রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ ইংরেজিতে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১২ সালে। অনেকটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এর অসাধারণ একটি ভূমিকা লিখেছিলেন আইরিশ কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম বাটলার ইয়েট্স্।
ইয়েট্স্-এর এ লেখাটি বহুল উদ্ধৃত। কিন্তু এর পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভরযোগ্য অনুবাদ সুলভ নয়। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম -এর পাঠকদের জন্য রচনাটি অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের কবি ও বরেণ্য ইয়েট্স্-অনুবাদক সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ এবং পশ্চিমবঙ্গের কবি ও অনুবাদক অংকুর সাহা।
কিছুদিন আগে আমি এক নামজাদা বাঙালি চিকিৎসককে বলেছিলাম, ‘আমি জর্মন জানি না, তবু, যদি অনুবাদে কোনো জর্মন কবি আলোড়িত করে আমাকে, আমি ব্রিটিশ ম্যুজিয়মে ঢুঁ দেব একবার, খুঁজে বের করব ইংরেজিতে লেখা কোনো বই, যা আমাকে তাঁর জীবন নিয়ে, চিন্তার ইতিহাস নিয়ে কিছু বলবে। অথচ যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার এই গদ্য অনুবাদগুলি আমার রক্তকে এতটা চঞ্চল করেছে যেমন আর-কোনো লেখা আমাকে করে নি অনেকদিন, তাঁর জীবন সম্পর্কে, যে-চিন্তাপ্রবাহ এই কবিতাগুলিকে সম্ভবপর ক’রে তুলেছে, তার সম্পর্কে, কিছুই জানতে আমি পারব না যদি-না কোনো ভারতীয় পর্যটক আমাকে জানায়। ’ আমার আবেগ তার কাছে স্বাভাবিক ঠেকেছিল, কেননা সে বলল, ‘আমি রোজ রবীন্দ্রনাথ পড়ি, তাঁর কবিতার একটা চরণ পড়লেই জগতের যাবতীয় দুর্দশা ভুলে থাকা যায়। ’ আমি বললাম, ‘দ্বিতীয় রিচার্ডের সময়ে লন্ডনবাসী কোনো ইংরেজ পেত্রার্ক বা দান্তের অনুবাদ পড়লে, তার সংশয় মেটাতে কোনো বই খুঁজে পেত না, সে বরং খুঁজে বার করত ফ্লরেন্স-এর কোনো মহাজন বা লম্বার্ডের কোনো সওদাগরকে প্রশ্নগুলি করতে, আমি যেমন তোমাকে করছি এখন। আমি যতদূর আন্দাজ করছি, এক নোতুন রেনেসাঁর অভ্যুদয় ঘটেছে তোমার দেশে, আর কানকথা-ছাড়া সে-বিষয়ে কিছু জানবার উপায় আমার নাই। ’ সে বলল, ‘আরও কবি আমাদের আছে, কিন্তু কেউ তাঁর তুল্য নয়; আমরা এ-সময়কে বলি রবীন্দ্র-যুগ। গোটা য়ুরোপে এমন কোনো কবিকে আমার জানা নাই যে স্বদেশে তাঁর চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। কবি হিসাবে যত বড় তিনি, সঙ্গীতস্রষ্টা হিসেবেও ততটাই। তাঁর গান পশ্চিম ভারত থেকে শুরু ক’রে বর্মা পর্যন্ত, যেখানেই কেউ বাংলায় কথা বলে, শুনতে পাবে তুমি। মাত্র উনিশেই, তাঁর পয়লা উপন্যাসটির প্রকাশের সাথে-সাথেই, তিনি বিখ্যাত হ’য়ে গিয়েছিলেন; আর আরেকটু বেশি বয়সে লেখা নাটকগুলি তাঁর, আজও মঞ্চস্থ হয় কলকাতায়। তাঁর জীবনের সম্পূর্ণতা, আরাধনার বস্তু আমার; যখন খুবই ছোট, দিনমান তাঁদের বাগানে ব’সে তিনি লিখে গেছেন প্রাকৃতিক বিষয়গুলি নিয়ে; হরেদরে পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ, দুর্বিষহ বেদনার শিকার হয়েছেন যখন, তিনি লিখেছেন আমাদের ভাষার শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতাগুলি’; আর তারপর গভীর আবেগে বলে সে, ‘সতেরোর উঠতি যৌবনে কতটা ঋণ আমার ছিল তাঁর প্রেমের কবিতাগুলির কাছে তা মুখে বলবার সাধ্য আমার নাই। তারপর তাঁর শিল্প আরও গভীর হ’য়ে উঠল দিনকে দিন, আরও ধর্মীয় ও দার্শনিক; মানুষের তাবৎ প্রেরণার উৎস তাঁর স্তোত্রগুলি। আমাদের প্রথম সন্ত সে, যে জীবনকে অস্বীকার করে নি, বরং খোদ জীবনেরই ভিতর থেকে কথা ব’লে গেছে, আর এ-জন্যেই এত ভালোবাসা আমাদের তাঁর জন্যে। ’ আমার স্মৃতিতে তাঁর সুনির্বাচিত শব্দগুলি বদলে গেছে হয়তো, কিন্তু মোদ্দা কথাটা ছিল এরকমই। ‘অল্প ক’দিন আগে তিনি প্রার্থনা পরিচালনা করেছিলেন আমাদের এক চার্চে, --আমরা ব্রাহ্মরা তোমাদের ইংরেজি শব্দটা ব্যবহার করি-- এটি কলকাতার সবচেয়ে বড় ব্রাহ্ম উপাসনালয়, আর শুধু যে টৈটম্বুর ভ’রে গিয়েছিল সেটি তা-ই নয়, বাইরের রাস্তাগুলিও থৈ-থৈ করছিল মানুষে। ’
অন্য ভারতীয়রাও দেখা করেছে আমার সাথে, আর এই মানুষটির প্রতি তাদের ভক্তি বড়ই অদ্ভুত ঠেকেছিল আমার আমাদের এই জগতে, যেখানে বড়-ছোট উভয়কেই আমরা ঢেকে ফেলি একই দৃষ্টিনন্দন রঙ্গ আর আধো-রসিকতার ঘোমটায়। আমরা আমাদের ক্যাথিড্রালগুলি বানাচ্ছিলাম যখন, আমাদের বড়মানুষগুলিকে তুলনীয় কোনো শ্রদ্ধা-প্রদর্শনের কথা আমাদের মনে হয়েছিল কি কখনও? ‘রোজ ভোর তিনটায়-- আমি জানি, কারণ আমি নিজে দেখেছি’-- একজন বলল আমাকে, ‘তিনি ঠায় ব’সে দু’ঘণ্টা ধ’রে ডুবে থাকেন ঈশ্বর-প্রকৃতির ধ্যানে; তাঁর বাবা, মহর্ষি মহাশয়, পরের সারা-দিনটাও কাটিয়ে দিতেন অমন ধ্যানে; একবার নদীতে, প্রকৃতির সৌন্দর্যে ধ্যানমগ্ন হ’য়ে পড়লেন তিনি, আর আবার যাত্রারম্ভ করতে পাক্কা আট ঘণ্টা ব’সে থাকতে হ’ল তাঁর মাল্লাদের। ’ সে তারপর আমাকে বলল ঠাকুর পরিবারের কথা, যার দোলনায় বেড়ে উঠেছে কত-কত বড়মানুষ, প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে। ‘আজ,’ বলল সে, ‘রয়েছেন গগনেন্দ্রনাথ আর অবনীন্দ্রনাথ, চিত্রশিল্পী; আর দ্বিজেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের ভাই, এক মশহুর দার্শনিক। কাঠবেড়ালিরা ডাল থেকে নেমে এসে বেয়ে ওঠে তাঁর হাঁটুতে, পাখি এসে বসে তাঁর হাতে। ’ এই লোকগুলোর ভাবনায় এমন এক দৃশ্যমান সৌন্দর্য ও অর্থের আভাস আমি দেখতে পাই যাতে মনে হয় এরা নীটশের ঐ মতবাদটিকে ধারণ করে, যে, এমন কোনো নৈতিক কি বৃদ্ধিবৃত্তিক সৌন্দর্যে আস্থা আনা উচিত নয় আমাদের, যা কোনোদিন শারীর-প্রপঞ্চে নিজের ছাপ ফেলবে না। আমি বললাম, ‘পুব দুনিয়ায় তোমরা জানো একটা পরিবারকে কী ক’রে কীর্তিময় ক’রে রাখা যায়। এই সেদিন এক জাদুঘরের কিউরেটর একজন ছোটখাটো শ্যামলা-বরন মানুষ, যে তাদের চীনা চিত্রকর্মগুলিকে গুছিয়ে রাখছিল, তাকে দেখিয়ে বললেন, “ও মিকাদো-র সমজদারদের বংশানুক্রমিক উত্তরসূরি, ওর পরিবারের চতুর্দশতম, যে এ পদে বহাল হয়েছে। ” ’ সে বলল, ‘রবীন্দ্রনাথ যখন ছোট, তাঁর বাড়ি বোঝাই ছিল সাহিত্য আর সঙ্গীতে। ’ আমার মনে পড়ল তাঁর কবিতার প্রাচুর্যের, সারল্যের কথা, আর বললাম, ‘তোমাদের দেশে খুব বেশি প্রচারণা- বা সমালোচনা-মূলক সাহিত্য লেখা হয় কি? আমাদের, বিশেষ ক’রে আমার নিজের দেশে এত বেশি তা করতে হয় যে আমরা সৃষ্টিশীল থাকতে পারিই না আর, এবং তা নিয়ে কিছু করার উপায়ও থাকে না কোনো। আমাদের জীবনটা যদি এক লাগাতার যুদ্ধ না হ’ত, আমাদের কোনো রুচির বালাই থাকত না, জানতাম না ভালো কাকে বলে, পেতাম না কোনো শ্রোতা বা পাঠক। আমাদের সামর্থ্যরে পাঁচের চার ভাগ ব্যয় হয় আমাদের নিজেদের বা অন্যদের কুরুচির সঙ্গে লড়াই ক’রে-ক’রে। ’ ‘আমি বুঝতে পারি,’ সে বলে, ‘আমাদেরও প্রচারণা সাহিত্য আছে। গাঁওগেরামে সংস্কৃত থেকে ভাবানূদিত দীর্ঘ পৌরাণিক কবিতার পাঠ হয়, আর সেগুলিতে হামেশা অনেক প্রপেণ ঘটানো হয়, লোকজনকে কর্তব্যসচেতন করতে। ’
২.
দিনের পর দিন আমি এই অনুবাদগুলির পাণ্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছি এবং পড়েছি সুযোগ পেলেই, ট্রেনের কামরায়, অমনিবাসের দোতলায় অথবা রেস্তোরাঁয়, আর অচেনা কেউ এলেই বন্ধ করেছি খাতা, কারণ কাউকে জানতে দিতে চাই না কবিতাগুলো কতটা সাড়া ফেলেছে আমার মনে। এই গানগুলি তাদের মূল ভাষায়-- আমার বাঙালি বন্ধুরা আমায় যেমন বলে, সংবেদী ছন্দের সূত্রে বাঁধা, তাদের রঙের লাবণ্য এবং ধ্বনির উদ্ভাবন-শক্তির অনুবাদ অসম্ভব-- এমন এক জগতের কথা প্রকাশ করে তারা-- বহুকাল ধরে যা আমার স্বপ্নের জগৎ। যদিও তাদের শরীরে এক উচ্চতম সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ, কবিতাগুলি গ’ড়ে ওঠে খোলা মাঠে ঘাস বা শরের মতন স্বাভাবিকভাবে। তাদের ঐতিহ্য, যেখানে ধর্ম এবং কবিতার মধ্যে কোনো প্রাচীর নেই, তারা যুগ যুগ ধরে সঞ্চালিত, শিতি এবং অশিক্ষিতের উপমা ও আবেগ দিয়ে সমৃদ্ধ এবং আবার সাধারণ মানুষের কাছে ফিরে এসেছে জ্ঞানী ও মহতের চিন্তাভাবনা হিসেবে। যদি বাংলাদেশের সভ্যতা অটুট থাকে এবং যদি তার ঐক্যবদ্ধ মানসিকতা হয় সর্বজনীন-- যদিও এখন ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব-- এবং যদি আমাদের মতন না হয়, যাতে এক মানসিকতা ভাঙে এক ডজন পরস্পর অপরিচিত মানসিকতায়-- তাহলে পরবর্তী কয়েক প্রজন্মে এই কবিতাগুচ্ছের সুবেদী সদস্যগুলি ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র, এমনকী পথের ভিখারির অন্তরেও। ইংল্যান্ডে যখন বুদ্ধিজীবীরা সহমত ছিলেন, তখন মহাকবি চসার [১৩৪৩-১৪০০] লিখেছিলেন তাঁর মহান কাব্য ‘ট্রয়লাস ও ক্রেসিডা’-- তিনি ভেবেছিলেন তাঁর কবিতা লোকে পড়বে এবং পড়ে শোনাবে অন্যকে-- কিন্তু সেই যুগটাই ছিল এমনধারা তাঁর রচনা অনেক বছর ধরে মূলতঃ শোভা পেল চারণকবির সঙ্গীতময় কণ্ঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও, চসার এবং তাঁর পূর্বসূরিদের মতন সুর আরোপ করেন তাঁর কবিতায় এবং কানে শুনে মুহূর্তের ভেতর মানুষ বুঝতে পারে তিনি অপর্যাপ্ত, তিনি স্বতঃস্ফূর্ত, দুঃসাহসী তাঁর অনুরাগ, প্রতিমুহূর্তে চমক জাগান তিনি এবং তা-সত্ত্বেও কখনও মনে হয় না তিনি অচেনা, কিংবা অস্বাভাবিক অথবা তাঁর সাফাই গাওয়া প্রয়োজন। এই গীতিকবিতাগুলির স্থান হবে না অভিজাত নারীর পড়ার টেবিলের সুদৃশ্য প্রকাশনায়-- অলস হাতে পাতা ওলটাতে ওলটাতে যারা জীবনের অর্থহীনতায় দীর্ঘশ্বাস ফেলবে, অথবা বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রছাত্রীদের বটুয়ায়, যারা প্রকৃত জীবন শুরু করার আগে এক পাশে সরিয়ে রাখবেন তাঁকে; তার বদলে বংশানুক্রমে পথিকেরা রাজপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গুনগুন করে গাইবেন তাকে, মাঝি নদীতে নৌকা বাইবার সময়, প্রেমিক-প্রেমিকা একে অন্যের অপোয় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনুভব করবে যে কবিতাগুলির মৃদু, ঝির ঝির গুঞ্জরনে ঈশ্বরপ্রেমের এক অলৌকিক ঝরনাধারায় স্নান করে উঠল তাঁদের তীব্র, তিক্ত অনুভূতি এবং আবার প্রথম যৌবনে ফিরিয়ে নিয়ে গেল তাদের। প্রতি পলে এই কবির হৃদয় বয়ে যায় কোনো মর্যাদাহানি বা আপাত সৌজন্যের প্রকাশ ছাড়াই সেই সব মানুষের প্রতি; কারণ তিনি জানেন যে তারা বুঝবে তার তাৎপর্য এবং তাদের জীবন-পরিস্থিতিরই শিল্পিত প্রকাশ তাঁর রচনায়। পথিকের ধূসর আলখাল্লা যাতে ধুলো পড়লে বোঝা না যায়, যে মেয়েটি তার মিলনশয্যায় আকুল হয়ে খোঁজে তার রাজকীয় দয়িতের মালা থেকে খসে পড়া ফুলের পাপড়িগুলি, যে ভৃত্য অথবা বধূ শূন্য কে অপো ক’রে থাকে তার প্রভু অথবা প্রিয়ের আগমনের-- তারা সবাই ঈশ্বরের আকাক্সায় অপেমাণ হৃদয়ের প্রতীক। ফুলদল ও নদী, শঙ্খের মধুর ধ্বনি, শ্রাবণ মাসের মুষলধারে বৃষ্টি, অথবা মিলনে ও বিরহে হৃদয়ের অভিব্যক্তি; এবং নৌকায় বংশীবাদনরত একা মানুষটি প্রাচীন-- চীনা চিত্রশিল্পে দেখা রহস্যময় অর্থবহ মানুষগুলির মতন, তারা সকলেই ঈশ্বর। একটা আস্ত মানবসমাজ, একটা অটুট সভ্যতা, যদিও আমাদের চোখে মনে হবে সীমাহীনভাবে অদ্ভুত, তারা কিন্তু এই অলৌকিক কল্পনার সঙ্গে সুপরিচিত; আমরা এই কবিতাগুলি প’ড়ে আলোড়িত হই তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির জন্যে নয়, বরং তাদের মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই বলে, যেন আমরা হঠাৎ পা ফেলছি ক্রিস্টিনা রসেটি [১৮৩০-১৮৯৪] বর্ণিত উইলো-অরণ্যে, অথবা সাহিত্যের মাধ্যমে জীবনে প্রথমবারের জন্যে স্বপ্নের মধ্যে শুনতে পেয়েছি নিজের কণ্ঠস্বর।
রেনেসাঁর পর থেকে ইয়োরোপের সন্ত কবিদের রচনা-- তাঁদের উপমা এবং চিন্তাভাবনার সাধারণ কাঠামো যতই পরিচিত হোক না কেন-- আমাদের আগ্রহকে ধ’রে রাখতে অসমর্থ। আমরা জানি যে শেষ পর্যন্ত এই বস্তু-পৃথিবীকে পরিত্যাগ করার সময় এসেছে; কিন্তু কীভাবে আমরা এত কবিতা পাঠ, এত চিত্রশিল্পের অবলোকন, এত মধুর সঙ্গীত-শ্রবণের পর-- যার মধ্যে শরীরের আকাঙ্ক্ষা এবং অন্তরের কান্না মিশেছে এক স্রোতে-- তাকে ত্যাগ করতে পারি এমন রূঢ় ও নিষ্ঠুরভাবে? সন্ত বার্নার্ড যেমন সুইটজারল্যান্ডের হ্রদগুলির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মোহিত হতে না চেয়ে দু’হাতে চোখ বন্ধ করেছিলেন, তার সঙ্গে আমাদের কী মিল রয়েছে? অথবা বাইবেল নতুন সুসমাচারের অন্তর্গত উদ্ঘাটন গ্রন্থের সহিংস প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে? আমরা এই গ্রন্থে, খুঁজে দেখতে চাইলে, সৌজন্যমূলক শব্দের সমাহার দেখতে পাবো।
“পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহো ভাই,
সবারে আমি প্রণাম করে যাই।
ফিরায়ে দিনু দ্বারের চাবি
রাখি না আর ঘরের দাবি,
সবার আজি প্রসাদবাণী চাই,
সবারে আমি প্রণাম করে যাই।
অনেক দিন ছিলাম প্রতিবেশী,
দিয়েছি যত নিয়েছি তার বেশি।
প্রভাত হয়ে এসেছে রাতি,
নিবিয়া গেল কোণের বাতি,
পড়েছে ডাক চলেছি আমি তাই,
সবারে আমি প্রণাম করে যাই। ’’ [গীতিমাল্য]
এবং আমাদের নিজস্ব মানসিকতা ক্যাথলিক সন্ত টমাস আ’কেম্পিস [১৩৮০-১৪৭১] অথবা জন অফ দ্য ক্রস [১৫৪২-১৫৯১] এর ভাবনা থেকে বহু দূরে, যখন তার ডাক শোনা যায়,
“জীবন আমার
এত ভালবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়,
মৃত্যুকে এমন ভালবাসিব নিশ্চয়। ” [নৈবেদ্য, ৯০]
তার মানে অবশ্য এই নয় যে গ্রন্থটি কেবল আমাদের বিদায়-ব্যথার গভীরতাকে মাপে। আমরা যদি মনে মনে অনুধাবন না করতাম যে আমরা ঈশ্বরকে ভালোবাসি, আমাদের পে মুশকিল হ’ত ঈশ্বরে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা। কিন্তু জীবনের দিকে পিছন ফিরে দেখে আমরা আবিষ্কার করি, বনের পথ বেয়ে ঘুরতে-ঘুরতে অথবা পাহাড়ি নির্জন পথে মনের আনন্দে, যে রহস্যময় দাবি আমরা করে থাকি প্রিয়তমা অথচ না-পাওয়া রমণীটির প্রতি-- প্রেমের নিহিত আবেগ থেকেই উঠে আসে এই ছলনাময় মধুরতা।
“তখন করি নি নাথ কোনো আয়োজন;
বিশ্বের সবার সাথে, হে বিশ্বরাজন,
অজ্ঞাত হাসিতে আসি আমার অন্তরে
কত শুভদিনে; কত মুহূর্তের ’পরে
অসীমের চিহ্ন লিখে গেছে। ” [নৈবেদ্য, ৩৩]
৩.
আমরা মোটা মোটা সব বই লিখে থাকি যাতে এমন কোনো গুণসম্পন্ন পৃষ্ঠা নেই যা লেখার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সুখময় অভিজ্ঞতা, একটা সাদামাটা কাঠামো গড়ে নিই আমরা এবং বিশ্বাস রাখি তাতে, আমরা উপার্জন করি অর্থ এবং মাথার মধ্যে ভরে দিই রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা-- সব উটকো বাজে কাজ-- অন্যদিকে শ্রী ঠাকুর, ভারতীয় সভ্যতার মতনই, আবিষ্কার করতে যান নিজের স্বরূপকে এবং তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততার কাছে নিজেকে সঁ’পে দিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। তিনি মাঝেমধ্যেই তাঁর জীবনের সঙ্গে তুলনা করে দেখান অন্যদের, যাঁরা আমাদের মতন পশ্চিমী জীবন যাপন করে এবং পিঠের ওপরে পৃথিবীর বোঝা বয়ে নিয়ে যেতে ব্যস্ত-- তিনি এটা করেন বিনয়ের সঙ্গে কারণ তিনি কেবল জানেন কোন পথে আসবে তাঁর অভীষ্ট :
“সবাই ঘরের পানে যাবার বেলা আমায় দেখে হাসে,
চোখে লাগছে ঘুমঘোর
আমি বসে আছি বসনখানি টেনে মুখের ’পরে
যেন ভিখারিনীর মতো
কেহ শুধায় যদি ‘কী চাও তুমি’ থাকি নিরুত্তরে
করি নয়ন দুটি নত। ” [প্রচ্ছন্ন, খেয়া]
অন্য সময়ে, তাঁর পূর্বজীবনের ভিন্নতার কথা স্মরণ ক’রে, তিনি হয়তো বলবেন,
“মন্দ ভালোর দ্বন্দ্বে খেটে
গেছে তো দিন অনেক কেটে,
অলস বেলার খেলার সাথি
এবার আমার হৃদয় টানে।
বিনা কাজের ডাক পড়েছে
কেন যে তা কেই বা জানে। ” [গীতিমাল্য, ৮]
এমন নিষ্কলঙ্ক সরলতা সাহিত্যের জগতে অন্যত্র দেখাই যায় না, যাতে বনের পাখি এবং গাছের পাতা আপন করে নিতে পারে তাঁকে যেভাবে তারা নেয় শিশুদের, এবং ঋতুর পরিবর্তন এক বিশাল ঘটনা তাঁর কাছে, কারণ তাদের এবং আমাদের চিন্তার নৈকট্য রয়েছে সেখানে। মাঝে মাঝেই আমি বিস্ময়ে ভাবি যে তিনি তাঁর অনুপ্রেরণা বাংলার সাহিত্যের থেকে পেয়েছেন, নাকি ধর্মবিশ্বাসের থেকে, আবার অন্য সময়, যখন মনে পড়ে কীভাবে পাখিরা এসে বসত তাঁর দাদার বাহুতে, তখন আনন্দ পাই ভেবে যে বিষয়টি বংশগত-- যে রহস্যটি তেলে জলে বেড়ে উঠেছে শতাব্দী ধরে-- কেলটিক উপকথার ত্রিস্তান বা মধ্যযুগের কাহিনির রাজা পেলানোরের মতন। সত্যিসত্যিই, যখন তিনি শিশুদের কথা বলেন, তখন তাঁর নিজগুণে অথবা তাঁর বলার গুণে, কখনই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয় যে তিনি একই সঙ্গে বলে ফেলতে চাইছেন না সাধু সন্তদের কথাও--
“বালুকা দিয়ে বাঁধিছে ঘর,
ঝিনুক নিয়ে খেলা।
বিপুল নীল সলিল-’পরি
ভাসায় তার খেলার তরী
আপন হাতে হেলায় গড়ি
পাতায়-গাঁথা ভেলা।
জগৎ পারাবারের তীরে
ছেলেরা করে খেলা।
জানে না তারা সাঁতার দেওয়া,
জানে না জাল ফেলা।
ডুবারি ডুবে মুকুতা চেয়ে,
বণিক ধায় তরণী বেয়ে,
ছেলেরা নুড়ি কুড়ায়ে পেয়ে
সাজায় বসি ঢেলা।
রতন ধন খোঁজে না তারা,
জানে না জাল ফেলা। ” [গীতিমাল্য, ২৬]
ডবলু বি ইয়েট্স্
সেপ্টেম্বর ১৯১২
[ড্যাশ বোঝাতে -- চিহ্ন ব্যবহার করা হলো]
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১১১০, আগস্ট ০৬, ২০১০