল : সেই সেই। স্কুলপাঠ্য। ভারতচন্দ্রও পাঠ্য। ভারতচন্দ্রের এখন নতুনভাবে অ্যাসেসমেন্ট হচ্ছে।
জহির : এটা তো ভালো দিক।
উৎপল : হ্যাঁ, ভালো দিক নিশ্চয়ই। তো এখানে তুমি আশা করি আমাকে পোস্টমডার্নিজম সম্পর্কে প্রশ্ন করো না। পোস্ট মডার্নিস্টরা মডার্নিজমের আগের যে কবিতাগুলো তাতে খুব উৎসাহী। পোস্টমডার্নিস্টরা ভারতচন্দ্রে উৎসাহী।
জহির : আপনার কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদের ব্যাপারে আপনি খুব যত্নশীল। আপনার বইগুলোর প্রচ্ছদ, প্রচ্ছদশিল্পীদের ব্যাপারে কিছু বলেন।
উৎপল : সব আমার মনে হয় একটা যৌথ কাজ। তো একটা ফিল্ম তৈরি করার মতো। একটা বই বেরোনো মানে হচ্ছে যে প্রেসের লোক, কাভার-শিল্পী, কাভার যে প্রিন্ট করছে, সব মিলিয়ে একটা যৌথ কাজ। যেখানে আমি প্রত্যেক ব্যাপারে সচেতন এবং সরাসরি তার সঙ্গে গিয়ে কথা বলি। তাকে চা খাওয়াই নিয়ে। খুশি করি। গল্প করি। নানা রকম। আমার কাছে মানবিক সম্পর্কের দিক থেকে এরা খুব মূল্যবান।
জহির : না, আপনি তো যাকে তাকে দিয়ে আপনার বইয়ের প্রচ্ছদ করান না।
উৎপল : না, আমি করাই না। কিন্তু কমার্শিয়াল পাবলিশার যখন করে তার ধারায় চলে। তবে এখন বড় পাবলিশাররাও আমাকেও জিজ্ঞেস করে নেয় যে কাকে দিয়ে মলাট করাবেন ভাবছেন? কী করবেন? আমার এই বইটারও কভার হিরণ মিত্র করেছে। ‘সুখ-দুঃখের সাথী’। একটা বড় নকশার বই আছে। পুরনো। একশ’ বছরের পুরনো। তাতে সব ওইসব পুরনো দিনের নকশা ডিজাইন আছে। তা তার থেকে এটা নেওয়া এবং এই মোটা কভারে এসব হিরণ মিত্রের কল্পনা। এগুলোকে আগে টেলপিস বলত।
জহির : রাজকীয় ব্যাপার-স্যাপার আছে।
উৎপল : রাজকীয় ব্যাপার...। তখনকার দিনের। আর যেমন আমার গদ্যসংগ্রহের কভারটা হচ্ছে ইসলামিক ক্যালিগ্রাফির। ওই তার থেকে নেয়া। সেটাও হিরণ সাজিয়েছিল। ঋত্বিকের মেয়ের কথা বলেছিলাম। শুচিস্মিতা। ও আমার কভার করেছে।
জহির : কোন বইটা?
উৎপল : বইটার নাম হচ্ছে ‘লোচনদাস কারিগর’। না, না এই বইটার নাম—‘কহবতীর নাচ’। একটা মাটির সরায় এঁকেছিল, দেখে খুব ভালো লেগেছিল। আমি বলেছিলাম, আচ্ছা এটা কি ফ্ল্যাট কাগজে হয়? তো ও খুব প্রতিভাসম্পন্না মেয়ে। ও বলল, কেন বলুন তো? আমি বললাম, তুমি আমার বইয়ের কভার করো। খুব খুশি হলো সে।
জহির : পুরী সিরিজের?
উৎপল : পুরী সিরিজের কভার কেউ করেনি। আমার ঘরে একটা ইংরেজ ছেলে এসেছিল। তখন সে একটা মোটা ফেল্ট পেন নিয়ে এসেছিল। ওই মার্কার তখন বিদেশে প্রথম বেরিয়েছে। তা সেটা দিয়ে করলাম। মলাটে আমারই হাতের লেখা। ওটা কেউ করেনি। কভার নিজে করবে। রবীন্দ্রনাথের মহুয়া বইটা দেখবে কভার তাঁর নিজের করা।
জহির : নিজের কভার করলে নিজে শিল্পী নিজেই কবি—লোকে তো স্বার্থপর বলবে।
উৎপল : কিসের স্বার্থপর? তোমার বই। তোমার নিজের জিনিস। এতে ক্ষতিটা কোথায়? শিল্পীরা তাদের ছবি আঁকুক। তারা তাদের কাজ করুক। না, তাছাড়া এরকম বিরোধী সম্পর্ক তো তৈরি হয় না। তারা তোমার কাছের লোক। বন্ধু শিল্পীর কোনো প্রদর্শনীতে গেলে, কারো জিনিস ভালো লাগল—সেখান থেকে গ্রহণ করলে। (কিছুক্ষণ বিরতি)
জহির : ‘মঞ্জুরি বেড়ালটা ফেলে যাওয়া আশ্রয় খুঁজে পাই/ঝুড়ির মধ্যে থাকত, কখন আসত যেত কেউই জানে না,/ভূমিকম্পের এক আতঙ্কিত রাতে সে বেরিয়ে গেল—এখনো ফেরেনি’ এই কবিতার অনুষঙ্গ ঘটনা, এই ভূমিকম্প, বেড়াল বাস্তব অভিজ্ঞতার থেকে আনা...
উৎপল : এগুলো দেখতে গেলে খুব কঠিন। তবে ভূমিকম্পটা আমার মাথার ভেতর হয়েছিল বোধ হয়। (হাসি) কিন্তু তার পরের লাইনটা হচ্ছে যে, ‘তার জলের বাটিতে কাঁপছে কালপুরুষের ছায়া, বাঁকাভাবে, ঈষৎ খর্বিত। ’
জহির : হ্যাঁ, ছায়া, কালপুরুষের ছায়া পড়ছে। আপনি খর্বিত কল্পনা করেছেন কালপুরুষের ছায়াকে। নিজের সন্দেহ, অবিশ্বাসকে। বাস্তবতা দান করছেন, প্রমাণ করছেন এই বলে যে ছায়াটা বাঁকা, কিছুটা খর্বকায় ইত্যাদি...
উৎপল : (হেসে) অবিশ্বাস করব কেন? কালপুরুষের ছায়া কি পড়ে না? দেখোনি?
জহির : ছায়া তো আপনি দেখেননি?
উৎপল : কে বলেছে দেখিনি? আমি হয়ত ওই সময় দেখিনি।
জহির : সে জন্যই বলছি ওটা কল্পনা।
উৎপল : তবে ত্রিশ বছর আগে দেখেছি। একটা জলের বাটির মধ্যে তারার ছায়া পড়েছে।
জহির : তাই নাকি?
উৎপল : দেখোনি, ওমা এখনো দেখতে পারো। চলো তোমাকে আমি দেখাচ্ছি। ছাদে নিয়ে গিয়ে একটা জলের বাটি রেখে দাও না। একটা তারার ছায়া পড়েছে। তবে বাটিটি ঠিকঠাক বসাতে হবে।
জহির : বুঝলাম, আপনি অবিশ্বাসী না।
উৎপল : না, না এসব ঘটনাগুলোর, এতে আমি বিশ্বাসী। গভীনভাবে বিশ্বাসী। কালপুরুষের ছায়া যে জলে পড়ে এটা কি আমি বিশ্বাস করব না? বেশি বিশ্বাস করি।
জহির : আপনি কি ছায়াপথে বিশ্বাস করেন?
উৎপল : ছায়াপথ দেখেছি চোখের সামনে। চোখের সামনে দেখাটা একটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জিনিস। এটা বিশ্বাস করব না? তবে তুমি যদি বলো যে ওটা যেটা দেখছেন ওটা ছায়াপথ নয়। ওটা অন্যকিছু। তুমি বলবে।
জহির : ছায়াপথে বিশ্বাস আর ঈশ্বরে বিশ্বাস এক কথা। আপনি অনেক কিছু না দেখেই বিশ্বাস করেন। ঈশ্বর বিশ্বাস করলে আপনার অসুবিধা কোথায়?
উৎপল : না, আমি না দেখে বিশ্বাস করি না। আমি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হলে, তবেই বিশ্বাস করি। আমার যে পঞ্চ ইন্দ্রিয় আছে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক—এগুলো তারা ধরতে না পারলে বিশ্বাস করি না। আমি মনে মনে অ্যাবস্ট্রাক্ট কোনো জিনিস তৈরি করি না। সব জিনিস যা নিজে দেখেছি আর তুমি যদি সংবেদনশীল হও, তাহলে তুমিও দেখবে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কত দৃশ্য, কত স্ট্রিট রিয়ালিটি। সব দেখেছো তুমি, কিন্তু চাপে ভুলে গেছো। তাড়াতাড়ি যেতে হবে অমুকখানে, অমুক কাজের দায়িত্ব। একটা কিছুর জন্য যেতে হবে। রিয়ালিটি তোমার সাথে কথা বলে সবসময়। সেটা যদি তুমি না শোনো...। ধরো ওই একটা পেইন্টিংয়ের সামনে তুমি দাঁড়িয়ে আছো। আমি অনেককে দেখি পেইন্টিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বকবক করে। আর পেইন্টিং যে তোমার সাথে কথা বলে সেটা তুমি শোনো না। একটা বড় পেইন্টিং তোমার সামনে চ্যালেঞ্জ করছে। বলছে, তুমি দেখো, দেখে আমাকে বোঝার চেষ্টা করো। তুমি অডিট করো পেইন্টিং। অডিট করা মানে এই কোথা থেকে শুরু, কোথা পর্যন্ত দেখো, এই প্রত্যেকটা লাইন, ঘুরে ঘুরে জিনিসটা কিভাবে বানিয়েছে—তবেই তো তুমি জানতে পারবে। প্রকৃতি দেখো। প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলো। প্রকৃতির কথা শোনো। তবেই তো তুমি জানতে পারবে।
জহির : ট্র্যাডিশন নিয়ে, বাউলদের চিন্তা/জ্ঞান নিয়ে, মানুষ আবার এই যে শিকড়ের দিকে ফিরে যেতে চাচ্ছে এইসব নিয়ে একটু বলেন।
উৎপল : এ সবকিছুই আমার কাছে মূল্যবান। তবে আমি যখন লিখতে বসি তখনকার মুডের ওপর নির্ভর করে। আমার পূর্বনির্ধারিত কোনো ধারণা নেই। বাউলরা কী করে? মানে গান করে তো এটুকু জানি। দেহতত্ত্বের গান করে। এইসব নানা রকম...তাই না। এইসব জানি। কিন্তু আমার আকর্ষণে ওইসব জিনিস নেই। আমার আকর্ষণ হচ্ছে সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত। আনপ্লানড! তুমি যে বেরুচ্ছো রাস্তায় কী দেখছো, কী বুঝছো, তোমার ইন্দ্রিয়গুলো কী গ্রহণ করছে এগুলোই। বাউল কোথায় কী করছে সে নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। বাউল তার মন মতো কাজ করছে। আমি আমার মতো কাজ করছি। কেউ যদি বলে একটা পাইলট প্লেন চালাচ্ছে, আপনি তার সম্বন্ধে কী ভাবেন? তার সম্বন্ধে আমি কী ভাবব? আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
জহির : না, না, আমি জ্ঞানগত জায়গা থেকে আপনাকে বলছি। মানে বাউলের চিন্তা আপনার কাছে...।
উৎপল : ঠিক আছে। সে তার জ্ঞানমতো বোধ হয় কাজ করছে। আমার জগৎ এসব নয়। বারবার বলছি আমার কোনো জগতে এসব নেই। খুব হার্ড রিয়ালিটি হচ্ছে আমার জগৎ। হার্ড মানে কিন্তু শক্ত নয়, আমাকে খুব আহত করছে তা নয়। একবারে রিয়াল যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। আমি নিজেকে ইমপেরিসিস্ট বলে মনে করি। যা ইন্দ্রিয়ের বাইরে, সেইরকম কোনো জিনিস আমি গ্রহণ করি না। আমার উৎসাহ নেই, সেরকম কোনো জিনিস যা বাস্তবে নেই। তুমি যদি আমাকে বলো ঈশ্বর আছে কি নেই, এটা নিয়ে তক্কো করো, আমি একদম এসব ব্যাপারে তক্কো করব না। কিন্তু ঈশ্বর বিশ্বাস করে কেউ কোনো কাজ করে, সেটা আমি চোখে দেখেছি। আমি সেটা সম্বন্ধে লিখব। হ্যাঁ কোনো মানুষ ঈশ্বরবিশ্বাসী। কোনো মানুষ নাস্তিক।
জহির : নাস্তিক বলে অনেকে অবশ্য গর্ববোধ করে।
উৎপল : যে করে সে করে, আমি তার কী করব? আমি তাকে শিক্ষা দেওয়ার কে? আমি যদি দেখি কেউ নাস্তিক হয়ে গর্ববোধ করে। কিছু একটা করছে, বক্তৃতা দিচ্ছে, সেটা আমার লেখবার বিষয় হতে পারে।
জহির : এসবকিছুই আপনার লেখার মেটারিয়াল।
উৎপল : হ্যাঁ, সমস্ত কিছু নিয়ে লেখা তৈরি হয়। আমি যদি কিছুকে বাদ দিয়ে দিই যে আমি এটাকে নিয়ে ভাবব না, এটা নিয়ে লিখব না...তা আমার স্বভাব নয়। সেইজন্য সংবেদনশীল লেখকরা সবসময় অলেখকদের সাথে মেলামেশা করে। মানে যারা খুব র’ লোক। তাদের সাথে মেলামেশা করে, তাদের কাছ থেকে মেটেরিয়াল পায়।
জহির : কবিতা হয়ে ওঠার পূর্ব শর্ত-টর্ত আছে কিনা? মানে আমি যাচ্ছে-তাই লিখলে কবিতা হয়ে যাবে?
উৎপল : না, এক্ষেত্রে আমার কথা বলতে পারি। বরাবরই বলছি যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ ছাড়া আর অন্য কোনো জিনিসে আমার তেমন কোনো আস্থা নেই।
জহির : না, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ নিয়ে তো প্রবন্ধও লেখা যায়, মানে কবিতা...
উৎপল : যেতে পারে। প্রবন্ধ লেখা যায়। সিনেমা করা যায়। ফিল্ম করা যায়।
জহির : গদ্য-পদ্যের পার্থক্য কোথায়?
উৎপল : পার্থক্য বোধহয় সে রকম নেই। পার্থক্য করলে পার্থক্য, না করলে পার্থক্য নয়। আমার কাছে খুব কংক্রিট, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য না হলে আমি সে জিনিসটার প্রতি কোনো আকর্ষণ বোধ করি না।
জহির : শিল্পগত কোনো পার্থক্য?
উৎপল : আজকাল করে না। না করলে কোনো ক্ষতি নাই।
জহির : অনেকে তো ভয় পাচ্ছে এইটা নিয়ে।
উৎপল : হ্যাঁ। তা পাক না। সেটা নিয়ে লেখো না তুমি! যে অনেকে ভয় পাচ্ছে, তো ভিতু কিছু লোক। ভীতু লোকদের নিয়ে খুব ভালো লেখা যায়।
জহির : ইরাক যুদ্ধ, আফগান যুদ্ধ। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ওদের নাকি ১৫৩টা সামরিক ঘাঁটি দেশে দেশে। ‘থার্ড-ওয়াল্ড কালচার’ এর সঙ্গে কনফ্রন্টেশন ইত্যাদি আমাদের জাতীয়তাবাদের দিকে ঠেলে দিতেছে।
উৎপল : যেতে পারে। যাব না কেন? কী বলব এত বদমায়েশি আমাদের চোখের সামনে ঘটছে। ২০০০ সালের পর থেকে। তার বিরুদ্ধে লোকে কিছু করবে না? লোকে নানাভাবে রিঅ্যাক্ট করে। কেউ শেকড় খোঁজে। তুমি যেটা বললে সেটা করে। কারো কারো রাতে ঘুম হয় না। আমি তো অনেক সময় রাতে ঘুমুতে পারি না। যখন শুনি এসব কথা। ইরাকে এখন বোমা ফেলছে বাচ্চাদের ওপর। ভাবা যায়? আর সে সব বোমা মানে হচ্ছে ফসফরাস বোমা। সারা শরীরের সব মাংসগুলো খুলে পড়ে। শুধু কঙ্কালটা পড়ে থাকে। এক সেকেন্ডের মধ্যে। এরা আণবিক বোমা ফেলেছে মানুষের ওপর। ভাবতে পারো? তারা এখন বড় বড় কথা বলছে যে তুমি বোমা বানাবে না। তুমি এ করবে না—ও করবে না। যাহোক সে দুঃখের কথা আর আমরা কী বলব? এসব যত কম বলা যায়, ততই ভালো।
জহির : ওরা তো ওদের ইন্টেলেকচুয়াল সাইড, নোয়াম চমস্কিকে তো পাত্তা দেয় না, তাদের লেখার ইমপ্যাক্টটা আমাদের থার্ড ওয়ার্ল্ডে আছে।
উৎপল : শোনো, যুদ্ধ হচ্ছে দুটো কারণে। এক নম্বর হচ্ছে তেলের জন্যে, আর দু’নম্বর হচ্ছে ওয়ার থেকে প্রফিটিয়ারিং। অনেকে ওয়ার থেকে প্রফিট করে।
জহির : ওয়ার থেকে কিভাবে প্রফিট করে?
উৎপল : ওরে বাপ! ওয়ার থেকে প্রফিট করে না? প্রফিটের জন্যেই তো লড়াই হচ্ছে। একটা ওই যে ‘অয়েল ফর ফুড’ যে প্রজেক্ট হয়েছিল, কত লোক তার থেকে কোটি কোটি টাকা করেছে। অস্ত্রগুলো বানাচ্ছে কারা?
জহির : এটা নীল নকশা। তারে এনলার্জ করে আপডেট করে।
উৎপল : হ্যাঁ, আপডেট করে। এবং নতুন স্বার্থলোভী লোকেরা আসে। এসে করে। এগুলো সব করে। এ ভয়ঙ্কর। এ রকম। মুখে বলে যাচ্ছে ডেমোক্রেসি, গণতন্ত্র, হেনতেন—এসব বলে যাচ্ছে। কী আর বলব? প্রথম কথা হচ্ছে নিজের দেশকে শক্ত করে তৈরি করা। নিজের দেশের দালালগুলো যারা তাদের চেনা, তাদের ধরে ঠ্যাঙানো রাস্তায় একেবারে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমাদের বাঙলায় বলে মাথা মুড়িয়ে গাধার পিঠে চড়িয়ে দেশ থেকে বার করে দেওয়া। এগুলো করা দরকার। অপরকে গালাগালি দিতে গেলে দেখবে, তোমার দেশের মধ্যেই তোমার ঘরের পাশের লোকই সব শত্রু।
জহির : এই যে মানুষ, দেশ, এইসব নিয়ে আপনার সংবেদনশীলতা... অন্যদিকে আপনার কবিতায়, লেখায় এর সঙ্গে রেসপন্সিবিলিটির জায়গায় একটা ফারাক আছে বোধহয়। এই ফারাক জায়গাটা কী করবেন?
উৎপল : না, লিখি। লিখব না কেন। দরকার হলে লিখি। তবে এই ফারাক। এই দুটোকে এক জায়গায় বোধহয় আনা যায় না। আমি জানি না, যায় কিনা? তবে আমি ভাবব, তুমি যখন বললে। কাল আমি ঢাকার টেলিভিশনে এসব কথা বলেছি। যদিও কলকাতা আমাকে বলে দিয়েছে যে আপনি কোনোরকম রাজনৈতিক আলোচনায় মধ্যে যাবেন না।
জহির : আপনি তো কোনো দেশের, কারো ধার ধারেন না?
উৎপল : নিশ্চয়ই। আমি ধারি না।
জহির : অনেকে মনে করে আমেরিকার সাধারণ লোক তো আর দোষ করে নি। আমেরিকার অ্যাডমিনিস্ট্রেশনই এই যুদ্ধের জন্য দায়ী।
উৎপল : আরে রাখো রাখো। এগুলো সব ছেলে ভুলানো কথা।
জাহিদ : দাদা এই কবিতাটা একটু শোনাবেন...এই যে এটা...‘সুখ-দুঃখের সাথী’র ভূমিকার কবিতাটি।
উৎপল : না-না এটা কেন? যুদ্ধ বিষয়ে যেটা আছে ওই যে ‘বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারের ভূমিকার কবিতাটা শোনো...
কত গল্পে নেমে গেছি—কত না গাথায়—
ভাঙা ধ্বস্ত সিঁড়ি বেয়ে, দু-চার ধাপ টপকে গেছি,
পড়তে পড়তে বেঁচে যাই, ওইভাবে, বোকার মতন বাঁচি—
মহাভারতের মাঠে, হোমারের উপকূলে, এজিদ-কান্তারে, দেখি
যুদ্ধ শুরু হলো, শেষ হলো, নায়ক নিহত, রাজ্য শ্মশান—
প্রতি গল্প বিশ্বরূপ, মাথামুণ্ডু না বুঝেই কাঁদি,
হায়, অবিদ্যায় ঢাকা থাকল ঋজু পাঠ—যেন তারা
হিমের কুটুম ওই অস্বচ্ছ মানুষজন, গাছপালা, রণক্ষেত্র—
কেন, এর বেশি সবটা বুঝিনি?
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৬
শিল্প-সাহিত্য
ঢাকায় উৎপলকুমার বসুর সাক্ষাৎকার (শেষ কিস্তি)
সাক্ষাৎকার ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।