ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

খাপছাড়া রবীন্দ্রনাথ

আলতাফ হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১০
খাপছাড়া রবীন্দ্রনাথ

না না ভুল পড়েননি পাঠক, ’খাপছাড়া’-র রবীন্দ্রনাথের কথা লিখতে বসিনি, খাপছাড়া রবির কথাই লিখতে বসেছি। যতটা যা পারি।

মিথ্যা নয় যে, রবীন্দ্রনাথ পড়তে বাকি রাখিনি, ছোটবেলা থেকে ধরে। কিন্তু তার অনেকটাই ভুলেছি, ফিরে পড়ার, ফিরে-ফিরে পড়ার সুযোগ না পাওয়ার কারণে। অবশ্য ইচ্ছাও আর আগের মতো থাকার কারণ ছিল না। পড়ার মতো নতুন নতুন বই আসার যেমন বিরাম ছিল না, অন্য আরও নানাবিধ আকর্ষণে স্বভাবতই মজেছি। তবে তার মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র ও গীতবিতানকে তা বলে ছেড়ে থাকিনি কখনও। হাতের কাছে ছিল, ব্যবহারেই ছিল। গল্পগুচ্ছও ছিল কাছাকাছি। আর যেটি ছিল কৈশোরে বহুদিনের সঙ্গী, সেই খাপছাড়া একসময় হাতছাড়া হয়ে হারিয়ে যাওয়ায় সেটির অভাবে মাঝে মাঝে হায় হায় করেছি। এই সেদিন যাওয়া হলো শান্তিনিকেতনে আর তখনই বইটি চোখে পড়ে যাওয়ায় এক মুহূর্ত দেরি না করে কিনে নিয়ে ফিরেছি।
এর মধ্যে তাগাদা যখন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর থেকে পেলাম রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখার, তখনই মনে হলো আজকের এই বিষয়টি নিয়ে চেষ্টা করা যেতে পারে। বহুদিন পূর্বে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি রচনা পড়া হয়েছিল ‘অসম্ভবের ব্যাকরণ’ শিরোনামের। দারুণ পছন্দের লেখা হয়ে পড়েছিল সেটি। কতবার যে পড়েছিলাম! তবে ঠিক কী লেখা ছিল সে নিবন্ধে আজ আর মনে পড়ছে না। এটুকু মনে পড়ছে যে তাতে খাপছাড়া ও রবীন্দ্রঅঙ্কিত ছবির কথা ছিল। রবীন্দ্রনাথ যে কত আধুনিক তা দেখানো হয়েছিল ধারণা করি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনেক লিখেছেন শঙ্খ ঘোষ, তার সামান্যই পড়া হয়েছে আমার। সুতরাং জানি না খাপছাড়া-রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শঙ্খ কখনো লিখেছেন কি না। তবে তিনি বা আর কেউ খাপছাড়া প্রসঙ্গে লিখলেও আমার ধারণা আমারও লেখার আছে কিছু এবং তা বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর-এর জন্য হোক বা না-ই হোক। এখানে বলে রাখি আরেকটি কথা। আমার এ লেখায় নতুন কোনও কথা যদি না-ও বলা হয়ে থাকে, যারা পড়েননি ‘খাপছাড়া’ দুর্ভাগ্যক্রমে, তাঁদের জন্য কিছু নমুনা এখানে রাখতে পারলাম বলে আমি খুশি থাকব, পাঠকেরাও অসুখী হবেন না বলে আশা করব।
যেভাবে সাজানো হয়েছে খাপছাড়া বইটি হাতে আঁকা হাস্যরসের ছবি দিয়ে, তাতে লোকের মনে হতেই পারে যে এ বই বাচ্চাদের জন্য বা কিশোরদের জন্যই লেখা। এটা ঠিক যে নিছক হাসিরও ছড়া এ বইতে আছে কিছু এবং সেসব পড়ে অল্পবয়সী সকলেরই হাসি পাওয়ার কথা। কিন্তু দেখুন সেরকম একটি ছড়াও পড়ে :

সন্ধেবেলার বন্ধুঘরে
    জুটল চুপিচুপি
         গোপেন্দ্র মুস্তফি।

রাত্রে যখন ফিরল ঘরে
সবাই দেখে তারিফ করে--
পাগড়িতে তার জুতোজোড়া,         
            পায়ে রঙিন টুপি।

এই উপদেশ দিতে এল--
সব করা চাই এলোমেলো,
‘মাথায় পায়ে রাখব না ভেদ’
    --চেঁচিয়ে বলে গুপি।

‘সব করা চাই এলোমেলো’, ‘মাথায় পায়ে রাখব না ভেদ’ ধরনের ভাবনা সব মানুষের মনেই জীবনের কোনও-না-কোনও সময় আসতেই পারে এবং তা স্বাভাবিকও, কিন্তু তারপরও রবীন্দ্রনাথের লেখায় এ জাতীয় ভাবনা দেখে আমার মনে পড়ে যায় তাঁর ছিন্নপত্রাবলী-জীবনকালের কথা যেখানে দার্শনিক ভাবনার খানিকটা প্রতিফলন আমরা দেখেছি, যা প্রকৃত অর্থেই খাপছাড়া, অ্যাবসার্ড। নিরর্থকতার সমার্থক। সব করা চাই এলোমেলো এবং মাথায় পায়ে রাখবো না ভেদ-- এসব একেবারে একালেরই কথা, এ কালের কবি-লেখকদের, শিল্পীদের কথা। কবিতার যে কোনও মানে থাকবে না, কবিতা কিছু বলবে না, এসবও আমরা অনেকদিন ধরেই শুনে আসছি, যা শুনলে এখনও আমাদের প্রচলিত লেখকদের অনেকের মাথায় বাজ পড়ার দশা হয়। আবার কোনও কোনও ‘প-িত’ নাকি প্রবন্ধ লিখে বলেন, রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নন। এদের মাথায় যে কী আছে তা প্রকৃতিই বলতে পারে কেবল।
আমরা সাহিত্যপাঠকেরা জানি কালো কমেডির কথা। দেখুন কী রকম উপাদান এ লেখায় কালো কমেডির :

উজ্জ্বলে ভয় তার,
    ভয় মিটমিটেতে,
ঝালে তার যত ভয়
    তত ভয় মিঠেতে।
ভয় তার পশ্চিমে
    ভয় তার পূর্বে,
যে দিকে তাকায় ভয়
    সাথে সাথে ঘুরবে।
...  ...  ...
দিনের আলোতে ভয়
    সামনের দিঠেতে,
রাতের আঁধারে ভয়
    আপনারি পিঠেতে।

শুধু ‘তার’ ভয়েরই বিবরণ। কেন ভয় সে কথাও বলা হচ্ছে না। ভয়ের নিপুণ শিল্প যেন বিকীর্ণ আঁধারে। ঝালেতে ভয়, মিঠেতে ভয়, যেদিক পানেই তাকাও, ভয় তোমাকে ছাড়ছে না। রবীন্দ্রনাথের এমন ভাবনা, হোক না এক টুকরো, আর কোথাও আমরা  তেমনভাবে দেখতে পাই কি?

দেখুন কালো প্রহসনের আরও উদাহরণ। কালো প্রহসন বা ব্ল্যাক হিউমার সেরকম হাস্যরসই আনে যাতে তিক্ত, কঠিন কথা বলা হয়। রবীন্দ্রনাথের যুগে তো দেখতে পাওয়া যায়ইনি, যতদূর জানা আমার, পরেও এমন দৃষ্টান্ত খুব একটা নজরে পড়েনি :

ডাকাতের সাড়া পেয়ে
    তাড়াতাড়ি ইজেরে
 চোখ ঢেকে মুখ ঢেকে
    ঢাকা দিল নিজেরে।

পেটে ছুরি লাগালো কি,
প্রাণ তার ভাগালো কি,
দেখতে পেল না কালু
    হল তার কী যে রে।

এ লেখা কে বলবেন যে ছোটদের জন্য? বা, হাসবার জন্য? পেটে ছুরি মেরে প্রাণ ভাগানোর এ দৃশ্য ব্ল্যাক হিউমার ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে বলুন?
আমার আজ বেশি বলার নেই। অমুক আধুনিক বা পোস্টমডার্ন, তমুক নন এসব তর্কও বৃথা। এত জ্ঞানগম্যি কেন ফলাতে চাও বাছা, যেখানে তোমার হাড় যাচ্ছে ক্রমাগত য়ে? চলুন বরং আরও একটি খাপছাড়া শোনা যাক :

গণিতে রেলিটিভিটি প্রমাণের ভাবনায়
    দিনরাত একা বসে কাটালো সে পাবনায়--
        নাম তার চুনিলাল, ডাক নাম ঝোড়কে।
১ গুলো সবই ১ সাদা আর কালো কি,
    গণিতের গণনায় এ মতটা ভালো কি?
        অবশেষে সাম্যের সামলাবে তোড় কে?

একের বহর কভূ বেশি কভূ কম হবে,
    এক রীতি হিসাবের তবুও তবুও কি সম্ভবে?
        ৭ যদি বাঁশ হয়, ৩ হয় খড়কে,
            তবু শুধু ১০ দিয়ে জুড়বে সে জোড় কে?


যোগ যদি করা যায় হিড়িম্বা কুন্তীতে,
     সে কি ২ হতে পারে গণিতের গুন্তিতে?
যতই না কষে চাও মোচা আর থোড়কে।

‘খাপছাড়া’ যত পড়া হবে তত বেশি উদ্ধৃতি দিতে, মন্তব্য যোগ করতে ইচ্ছা করবে, আপাতত তা সম্ভব হচ্ছে না। ইশারাকেই কাফি মনে করা হচ্ছে।


[ড্যাশ বোঝাতে -- চিহ্ন ব্যবহার করা হলো]


বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ০০০০, আগস্ট ০৬, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।